আকায়েদকে ঘিরে রহস্য ঘনীভূত, অনেক প্রশ্ন
নিউ
ইয়র্কে পাতালপথে বোমা হামলাকারী আকায়েদ উল্লাহ (২৭)কে ঘিরে রহস্য ঘনীভূত
হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রশ্ন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আকায়েদ কি নিজেই
নিজের হৃদয়ের তাগিদে প্রথম সহিংস অপারেশন চালিয়ে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে
চাইছিল? যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে এসব কথা
লিখেছেন সাংবাদিক জেফ্রে জেটলম্যান। তিনি লিখেছেন, হামলা চালানোর আগে নিজের
জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে যায় আকায়েদ উল্লাহ। এরপরই
ম্যানহাটনের জনবহুল পাতাল স্টেশনে পাইপ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে
দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এসব করার আগে সে একটি শেষ কাজ করেছে।
তা হলো, সারারাত বাসে চড়ে নিজের দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করতে গিয়েছে। রাজধানী ঢাকায় সে তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছে। ঘুমিয়েছে মসজিদে, গাছের নিচে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করেছে কয়েক শ’ ডলারের ওষুধ। এ বিষয়ে তার শাশুড়ি মাহফুজা আখতার বলেছেন, যখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তখন তাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। কিন্তু যখন ফিরে আসে, তখন তাকে খুবই হতাশ দেখাচ্ছিল। সে বলেছিল- ওইসব মানুষ (সম্ভবত রোহিঙ্গা) প্রতিটি মিনিট বসবাস করছে নরকে।
তার ওই সফরের কয়েক সপ্তাহ পরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা বলেছেন, আকায়েদ উল্লাহ নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ফিরে ম্যাচের কাঠি, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে পাওয়া পাইপ ব্যবহার করে বোমা তৈরি শুরু করে। এরপর ১১ই ডিসেম্বর সোমবার ম্যানহাটনের পাতাল স্টেশনে এর বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে সে নিজে আহত হয়। আহত হন কয়েকজন পথচারী। এ বিস্ফোরণে যে পরিমাণ ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল তা হয় নি। ঘটনাস্থলেই তাকে আটক করা হয়। তারপর থেকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ম্যানহাটনের ইস্ট সাইটে অবস্থিত বেলেভু হাসপাতাল সেন্টারে। সেখানে বিছানায় শুয়েই সে তদন্তকারীদের সহযোগিতা করছে। বলেছে, মুসলিম বিশ্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের পক্ষে উদ্বুদ্ধ হয়েছে সে। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিষয়ক বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে অভিযুক্ত হলে সে কখনো জেল থেকে বেরুতে পারবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সে খোলামেলা কথা বলছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মুখ বন্ধ রাখছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে তার এক ডজনেরও বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এরপরও রহস্যের কিনারা হচ্ছে না যে, কেন সে ওই হামলা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে এখনো একটি শূন্যতা রয়েছে। জঙ্গিদের সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার প্রতি মাঝে মাঝে সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে। কখনো ক্ষুব্ধ হচ্ছে। তাকে যারা চিনতেন তাদের অনেকে বলেছেন, সে ছিল একজন স্নেহশীল ও ক্ষমাপ্রবণ ব্যক্তি। তাকে দেখে কখনো নিরাশ মনে হয় নি, যে নিরাশা থেকে মানুষ তার নিজের জীবন বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন কি সে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলে নি। তার মা, ভাইবোনের সঙ্গে সে ছিল ঘনিষ্ঠ। এর বাইরে সে নিজে একটি পরিবার গড়ে তুলছিল। ওদিকে আকায়েদ উল্লাহর বিরুদ্ধে এই মামলাটি দেখভালের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের ১৫ জন কর্মকর্তা। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো আকায়েদ উল্লাহর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির পরিদর্শন। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশি তদন্তকারীদের কোনো পক্ষই আকায়েদ উল্লাহকে বাংলাদেশ থেকে জিহাদি আদর্শ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিযুক্ত করছে না। তারা মনে করছেন, ২০১১ সালে নিউ ইয়র্কে পৌঁছার পরই সে উগ্রবাদের দিকে ঝোঁকে। এর আগে তাকে জঙ্গি গ্রুপগুলোর প্রতি আগ্রহী হিসেবে দেখা যায় নি।
