এখন মেইড ইন বাংলাদেশ যুগ
এখন
‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ যুগ। মেইড ইন চায়না যুগের ইতি ঘটেছে। ফিলিপাইন ও
ইন্দোনেশিয়ায় চীনা বিনিয়োগে বাধা রয়েছে। এক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগকে অধিকহারে
স্বাগত জানাচ্ছে ঢাকা। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত এক দীর্ঘ
প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২২ বছর আগের বাংলাদেশ এখন
কীভাবে পাল্টে গেছে। এখন চীনা বিনিয়োগকারীরা, বিশেষ করে গার্মেন্ট খাতে
চীনারা বেশি বেশি বিনিয়োগ করছেন। এমনই একজন চীনা ব্যবসায়ী লিও ঝুয়াং লিফেং।
ওভারসিস চাইনিজ এসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের সভাপতি বর্তমানে। ২২ বছর আগে তিনি ঢাকায় এসেছেন। তখন ঢাকার বিমানবন্দরে মাত্র দুটি লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট সক্রিয় ছিল। লাইটিংও যথাযথ ছিল না।
লিও ঝুয়াং লিফেং-এর বয়স এখন ৫১ বছর। তিনি গার্মেন্ট ব্যবসা করার জন্য ঢাকায় অবতরণ করেন ১৯৯৭ সালে। তার ধারণা, এখানকার শ্রম খরচ কম ও পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়ায় ভালো ব্যবসা করতে পারবেন। তিনি বর্তমানে এলডিসি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বলেন, ওই সময় ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব ছিল। এমন কি ইন্ট্যান্ট নুডলস কেনাটাও এতো সহজ ছিল না। তার এলডিসি গ্রুপে বর্তমানে কাজ করেন প্রায় ২০০০০ শ্রমিক। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রভূত পরিবর্তন হয়েছে। তবে চীন যে পরিবর্তন করেছে তার সঙ্গে অবশ্যই বাংলাদেশকে তুলনা করা চলে না। লিও ঝুয়াং লিফেং-এর কারখানা এখন বড় এক একটি গ্রামের মতো। সেখানে রয়েছে স্টাফ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য বিনা পয়সায় মেডিকেল সেবা দেয়ার সেন্টার। আছে তাদের সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার।
এমন পরিবেশ বাংলাদেশের অনেক স্থানেই রয়েছে। ফলে চীনা ও অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে আসা অব্যাহত রেখেছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব বিনিয়োগ এখন এই দেশটিকে উৎপাদনের ‘পাওয়ার হাউজে’ পরিণত করেছে। এখানে ৩৫ লাখ শ্রমিক স্থানীয় ও ইউনিকলো, এইচঅ্যান্ডএমের মতো আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পোশাক তৈরি করছেন। মাইকেল কোরসের মতো বিলাসবহুল ব্রান্ডের পোশাকও এখন তৈরি হয় বাংলাদেশে। চীনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক ‘মেইড ইন চায়না’র পরিবর্তে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ ব্যবহার করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
লিও ঝুয়াং লিফেং-এর হিসাবে ২২ বছর আগে তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন মাত্র ২০ থেকে ৩০টি চীনা কোম্পানি এদেশে কাজ করতো। তার হিসাবে তা এখন বেড়ে ৪০০-তে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া চীনা ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ। কিন্তু এ বছর তা ৮.১৩ ভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদি এটা হয়, তাহলে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হবে অন্যতম।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের এই সক্ষমতা। এতে অনেকেরই ভ্রু উত্থিত হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, অর্থনীতি শক্তিশালী থাকার কারণে এই ঋণ মোকাবিলা করতে সক্ষম প্রশাসন। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকা অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। বাংলাদেশের উন্নয়নে সমর্থন দিতে চায়, এমন যেকোনো দেশের সঙ্গে প্রশাসন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে থাকবে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের চমৎকার এক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশকে কয়েক শত কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছে ভারত- এদিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। বলেছেন, আপনার প্রশ্ন হতে পারে চীনের এই ঋণ কি বাংলাদেশ শোধ করতে পারবে। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো উদ্বেগ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, তথাকথিত চীনা ঋণের ফাঁদ এড়িয়ে চলতে পেরেছে বাংলাদেশ।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট আরো লিখেছে, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জাকার্তা, ম্যানিলা ও নমপেন থেকে অনেকটা পার্থক্য ঢাকার। এখানে মহাসড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামোতে রয়েছে সংকট। ব্যস্ততম সময়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে। ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে লেগে যায় হতাশাজনক তিন ঘণ্টা। তা সত্ত্বেও এখানে অনেক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তার মধ্যে হংকংয়ের এভারগ্রিন প্রোডাক্টস গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং অন্যতম। বিশ্বে সবচেয়ে বৃহৎ পরচুল উৎপাদনের অন্যতম বৃহৎ কারখানা এটি। তিনি চীন থেকে কারখানা বাংলাদেশে সরিয়ে আনার পর এখন তার কর্মীসংখ্যা ১৮০০০। উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় তার কারখানায় উৎপাদন হয় মাসে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ পরচুলা। এর পাশাপাশি হংকংয়ের ৬টিসহ বিদেশি ২০টি কোম্পানি তাদের কারখানা স্থাপন করেছে ২১৩ একর জায়গার ওই জোনে। বাংলাদেশে রয়েছে এমন আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোন। এসব কারখানা কাঁচামাল আমদানিতে কম অথবা শূন্য শুল্কহারের সুবিধা পায়।
চীনে শ্রম খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ১০ বছর আগে নিজের দেশ চীন ছেড়ে বাংলাদেশে এসে কারখানা স্থাপন করেন ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং। তার মতো আরো অনেকে একই কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমাকে এশিয়ার যেকোনো স্থানে কারখানা সরিয়ে নিতে হয়েছিল। এটা শুধু বেতনের কারণে নয়, আমাদের দেশে শ্রমিকদের যে সামাজিক কল্যাণমূলক সুবিধা দেয়ার কথা তার মূল্য অনেক বেড়ে যাচ্ছিল।
এক দশক আগে চীনের শেনঝেন, গুয়াংঝৌউ এবং কুনমিংয়ের মতো শহরে কারখানা ছিল ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং-এর। তিনি গুয়াংঝৌউয়ের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। চীনে অন্য যেসব কারখানা আছে তা নাটকীয়ভাবে সীমিত করেছেন। বর্তমানে তার কোম্পানিতে যে পরিমাণ পরচুলা উৎপাদন হয় তার শতকরা ৯৩ ভাগই বাংলাদেশি। তিনি কারখানা সরিয়ে আনার আগে মাসে চীনা কর্মীদের বেতন দিতে হতো ২০০০ ইউয়েন। কিন্তু তা সরিয়ে আনার পর তাকে স্থানীয় শ্রমিকদের মাসে মাত্র ১৭০ ইউয়েন বেতন দিতে পারেন। যা ২৫ ডলারের মতো।
বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বনিম্ন মজুরি হলো মাসে ৯৫ ডলার, যা এখনো এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কম। কম্বোডিয়ায় প্রতি মাসে এই বেতন ১৮২ ডলার। হ্যানয় এবং হো চি মিন সিটিতে ১৮০ ডলার। মিয়ানমারে এই বেতন প্রতিদিন ৩.৬০ ডলার। বাংলাদেশে কম মজুরি থাকায় দেশটিতে ৩০০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের কারখানা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রপ্তানির শতকরা ৮০ ভাগ এই শিল্প। তবে এখানে মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় শ্রমিকরা। জানুয়ারিতে হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক সর্বনিম্ন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েক ডজন মানুষ আহত হন। নিহত হন একজন।
এলডিসি গ্রুপের ঝুয়াং বলেন, কম্বোডিয়ায় কারখানা স্থাপনে কিছু সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, সেখানে রয়েছে শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন। এ ছাড়া সেটা হলো মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের একটি ছোট্ট দেশ। সেই তুলনায় বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি। তিনি ভিয়েতনামের পক্ষে নন। কারণ, সেখানে উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুয়াং বলেন, কম্বোডিয়ায় দুর্নীতি একটি সাধারণ বিষয়। জনসংখ্যা কম। শ্রমিক ইউনিয়ন শক্তিশালী।
ঝুয়াং ২২ বছর আগে বাংলাদেশে আসার পর এখানে চীনা কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাদের যে পরিমাণ উপস্থিতি সে তুলনায় বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি খুবই কম। ওই দেশগুলোতে খুব সহজেই রাস্তায় দেখা মেলে চীনা শ্রমিক বা ব্যবসায়ীর। ফলে চীনাদের এই ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে ওই দেশগুলোতে অস্বস্তি ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখন অবধি বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নি।
