দক্ষিণ কোরিয়ায় বিমান ট্র্যাজেডি নিহত ১৭৯

দক্ষিণ কোরিয়া জুড়ে শোকের ছায়া। রোববার সকালটা বিষাদের এক খবরে মুষড়ে পড়ে দেশটি। ১৮১ আরোহী নিয়ে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুনের বলয় তৈরি হয়ে তা বিস্ফোরিত হয়। এতে কমপক্ষে ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন। বিমানের ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তবে তাদের অবস্থা কেমন তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। এ ঘটনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘোষণা করা হয়েছে সাতদিনের শোক। ওদিকে এ খবর পেয়ে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর সদস্য এবং তাদের বন্ধুরা ছুটে যান মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখানে তারা অশ্রুসজল চোখে প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরছিলেন। বিমানটির একজন যাত্রীর পরিবার বলেছে, তারা বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে একজন যাত্রীর কাছ থেকে টেক্সট মেসেজ পেয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, ফ্লাইটের পাখায় একটি পাখির ধাক্কা লেগেছে। আরেকজন মেসেজ লিখেছেন, আমার শেষ কথা বলে দেয়া উচিত। স্থানীয় অনেক মানুষ বিমানটির জেট ইঞ্জিনে আগুনের বলয় দেখেছেন। শুনতে পেয়েছেন কয়েকদফা বিস্ফোরণের শব্দ। বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার দূরে ছিলেন এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন- হঠাৎ দেখি বিমানটি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। মনে করেছিলাম তা অবতরণ করছে। কিন্তু তারপরই দেখতে পাই আগুন জ্বলছে। এরপরই বিকট বিস্ফোরণ। বাতাসে ধোঁয়া উড়লো। ধারাবাহিকভাবে কতোগুলো বিস্ফোরণ হলো। এর ফলে যে প্রাণহানি হয়েছে তা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ শোক প্রকাশ করছে নিহতদের জন্য। শোক জানিয়েছেন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি। শোক প্রকাশ করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও।

উল্লেখ্য, জেজু এয়ারের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমানটি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান যাচ্ছিল। স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৯টার সামান্য পরেই তা অবতরণের চেষ্টা করে। কিন্তু অবতরণ নয়, তা একটি দেয়ালের ওপর বিধ্বস্ত হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট বিমানটি রানওয়ে থেকে পিছলে যায়। তারপরই বিধ্বস্ত হয়। আগুন ধরে তা বিস্ফোরিত হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আকাশে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয়। তবে ফ্লাইটের শুধু টেইলের বা পেছন দিকের একটি পোড়া অংশ পাওয়া গেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, ল্যান্ডিং গিয়ার পুরোপুরি প্রসারিত না হওয়া সত্ত্বেও বিমানটি ‘বেলি ল্যান্ডিং’ করার চেষ্টা করে। এখন তদন্তকারীরা যাচাই করে দেখছেন পাখির সঙ্গে ধাক্কা লেগে এ ঘটনা ঘটেছে, নাকি খারাপ আবহাওয়া এর কারণ। দুর্ঘটনার কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পরেও ঘটনাস্থল থেকে কালো ধোঁয়া উড়ছিল। অন্যদিকে চলছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিমানের বিধ্বস্ত অংশ সংগ্রহের কাজ। ঘটনাস্থলে যাত্রীদের পোশাক, লাগেজ, পানির বোতল- সবই রক্তে ভেজা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। স্থানীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, বিমানের দু’জন আরোহীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফ্লাইটে সবচেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তি ছিলেন ৭৮ বছর বয়সী একজন পুরুষ। আর সবচেয়ে কম বয়সী ছিল তিন বছর বয়সী একটি শিশু। বিমানটিতে দু’জন থাই যাত্রী ছিলেন বলে রিপোর্টে বলা হচ্ছে। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়েটংতার্ন শিনাওয়াত্রা এক্সে শোক জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি আমরা শোক প্রকাশ করছি। ওই বিমানে কোনো থাই যাত্রী আছেন কিনা তা যাচাই করতে জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের অবস্থা কী তাও তিনি জানতে চেয়েছেন।

ওদিকে খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছান দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং মোক। তিনি কর্মকর্তাদের জোরালো অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি। প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছে যে, বিমান দুর্ঘটনার প্রতি সরকারি প্রতিক্রিয়া নিয়ে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিজে। উল্লেখ্য, জেজু এয়ার পরিচালিত ৭৩৭-৮০০ মডেলের ওই বিমানে ১৭৫ জন যাত্রী ও ৬ জন ক্রু ছিলেন। এ ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে জেজু এয়ার। তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই দুর্ঘটনায় করণীয় সব কিছু করতে আমাদের শক্তি ব্যবহার করবে জেজু এয়ার। আতঙ্ক, ক্ষতির জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। বিমান সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিম ই-বায়ে টেলিভিশনে বলেছেন, বিমানটি দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। বিমানটির কোনো দুর্ঘটনায় পড়ার কোনো রেকর্ড নেই। আগে কোনো রকম ত্রুটির আলামত পাওয়া যায়নি এতে। তদন্তে সহযোগিতা করবে এই এয়ারলাইন। নিহতদের জন্য সমর্থন দেয়াকে শীর্ষ অগ্রাধিকার মনে করবে। ওদিকে মুয়ান বিমানবন্দরে সব রকম অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়।

মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিবিসি’র সাংবাদিক জ্যাঁ ম্যাকেঞ্জি বলছেন, একটি কক্ষে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নিহতদের দেহ শনাক্ত করতে কয়েকশ’ পরিবার সেখানে অপেক্ষা করছেন। নিহতদের শরীরের ক্ষত এত বেশি যে, তারা ছেলে না মেয়ে তা চেনার উপায় নেই। কেউ স্বামীকে হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন স্ত্রীকে। কেউবা ছেলেমেয়ে, কেউবা নাতিপুতিকে হারিয়েছেন। অনেক পরিবার একাধিক সদস্যকে হারিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই থাইল্যান্ডে বড়দিন উদ্‌যাপন করে ফিরছিলেন। মায়েং জি-সু (৭৮) বলেন, তার এক ভাতিজা ও ভাতিজার দুই সন্তান ছিল ফ্লাইটে। কিন্তু পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেছে। তিনি হাউমাউ ও চিৎকার করে বলেন, বিশ্বাস করতে পারছি না একটি পুরো পরিবার অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার হৃদয়ে খুব বেশি ব্যথা বোধ করছি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.