মিয়ানমার হলো বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এ বছর সেখানকার সেনাবাহিনী কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে উৎখাত করেছে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা তাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের দুর্গতিতে মুসলিম বিশ্বে সমবেদনা দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এরই মধ্যে ওই আশ্রয় শিবিরগুলোতে অর্ধ ডজন বিভিন্ন ইসলামপন্থি জঙ্গি গ্রুপ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চেষ্টা করছে।
এরই মধ্যে সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জ্বরের ওষুধ, এন্টাসিড জাতীয় ও কিছু মৌলিক ওষুধ বিতরণ করেছে আকায়েদ উল্লাহ। নিজের শাখাগুলোর প্রতি এমন আহ্বান জানিয়েছিল আল কায়েদা। আহ্বান জানিয়েছিল মুসলিমদের প্রতি। এতে মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল রোহিঙ্গাদেরকে অর্থ, ওষুধ, খাদ্য, পোশাক ও অস্ত্র বিতরণ করতে। আহ্বান জানানো হয়েছিল সহায় সম্পদ ব্যবহার করে ‘ভাইদের উদ্ধার’ করতে।
তবে সুনির্দিষ্ট এই আহ্বানে আকায়েদ উল্লাহ সাড়া দিয়েছে কিনা তা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের তদন্তকারীরা বলেছেন, বেশকিছু জিহাদি ওয়েবসাইট নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছিল সে।
তার আত্মীয়রা বলেছেন, তার গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে মিশনে নেমেছিল। এর মাধ্যমে বিপদে থাকা মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকে সে এ কাজ করে থাকতে পারে।
বাংলাদেশে আকায়েদ উল্লাহর পরিবারের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন তার শাশুড়ি মাহফুজা আকতার। তিনি বলেন, আমার মনে হতো সে ওই ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাক।
দশকের পর দশক ধরে দরিদ্র, প্রধানত সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ সন্ত্রাস বিষয়ক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এখানে উচ্চ মাত্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে এক ঘণ্টার মধ্যে একদিনে ৪ শতাধিক বোমা হামলা হয়েছে। চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তরুণ ব্লগারদের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। তার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামপন্থিদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান নিজেদের ইসলামিক দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী। এটা পাকিস্তানের গতির বিপরীতমুখী। এর প্রতিষ্ঠার মধ্যে এর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ চান নি বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাক। তারপর বছরের পর বছর এখানে ইসলামপন্থিদের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে।
আকায়েদ উল্লাহ বড় হয়েছেন ঢাকার হাজারীবাগে। এটি হলো ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকা। এখানে বহু নারী পুরো শরীর ঢাকা বোরকা পরেন। অনেক মানুষের মুখেই ঘন দাড়ি। তাদের গোঁফ কামানো। তাদের পরনের পাজামা বা যেকোনো পোশাক সতর্কতার সঙ্গে পায়ের গোঁড়ালির উপরে উঠিয়ে রাখা। শৈশবে আকায়েদ উল্লাহ ও তার মা এই হাজারীবাগেই ঘুরতেন। তারা এক দরজা থেকে আরেক দরজায় নক করতেন। প্রতিবেশীদেরকে ডাকতেন মসজিদে নামাজ আদায়ে যেতে। তারা ছিলেন শান্তিকামী তাবলিগ জামায়াতের সদস্য।
আকায়েদ উল্লাহ এতটাই ধর্মপ্রাণ ছিল বলে তার বন্ধুরা বলেছেন। সে ছিল একজন মুদি দোকানির ছেলে। পড়াশোনা করেছে ঢাকার বেশ কিছু বেসরকারি স্কুল কলেজে। এর মধ্যে রয়েছে কাকলি হাই স্কুল ও ঢাকা সিটি কলেজ। তার হাই স্কুল জীবের বন্ধু ওয়াজিদুর রহমান। আকায়েদের সঙ্গে তিনি ক্রিকেট খেলতেন। ওয়াজিদুর রহমান বলেছেন, আকায়েদ কখনো ধূমপান করতো না। কখনো কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতো না। সব সময়ই ছিল আন্তরিক। সে অপরাধ করার মতো কোনো মানুষ ছিল না। তিনি আরো বলেন, যেদিন আকায়েদ বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা করে সেদিন সরারাত আমার ফোন বাজতে থাকে। সবাই একটিই প্রশ্ন করছিলেন- ওটা কি আমাদের সেই আকায়েদ উল্লাহ?
