চট্টগ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু
মশা
নিধনে চসিকের ক্রাশ প্রোগ্রাম চলছে। চলছে প্রচার-প্রচারণাও। তবুও থামছে না
ডেঙ্গুর বিস্তার। চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলা ও উপজেলায়
সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু।
গত বৃহসপতিবারও নতুন করে আক্রান্ত আরো ৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর এ নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৩২ জনে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে শুক্রবার সকালে সর্বশেষ এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে এর বাইরেও আরো অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য মিলছে নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের চেম্বারগুলো থেকে।
যার সংখ্যা তিন শতাধিক হতে পারে।
যাদের বেশিরভাগই নিজ বাসা বা বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। এরমধ্যে শিশুদের সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো। কিন্তু কীটস সংকটের কারণে এদের অনেকের ডেঙ্গু পরীক্ষাও হচ্ছে না।
এছাড়া গত ২০শে জুলাই চট্টগ্রাম মহানগরীর মোগলটুলি এলাকায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে তাজবির খান নামে (১০) এক শিশু ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্যও মিলেছে। যার কোনো হিসাব নেই চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষের কাছে।
অথচ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক (রোগ ও নিয়ন্ত্রণ) মো. নুরুল হায়দার ডেঙ্গু রোগে শিশু তাজবিরের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেন। এমনকি স্থানীয় কাউন্সিলর আব্দুল কাদেরও এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
জুলাই মাসের শুরুর দিকে টানা বৃষ্টির পর নগরীর প্রত্যন্ত এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ নগর ও জেলা-উপজেলার সরকারি কোনো হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও স্বজনরা। ফলে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ১২০০-১৮০০ টাকা পর্যন্ত খরচে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগে একমাত্র ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে ৩০০ টাকায় প্রাথমিক পর্যায়ের ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও সেখানেও রি-এজেন্ট বা কীটস সংকট থাকায় পরীক্ষা তেমন হয়নি।
তবে গত ৩০শে জুলাই থেকে সরকারিভাবে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলা সরকারি হাসপাতালসমূহে কিটসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পৌঁছার পর বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন আক্রান্তরা। তবে এক্ষেত্রে সবার কপালে জুটছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ সুবাধে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি ফি আদায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা চলছে। এ কারণে গত বুধবার নগরীর অভিজাত সিএসসিআর হাসপাতালকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস ও সরঞ্জাম পৌঁছায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ নগর ও জেলা-উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হচ্ছে। এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শনাক্তকরণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার জন্য সরকারিভাবে ৫২০টি কীটস পাওয়া গেছে। এতে পরীক্ষার সুযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তও বাড়ছে। বৃহস্পতিবার নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৩৬ জন রোগী চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগের দিন বুধবার ভর্তি হয়েছে ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী। এর আগের দিন মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছে ৩২ জন। সোমবার ভর্তি হয়েছে সর্বাধিক ৪১ জন। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরে ভর্তি হয়েছে ১৯২ জন। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জেলা ও উপজেলাসহ মোট ২৩২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে পুরুষের সংখ্যাই সর্বাধিক। শিশুর সংখ্যা ১৪। নারীর সংখ্যাও কম।
তিনি বলেন, ঢাকার মতো চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর বিস্তার তেমন ঘটেনি। আক্রান্তদের অধিকাংশই পুরুষ। যাদের বেশিরভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছেন। শিশু ও নারীর সংখ্যাও কম। এ থেকে প্রমাণ হয় চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম বৃষ্টিপাতের আগে থেকেই ছিল। সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণাও কার্যক্রম চালায়। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করায় ডেঙ্গু রোগের তেমন বিস্তার ঘটেনি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানান তিনি।
এদিকে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটার বিষয়ে অন্যরকম তথ্য মিলছে বেসরকারিভাবে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও সচেতন নাগরিক সমাজ থেকে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, নগরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়াও আরো শত শত ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। যারা বাড়ি ও ক্লিনিকে থেকে প্রাইভেট চিকিৎসা চালাচ্ছেন। তার কোনো হিসেব সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষের কাছে।
এমনকি গত ২০শে জুলাই নগরীর মোগলটুলি কাটাবটগাছ এলাকার লোকমান খানের ১০ বছরের ছেলে তাজবির খান একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তারও কোনো তথ্য নেই সিভিল সার্জনের কাছে। তাজবির খানের বাবা লোকমান খান জানান, ১২ই জুলাই হঠাৎ করেই মাথাব্যথা আর জ্বরে আক্রান্ত হয় তাজবীর। শুরু থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্যাথলজি পরীক্ষায় প্রথমে ডেঙ্গু ধরা পরেনি। পরে ১৮ই জুলাই ক্লিনিকে ভর্তির পর শিশু তাজবিরের দেহে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। দিন দিন ছেলের অবস্থার অবনতি হতে হতে ২০শে জুলাই ভোরে মারা যায় তাজবির।