অর্থনীতিতে চীনা মডেল ব্যবহার করছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক চীনা বিনিয়োগকারী ও কর্মী রয়েছেন। স্থানীয়দের জন্য তারা প্রচুর সংযোগ সৃষ্টি করছেন। এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। আমরা খুশি। তারা এ দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করছেন। বাংলাদেশে চীনাদের বিনিয়োগ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন ঢাকায় সেন্ট্রাল ওমেন্স ইউনিভার্সিটির আইনের লেকচারার ফারহান হক। চীনা বিনিয়োগ ও কর্মীদের বিষয়ে সমর্থন করেন বাংলাদেশিরা ও রাজনীতিকরা। তাদের অন্যতম বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিজনকে স্বাগত জানাই। এরই মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন চীনা নাগরিকরা। যদি আপনি আমাদের মার্কেট, শপিং মল পরিদর্শন করেন তাহলে বিপুল পণ্যের সমাহার দেখতে পাবেন, যা চীনে তৈরি। চীনা বিনিয়োগ আমাদের দেশকে সহায়তা করছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে তারা এসব কথা বলেছেন।
এ নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। এতে বাংলাদেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাত ছিল অনুন্নত। এভারগ্রিন প্রোডাক্টসের চ্যাং এক দশক আগে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন ছিল বর্ষা মৌসুম। এ সম্পর্কে চ্যাং বলেন, মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। তাতে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছিল ঢাকা। আমার গাড়ির চাকা পানিতে তলিয়ে যেত পুরোপুরি। বিদ্যুতের অবস্থা ছিল নাজুক। যখনই ঢাকা আসতাম, প্রতিবারই দেখতাম বিদ্যুতের ঘাটতি। বিদ্যুৎহীন থাকতে হতো প্রতিবার চার ঘণ্টা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের সেই অবস্থা নেই। রাস্তাগুলো চওড়া করা হয়েছে। মহাসড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও বিশাল কন্টেইনারবাহী জাহাজে পণ্য বাংলাদেশে পৌঁছাতে চার থেকে ৫ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে চীন থেকে কম্বোডিয়ায় সময় লাগে মাত্র ১০ দিন। এজন্য চ্যাংয়ের এক বন্ধু তার কারখানা খুলেছেন কম্বোডিয়ায়। তবে বাংলাদেশে ব্যবসা করার সুবিধা একটিই। তা হলো- এখানে শ্রম খরচ কম। আর বাজে দিক হলো, শিপিংয়ে সময় লাগে অনেক বেশি। এর ফলে উৎপাদিত পণ্য কারখানায়ই জমা থাকে বেশি।
একই রকম কথা বলেছেন হংকংয়ের ডেভিড লাম মিং-হিউং। তিনি চশমা প্রস্তুতকারক একটি কারখানার জেনারেল ম্যানেজার। তার মতে, চীন থেকে পণ্যের চালান বাংলাদেশে শিপিং খাতে সময় লাগে এক মাসের মতো। যদি এক্ষেত্রে বার্থের সংকট থাকে তাহলে আরো এক সপ্তাহ সময় বেশি লাগবে। তার মতে, ১৯৭০ এর দশকে প্রথম যখন চীন উন্মুক্ত নীতি গ্রহণ করেছিল, ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সেই চীনের মতো। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য চীনা মডেল ব্যবহার করছে বাংলাদেশ।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং। ওই সময় দুই দেশ ২৭টি বিনিয়োগ ও ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার পরিমাণ ২৪০০ কোটি ডলার। সি জিনপিংয়ের ওই সফরের পর চীন থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের একটি পত্রিকার হিসাব মতে, ২০১৭/১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৬/১৭ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।
ওদিকে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলা নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তাকে ভুল বোঝাবুঝি, পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন ঢাকায় চীনা দূতাবাসের উপ-প্রধান চেন ওয়েই। তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশ শুধু চীনের সহায়তার ওপরই নির্ভর করে না। একই সঙ্গে তার অর্থনীতিতে গতি আনার জন্য নির্ভর করে ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর। এসব দেশের বিনিয়োগ ও সহায়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সব দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখতে চায়। এক্ষেত্রে কোনো একক পক্ষকে তারা বেছে নেয় নি।
ওদিকে নয়া দিল্লির সেন্টার অব পলিসি রিচার্সের প্রফেসর ব্রাহ্ম চ্যালানির হিসাব মতে, বাংলাদেশে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ঋণ হলো জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা প্রায় ১৪ ভাগের সমতুল্য। এই ঋণ সহনীয়। বাংলাদেশ এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, তার এই ঋণের মাত্রা ম্যানেজযোগ্য। ‘বাংলাদেশ: পলিটিক্স, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি’ বইয়ের লেখক ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর ডেভিড লুইস বলেন, কার্যকর রপ্তানি কৌশলের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী। এসব রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতম খাত হলো গার্মেন্ট। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে এই খাত।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক। এ বছর বাংলাদেশ ৩৯০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করার আশা করছে। ২০২১ সালের মধ্যে সরকার এই অঙ্ক ৫০০০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায়।
