প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত প্রকল্পেও বাধা
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা নির্দেশিত খাল সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়নও বাধার মুখে পড়েছে।
সুরাহা করতে হিমশিম খাচ্ছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। নগরীর মধ্যে
প্রবাহিত পয়ঃনিষ্কাশন কাজে ব্যবহৃত ১৩টি প্রধান খালের ৭৩ কিলোমিটারের মধ্যে
৬১.৫ কিলোমিটারই এখন দখলদারদের কবলে। ছড়া (খাল) সংরক্ষণে গত বছর ২৩৬.৪০
কোটি টাকা একনেক সভায় অনুমোদন হলেও দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারায় থমকে
গেছে প্রকল্পের কাজ। খাল উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসনের চাহিদামতো সহযোগিতা না
পাওয়ায় সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে
সিসিক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে আজ বৃহস্পতিবার সিলেটের স্থানীয়
প্রশাসনকে নিয়ে বৈঠকে বসছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কয়েক বছর
ধরে বৃষ্টির নগরীতে পরিণত হয়েছে সিলেট।
সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর রাস্তাঘাট
ডুবে যায়, পানি ঢুকে নাকাল হয়ে পড়ে বাসা, বাড়ি, দোকানপাট। ২০১৩ সালের শুরুর
দিকে জলাবদ্ধতা যখন প্রকট, ঠিক তখনই ঘোষণা করা হয় সিসিকের নির্বাচনী
তফসিল। নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের প্রতি নগরবাসীর প্রধান দাবিও ছিল
জলাবদ্ধতা নিরসন। বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল
জলাবদ্ধতা নিরসন। নির্বাচিত হওয়ার পর কাজও শুরু করেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের
মতামত নিয়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য যেসব খাল নগরীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তা
দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। খাল উদ্ধার করতে গিয়ে দেখা যায় ৭৩
কিলোমিটার দীর্ঘ সিটি কর্পোরেশনের ১৩টি বড় খালের দু’পাশ দখল করে প্রায় এক
হাজার স্থাপনা তৈরি করেছে অবৈধ দখলদাররা। ৩০ ফুট প্রস্থের খাল এখন কোথাও
কোথাও ৩ কিংবা ৪ ফুটে পরিণত হয়েছে। কোথাও আবার খালের গতিপথ পরিবর্তন করে
গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসিক ভবন। অবৈধ দখলদারের তালিকা হলেও উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায়
বেশিদূর যেতে পারেনি সিসিক। ৭৩ কিলোমিটারের মধ্যে নকশা অনুযায়ী মাত্র ১১.৫
কিলোমিটার সংরক্ষণ করে দুই পাশে গার্ড ওয়াল তৈরির কাজ হয়েছে গত ৪ বছরে।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, বাকিটুকু
উদ্ধার করে সংরক্ষণ এবং এর দুই পাশে নগরবাসীর চলাচলের জন্য রাস্তা
নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে একটি প্রকল্প পাঠানো হয় স্থানীয় সরকার
মন্ত্রণালয়ে। প্রকল্পটির প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর ২৩৬.৪০ কোটি টাকার প্রকল্প
অনুমোদন হয় একনেকে। যা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে খাল সংরক্ষণের
সবচেয়ে বড় প্রকল্প। নূর আজিজুর রহমান বলেন, প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পরই নকশা
অনুযায়ী খাল চিহ্নিত করতে মাঠে নামে সিসিক। এরই মধ্যে চিহ্নিতের কাজ শেষ
হয়েছে। তিনি জানান, নকশা অনুযায়ী কোথাও খালের পূর্ণ অস্তিত্ব নেই। নকশা
মেনে খাল সংরক্ষণ করতে হলে উচ্ছেদ করতে হবে প্রায় হাজারখানেক স্থাপনা। এটা
কোনোভাবেই সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি জানান, খালের জমি
সরকারের খাস খতিয়ানে। সেই হিসেবে জেলা প্রশাসক এ জমির মালিক। কিন্তু উচ্ছেদ
করতে হচ্ছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে।
জেলা প্রশাসনের তেমন সহযোগিতাও মিলছে
না। আর উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে
বলে জানান তিনি। সিটি কর্পোরেশনে জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১ হাজার দখলদারের
তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রভাবশালী দখলদার মার্লিন বিল্ডার্সের মালিক
চৌধুরী শামীম হামিদ। তিনি মালনীছড়া বা খালের ১ লাখ ১০ হাজার বর্গফুট জমির
ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। এই খালে আরও ২১ জন বড় দখলদার রয়েছেন। এর পরই
