বিতর্ক ছাপিয়ে এক ক্রিকেটারের কুর্সি জয়
ইমরান
খান। পুরো নাম ইমরান আহমাদ খান নিয়াজি। একজন সফল ক্রিকেটার। একজন সফল
রাজনীতিক। যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই তার কাছে ধরা দিয়েছে সফলতা।
প্রথমবারের মতো এবং একবারই পাকিস্তান বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
তা ওই ইমরান খানের হাত ধরে। আর এবার তিনি রাজনীতির দাবায় বাজিমাত করেছেন।
সদ্য সমাপ্ত পার্লামেন্টের একজন সদস্য ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে প্রবেশ করার
আগে তিনি ছিলেন একজন ক্রিকেটার ও সমাজহিতৈষী। দু’দশক ধরে তিনি আন্তর্জাতিক
ক্রিকেট খেলেছেন। পরে সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান শওকত খানম মেমোরিয়াল
ক্যান্সার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স সেন্টার এবং নামাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
তার জন্ম ১৯৫২ সালের ৫ই অক্টোবর পাঞ্জাবের লাহোরে এক পস্তুন পরিবারে। তিনি
পড়াশোনা শুরু করেন ওরসেস্টারের আইছিসকনে। পরে কেবল কলেজ, অক্সফোর্ডে
পড়াশোনা করেন। ১৩ বছর বয়স থেকেই তিনি ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। প্রথমদিকে
তিনি কলেজের হয়ে খেলতেন। পরে যোগ দেন ওরসেস্টারশায়ার ক্রিকেট ক্লাবে। ১৯৭১
সালে বার্মিংহামে ইংলিশ সিরিজ চলাকালে ১৮ বছরে পাকিস্তানের হয়ে তার
ক্রিকেটে অভিষেক হয়। অক্সফোর্ডে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পরে ইমরান খান
১৯৭৬ সালে যোগ দেন পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলে। তারপর একটানা ১৯৯২ সাল
পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পুরো সময় তিনি
টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়
তিনি নেতৃত্ব দেন। এরপরই তিনি ক্রিকেট থেকে অবসরে যান এবং পাকিস্তানের
ইতিহাসে সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়দের অন্যতম হয়ে থাকেন। টেস্ট ক্রিকেটে তিনি
সর্বমোট ৩৮০৭ রান করেছেন। উইকেট নিয়েছেন ৩৬২টি। টেস্ট ক্রিকেটে এ যাবত
বিশ্বে মাত্র আটজন ক্রিকেটারের ভাগ্যে জুটেছে ‘অল রাউন্ডারস ত্রিপল’ খেতাব।
তার একজন ইমরান খান। তাকে ২০১০ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেম দেয়া হয়।
১৯৯১ সালে তিনি মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার
জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রচারণা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি ২ কোটি ৫০ লাখ
ডলারে লাহোরে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ২০১৫ সালে পেশোয়ারে
দ্বিতীয় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এখনও ইমরান খান উদারমনা সমাজ হিতৈষী
ও ভাষ্যকার। তিনি ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্রাডফোর্ড ইউনিভার্সিটির
চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্মানসূচক ফেলোশিপ পেয়েছেন রয়েল কলেজ
অব ফিজিসিয়ানস থেকে ২০১২ সালে।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ দলটির জাতীয় নেতায় পরিণত হন তিনি। ২০০২ সালের অক্টোবরে জাতীয় পরিষদের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ইমরান খান। তারপর ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধী দলীয় একজন নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আবার নির্বাচিত হন। এ সময় পপুলার ভোটের হিসাবে তার দল দেশে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে আসে। তিনি নিজে দলের পার্লামেন্টারি নেতা।
ইমরান খানের পারিবারিক জীবন
ইমরান খান ১৯৫২ সালের ৫ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করলেও কোনো কোনো রিপোর্টে ২৫শে নভেম্বরকে উল্লেখ করা হয়। পরে জানা যায়, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা ভুল করে তার পাসপোর্টে জন্মদিন ২৫শে নভেম্বর উল্লেখ করেছেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি ও তার স্ত্রী শওকত খানমের একমাত্র ছেলে ইমরান খান। তার পিতৃপুরুষের আদিবাস পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মিয়ানওয়ালিতে। তারা পস্তুন সম্প্রদায়ের। তারা নিয়াজি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তার মা পস্তুন উপজাতির বুরকি সম্প্রদায়ের। এ সম্প্রদায় থেকে পাকিস্তানের ইতিহাসে বহু সফল ক্রিকেটারের জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ইমরানের কাজিন জাভেদ বুরকি, মাজিদ খান।