ওভারসিস চাইনিজ এসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের সভাপতি বর্তমানে। ২২ বছর আগে তিনি ঢাকায় এসেছেন। তখন ঢাকার বিমানবন্দরে মাত্র দুটি লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট সক্রিয় ছিল। লাইটিংও যথাযথ ছিল না।
লিও ঝুয়াং লিফেং-এর বয়স এখন ৫১ বছর। তিনি গার্মেন্ট ব্যবসা করার জন্য ঢাকায় অবতরণ করেন ১৯৯৭ সালে। তার ধারণা, এখানকার শ্রম খরচ কম ও পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়ায় ভালো ব্যবসা করতে পারবেন। তিনি বর্তমানে এলডিসি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বলেন, ওই সময় ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব ছিল। এমন কি ইন্ট্যান্ট নুডলস কেনাটাও এতো সহজ ছিল না। তার এলডিসি গ্রুপে বর্তমানে কাজ করেন প্রায় ২০০০০ শ্রমিক। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রভূত পরিবর্তন হয়েছে। তবে চীন যে পরিবর্তন করেছে তার সঙ্গে অবশ্যই বাংলাদেশকে তুলনা করা চলে না। লিও ঝুয়াং লিফেং-এর কারখানা এখন বড় এক একটি গ্রামের মতো। সেখানে রয়েছে স্টাফ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য বিনা পয়সায় মেডিকেল সেবা দেয়ার সেন্টার। আছে তাদের সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার।
এমন পরিবেশ বাংলাদেশের অনেক স্থানেই রয়েছে। ফলে চীনা ও অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে আসা অব্যাহত রেখেছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব বিনিয়োগ এখন এই দেশটিকে উৎপাদনের ‘পাওয়ার হাউজে’ পরিণত করেছে। এখানে ৩৫ লাখ শ্রমিক স্থানীয় ও ইউনিকলো, এইচঅ্যান্ডএমের মতো আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পোশাক তৈরি করছেন। মাইকেল কোরসের মতো বিলাসবহুল ব্রান্ডের পোশাকও এখন তৈরি হয় বাংলাদেশে। চীনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক ‘মেইড ইন চায়না’র পরিবর্তে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ ব্যবহার করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
লিও ঝুয়াং লিফেং-এর হিসাবে ২২ বছর আগে তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন মাত্র ২০ থেকে ৩০টি চীনা কোম্পানি এদেশে কাজ করতো। তার হিসাবে তা এখন বেড়ে ৪০০-তে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া চীনা ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ। কিন্তু এ বছর তা ৮.১৩ ভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদি এটা হয়, তাহলে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হবে অন্যতম।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের এই সক্ষমতা। এতে অনেকেরই ভ্রু উত্থিত হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, অর্থনীতি শক্তিশালী থাকার কারণে এই ঋণ মোকাবিলা করতে সক্ষম প্রশাসন। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকা অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। বাংলাদেশের উন্নয়নে সমর্থন দিতে চায়, এমন যেকোনো দেশের সঙ্গে প্রশাসন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে থাকবে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের চমৎকার এক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশকে কয়েক শত কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছে ভারত- এদিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। বলেছেন, আপনার প্রশ্ন হতে পারে চীনের এই ঋণ কি বাংলাদেশ শোধ করতে পারবে। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো উদ্বেগ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, তথাকথিত চীনা ঋণের ফাঁদ এড়িয়ে চলতে পেরেছে বাংলাদেশ।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট আরো লিখেছে, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জাকার্তা, ম্যানিলা ও নমপেন থেকে অনেকটা পার্থক্য ঢাকার। এখানে মহাসড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামোতে রয়েছে সংকট। ব্যস্ততম সময়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে। ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে লেগে যায় হতাশাজনক তিন ঘণ্টা। তা সত্ত্বেও এখানে অনেক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তার মধ্যে হংকংয়ের এভারগ্রিন প্রোডাক্টস গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং অন্যতম। বিশ্বে সবচেয়ে বৃহৎ পরচুল উৎপাদনের অন্যতম বৃহৎ কারখানা এটি। তিনি চীন থেকে কারখানা বাংলাদেশে সরিয়ে আনার পর এখন তার কর্মীসংখ্যা ১৮০০০। উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় তার কারখানায় উৎপাদন হয় মাসে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ পরচুলা। এর পাশাপাশি হংকংয়ের ৬টিসহ বিদেশি ২০টি কোম্পানি তাদের কারখানা স্থাপন করেছে ২১৩ একর জায়গার ওই জোনে। বাংলাদেশে রয়েছে এমন আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোন। এসব কারখানা কাঁচামাল আমদানিতে কম অথবা শূন্য শুল্কহারের সুবিধা পায়।
চীনে শ্রম খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ১০ বছর আগে নিজের দেশ চীন ছেড়ে বাংলাদেশে এসে কারখানা স্থাপন করেন ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং। তার মতো আরো অনেকে একই কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমাকে এশিয়ার যেকোনো স্থানে কারখানা সরিয়ে নিতে হয়েছিল। এটা শুধু বেতনের কারণে নয়, আমাদের দেশে শ্রমিকদের যে সামাজিক কল্যাণমূলক সুবিধা দেয়ার কথা তার মূল্য অনেক বেড়ে যাচ্ছিল।
এক দশক আগে চীনের শেনঝেন, গুয়াংঝৌউ এবং কুনমিংয়ের মতো শহরে কারখানা ছিল ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং-এর। তিনি গুয়াংঝৌউয়ের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। চীনে অন্য যেসব কারখানা আছে তা নাটকীয়ভাবে সীমিত করেছেন। বর্তমানে তার কোম্পানিতে যে পরিমাণ পরচুলা উৎপাদন হয় তার শতকরা ৯৩ ভাগই বাংলাদেশি। তিনি কারখানা সরিয়ে আনার আগে মাসে চীনা কর্মীদের বেতন দিতে হতো ২০০০ ইউয়েন। কিন্তু তা সরিয়ে আনার পর তাকে স্থানীয় শ্রমিকদের মাসে মাত্র ১৭০ ইউয়েন বেতন দিতে পারেন। যা ২৫ ডলারের মতো।
বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বনিম্ন মজুরি হলো মাসে ৯৫ ডলার, যা এখনো এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কম। কম্বোডিয়ায় প্রতি মাসে এই বেতন ১৮২ ডলার। হ্যানয় এবং হো চি মিন সিটিতে ১৮০ ডলার। মিয়ানমারে এই বেতন প্রতিদিন ৩.৬০ ডলার। বাংলাদেশে কম মজুরি থাকায় দেশটিতে ৩০০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের কারখানা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রপ্তানির শতকরা ৮০ ভাগ এই শিল্প। তবে এখানে মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় শ্রমিকরা। জানুয়ারিতে হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক সর্বনিম্ন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েক ডজন মানুষ আহত হন। নিহত হন একজন।
এলডিসি গ্রুপের ঝুয়াং বলেন, কম্বোডিয়ায় কারখানা স্থাপনে কিছু সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, সেখানে রয়েছে শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন। এ ছাড়া সেটা হলো মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের একটি ছোট্ট দেশ। সেই তুলনায় বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি। তিনি ভিয়েতনামের পক্ষে নন। কারণ, সেখানে উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুয়াং বলেন, কম্বোডিয়ায় দুর্নীতি একটি সাধারণ বিষয়। জনসংখ্যা কম। শ্রমিক ইউনিয়ন শক্তিশালী।
ঝুয়াং ২২ বছর আগে বাংলাদেশে আসার পর এখানে চীনা কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাদের যে পরিমাণ উপস্থিতি সে তুলনায় বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি খুবই কম। ওই দেশগুলোতে খুব সহজেই রাস্তায় দেখা মেলে চীনা শ্রমিক বা ব্যবসায়ীর। ফলে চীনাদের এই ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে ওই দেশগুলোতে অস্বস্তি ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখন অবধি বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নি।
অর্থনীতিতে চীনা মডেল ব্যবহার করছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক চীনা বিনিয়োগকারী ও কর্মী রয়েছেন। স্থানীয়দের জন্য তারা প্রচুর সংযোগ সৃষ্টি করছেন। এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। আমরা খুশি। তারা এ দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করছেন। বাংলাদেশে চীনাদের বিনিয়োগ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন ঢাকায় সেন্ট্রাল ওমেন্স ইউনিভার্সিটির আইনের লেকচারার ফারহান হক। চীনা বিনিয়োগ ও কর্মীদের বিষয়ে সমর্থন করেন বাংলাদেশিরা ও রাজনীতিকরা। তাদের অন্যতম বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিজনকে স্বাগত জানাই। এরই মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন চীনা নাগরিকরা। যদি আপনি আমাদের মার্কেট, শপিং মল পরিদর্শন করেন তাহলে বিপুল পণ্যের সমাহার দেখতে পাবেন, যা চীনে তৈরি। চীনা বিনিয়োগ আমাদের দেশকে সহায়তা করছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে তারা এসব কথা বলেছেন।