আকায়েদ উল্লাহ সাত বছর আগে পিতামাতা সহ ঢাকা ত্যাগ করে। ইমিগ্রেশন ভিসায় চলে যায় নিউ ইয়র্কে। সেখানে তার আত্মীয়দের সঙ্গে বসবাস করার জন্য এই ভিসা। নিউ ইয়র্কে গিয়ে সে ড্রাইভিং করেছে। পার্ট টাইমে ইলেকট্রিসিয়ানের কাজ করেছে।
বাংলাদেশ হলো একটি দরিদ্র দেশ। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বিশ্বের কাছে এ দেশটি হলো ‘লেবার ফ্যাক্টরি’। সমুদ্রগামী কার্গো জাহাজে খুবই কম বেতনে চাকরি করেন বাংলাদেশিরা। তারা কুয়েতে তেলকূপ পরিষ্কার করার কাজ করেন অথবা নিউ ইয়র্কে ট্যাক্সি চালান। দৃশ্যত এখন প্রতিজন বাংলাদেশির হয়তো কোনো বন্ধু বা কোনো আত্মীয় যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেন অথবা এমন কাউকে তারা চেনেন যার মাধ্যমে তারাও সেখানে যেতে চান।
আকায়েদ উল্লাহর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আকায়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানে। তখন তার কাছে মনে হচ্ছিল ভিন্ন একজনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হচ্ছে।
জেফ্রে আরো লিখেছেন, উগ্রবাদী জঙ্গি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজারকে। নজরদারি করা হচ্ছে মসজিদে। তবে তাদেরকে আরো সতর্ক হতে হবে। তারা চেষ্টা করছে জঙ্গিদের কাউন্টার দিতে।
২০১৩ সালে প্রথম একজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়। সে বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার পরও তা একের পর এক ঘটে গেছে। হত্যা করা হয়েছে লেখক, প্রকাশক, সমকামী অধিকারকর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে।
এই সময়ে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় নেই। তবে তারা বিতর্ককে নির্ধারণ করছে বলেই মনে হয়। বেশ কিছু বুদ্বিজীবী বলেছেন, হত্যা করা হয়েছে এমন বন্ধুদের বিষয়ে মুখ খুলতেও তারা আতঙ্কিত। ইসলামপন্থিরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিক্যবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপদজনক বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো নাস্তিক্যবাদ। মুহাম্মদ জসিমুদ্দিন রহমানি বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামের অবমাননাকারীদের হত্যা করতে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঢাকায় ফিরে নিজের স্ত্রীকে এই জসিমুদ্দিনের লেখা একটি বই পড়তে বলেছিল আকায়েদ উল্লাহ। তার এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল তার স্ত্রী ও ৬ মাস বয়সী ছেলেকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করা। দূরত্ব সত্ত্বেও স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধন। তার পরিবার বলেছে, দিনে ৫ থেকে ১০ বার স্ত্রীকে ফোন করতো আকায়েদ। কিন্তু শেষ সফরের সময় সে তার স্ত্রীকে বলেছে, জসিমুদ্দিন রহমানি ইসলাম সম্পর্কে যে কঠোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটাই হলো ইসলাম।
বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী অপারেশনের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতো আকায়েদ। আসলে তা কোথা থেকে তার মাঝে এসেছে এ বিষয়ে যথার্থভাবে আমরা জানি না। হতে পারে সে খুব ভালভাবে এর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে নি।
একটি ইসলামপন্থি গ্রুপের সাবেক সদস্য হাসান রফিক। তারা এখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করার চেষ্টা করছেন। হাসান রফিক বলেছেন, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি জঙ্গি গ্রুপগুলোর সদস্য সংগ্রহের জন্য বড় একটি স্থান হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শিবির। এখানেই সফর করেছে আকায়েদ। রফিক বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে আকায়েদকে ওই শিবিরগুলোতে কেউ সহায়তা করেছে। সে কে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
তা হলো, সারারাত বাসে চড়ে নিজের দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করতে গিয়েছে। রাজধানী ঢাকায় সে তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছে। ঘুমিয়েছে মসজিদে, গাছের নিচে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করেছে কয়েক শ’ ডলারের ওষুধ। এ বিষয়ে তার শাশুড়ি মাহফুজা আখতার বলেছেন, যখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তখন তাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। কিন্তু যখন ফিরে আসে, তখন তাকে খুবই হতাশ দেখাচ্ছিল। সে বলেছিল- ওইসব মানুষ (সম্ভবত রোহিঙ্গা) প্রতিটি মিনিট বসবাস করছে নরকে।