কৈশোরে ইমরান খান ছিলেন চুপচাপ ও লাজুক। তার ছিল চার বোন। পরিবার ছিল উচ্চ মধ্যবিত্তের। তারা শৈশবেই যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছিলেন।
রাজনীতিতে ইমরান
১৯৯৬ সালে তিনি নিজে প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)। এ দল থেকে ১৯৯৭ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে দুটি আসনে তিনি নির্বাচন করেন। একটি আসন হলো মিয়ানওয়ালি (আসন নং ৫৩) ও লাহোর (আসন নং ৯৪)। কিন্তু দুটি আসনেই তিনি হেরে যান। দুই আসনেই বিজয়ী হন পিএমএলএনের প্রার্থী। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে তখনকার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ওই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিলেন ইমরান খান। তিনি বিশ্বাস করতেন মোশাররফ পাকিস্তান থেকে দুর্নীতি খতম করতে পারবেন। রাজনীতিকে মাফিয়ামুক্ত করতে পারবেন। ইমরান খান এক পর্যায়ে জানান, ২০০২ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে চেয়েছিলেন পারভেজ মোশাররফ। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। ২০০২ সালের অক্টোবরে জাতীয় পরিষদের ২৭২ আসনে নির্বাচন হয়। তাতে অংশ নেন ইমরান। নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেলে জোট সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। এ সময় তিনি মিয়ানওয়ালি থেকে নির্বাচিত হন। কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের বন্দিশিবির গুয়ানতানামো বে’তে পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননা করা হয়েছে বলে মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি- এ কথা বলা হয় নিউজ উইকের এক প্রতিবেদনে। এরপর ২০০৫ সালের ৬ই মে তাকে এ ঘটনার জন্য ‘মোস্ট ডাইরেক্টলি রেসপনসিবল’ বলে আখ্যায়িত করে দ্য নিউ ইয়র্কার। ২০০৭ সালে তিনি পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাইরে রাজনৈতিক বিরোধের মুখে পড়েন। ২০০৭ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সেনাপ্রধানের পদ না ছেড়েই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ৬ই অক্টোবর ওই নির্বাচন ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদ করে পার্লামেন্ট থেকে ওই বছর ২রা অক্টোবর পদত্যাগ করেন ৮৫ জন এমপি। তারা গড়ে তুলেছিলেন অল পার্টিজ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট। এর সঙ্গে যোগ দেন ইমরান খানও। তখনকার প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এরপর ৩রা নভেম্বর গৃহবন্দি করা হয় ইমরান খানকে। পরে সেখান থেকে পালিয়ে আত্মগোপন করেন ইমরান। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দিতে ১৪ই নভেম্বর প্রকাশ্যে আসেন তিনি। ওই বিক্ষোভ থেকে তাকে আটক করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র বিষয়ক শাখার নেতাকর্মীরা এবং তার সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করে। বিক্ষোভ যতদিন হয়েছে এ সময় তাকে আটক রাখা হয়েছে। তাকে পাঠানো হয় পাঞ্জাবের দেরা গাজি খান জেলে। সেখানে কয়েকদিন কাটানোর পর তিনি মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর লাহোরে লক্ষাধিক সমর্থকের উদ্দেশে ভাষণ দেন ইমরান খান। এ সময় তিনি সরকারের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেন। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের সুনামি আহ্বান করেন। একই বছর ২৫শে ডিসেম্বর তিনি করাচিতে আরেকটি সফল জনসভা করেন। এতেও কয়েক লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই ক্ষমতাসীন দলগুলোর জন্য প্রকৃত হুমকি হয়ে উঠেন ইমরান খান। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের জরিপ বলে, জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে ইমরান খানের পিটিআই।
