একাত্তর: আগে-পরে, ৩- মুজিব বাহিনীর লক্ষ্য ছিল ভ্রান্ত বাম সরকার কায়েম by কাজল ঘোষ
পছন্দের
বাইরে কিছু হলেই জেনারেল ওসমানী পদত্যাগের কথা বলতেন। ছুটে যেতেন
তাজউদ্দীন আহমদের অফিস কক্ষে। লম্বা স্যালুট দিয়ে বলতেন, ‘স্যার, আই ওয়ান্ট
টু লিভ’। একদিন তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি লিখিত
পদত্যাগ পত্র দিন। তারপর থেকে মুখে মুখে পদত্যাগ বলা কমে গিয়েছিল
জেনারেলের। টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনী নিয়ে সন্দিহান ও আতঙ্কিত ছিলেন
তাজউদ্দীন আহমদ।
অন্যদিকে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল ভিন্ন এক মোটিভে। যারা বিশ্বাস করতো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সকল বাহিনীর বাইরে ভিন্ন এক দর্শন-আদর্শে পরিচালিত এই বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল প্রবাসী সরকারের অধীন এফএফ ও সিএনসি গ্রুপের । মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভেতরের মানুষ নূরে আলম সিদ্দিকী তা দেখেছেন গভীর পর্যবেক্ষণি শক্তির মাধ্যমে। সেই দ্বন্দ্ব কোথায় টেনে নিয়ে গেছে মুক্তি সংগ্রামকে- তা পড়ুন তৃতীয় কিস্তিতে:
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের সময় একইসঙ্গে বেশকিছু বাহিনী ভিন্ন ভিন্ন নামে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। শোনা যায় তাত্ত্বিক দিক থেকে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে বিভেদ-অনৈক্যও ছিল?
বাংলাদেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু কিছু বাহিনী সংগঠিত হয় বিভিন্ন নামে। তারা সরাসরি পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্তই হয়নি বিস্তীর্ণ এলাকাকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। অসংখ্য বাহিনীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম। শুনেছি জীবনের একটি পর্বে তিনি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কোনো একটি পর্যায়ে চাকরি থেকে সরে এসে তিনি করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হয়ে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। তার ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। আমি তখন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। খুব সম্ভবত তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক। তাদের পুরো পরিবারটি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট। ফলে কাদের সিদ্দিকীও ছাত্রলীগের কর্মী থেকে খ্যাতিমান নেতা হয়ে ওঠেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি যতদূর জানি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীকে সংগঠিত করে সোয়াত নামক একটি সামরিক জাহাজ থেকে অস্ত্র লুণ্ঠন করে কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য একটি বাহিনী গড়ে তুলেন- যার নাম ছিল কাদেরিয়া বাহিনী। তিনি টাঙ্গাইলে বিশেষ করে গারো পাহাড়ি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা পাকিস্তানের দখলমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। পরিপূর্ণ সামরিক ইউনিটের মতো তার বাহিনী সংগঠিত হলেও রণকৌশল হিসেবে গেরিলা কায়দায় ‘হিট অ্যান্ড হাইট’ ছিল তার রণকৌশল। তার সামরিক বাহিনী গঠনে মুজিবনগর সরকার এমনকি জেনারেল এমএজি ওসমানীরও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই কাদেরিয়া বাহিনী গঠনের খবর শুনে প্রাথমিকভাবে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ খুবই সন্দিহান এবং আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। এ ব্যাপারে শঙ্কিত চিত্তে আমাকে তিনি যতবারই প্রশ্ন করেছেন, আমি