তার ওই সফরের কয়েক সপ্তাহ পরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা বলেছেন, আকায়েদ উল্লাহ নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ফিরে ম্যাচের কাঠি, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে পাওয়া পাইপ ব্যবহার করে বোমা তৈরি শুরু করে। এরপর ১১ই ডিসেম্বর সোমবার ম্যানহাটনের পাতাল স্টেশনে এর বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে সে নিজে আহত হয়। আহত হন কয়েকজন পথচারী। এ বিস্ফোরণে যে পরিমাণ ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল তা হয় নি। ঘটনাস্থলেই তাকে আটক করা হয়। তারপর থেকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ম্যানহাটনের ইস্ট সাইটে অবস্থিত বেলেভু হাসপাতাল সেন্টারে। সেখানে বিছানায় শুয়েই সে তদন্তকারীদের সহযোগিতা করছে। বলেছে, মুসলিম বিশ্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের পক্ষে উদ্বুদ্ধ হয়েছে সে। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিষয়ক বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে অভিযুক্ত হলে সে কখনো জেল থেকে বেরুতে পারবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সে খোলামেলা কথা বলছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মুখ বন্ধ রাখছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে তার এক ডজনেরও বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এরপরও রহস্যের কিনারা হচ্ছে না যে, কেন সে ওই হামলা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে এখনো একটি শূন্যতা রয়েছে। জঙ্গিদের সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার প্রতি মাঝে মাঝে সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে। কখনো ক্ষুব্ধ হচ্ছে। তাকে যারা চিনতেন তাদের অনেকে বলেছেন, সে ছিল একজন স্নেহশীল ও ক্ষমাপ্রবণ ব্যক্তি। তাকে দেখে কখনো নিরাশ মনে হয় নি, যে নিরাশা থেকে মানুষ তার নিজের জীবন বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন কি সে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলে নি। তার মা, ভাইবোনের সঙ্গে সে ছিল ঘনিষ্ঠ। এর বাইরে সে নিজে একটি পরিবার গড়ে তুলছিল। ওদিকে আকায়েদ উল্লাহর বিরুদ্ধে এই মামলাটি দেখভালের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের ১৫ জন কর্মকর্তা। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো আকায়েদ উল্লাহর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির পরিদর্শন। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশি তদন্তকারীদের কোনো পক্ষই আকায়েদ উল্লাহকে বাংলাদেশ থেকে জিহাদি আদর্শ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিযুক্ত করছে না। তারা মনে করছেন, ২০১১ সালে নিউ ইয়র্কে পৌঁছার পরই সে উগ্রবাদের দিকে ঝোঁকে। এর আগে তাকে জঙ্গি গ্রুপগুলোর প্রতি আগ্রহী হিসেবে দেখা যায় নি।
মিয়ানমার হলো বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এ বছর সেখানকার সেনাবাহিনী কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে উৎখাত করেছে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা তাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের দুর্গতিতে মুসলিম বিশ্বে সমবেদনা দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এরই মধ্যে ওই আশ্রয় শিবিরগুলোতে অর্ধ ডজন বিভিন্ন ইসলামপন্থি জঙ্গি গ্রুপ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চেষ্টা করছে।
এরই মধ্যে সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জ্বরের ওষুধ, এন্টাসিড জাতীয় ও কিছু মৌলিক ওষুধ বিতরণ করেছে আকায়েদ উল্লাহ। নিজের শাখাগুলোর প্রতি এমন আহ্বান জানিয়েছিল আল কায়েদা। আহ্বান জানিয়েছিল মুসলিমদের প্রতি। এতে মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল রোহিঙ্গাদেরকে অর্থ, ওষুধ, খাদ্য, পোশাক ও অস্ত্র বিতরণ করতে। আহ্বান জানানো হয়েছিল সহায় সম্পদ ব্যবহার করে ‘ভাইদের উদ্ধার’ করতে।
তবে সুনির্দিষ্ট এই আহ্বানে আকায়েদ উল্লাহ সাড়া দিয়েছে কিনা তা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের তদন্তকারীরা বলেছেন, বেশকিছু জিহাদি ওয়েবসাইট নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছিল সে।