মোগলটুলি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল কাদের বলেন, দীর্ঘদিন বিদেশ থেকে ফিরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শিশু তাজবিরের মৃত্যু সংবাদ পাই। আগে থেকেই আমাদের মশক নিধন কার্যক্রম ছিল। তাজবিরের মৃত্যুর পর আমরা এই কার্যক্রম আরো জোরালো করেছি।
নগরবাসীরা জানান, মশক নিধনে চসিকের ক্রাশ প্রেগ্রাম চলছে। তবুও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। বর্তমানে নগরীর সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বেশি। এরমধ্যে শিশুর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। অনেক শিশু জ্বর-কাশিতে ভুগলেও তাদের ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তাদের পরীক্ষা করা হলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যেতে পারে।
চমেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সাধারণত জ্বর আসে। কিন্তু শিশুদের অনেকের ক্ষেত্রে জ্বরের লক্ষণ দেখা যায় না। রক্তের মধ্যে যে পানি রয়েছে তা শিশুদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরে তরলের তারতম্য হয়ে যায়। এসময় তাদের ব্লাড প্রেসার কমে যায়। তখন শিশুরা মারাও যেতে পারে। ডেঙ্গুরোগ প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
চমেক হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১৫২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে অর্ধেক সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালের ৯, ১৩, ১৪ ও ১৬নং ওয়ার্ডে ডেঙ্গু ব্লকে ৭৩ জন রোগী চিকিৎসাধীন।
একইভাবে নগরীর জেনারেল হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতাল, সিএসসিআর, পার্কভিউ হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, এপিক হাসপাতালে আরও ৭৪ জনের মতো ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নেয়। এরমধ্য থেকেও এক-তৃতীয়াংশ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ জন এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। টেকনাফেও ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেলেও তার কোনো হিসাব নেই সিভিল সার্জনের কাছে।
এদিকে নগরীর বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. আবু সাঈদ চৌধুরী জানান, ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করানো হয় না। এরপরও ৩০০ রোগী বর্তমানে ভর্তি রয়েছে। এরমধ্যে জ্বরে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাদের কারো ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়নি। কারণ হাসপাতালে কীটস সংকট রয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সূত্রমতে, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলার সবকটি সরকারি হাসপাতালের জন্য বৃহস্পতিবার রাতে ১৫ হাজার ডেঙ্গু পরীক্ষার কীটস আনা হয়েছে। যা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। ফলে ডেঙ্গু পরীক্ষা মূলত ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৫০০ টাকা নির্ধারণের পর অতিরিক্ত ফি নেওয়ায় সিএসসিআর হাসপাতালকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করায় বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ভোগান্তি অনেকগুণ বেড়ে গেছে রোগী ও স্বজনদের।
গত বৃহসপতিবারও নতুন করে আক্রান্ত আরো ৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর এ নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৩২ জনে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে শুক্রবার সকালে সর্বশেষ এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে এর বাইরেও আরো অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য মিলছে নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের চেম্বারগুলো থেকে।
যার সংখ্যা তিন শতাধিক হতে পারে।
যাদের বেশিরভাগই নিজ বাসা বা বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। এরমধ্যে শিশুদের সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো। কিন্তু কীটস সংকটের কারণে এদের অনেকের ডেঙ্গু পরীক্ষাও হচ্ছে না।
এছাড়া গত ২০শে জুলাই চট্টগ্রাম মহানগরীর মোগলটুলি এলাকায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে তাজবির খান নামে (১০) এক শিশু ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্যও মিলেছে। যার কোনো হিসাব নেই চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষের কাছে।
অথচ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক (রোগ ও নিয়ন্ত্রণ) মো. নুরুল হায়দার ডেঙ্গু রোগে শিশু তাজবিরের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেন। এমনকি স্থানীয় কাউন্সিলর আব্দুল কাদেরও এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
জুলাই মাসের শুরুর দিকে টানা বৃষ্টির পর নগরীর প্রত্যন্ত এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ নগর ও জেলা-উপজেলার সরকারি কোনো হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও স্বজনরা। ফলে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ১২০০-১৮০০ টাকা পর্যন্ত খরচে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগে একমাত্র ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে ৩০০ টাকায় প্রাথমিক পর্যায়ের ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও সেখানেও রি-এজেন্ট বা কীটস সংকট থাকায় পরীক্ষা তেমন হয়নি।