প্রতিবারই সংশয় বিমুক্ত চিত্তে তাকে আশ্বস্ত করেছি, কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র শক্তি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য একটি জীবন্ত আতঙ্ক। সম্ভব হলে কাদেরিয়া বাহিনীকে আমাদের সহযোগিতা প্রদান নৈতিক কর্তব্য। তাকে অন্তরায় সৃষ্টি করার কোনো অবকাশ নেই। জেনারেল ওসমানী আমার মতামতের ওপর খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং এসব ব্যাপারে তিনি আমার মতামতের ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে চিরকুমার জেনারেল ওসমানী একটা অদ্ভূত খামখেয়ালি গোছের মানুষ ছিলেন। একদিকে শিশুর মতো সরল অন্যদিকে বদরাগী, রগচটা, কিছুটা অস্থির চিত্তেরও বটে। তিনি অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী ছিলেন। রাগ হলে নিজের ওপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন। তার ইচ্ছার বাইরে কিছু একটা ঘটলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সামনে গিয়ে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াতেন এবং পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন প্রায়শই। বলতেন, ‘স্যার, আই ওয়ান্ট টু লিভ।’ একবার বিরক্ত হয়ে তাজউদ্দীন ভাই জেনারেল ওসমানীকে অনেকটা রুঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি পদত্যাগ করতে চাইলে লিখিত পদত্যাগপত্র পেশ করুন। এরপর থেকে তার পদত্যাগের অভিপ্রায় ও প্রবণতা অনেকখানি লোপ পায়। মনে রাখা অত্যন্ত দরকার তিনি শুধু সেনাধ্যক্ষই ছিলেন না সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় সংসদের (এমএনএ) সদস্যও ছিলেন। সেনাধ্যক্ষ হিসেবে তিনি প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীর সমমর্যাদায় ছিলেন। আমি আগেও বলেছি তিনি স্যান্ডার্সের গ্রাজুয়েট ছিলেন। তার চালচলন, ওঠা, বসা, খাওয়া, দাওয়ায় ছিলেন একজন পাক্কা বৃটিশ। ছুরি চামচ ছাড়া হাত দিয়ে তিনি কিছুই খেতেন না; খেতে পারতেন না বলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। দিনে তো আমরা বিভিন্ন কাজকর্মে থাকতাম। রাতে কখনও কখনও তার সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নিতাম। সেখানে তিনি অত্যন্ত অমায়িক, প্রাণভোলা, বিনয়ী এবং আত্মভোলা একজন মানুষ ছিলেন। যেহেতু সিএনসি স্পেশ্যাল ফোর্স সংঘটিত করার দায়িত্ব তিনি আমাকে দিয়েছিলেন তাই আমি তাকে স্যার বলে সম্বোধন করতাম। যেটা আমার অনেকটা আদতের বাইরে। রাতের খাবার টেবিলে এককভাবে আমি ওনাকে অনেক জ্বালাতাম। একদিন ফুল ও ললনা সম্বন্ধে একটা বৈঠকী গল্পে আমি তাকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম আপনি চিরকুমার- এটা কি কোনো রমণীর কাছ থেকে ছ্যাঁকা খাওয়ার পরের সিদ্ধান্ত। ওনি রাগান্বিত হননি। বিরাট মোছের ফাঁকে তার ঠোঁটে যেন একটি বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। তিনি স্মিত হাসলেন। জবাব দিলেন না। যার যা বুঝার নিজের মতো করে বুঝে নিলাম। জেনারেল ওসমানীর বাবা বৃটিশের ডিএম (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। এটা তাকে অনেকটা উচ্ছ্বসিত করতো। ডিএম থাকাকালে পিতার নানাবিধ উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। পরবর্তীতে তিনি যখন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ছিলেন তখনও তার মুখে অহরহ তার বাবার গল্প শুনেছি। তার একটি এলসেশিয়ান কুকুর ছিল শেষ জীবনে। তিনি তার নাম রেখেছিলেন ফিল্ড মার্শাল। একদিন তার বাসায় বসে চা খাচ্ছি হঠাৎ তিনি জোরে চিৎকার দিলেন ফিল্ড মার্শাল। আমি তো হতচকিত হয়ে গেলাম। বিহ্বলতা কাটতে না কাটতেই দেখলাম একটা দীর্ঘকায় খয়েরি কালো মিশ্রিত এলসেশিয়ান কুকুর সুবোধ শান্তচিত্তে তার পায়ের তলায় বসলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাস্যে তিনি বললেন, এ কিন্তু অনেক অনুগত এবং বিশ্বস্ত। আইয়ুব খানের মতো বিপজ্জনক ও বিশ্বাসভঙ্গকারী নয়।
