দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে এক করে দেওয়ার পরামর্শ
অনিয়ম ও খেলাপি ঋণে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে একীভূতের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
তিনি বলছেন, “যে সব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ সেগুলোর তিন-চারটি একীভূত করে একটি ব্যাংক করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূত করার সময় এসেছে। আর এখনই এটা করতে হবে।”
১৭ বছর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে রিকুইজিশন অ্যান্ড মার্জার আইন করার প্রস্তাব করেছিলেন ফরাসউদ্দিন।
ব্যাংক খাতে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এখন দ্রুত এই আইন করে একীভূতের কাজ শুরু করার কথা বলছেন তিনি।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ পরামর্শ দেন ফরাসউদ্দিন, যিনি ১৯৯৮ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থা সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলোকে আর এভাবে চলতে দেওয়া ঠিক না। এখন ব্যাংক একীভূত (মার্জার) করার সময় এসেছে। সারা পৃথিবীতেই এটা হয়। আমাদেরও করতে হবে।”
তার মতে, যে সব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ তার একটা তালিকা করতে হবে। তার মধ্য থেকে তিন-চারটি একীভূত করে একটি ব্যাংক করতে হবে।
একীভূতকরণের জন্য প্রাথমিকভাবে চারটি সরকারি ব্যাংকের একটি তালিকাও করেছে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এগুলো হলো- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক লিমিটেড।
এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। পৃথকভাবে পরিচালিত হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর লোকসানের পরিমাণ ক্রমেই বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সুপারিশ করার কথা ভাবছে সরকার।
দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলিয়ে মোট ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে আর্থিক অবস্থার অবনতির তালিকায় রয়েছে ১৩ ব্যাংক।
বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ধুকছে; বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকও খারাপের দিকে।
সম্প্রতি ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঢেলে সাজানো হয়েছে। সরানো হয়েছে দুই ব্যাংকের এমডিকেই।
খেলাপি ঋণ বাড়ছেই
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়মনীতি না মেনে ঋণ দেওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে আর্থিক খাতে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার সময় দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের এই নয় বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে সাড়ে তিন গুণ হয়েছে।
এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার খারাপ ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করা হয়েছে। লুকিয়ে রাখা এই বিশাল অঙ্ক খেলাপি ঋণের হিসাবের বাইরে রয়েছে। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংক খাত ঠিক রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া, পর্যবেক্ষক বসানো, পর্ষদ সভার যাবতীয় নথি বিশ্লেষণ, বড় ঋণ অনুমোদন, একক গ্রাহকের ঋণসীমা নির্ধারণ ও ঋণ পুনর্গঠন ব্যবস্থা চালু।
এরপরও এই খাতকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যুক্ত হয়েছে ‘পরিবর্তন আতঙ্ক’। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে কয়েকটি ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি।
সরকারি ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। জুলাই-সেপ্টেম্বর-এ তিন মাসেই সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের দেশীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, যা গত জুনে ছিল ৩১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। এ সময়ে ন্যাশনাল, ফারমার্সসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। ফলে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে।
সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে সংসদীয় কমিটিরও পর্যবেক্ষণ এসেছে।
বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দুই বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৩ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগের উপর। ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা বিনিয়োগ হচ্ছে না।
No comments