খেলাপি ঋণ হ্রাসে সুশাসন by এমএ মাসুম
খেলাপি
ঋণের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং
খাতের জন্য দুর্বিষহ বোঝা হয়ে উঠেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঋণ দিয়ে
বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বড় ঋণগুলো আদায় হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়লে
পুরো অর্থনীতি চরম দুরবস্থায় পতিত হবে। দেশের ঋণ গ্রহীতারা কেন খেলাপি হন,
তার কারণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই এক বৈঠকে উল্লেখ করেন।
তার মতে, খেলাপি হওয়াটা লজ্জাজনক হলেও ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে সেটা নেই। তাদের
মধ্যে অনেকে মনে করেন, কষ্ট করে টাকা পেয়েছে, এ টাকা আর ফেরত দিতে হয় না।
ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা, যা পরবর্তী
সময়ে খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। জাতীয় সংসদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা
যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ঋণ খেলাপির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮
জন। তাদের কাছে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের ৭৩ শতাংশের সমান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-১০১৭’-তে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ডিসেম্বরে ৭৪ হাজার ৩০২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের দখলে রয়েছে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। আবার এ খেলাপি ঋণের অর্ধেকই ৫ ব্যাংকের দখলে রয়েছে অর্থাৎ খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩৭ হাজার কোটি টাকাই রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকের। বাকি ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ রয়েছে অন্য ৫৩ ব্যাংকের। খেলাপি ঋণে শীর্ষে থাকা ১০ ব্যাংকের মধ্যে তিনটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, একটি বিশেষায়িত ব্যাংক ও একটি বিদেশি ব্যাংক রয়েছে। খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৪ (৮৩.৯) শতাংশই মন্দ ঋণ। অর্থাৎ এ ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। বাকি ১৬ শতাংশ খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮ শতাংশ সন্দেহজনক মানে শ্রেণিকৃত, বাকি ৮.১ শতাংশ নিম্নমানে শ্রেণিকৃত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণের বেশিরভাগই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে কিছু শিল্প গ্রুপের হাতে। ব্যংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের একটি বড় অংশই মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের হাতে আটকা পড়ে রয়েছে। ফলে কোনো কারণে একটি গ্রুপ সমস্যায় পড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংকিং খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বৃহৎ শিল্প গ্রুপ খেলাপি হয়ে যাওয়া। কোনো একটি গ্রুপের বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হলেই ব্যাংকিং খাতে খোলাপি ঋণ বেড়ে যায় হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলোÑ অনেক বৃহৎ ঋণ বিতরণ করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও প্রকল্প মূল্যায়ন বিবেচনা করা হয় না। এসব কারণে ব্যংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি বৃদ্ধির প্রবণতাও রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন সংকট যেন কিছুতেই কাটছে না। বস্তুত, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুন ’১৮ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকায়। প্রতি বছরই জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগাতে হয়। এ পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেই ভালো নয়। এটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার লক্ষণ। জানা যায়, ব্যাংকগুলোর আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়া। বেশিরভাগ ব্যাংকেরই মন্দ ঋণ বেড়ে গেছে। আর মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছরই বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে। এ প্রবণতা অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। এক দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও সুশাসন, জবাবদিহিতার সূচকে পেছনে হাঁটছে। আবার সহজ ব্যবসা করার সূচকেও তেমন উন্নতি হচ্ছে না। দারিদ্র্য নিরসন হলেও আয় বৈষম্য বাড়ছে ব্যাপক হারে। সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত এক কর্মশালায় বলা হয়, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেশি। ২০১৭ সালে বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ খেলাপি, মার্চ ২০১৮-তে ছিল ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা ছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে খেলাপি ঋণের এটাই সর্বোচ্চ হার। এ থেকে ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির ভয়াবহতা বোঝা যায়। এটি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, কয়েক বছর ঋণ খেলাপির হার বাড়লেও যথাযথ পদক্ষেপের অনুপস্থিতি।
সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার লাগামহীনভাবে বাড়লেও অন্যান্য দেশে এ হার কমছে। এর মধ্যে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ার ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালে ২ শতাংশ, ভারতে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। প্রশ্ন উঠছে ঋণ খেলাপির এত টাকা কোথায় যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে আসছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেপ্রিটি (জিএফআই)। জিএফআইর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য রফতানি পণ্যের সম্মিলিত যে আকার তার চেয়ে বেশি অর্থ অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থ পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বে চার নম্বরে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ।