এফ এফ বাহিনীর কথায় আসি। ফ্রিডম ফাইটার্স সম্পূর্ণ প্রবাসী সরকারি প্রণোদনায় গঠিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত। এরা সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত এবং বিভিন্ন সেক্টরে; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরা ছিলেন অকুতোভয়; মৃত্যুঞ্জয়ী; স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবের ধন। এদের দেশপ্রেম ও সাহস পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে সাক্ষাৎ আজরাইলের মতো প্রতিভাত হয়। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এদের অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধ বিশ্বকে বিস্ময়ে অভিভূত করে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে জীবন্ত আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভারতের অনেক সেনাবাহিনীর অধিকর্তারাও বিস্ময়ে বিভূতচিত্তে ওদের বীরত্বের কথা সর্বত্র বর্ণনা করেছেন। আমিও বিদগ্ধ চিত্তে তাদের বীরত্বের অনেক বাস্তব ঘটনা শুনে শুধু গৌরবান্বিত হইনি স্থির প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রত্যয় ও প্রতীতী কেবল বৃদ্ধিই পায়নি বিজয় সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছি। দেশের প্রান্তিক জনতা, লুঙ্গি পরা কাছা বেঁধে থাকা কৃষক এফএফ-এর সংগৃহীত লোকবল ছিল। এরা প্রশিক্ষণের পর তখনকার মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, মেজর জলিলসহ ১১টি সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এখানে বাস্তবতার নিরিখে একটা কথা নির্মোহচিত্তে উল্লেখ করা দরকার মুজিব বাহিনী বলে যে একটি রাজনৈতিক, সামরিক ক্যাডার তৈরি করা হয় দুর্ভাগ্যক্রমে তদের মোটিভেশন দেয়া হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। মুজিব বাহিনীর নেতৃ চতুষ্টয়ের ধারণা ছিল মুজিব ভাইকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারবো না। পাকিস্তানিরা তাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করবে। তখন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুজিব বাহিনীর মাধ্যমে একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করে অনায়াসে তারা তাজউদ্দীন সাহেবের সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্রকেন্দ্রিক একটি ভ্রান্ত বাম সরকার প্রতিষ্ঠিত করবে।
মুজিব বাহিনীর নেতৃ চতুষ্টয় ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ। চার খলিফার দুই খলিফা আ স ম রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। কিছুটা আড়াল করে শাজাহান সিরাজেরও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। সমগ্র বিষয়টি আমি বুঝলেও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করিনি। অবস্থাটা কিল খেয়ে কিল হজম করার মতোই। তাজউদ্দীন সাহেব এবং জেনারেল ওসমানী বিষয়টি দিয়ে উদ্বিগ্ন-উত্তেজিত ছিলেন। সেই অবস্থায় আমাকে সিএনসি স্পেশ্যাল বাহিনী সংগঠিত করার জন্য সর্বপ্রকার প্রণোদনা ও সহায়তা করা হয়। চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে জেনারেল অরোরার তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনী সংগঠিত হয়েছিল বলে আমার খবর। সিএনসি স্পেশ্যাল নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন বলে। এখন আমার প্রায়শই মনে হয় যে, নেতৃস্থানীয় এবং বিপুল সংখ্যক ছাত্রকর্মী নিয়ে সিএনসি স্পেশ্যাল বাহিনী গঠিত হয়েছিল সেটির নামকরণ বঙ্গবন্ধু বাহিনী দিলে অনেক ভালো মতো। এফএফ ও সিএনসি স্পেশ্যাল একই কমান্ডে পরিচালিত হতো। কিন্তু মুজিব বাহিনীর কমান্ড অন্যত্র থাকার কারণে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে এফএফ ও সিএনসি স্পেশ্যালের দু’একটি সংঘর্ষের কথাও শোনা যায়। জেনারেল ওসমানী ও আমি চাইতাম যে কোনো মূল্যে এই সংঘর্ষ এড়াতে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ ব্যাহত হবে বলেই নয় মুক্তিযুদ্ধ সফল হওয়ার পরও এই সাংঘর্ষিক মানসিকতা একটা গৃহযুদ্ধেরও রূপ দিতে পারতো। আল্লাহর অশেষ রহমত মুুক্তিযুদ্ধ উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃ চতুষ্টয়ের আহ্বানে সফল বাহিনী হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে সংগ্রাম পরিষদের কমান্ডের আওতায় সকলে একত্রিত হন এবং ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ছাত্রলীগ একাকার হয়ে যায় ছাত্রলীগেই। তার ফলশ্রুতিতে আজকে যেমন দল-উপদলে সশস্ত্র সাংঘর্ষিক অবস্থা সেটি আমরা সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারি। ১৯৭৩-এ জাসদ প্রভাবান্বিত সশস্ত্র ক্যাডারে তৈরি গণবাহিনী অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে তাত্ত্বিক কারণে অনিষ্ফল বিপ্লবের প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির চিত্তে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। আমি দলের অভ্যন্তরে আদর্শগত চিন্তায় প্রখর থাকলেও দলের অভ্যন্তরে গ্রুপিং-এ এতো পারদর্শী ছিলাম না। বরং ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে তারতম্য করতেও আমার প্রচণ্ড দ্বিধা সংশয় ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দূর করতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানী এবং আমি নিজেও কিছুটা এই বিভেদ অনৈক্য মিটানোর অনেক চেষ্টা ও উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু পরিপূর্ণ সফল হইনি। কারণ মুজিব বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ও কাউন্সেলিং ছিল ভিন্নতর। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুজিব ভাই ফিরে আসবে না এই স্থির বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করে নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। প্রিন্স সিহানুককে বাদ দিয়ে কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ বাহিনীর একটি অংশ থিও স্যাম্পেন-এর নেতৃত্বে যেমন একটি বিদ্রোহী ও বিকল্প সরকার গঠন করেছিল এবং প্রিন্স নরোদম সিহানুককে আবার চীন ফিরে গিয়ে নতুন করে সৈন্য, অস্ত্র, শক্তি সঞ্চয় করে দীর্ঘদিনের যুদ্ধে কম্বোডিয়াকে স্যাম্পেন অনুগত সৈন্যদের কবল থেকে মুক্ত করতে হয়। বঙ্গবন্ধু না ফিরলে অবস্থাটা বোধহয় তদ্রূপই হতো।
অন্যদিকে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল ভিন্ন এক মোটিভে। যারা বিশ্বাস করতো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সকল বাহিনীর বাইরে ভিন্ন এক দর্শন-আদর্শে পরিচালিত এই বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল প্রবাসী সরকারের অধীন এফএফ ও সিএনসি গ্রুপের । মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভেতরের মানুষ নূরে আলম সিদ্দিকী তা দেখেছেন গভীর পর্যবেক্ষণি শক্তির মাধ্যমে। সেই দ্বন্দ্ব কোথায় টেনে নিয়ে গেছে মুক্তি সংগ্রামকে- তা পড়ুন তৃতীয় কিস্তিতে:
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের সময় একইসঙ্গে বেশকিছু বাহিনী ভিন্ন ভিন্ন নামে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। শোনা যায় তাত্ত্বিক দিক থেকে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে বিভেদ-অনৈক্যও ছিল?
বাংলাদেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু কিছু বাহিনী সংগঠিত হয় বিভিন্ন নামে। তারা সরাসরি পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্তই হয়নি বিস্তীর্ণ এলাকাকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। অসংখ্য বাহিনীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম। শুনেছি জীবনের একটি পর্বে তিনি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কোনো একটি পর্যায়ে চাকরি থেকে সরে এসে তিনি করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হয়ে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। তার ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। আমি তখন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। খুব সম্ভবত তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক। তাদের পুরো পরিবারটি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট। ফলে কাদের সিদ্দিকীও ছাত্রলীগের কর্মী থেকে খ্যাতিমান নেতা হয়ে ওঠেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি যতদূর জানি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীকে সংগঠিত করে সোয়াত নামক একটি সামরিক জাহাজ থেকে অস্ত্র লুণ্ঠন করে কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য একটি বাহিনী গড়ে তুলেন- যার নাম ছিল কাদেরিয়া বাহিনী। তিনি টাঙ্গাইলে বিশেষ করে গারো পাহাড়ি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা পাকিস্তানের দখলমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। পরিপূর্ণ সামরিক ইউনিটের মতো তার বাহিনী সংগঠিত হলেও রণকৌশল হিসেবে গেরিলা কায়দায় ‘হিট অ্যান্ড হাইট’ ছিল তার রণকৌশল। তার সামরিক বাহিনী গঠনে মুজিবনগর সরকার এমনকি জেনারেল এমএজি ওসমানীরও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই কাদেরিয়া বাহিনী গঠনের খবর শুনে প্রাথমিকভাবে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ খুবই সন্দিহান এবং আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। এ ব্যাপারে শঙ্কিত চিত্তে আমাকে তিনি যতবারই প্রশ্ন করেছেন, আমি প্রতিবারই সংশয় বিমুক্ত চিত্তে তাকে আশ্বস্ত করেছি, কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র শক্তি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য একটি জীবন্ত আতঙ্ক। সম্ভব হলে কাদেরিয়া বাহিনীকে আমাদের সহযোগিতা প্রদান নৈতিক কর্তব্য। তাকে অন্তরায় সৃষ্টি করার কোনো অবকাশ নেই। জেনারেল ওসমানী আমার মতামতের ওপর খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং এসব ব্যাপারে তিনি আমার মতামতের ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে চিরকুমার জেনারেল ওসমানী একটা অদ্ভূত খামখেয়ালি গোছের মানুষ ছিলেন। একদিকে শিশুর মতো সরল অন্যদিকে বদরাগী, রগচটা, কিছুটা অস্থির চিত্তেরও বটে। তিনি অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী ছিলেন। রাগ হলে নিজের ওপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন। তার ইচ্ছার বাইরে কিছু একটা ঘটলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সামনে গিয়ে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াতেন এবং পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন প্রায়শই। বলতেন, ‘স্যার, আই ওয়ান্ট টু লিভ।’ একবার বিরক্ত হয়ে তাজউদ্দীন ভাই জেনারেল ওসমানীকে অনেকটা রুঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি পদত্যাগ করতে চাইলে লিখিত পদত্যাগপত্র পেশ করুন। এরপর থেকে তার পদত্যাগের অভিপ্রায় ও প্রবণতা অনেকখানি লোপ পায়। মনে রাখা অত্যন্ত দরকার তিনি শুধু সেনাধ্যক্ষই ছিলেন না সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় সংসদের (এমএনএ) সদস্যও ছিলেন। সেনাধ্যক্ষ হিসেবে তিনি প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীর সমমর্যাদায় ছিলেন। আমি আগেও বলেছি তিনি স্যান্ডার্সের গ্রাজুয়েট ছিলেন। তার চালচলন, ওঠা, বসা, খাওয়া, দাওয়ায় ছিলেন একজন পাক্কা বৃটিশ। ছুরি চামচ ছাড়া হাত