২০১২ সালের ৬ই অক্টোবর তিনি দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের কোটাই গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিবাদে ইসলামাবাদে গাড়িবহরের এক বিক্ষোভে যোগ দেন। ২০১৩ সালের ২৩শে মার্চ তিনি নির্বাচনী নতুন স্লোগান ধরন। এর নাম দেন ‘নয়া পাকিস্তান রেভ্যুলুশন’। ২৯শে এপ্রিল দ্য অবজারভার ইমরান খান ও তার দল পিটিআইকে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের প্রধান বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০১৩ সালের ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পাঞ্জাব) প্রেসিডেন্ট মানজুর ওয়াত্তু সম্ভাব্য জোট সরকারে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজকে সরকার গঠন থেকে বিরত রাখতে ইমরান খানের পিটিআই এবং পিপিপিকে নিয়ে জোট গঠনের কথা ভাবছিলেন মানজুর ওয়াত্তু। কিন্তু তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ইমরান। ২০১৪ সালে ইমরান খানকে পাকিস্তানের ভেতরে ও বাইরে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে র্যাংকিং করে ইউগভ।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৯৫ সালের ১৬ই মে বৃটিশ এক ধনকুবেরের কন্যা জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ওই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল প্যারিসে। আর অনুষ্ঠানটির স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দুই মিনিট। এর এক মাস পরে ২১শে জুন তারা আবার ইংল্যান্ডের রিচমন্ড রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। জেমিমা গোল্ডস্মিথ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। তারা হলো- সুলাইমান ইশা ও কাশিম। এক পর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তাদের দাম্পত্য জীবন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন জেমিমা। তাতে তিনি ওই গুজবকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সেই গুজবই বাস্তবে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের ২২শে জুন ঘোষণা দেয়া হয় যে, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছে। এর ফলে ৯ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটে। বলা হয়, পাকিস্তানের জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারছিলেন না জেমিমা।
২০১৫ সালের জানুয়ারি। এবার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ সাংবাদিক রেহাম খানকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ইসলামাবাদে তার নিজের বাসভবনে ওই বিয়ে হয়। ২২শে অক্টোবর তারা ঘোষণা দেন যে, বিবাহ বিচ্ছেদে যাচ্ছেন তারা।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি, ২০১৭ সালের শেষের দিকে এবং ২০১৮ সালের শুরুর দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, নিজের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেছেন ইমরান খান। তবে প্রথমে পিটিআইয়ে সহযোগী ও মানিকার পরিবারের সদস্যরা একে গুজব বলে উড়িয়ে দেন। গুজব ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মিডিয়ার সমালোচনা করেন ইমরান। যে নিউজ চ্যানেল এই খবর প্রচার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে পিটিআই। ২০১৮ সালের ৭ই জুন পিটিআইয়ের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, বুশরা মানিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইমরান খান। তিনি সেই প্রস্তাব তখনও গ্রহণ করেননি। ২০১৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মানিকাকে ইমরান খান বিয়ে করেছেন বলে নিশ্চিত করে পিটিআই।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ দলটির জাতীয় নেতায় পরিণত হন তিনি। ২০০২ সালের অক্টোবরে জাতীয় পরিষদের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ইমরান খান। তারপর ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধী দলীয় একজন নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আবার নির্বাচিত হন। এ সময় পপুলার ভোটের হিসাবে তার দল দেশে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে আসে। তিনি নিজে দলের পার্লামেন্টারি নেতা।
ইমরান খানের পারিবারিক জীবন