বড় দখলদার হিসেবে রয়েছেন শামিমাবাদ আবাসিক এলাকার স্বত্বাধিকারী কুতুব
উদ্দিন। তিনি গাভিয়ার খালের গতি পরিবর্তন করে ১৫শ’ ফুট জমি দখল করেছেন।
এছাড়া মালনী ছড়ার অন্যতম দখলদার হিসেবে রয়েছেন মিরের ময়দানের মনির মিয়া।
গোয়ালীছড়ায় নাছির মিয়া, আফজল আহমেদসহ ২০ জন। যোগনীছড়ায় বেলাল আহমেদ চৌধুরী,
আবদুল মতিন। হলদীছড়ায় আবদুল মান্নান, রফিক হাসান, ধোপাছড়ায় আজিজ মিয়া,
ভুবিছড়ায় ফরিদ আহমেদসহ ৬ জন, মঙ্গলীছড়ায় গণি মিয়া দখলদার। এমতাবস্থায়
উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় সরকারের সব মহলের সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার দিকনির্দেশনা চেয়ে একটি আবেদন দিয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। তাদের
প্রত্যাশা খাল থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা
দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার যুগান্তরকে
বলেন, খাল দখল উচ্ছেদ যেহেতু সরকারের স্বার্থে সুতরাং এ কাজে সহযোগিতা না
করার কোনো কারণই নেই। সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। খাল উদ্ধারে সিলেট
মেট্রোপলিটন পুলিশের ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়। এমন অভিযোগ নগরভবন
সংশ্লিষ্টদের। এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম
কিবরিয়াকে কয়েক দফায় কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ পাঠালেও কোনো
প্রত্যুত্তর মেলেনি। এদিকে সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্রের দাবি খাল
দখলদারদের উচ্ছেদে নাখোশ খোদ সিটি কর্পোরেশনের বিএনপি ও আওয়ামী লীগের চার
কাউন্সিলর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা জানান, দখলদারদের কাছ থেকে
অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এই চার কাউন্সিলর উচ্ছেদ কাজে নিজ নিজ এলাকায় বাধাও
দিচ্ছেন। এ চার কাউন্সিলর হচ্ছেন ফরহাদ চৌধুরী শামীম, দিনার খান হাসু,
আজাদুর রহমান আজাদ ও ইলিয়াছুর রহমান। খাল দখলে সহযোগিতার অভিযোগ প্রসঙ্গে
কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম যুগান্তরকে বলেন, আমি বারবার নির্বাচিত
হয়েছি। আমি শাসক নই, সেবক।
সামনে নির্বাচন তাই প্রতিপক্ষ এমন গুজব রটাচ্ছে।
আমি উচ্ছেদ ও উদ্ধারে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলাম এখনও আছি। তিনি আরও বলেন,
আমার এলাকায় শুধু একটি ছড়া, মালনীছড়া। এ ছড়াটি আমার এলাকায় ৩০ ফুট থাকলেও
হাউজিং এস্টেটে মাত্র ৮ ফুট। অথচ এটা দেখার কেউ নেই। কাউন্সিলর দিনার খান
হাসু বলেন, আমার এলাকার ৪টি স্পটে খাল উদ্ধারের কাজ চলছে। আমি নিজে উপস্থিত
থেকে উদ্ধার অভিযান করছি। সাধারণ মানুষ বাড়িঘর নিজেরা ভেঙে জায়গা দিচ্ছে। আমরা উদ্ধারের পক্ষে, দখলদারদের পক্ষে নয়। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৮নং
ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছ অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, অবৈধ
দখলদারদের উচ্ছেদ করে তার ওয়ার্ডের কালীবাড়ি ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে।
অবৈধভাবে ছড়া খাল দখলদারদের সহযোগিতা করার প্রশ্নই আসে না। সিটি
কর্পোরেশনের ২০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ অভিযোগের ব্যাপারে
বলেন, এসব অপপ্রচার। ছড়া-খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সিটি মেয়রকে সহযোগিতা
করার পাশাপাশি ওয়ার্ডবাসীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। খাল দখলদার উচ্ছেদ ও
প্রতিবন্ধকতা দূর করতে করণীয় ঠিক করতে আজ (বৃহস্পতিবার) রাতে অর্থমন্ত্রী
আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেট সার্কিট হাউসে সভা ডেকেছেন। এসব বিষয়ে সিটি
কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী
তিনি নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কাজ
শুরুর চার মাসের মাথায় তাকে জেলে যেতে হয়। প্রায় ৩০ মাস পর তিনি দায়িত্বে
ফেরেন। কিন্তু তিনি যেসব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন তার অনুপস্থিতিতে তা আর
সামনে এগোয়নি। বাকি যে সময়টুকু তিনি দায়িত্বে রয়েছেন সর্বাত্মক চেষ্টা
চালিয়ে যাচ্ছেন।
No comments