দিয়ে তিনি কিছুই খেতেন না; খেতে পারতেন না বলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। দিনে তো আমরা বিভিন্ন কাজকর্মে থাকতাম। রাতে কখনও কখনও তার সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নিতাম। সেখানে তিনি অত্যন্ত অমায়িক, প্রাণভোলা, বিনয়ী এবং আত্মভোলা একজন মানুষ ছিলেন। যেহেতু সিএনসি স্পেশ্যাল ফোর্স সংঘটিত করার দায়িত্ব তিনি আমাকে দিয়েছিলেন তাই আমি তাকে স্যার বলে সম্বোধন করতাম। যেটা আমার অনেকটা আদতের বাইরে। রাতের খাবার টেবিলে এককভাবে আমি ওনাকে অনেক জ্বালাতাম। একদিন ফুল ও ললনা সম্বন্ধে একটা বৈঠকী গল্পে আমি তাকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম আপনি চিরকুমার- এটা কি কোনো রমণীর কাছ থেকে ছ্যাঁকা খাওয়ার পরের সিদ্ধান্ত। ওনি রাগান্বিত হননি। বিরাট মোছের ফাঁকে তার ঠোঁটে যেন একটি বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। তিনি স্মিত হাসলেন। জবাব দিলেন না। যার যা বুঝার নিজের মতো করে বুঝে নিলাম। জেনারেল ওসমানীর বাবা বৃটিশের ডিএম (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। এটা তাকে অনেকটা উচ্ছ্বসিত করতো। ডিএম থাকাকালে পিতার নানাবিধ উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। পরবর্তীতে তিনি যখন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ছিলেন তখনও তার মুখে অহরহ তার বাবার গল্প শুনেছি। তার একটি এলসেশিয়ান কুকুর ছিল শেষ জীবনে। তিনি তার নাম রেখেছিলেন ফিল্ড মার্শাল। একদিন তার বাসায় বসে চা খাচ্ছি হঠাৎ তিনি জোরে চিৎকার দিলেন ফিল্ড মার্শাল। আমি তো হতচকিত হয়ে গেলাম। বিহ্বলতা কাটতে না কাটতেই দেখলাম একটা দীর্ঘকায় খয়েরি কালো মিশ্রিত এলসেশিয়ান কুকুর সুবোধ শান্তচিত্তে তার পায়ের তলায় বসলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাস্যে তিনি বললেন, এ কিন্তু অনেক অনুগত এবং বিশ্বস্ত। আইয়ুব খানের মতো বিপজ্জনক ও বিশ্বাসভঙ্গকারী নয়।
এফ এফ বাহিনীর কথায় আসি। ফ্রিডম ফাইটার্স সম্পূর্ণ প্রবাসী সরকারি প্রণোদনায় গঠিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত। এরা সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত এবং বিভিন্ন সেক্টরে; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরা ছিলেন অকুতোভয়; মৃত্যুঞ্জয়ী; স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবের ধন। এদের দেশপ্রেম ও সাহস পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে সাক্ষাৎ আজরাইলের মতো প্রতিভাত হয়। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এদের অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধ বিশ্বকে বিস্ময়ে অভিভূত করে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে জীবন্ত আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভারতের অনেক সেনাবাহিনীর অধিকর্তারাও বিস্ময়ে বিভূতচিত্তে ওদের বীরত্বের কথা সর্বত্র বর্ণনা করেছেন। আমিও বিদগ্ধ চিত্তে তাদের বীরত্বের অনেক বাস্তব ঘটনা শুনে শুধু গৌরবান্বিত হইনি স্থির প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রত্যয় ও প্রতীতী কেবল বৃদ্ধিই পায়নি বিজয় সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছি। দেশের প্রান্তিক জনতা, লুঙ্গি পরা কাছা বেঁধে থাকা কৃষক এফএফ-এর সংগৃহীত লোকবল ছিল। এরা প্রশিক্ষণের পর তখনকার মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, মেজর জলিলসহ ১১টি সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এখানে বাস্তবতার নিরিখে একটা কথা নির্মোহচিত্তে উল্লেখ করা দরকার মুজিব বাহিনী বলে যে একটি রাজনৈতিক, সামরিক ক্যাডার তৈরি করা হয় দুর্ভাগ্যক্রমে তদের মোটিভেশন দেয়া হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। মুজিব বাহিনীর নেতৃ চতুষ্টয়ের ধারণা ছিল মুজিব ভাইকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারবো না। পাকিস্তানিরা তাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করবে। তখন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুজিব বাহিনীর মাধ্যমে একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করে অনায়াসে তারা তাজউদ্দীন সাহেবের সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্রকেন্দ্রিক একটি ভ্রান্ত বাম সরকার প্রতিষ্ঠিত করবে।