তবে গত ৩০শে জুলাই থেকে সরকারিভাবে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলা সরকারি হাসপাতালসমূহে কিটসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পৌঁছার পর বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন আক্রান্তরা। তবে এক্ষেত্রে সবার কপালে জুটছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ সুবাধে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি ফি আদায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা চলছে। এ কারণে গত বুধবার নগরীর অভিজাত সিএসসিআর হাসপাতালকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস ও সরঞ্জাম পৌঁছায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ নগর ও জেলা-উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হচ্ছে। এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শনাক্তকরণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার জন্য সরকারিভাবে ৫২০টি কীটস পাওয়া গেছে। এতে পরীক্ষার সুযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তও বাড়ছে। বৃহস্পতিবার নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৩৬ জন রোগী চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগের দিন বুধবার ভর্তি হয়েছে ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী। এর আগের দিন মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছে ৩২ জন। সোমবার ভর্তি হয়েছে সর্বাধিক ৪১ জন। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরে ভর্তি হয়েছে ১৯২ জন। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জেলা ও উপজেলাসহ মোট ২৩২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে পুরুষের সংখ্যাই সর্বাধিক। শিশুর সংখ্যা ১৪। নারীর সংখ্যাও কম।
তিনি বলেন, ঢাকার মতো চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর বিস্তার তেমন ঘটেনি। আক্রান্তদের অধিকাংশই পুরুষ। যাদের বেশিরভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছেন। শিশু ও নারীর সংখ্যাও কম। এ থেকে প্রমাণ হয় চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম বৃষ্টিপাতের আগে থেকেই ছিল। সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণাও কার্যক্রম চালায়। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করায় ডেঙ্গু রোগের তেমন বিস্তার ঘটেনি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানান তিনি।
এদিকে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটার বিষয়ে অন্যরকম তথ্য মিলছে বেসরকারিভাবে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও সচেতন নাগরিক সমাজ থেকে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, নগরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়াও আরো শত শত ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। যারা বাড়ি ও ক্লিনিকে থেকে প্রাইভেট চিকিৎসা চালাচ্ছেন। তার কোনো হিসেব সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষের কাছে।
এমনকি গত ২০শে জুলাই নগরীর মোগলটুলি কাটাবটগাছ এলাকার লোকমান খানের ১০ বছরের ছেলে তাজবির খান একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তারও কোনো তথ্য নেই সিভিল সার্জনের কাছে। তাজবির খানের বাবা লোকমান খান জানান, ১২ই জুলাই হঠাৎ করেই মাথাব্যথা আর জ্বরে আক্রান্ত হয় তাজবীর। শুরু থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্যাথলজি পরীক্ষায় প্রথমে ডেঙ্গু ধরা পরেনি। পরে ১৮ই জুলাই ক্লিনিকে ভর্তির পর শিশু তাজবিরের দেহে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। দিন দিন ছেলের অবস্থার অবনতি হতে হতে ২০শে জুলাই ভোরে মারা যায় তাজবির।
মোগলটুলি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল কাদের বলেন, দীর্ঘদিন বিদেশ থেকে ফিরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শিশু তাজবিরের মৃত্যু সংবাদ পাই। আগে থেকেই আমাদের মশক নিধন কার্যক্রম ছিল। তাজবিরের মৃত্যুর পর আমরা এই কার্যক্রম আরো জোরালো করেছি।
নগরবাসীরা জানান, মশক নিধনে চসিকের ক্রাশ প্রেগ্রাম চলছে। তবুও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। বর্তমানে নগরীর সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বেশি। এরমধ্যে শিশুর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। অনেক শিশু জ্বর-কাশিতে ভুগলেও তাদের ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তাদের পরীক্ষা করা হলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যেতে পারে।
চমেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সাধারণত জ্বর আসে। কিন্তু শিশুদের অনেকের ক্ষেত্রে জ্বরের লক্ষণ দেখা যায় না। রক্তের মধ্যে যে পানি রয়েছে তা শিশুদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরে তরলের তারতম্য হয়ে যায়। এসময় তাদের ব্লাড প্রেসার কমে যায়। তখন শিশুরা মারাও যেতে পারে। ডেঙ্গুরোগ প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
চমেক হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১৫২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে অর্ধেক সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালের ৯, ১৩, ১৪ ও ১৬নং ওয়ার্ডে ডেঙ্গু ব্লকে ৭৩ জন রোগী চিকিৎসাধীন।
একইভাবে নগরীর জেনারেল হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতাল, সিএসসিআর, পার্কভিউ হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, এপিক হাসপাতালে আরও ৭৪ জনের মতো ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নেয়। এরমধ্য থেকেও এক-তৃতীয়াংশ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ জন এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। টেকনাফেও ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেলেও তার কোনো হিসাব নেই সিভিল সার্জনের কাছে।
এদিকে নগরীর বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. আবু সাঈদ চৌধুরী জানান, ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করানো হয় না। এরপরও ৩০০ রোগী বর্তমানে ভর্তি রয়েছে। এরমধ্যে জ্বরে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাদের কারো ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়নি। কারণ হাসপাতালে কীটস সংকট রয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সূত্রমতে, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলার সবকটি সরকারি হাসপাতালের জন্য বৃহস্পতিবার রাতে ১৫ হাজার ডেঙ্গু পরীক্ষার কীটস আনা হয়েছে। যা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। ফলে ডেঙ্গু পরীক্ষা মূলত ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৫০০ টাকা নির্ধারণের পর অতিরিক্ত ফি নেওয়ায় সিএসসিআর হাসপাতালকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করায় বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ভোগান্তি অনেকগুণ বেড়ে গেছে রোগী ও স্বজনদের।
No comments