ব্যাংকিং খাতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে নতুন ব্যাংকগুলো। বর্তমান সরকারের সময়ে লাইসেন্স পাওয়া নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে। এরই মধ্যে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রতি প্রান্তিকেই তা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা থাকায় এবং প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কিছু ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এসব ব্যাংক কার্যক্রমে আসার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কবলে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, নতুন ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু চাপের মুখে তারা লাইসেন্স দিতে বাধ্য হয়। কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম এবং সব ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণই প্রমাণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সময়ের বিরোধিতা সঠিক ছিল। খেলাপি ঋণসংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে ফারমার্স ব্যাংকের। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণে ব্যাংকটি এক পর্যায়ে অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। এমনকি গ্রাহকের টাকা পর্যন্ত ফেরত দিতে পারছিল না। অবশেষে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে ৭১৫ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হয়।
দেশের ব্যাংক খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি মত প্রকাশ করেন খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ৩০ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং ১ নভেম্বর পুলিশের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে তফসিলি ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বর্তমানে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯টি। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৪টি। তাই এ খাত সংকোচনের দরকার হতে পারে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় আরও ৩টি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। এগুলো হলোÑ বেঙ্গল ব্যাংক, পিপল ব্যাংক এবং সিটিজেন ব্যাংক। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ সময় নতুন ব্যাংক দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে শিগগিরই কিছু ব্যাংককে একীভূত করার কথা জানান এবং এজন্য আইন প্রণয়ন করা হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশি হওয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এসব কারণে কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমিয়ে আনা ব্যাংকগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থাও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য অনবরত তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্বলতা কাটছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক আর্থিক কর্মকা- পরিচালনাকারী সংস্থা ফিচ রেটিংসের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। ফিচ রেটিংসে ‘ট্রিপল এ’ থেকে ‘ডি’ পর্যন্ত ১১টি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত রয়েছে পঞ্চম ধাপে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা বোঝায়। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত ‘বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন-২০১৮’ এ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার কৌশল নির্ধারণে জোর দেওয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো কোনো দেশে পাসপোর্ট জব্দ করা হয়, যাতে তারা অন্য দেশে পালিয়ে যেতে না পারে। এশিয়ার মধ্যেই এমন দেশের উদাহরণ পাওয়া যায়। চীনের সর্বোচ্চ আদালত সে দেশের ৬১ লাখ ৫০ হাজার ঋণ খেলাপি ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২২ লাখ ২০ হাজার ঋণ খেলাপিকে উচ্চগতি সম্পন্ন ট্রেনের টিকিট দেওয়া হয়নি, কারণ সেগুলো অনেক ব্যয়বহুল। প্রায় ৭১ হাজার ঋণ খেলাপিকে তাদের করপোরেট চাকরি বা নির্বাহী পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। চীনের একটি বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে পাওয়া ৫ লাখ ৫০ হাজার ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের আবেদন ফিরিয়ে দিয়েছে। দেশটির আদালত আমলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক উপদেষ্টাম-লীর সদস্য এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদেরও কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এর ফলে কেউ কেউ দল থেকে বহিষ্কার বা দলীয় পদ থেকে ছিটকে পড়েছে। ঋণ খেলাপিদের আইডি কার্ড নম্বরের ভিত্তিতে তাদের বড় বড় হোটেলে থাকা বা বিমান বা ট্রেনের টিকিট কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের পুরো নাম ও আইডি কার্ড নম্বর তুলে দেওয়া হয়েছে দেশটির সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে, যাতে কেউ ওইসব খেলাপি সম্পর্কে জানতে পারে। সম্মেলনে এক গবেষণাপত্র উপস্থাপনে বলা হয়, মালয়েশিয়ার সরকার এশিয়ার আর্থিক সংকট-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ আদায় নিশ্চিত করতে একটি ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কোম্পানিটি বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সব অ-নগদ সম্পদকে নগদ সম্পদে পরিণত করে এবং ধীরে ধীরে সর্বোচ্চ পরিমাণ আদায় নিশ্চিত করে। মালয়েশিয়ার মতো থাইল্যান্ডও একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল ২০০১ সালে। এমনিভাবে শ্রীলঙ্কাও তাদের খোলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। নেপালে ঋণ খেলাপিদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয় সে কারণে তাদের দেশে খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খেলাপি ঋণের কারণে দেশে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান সরকার ঋণে ৯ এবং আমানতে ৬ শতাংশ সুদ হার প্রথমে ১ জুলাই পরে ৯ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা ঘোষণা দেয়। জানা যায়, ঘোষিত এ হার অধিকাংশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেনি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণেই অধিকাংশ ব্যাংক এখনও ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়নি। ঋণ খেলাপিরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক প্রভাবশালী থাকায় অনেক সময় ব্যাংকাররা কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং এদের বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। ঋণ নিয়ে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দেয় না তাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ঘৃণা করতে হবে। ঋণ খেলাপিদের কালো তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে তারা নতুন করে ঋণ গ্রহণ, জমি ক্রয়, সম্পদ অধিগ্রহণ করে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে না পারে এবং প্রমোদ ভ্রমণ বা ভোগ-বিলাস করে বেড়াতে না পারে। খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে অনিয়ম ও দুর্র্নীতিমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন নয় বরং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বিষয় বিবেচনা করা উচিত। তাছাড়া, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