মুজিব বাহিনীর নেতৃ চতুষ্টয় ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ। চার খলিফার দুই খলিফা আ স ম রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। কিছুটা আড়াল করে শাজাহান সিরাজেরও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। সমগ্র বিষয়টি আমি বুঝলেও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করিনি। অবস্থাটা কিল খেয়ে কিল হজম করার মতোই। তাজউদ্দীন সাহেব এবং জেনারেল ওসমানী বিষয়টি দিয়ে উদ্বিগ্ন-উত্তেজিত ছিলেন। সেই অবস্থায় আমাকে সিএনসি স্পেশ্যাল বাহিনী সংগঠিত করার জন্য সর্বপ্রকার প্রণোদনা ও সহায়তা করা হয়। চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে জেনারেল অরোরার তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনী সংগঠিত হয়েছিল বলে আমার খবর। সিএনসি স্পেশ্যাল নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন বলে। এখন আমার প্রায়শই মনে হয় যে, নেতৃস্থানীয় এবং বিপুল সংখ্যক ছাত্রকর্মী নিয়ে সিএনসি স্পেশ্যাল বাহিনী গঠিত হয়েছিল সেটির নামকরণ বঙ্গবন্ধু বাহিনী দিলে অনেক ভালো মতো। এফএফ ও সিএনসি স্পেশ্যাল একই কমান্ডে পরিচালিত হতো। কিন্তু মুজিব বাহিনীর কমান্ড অন্যত্র থাকার কারণে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে এফএফ ও সিএনসি স্পেশ্যালের দু’একটি সংঘর্ষের কথাও শোনা যায়। জেনারেল ওসমানী ও আমি চাইতাম যে কোনো মূল্যে এই সংঘর্ষ এড়াতে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ ব্যাহত হবে বলেই নয় মুক্তিযুদ্ধ সফল হওয়ার পরও এই সাংঘর্ষিক মানসিকতা একটা গৃহযুদ্ধেরও রূপ দিতে পারতো। আল্লাহর অশেষ রহমত মুুক্তিযুদ্ধ উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃ চতুষ্টয়ের আহ্বানে সফল বাহিনী হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে সংগ্রাম পরিষদের কমান্ডের আওতায় সকলে একত্রিত হন এবং ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ছাত্রলীগ একাকার হয়ে যায় ছাত্রলীগেই। তার ফলশ্রুতিতে আজকে যেমন দল-উপদলে সশস্ত্র সাংঘর্ষিক অবস্থা সেটি আমরা সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারি। ১৯৭৩-এ জাসদ প্রভাবান্বিত সশস্ত্র ক্যাডারে তৈরি গণবাহিনী অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে তাত্ত্বিক কারণে অনিষ্ফল বিপ্লবের প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির চিত্তে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। আমি দলের অভ্যন্তরে আদর্শগত চিন্তায় প্রখর থাকলেও দলের অভ্যন্তরে গ্রুপিং-এ এতো পারদর্শী ছিলাম না। বরং ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে তারতম্য করতেও আমার প্রচণ্ড দ্বিধা সংশয় ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দূর করতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানী এবং আমি নিজেও কিছুটা এই বিভেদ অনৈক্য মিটানোর অনেক চেষ্টা ও উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু পরিপূর্ণ সফল হইনি। কারণ মুজিব বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ও কাউন্সেলিং ছিল ভিন্নতর। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুজিব ভাই ফিরে আসবে না এই স্থির বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করে নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। প্রিন্স সিহানুককে বাদ দিয়ে কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ বাহিনীর একটি অংশ থিও স্যাম্পেন-এর নেতৃত্বে যেমন একটি বিদ্রোহী ও বিকল্প সরকার গঠন করেছিল এবং প্রিন্স নরোদম সিহানুককে আবার চীন ফিরে গিয়ে নতুন করে সৈন্য, অস্ত্র, শক্তি সঞ্চয় করে দীর্ঘদিনের যুদ্ধে কম্বোডিয়াকে স্যাম্পেন অনুগত সৈন্যদের কবল থেকে মুক্ত করতে হয়। বঙ্গবন্ধু না ফিরলে অবস্থাটা বোধহয় তদ্রূপই হতো।
No comments