এ নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। এতে বাংলাদেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাত ছিল অনুন্নত। এভারগ্রিন প্রোডাক্টসের চ্যাং এক দশক আগে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন ছিল বর্ষা মৌসুম। এ সম্পর্কে চ্যাং বলেন, মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। তাতে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছিল ঢাকা। আমার গাড়ির চাকা পানিতে তলিয়ে যেত পুরোপুরি। বিদ্যুতের অবস্থা ছিল নাজুক। যখনই ঢাকা আসতাম, প্রতিবারই দেখতাম বিদ্যুতের ঘাটতি। বিদ্যুৎহীন থাকতে হতো প্রতিবার চার ঘণ্টা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের সেই অবস্থা নেই। রাস্তাগুলো চওড়া করা হয়েছে। মহাসড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও বিশাল কন্টেইনারবাহী জাহাজে পণ্য বাংলাদেশে পৌঁছাতে চার থেকে ৫ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে চীন থেকে কম্বোডিয়ায় সময় লাগে মাত্র ১০ দিন। এজন্য চ্যাংয়ের এক বন্ধু তার কারখানা খুলেছেন কম্বোডিয়ায়। তবে বাংলাদেশে ব্যবসা করার সুবিধা একটিই। তা হলো- এখানে শ্রম খরচ কম। আর বাজে দিক হলো, শিপিংয়ে সময় লাগে অনেক বেশি। এর ফলে উৎপাদিত পণ্য কারখানায়ই জমা থাকে বেশি।
একই রকম কথা বলেছেন হংকংয়ের ডেভিড লাম মিং-হিউং। তিনি চশমা প্রস্তুতকারক একটি কারখানার জেনারেল ম্যানেজার। তার মতে, চীন থেকে পণ্যের চালান বাংলাদেশে শিপিং খাতে সময় লাগে এক মাসের মতো। যদি এক্ষেত্রে বার্থের সংকট থাকে তাহলে আরো এক সপ্তাহ সময় বেশি লাগবে। তার মতে, ১৯৭০ এর দশকে প্রথম যখন চীন উন্মুক্ত নীতি গ্রহণ করেছিল, ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সেই চীনের মতো। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য চীনা মডেল ব্যবহার করছে বাংলাদেশ।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং। ওই সময় দুই দেশ ২৭টি বিনিয়োগ ও ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার পরিমাণ ২৪০০ কোটি ডলার। সি জিনপিংয়ের ওই সফরের পর চীন থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের একটি পত্রিকার হিসাব মতে, ২০১৭/১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৬/১৭ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।
ওদিকে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলা নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তাকে ভুল বোঝাবুঝি, পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন ঢাকায় চীনা দূতাবাসের উপ-প্রধান চেন ওয়েই। তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশ শুধু চীনের সহায়তার ওপরই নির্ভর করে না। একই সঙ্গে তার অর্থনীতিতে গতি আনার জন্য নির্ভর করে ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর। এসব দেশের বিনিয়োগ ও সহায়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সব দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখতে চায়। এক্ষেত্রে কোনো একক পক্ষকে তারা বেছে নেয় নি।
ওদিকে নয়া দিল্লির সেন্টার অব পলিসি রিচার্সের প্রফেসর ব্রাহ্ম চ্যালানির হিসাব মতে, বাংলাদেশে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ঋণ হলো জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা প্রায় ১৪ ভাগের সমতুল্য। এই ঋণ সহনীয়। বাংলাদেশ এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, তার এই ঋণের মাত্রা ম্যানেজযোগ্য। ‘বাংলাদেশ: পলিটিক্স, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি’ বইয়ের লেখক ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর ডেভিড লুইস বলেন, কার্যকর রপ্তানি কৌশলের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী। এসব রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতম খাত হলো গার্মেন্ট। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে এই খাত।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক। এ বছর বাংলাদেশ ৩৯০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করার আশা করছে। ২০২১ সালের মধ্যে সরকার এই অঙ্ক ৫০০০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায়।
No comments