এমএ মাসুম, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-১০১৭’-তে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ডিসেম্বরে ৭৪ হাজার ৩০২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের দখলে রয়েছে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। আবার এ খেলাপি ঋণের অর্ধেকই ৫ ব্যাংকের দখলে রয়েছে অর্থাৎ খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩৭ হাজার কোটি টাকাই রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকের। বাকি ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ রয়েছে অন্য ৫৩ ব্যাংকের। খেলাপি ঋণে শীর্ষে থাকা ১০ ব্যাংকের মধ্যে তিনটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, একটি বিশেষায়িত ব্যাংক ও একটি বিদেশি ব্যাংক রয়েছে। খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৪ (৮৩.৯) শতাংশই মন্দ ঋণ। অর্থাৎ এ ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। বাকি ১৬ শতাংশ খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮ শতাংশ সন্দেহজনক মানে শ্রেণিকৃত, বাকি ৮.১ শতাংশ নিম্নমানে শ্রেণিকৃত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণের বেশিরভাগই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে কিছু শিল্প গ্রুপের হাতে। ব্যংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের একটি বড় অংশই মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের হাতে আটকা পড়ে রয়েছে। ফলে কোনো কারণে একটি গ্রুপ সমস্যায় পড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংকিং খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বৃহৎ শিল্প গ্রুপ খেলাপি হয়ে যাওয়া। কোনো একটি গ্রুপের বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হলেই ব্যাংকিং খাতে খোলাপি ঋণ বেড়ে যায় হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলোÑ অনেক বৃহৎ ঋণ বিতরণ করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও প্রকল্প মূল্যায়ন বিবেচনা করা হয় না। এসব কারণে ব্যংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি বৃদ্ধির প্রবণতাও রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন সংকট যেন কিছুতেই কাটছে না। বস্তুত, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুন ’১৮ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকায়। প্রতি বছরই জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগাতে হয়। এ পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেই ভালো নয়। এটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার লক্ষণ। জানা যায়, ব্যাংকগুলোর আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়া। বেশিরভাগ ব্যাংকেরই মন্দ ঋণ বেড়ে গেছে। আর মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছরই বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে। এ প্রবণতা অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। এক দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও সুশাসন, জবাবদিহিতার সূচকে পেছনে হাঁটছে। আবার সহজ ব্যবসা করার সূচকেও তেমন উন্নতি হচ্ছে না। দারিদ্র্য নিরসন হলেও আয় বৈষম্য বাড়ছে ব্যাপক হারে। সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত এক কর্মশালায় বলা হয়, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেশি। ২০১৭ সালে বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ খেলাপি, মার্চ ২০১৮-তে ছিল ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা ছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে খেলাপি ঋণের এটাই সর্বোচ্চ হার। এ থেকে ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির ভয়াবহতা বোঝা যায়। এটি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, কয়েক বছর ঋণ খেলাপির হার বাড়লেও যথাযথ পদক্ষেপের অনুপস্থিতি।
সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার লাগামহীনভাবে বাড়লেও অন্যান্য দেশে এ হার কমছে। এর মধ্যে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ার ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালে ২ শতাংশ, ভারতে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। প্রশ্ন উঠছে ঋণ খেলাপির এত টাকা কোথায় যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে আসছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেপ্রিটি (জিএফআই)। জিএফআইর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য রফতানি পণ্যের সম্মিলিত যে আকার তার চেয়ে বেশি অর্থ অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থ পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বে চার নম্বরে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ।
ব্যাংকিং খাতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে নতুন ব্যাংকগুলো। বর্তমান সরকারের সময়ে লাইসেন্স পাওয়া নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে। এরই মধ্যে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রতি প্রান্তিকেই তা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা থাকায় এবং প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কিছু ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এসব ব্যাংক কার্যক্রমে আসার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কবলে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, নতুন ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু চাপের মুখে তারা লাইসেন্স দিতে বাধ্য হয়। কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম এবং সব ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণই প্রমাণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সময়ের বিরোধিতা সঠিক ছিল। খেলাপি ঋণসংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে ফারমার্স ব্যাংকের। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণে ব্যাংকটি এক পর্যায়ে অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। এমনকি গ্রাহকের টাকা পর্যন্ত ফেরত দিতে পারছিল না। অবশেষে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে ৭১৫ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হয়।