ইমরান খান ১৯৫২ সালের ৫ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করলেও কোনো কোনো রিপোর্টে ২৫শে নভেম্বরকে উল্লেখ করা হয়। পরে জানা যায়, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা ভুল করে তার পাসপোর্টে জন্মদিন ২৫শে নভেম্বর উল্লেখ করেছেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি ও তার স্ত্রী শওকত খানমের একমাত্র ছেলে ইমরান খান। তার পিতৃপুরুষের আদিবাস পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মিয়ানওয়ালিতে। তারা পস্তুন সম্প্রদায়ের। তারা নিয়াজি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তার মা পস্তুন উপজাতির বুরকি সম্প্রদায়ের। এ সম্প্রদায় থেকে পাকিস্তানের ইতিহাসে বহু সফল ক্রিকেটারের জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ইমরানের কাজিন জাভেদ বুরকি, মাজিদ খান।
কৈশোরে ইমরান খান ছিলেন চুপচাপ ও লাজুক। তার ছিল চার বোন। পরিবার ছিল উচ্চ মধ্যবিত্তের। তারা শৈশবেই যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছিলেন।
রাজনীতিতে ইমরান
১৯৯৬ সালে তিনি নিজে প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)। এ দল থেকে ১৯৯৭ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে দুটি আসনে তিনি নির্বাচন করেন। একটি আসন হলো মিয়ানওয়ালি (আসন নং ৫৩) ও লাহোর (আসন নং ৯৪)। কিন্তু দুটি আসনেই তিনি হেরে যান। দুই আসনেই বিজয়ী হন পিএমএলএনের প্রার্থী। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে তখনকার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ওই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিলেন ইমরান খান। তিনি বিশ্বাস করতেন মোশাররফ পাকিস্তান থেকে দুর্নীতি খতম করতে পারবেন। রাজনীতিকে মাফিয়ামুক্ত করতে পারবেন। ইমরান খান এক পর্যায়ে জানান, ২০০২ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে চেয়েছিলেন পারভেজ মোশাররফ। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। ২০০২ সালের অক্টোবরে জাতীয় পরিষদের ২৭২ আসনে নির্বাচন হয়। তাতে অংশ নেন ইমরান। নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেলে জোট সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। এ সময় তিনি মিয়ানওয়ালি থেকে নির্বাচিত হন। কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের বন্দিশিবির গুয়ানতানামো বে’তে পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননা করা হয়েছে বলে মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি- এ কথা বলা হয় নিউজ উইকের এক প্রতিবেদনে। এরপর ২০০৫ সালের ৬ই মে তাকে এ ঘটনার জন্য ‘মোস্ট ডাইরেক্টলি রেসপনসিবল’ বলে আখ্যায়িত করে দ্য নিউ ইয়র্কার। ২০০৭ সালে তিনি পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাইরে রাজনৈতিক বিরোধের মুখে পড়েন। ২০০৭ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সেনাপ্রধানের পদ না ছেড়েই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ৬ই অক্টোবর ওই নির্বাচন ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদ করে পার্লামেন্ট থেকে ওই বছর ২রা অক্টোবর পদত্যাগ করেন ৮৫ জন এমপি। তারা গড়ে তুলেছিলেন অল পার্টিজ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট। এর সঙ্গে যোগ দেন ইমরান খানও। তখনকার প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এরপর ৩রা নভেম্বর গৃহবন্দি করা হয় ইমরান খানকে। পরে সেখান থেকে পালিয়ে আত্মগোপন করেন ইমরান। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দিতে ১৪ই নভেম্বর প্রকাশ্যে আসেন তিনি। ওই বিক্ষোভ থেকে তাকে আটক করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র বিষয়ক শাখার নেতাকর্মীরা এবং তার সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করে। বিক্ষোভ যতদিন হয়েছে এ সময় তাকে আটক রাখা হয়েছে। তাকে পাঠানো হয় পাঞ্জাবের দেরা গাজি খান জেলে। সেখানে কয়েকদিন কাটানোর পর তিনি মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর লাহোরে লক্ষাধিক সমর্থকের উদ্দেশে ভাষণ দেন ইমরান খান। এ সময় তিনি সরকারের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেন। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের সুনামি আহ্বান করেন। একই বছর ২৫শে ডিসেম্বর তিনি করাচিতে আরেকটি সফল জনসভা করেন। এতেও কয়েক লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই ক্ষমতাসীন দলগুলোর জন্য প্রকৃত হুমকি হয়ে উঠেন ইমরান খান। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের জরিপ বলে, জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে ইমরান খানের পিটিআই।
২০১২ সালের ৬ই অক্টোবর তিনি দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের কোটাই গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিবাদে ইসলামাবাদে গাড়িবহরের এক বিক্ষোভে যোগ দেন। ২০১৩ সালের ২৩শে মার্চ তিনি নির্বাচনী নতুন স্লোগান ধরন। এর নাম দেন ‘নয়া পাকিস্তান রেভ্যুলুশন’। ২৯শে এপ্রিল দ্য অবজারভার ইমরান খান ও তার দল পিটিআইকে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের প্রধান বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০১৩ সালের ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পাঞ্জাব) প্রেসিডেন্ট মানজুর ওয়াত্তু সম্ভাব্য জোট সরকারে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজকে সরকার গঠন থেকে বিরত রাখতে ইমরান খানের পিটিআই এবং পিপিপিকে নিয়ে জোট গঠনের কথা ভাবছিলেন মানজুর ওয়াত্তু। কিন্তু তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ইমরান। ২০১৪ সালে ইমরান খানকে পাকিস্তানের ভেতরে ও বাইরে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে র্যাংকিং করে ইউগভ।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৯৫ সালের ১৬ই মে বৃটিশ এক ধনকুবেরের কন্যা জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ওই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল প্যারিসে। আর অনুষ্ঠানটির স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দুই মিনিট। এর এক মাস পরে ২১শে জুন তারা আবার ইংল্যান্ডের রিচমন্ড রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। জেমিমা গোল্ডস্মিথ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। তারা হলো- সুলাইমান ইশা ও কাশিম। এক পর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তাদের দাম্পত্য জীবন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন জেমিমা। তাতে তিনি ওই গুজবকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সেই গুজবই বাস্তবে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের ২২শে জুন ঘোষণা দেয়া হয় যে, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছে। এর ফলে ৯ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটে। বলা হয়, পাকিস্তানের জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারছিলেন না জেমিমা।
২০১৫ সালের জানুয়ারি। এবার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ সাংবাদিক রেহাম খানকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ইসলামাবাদে তার নিজের বাসভবনে ওই বিয়ে হয়। ২২শে অক্টোবর তারা ঘোষণা দেন যে, বিবাহ বিচ্ছেদে যাচ্ছেন তারা।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি, ২০১৭ সালের শেষের দিকে এবং ২০১৮ সালের শুরুর দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, নিজের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেছেন ইমরান খান। তবে প্রথমে পিটিআইয়ে সহযোগী ও মানিকার পরিবারের সদস্যরা একে গুজব বলে উড়িয়ে দেন। গুজব ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মিডিয়ার সমালোচনা করেন ইমরান। যে নিউজ চ্যানেল এই খবর প্রচার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে পিটিআই। ২০১৮ সালের ৭ই জুন পিটিআইয়ের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, বুশরা মানিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইমরান খান। তিনি সেই প্রস্তাব তখনও গ্রহণ করেননি। ২০১৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মানিকাকে ইমরান খান বিয়ে করেছেন বলে নিশ্চিত করে পিটিআই।
No comments