দেশের ব্যাংক খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি মত প্রকাশ করেন খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ৩০ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং ১ নভেম্বর পুলিশের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে তফসিলি ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বর্তমানে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯টি। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৪টি। তাই এ খাত সংকোচনের দরকার হতে পারে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় আরও ৩টি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। এগুলো হলোÑ বেঙ্গল ব্যাংক, পিপল ব্যাংক এবং সিটিজেন ব্যাংক। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ সময় নতুন ব্যাংক দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে শিগগিরই কিছু ব্যাংককে একীভূত করার কথা জানান এবং এজন্য আইন প্রণয়ন করা হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশি হওয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এসব কারণে কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমিয়ে আনা ব্যাংকগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থাও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য অনবরত তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্বলতা কাটছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক আর্থিক কর্মকা- পরিচালনাকারী সংস্থা ফিচ রেটিংসের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। ফিচ রেটিংসে ‘ট্রিপল এ’ থেকে ‘ডি’ পর্যন্ত ১১টি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত রয়েছে পঞ্চম ধাপে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা বোঝায়। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত ‘বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন-২০১৮’ এ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার কৌশল নির্ধারণে জোর দেওয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো কোনো দেশে পাসপোর্ট জব্দ করা হয়, যাতে তারা অন্য দেশে পালিয়ে যেতে না পারে। এশিয়ার মধ্যেই এমন দেশের উদাহরণ পাওয়া যায়। চীনের সর্বোচ্চ আদালত সে দেশের ৬১ লাখ ৫০ হাজার ঋণ খেলাপি ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২২ লাখ ২০ হাজার ঋণ খেলাপিকে উচ্চগতি সম্পন্ন ট্রেনের টিকিট দেওয়া হয়নি, কারণ সেগুলো অনেক ব্যয়বহুল। প্রায় ৭১ হাজার ঋণ খেলাপিকে তাদের করপোরেট চাকরি বা নির্বাহী পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। চীনের একটি বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে পাওয়া ৫ লাখ ৫০ হাজার ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের আবেদন ফিরিয়ে দিয়েছে। দেশটির আদালত আমলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক উপদেষ্টাম-লীর সদস্য এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদেরও কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এর ফলে কেউ কেউ দল থেকে বহিষ্কার বা দলীয় পদ থেকে ছিটকে পড়েছে। ঋণ খেলাপিদের আইডি কার্ড নম্বরের ভিত্তিতে তাদের বড় বড় হোটেলে থাকা বা বিমান বা ট্রেনের টিকিট কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের পুরো নাম ও আইডি কার্ড নম্বর তুলে দেওয়া হয়েছে দেশটির সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে, যাতে কেউ ওইসব খেলাপি সম্পর্কে জানতে পারে। সম্মেলনে এক গবেষণাপত্র উপস্থাপনে বলা হয়, মালয়েশিয়ার সরকার এশিয়ার আর্থিক সংকট-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ আদায় নিশ্চিত করতে একটি ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কোম্পানিটি বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সব অ-নগদ সম্পদকে নগদ সম্পদে পরিণত করে এবং ধীরে ধীরে সর্বোচ্চ পরিমাণ আদায় নিশ্চিত করে। মালয়েশিয়ার মতো থাইল্যান্ডও একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল ২০০১ সালে। এমনিভাবে শ্রীলঙ্কাও তাদের খোলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। নেপালে ঋণ খেলাপিদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয় সে কারণে তাদের দেশে খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খেলাপি ঋণের কারণে দেশে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান সরকার ঋণে ৯ এবং আমানতে ৬ শতাংশ সুদ হার প্রথমে ১ জুলাই পরে ৯ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা ঘোষণা দেয়। জানা যায়, ঘোষিত এ হার অধিকাংশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেনি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণেই অধিকাংশ ব্যাংক এখনও ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়নি। ঋণ খেলাপিরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক প্রভাবশালী থাকায় অনেক সময় ব্যাংকাররা কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং এদের বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। ঋণ নিয়ে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দেয় না তাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ঘৃণা করতে হবে। ঋণ খেলাপিদের কালো তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে তারা নতুন করে ঋণ গ্রহণ, জমি ক্রয়, সম্পদ অধিগ্রহণ করে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে না পারে এবং প্রমোদ ভ্রমণ বা ভোগ-বিলাস করে বেড়াতে না পারে। খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে অনিয়ম ও দুর্র্নীতিমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন নয় বরং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বিষয় বিবেচনা করা উচিত। তাছাড়া, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
এমএ মাসুম, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
No comments