তার আত্মীয়রা বলেছেন, তার গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে মিশনে নেমেছিল। এর মাধ্যমে বিপদে থাকা মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকে সে এ কাজ করে থাকতে পারে।
বাংলাদেশে আকায়েদ উল্লাহর পরিবারের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন তার শাশুড়ি মাহফুজা আকতার। তিনি বলেন, আমার মনে হতো সে ওই ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাক।
দশকের পর দশক ধরে দরিদ্র, প্রধানত সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ সন্ত্রাস বিষয়ক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এখানে উচ্চ মাত্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে এক ঘণ্টার মধ্যে একদিনে ৪ শতাধিক বোমা হামলা হয়েছে। চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তরুণ ব্লগারদের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। তার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামপন্থিদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান নিজেদের ইসলামিক দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী। এটা পাকিস্তানের গতির বিপরীতমুখী। এর প্রতিষ্ঠার মধ্যে এর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ চান নি বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাক। তারপর বছরের পর বছর এখানে ইসলামপন্থিদের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে।
আকায়েদ উল্লাহ বড় হয়েছেন ঢাকার হাজারীবাগে। এটি হলো ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকা। এখানে বহু নারী পুরো শরীর ঢাকা বোরকা পরেন। অনেক মানুষের মুখেই ঘন দাড়ি। তাদের গোঁফ কামানো। তাদের পরনের পাজামা বা যেকোনো পোশাক সতর্কতার সঙ্গে পায়ের গোঁড়ালির উপরে উঠিয়ে রাখা। শৈশবে আকায়েদ উল্লাহ ও তার মা এই হাজারীবাগেই ঘুরতেন। তারা এক দরজা থেকে আরেক দরজায় নক করতেন। প্রতিবেশীদেরকে ডাকতেন মসজিদে নামাজ আদায়ে যেতে। তারা ছিলেন শান্তিকামী তাবলিগ জামায়াতের সদস্য।
আকায়েদ উল্লাহ এতটাই ধর্মপ্রাণ ছিল বলে তার বন্ধুরা বলেছেন। সে ছিল একজন মুদি দোকানির ছেলে। পড়াশোনা করেছে ঢাকার বেশ কিছু বেসরকারি স্কুল কলেজে। এর মধ্যে রয়েছে কাকলি হাই স্কুল ও ঢাকা সিটি কলেজ। তার হাই স্কুল জীবের বন্ধু ওয়াজিদুর রহমান। আকায়েদের সঙ্গে তিনি ক্রিকেট খেলতেন। ওয়াজিদুর রহমান বলেছেন, আকায়েদ কখনো ধূমপান করতো না। কখনো কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতো না। সব সময়ই ছিল আন্তরিক। সে অপরাধ করার মতো কোনো মানুষ ছিল না। তিনি আরো বলেন, যেদিন আকায়েদ বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা করে সেদিন সরারাত আমার ফোন বাজতে থাকে। সবাই একটিই প্রশ্ন করছিলেন- ওটা কি আমাদের সেই আকায়েদ উল্লাহ?
আকায়েদ উল্লাহ সাত বছর আগে পিতামাতা সহ ঢাকা ত্যাগ করে। ইমিগ্রেশন ভিসায় চলে যায় নিউ ইয়র্কে। সেখানে তার আত্মীয়দের সঙ্গে বসবাস করার জন্য এই ভিসা। নিউ ইয়র্কে গিয়ে সে ড্রাইভিং করেছে। পার্ট টাইমে ইলেকট্রিসিয়ানের কাজ করেছে।
বাংলাদেশ হলো একটি দরিদ্র দেশ। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বিশ্বের কাছে এ দেশটি হলো ‘লেবার ফ্যাক্টরি’। সমুদ্রগামী কার্গো জাহাজে খুবই কম বেতনে চাকরি করেন বাংলাদেশিরা। তারা কুয়েতে তেলকূপ পরিষ্কার করার কাজ করেন অথবা নিউ ইয়র্কে ট্যাক্সি চালান। দৃশ্যত এখন প্রতিজন বাংলাদেশির হয়তো কোনো বন্ধু বা কোনো আত্মীয় যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেন অথবা এমন কাউকে তারা চেনেন যার মাধ্যমে তারাও সেখানে যেতে চান।
আকায়েদ উল্লাহর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আকায়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানে। তখন তার কাছে মনে হচ্ছিল ভিন্ন একজনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হচ্ছে।
জেফ্রে আরো লিখেছেন, উগ্রবাদী জঙ্গি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজারকে। নজরদারি করা হচ্ছে মসজিদে। তবে তাদেরকে আরো সতর্ক হতে হবে। তারা চেষ্টা করছে জঙ্গিদের কাউন্টার দিতে।
২০১৩ সালে প্রথম একজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়। সে বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার পরও তা একের পর এক ঘটে গেছে। হত্যা করা হয়েছে লেখক, প্রকাশক, সমকামী অধিকারকর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে।
এই সময়ে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় নেই। তবে তারা বিতর্ককে নির্ধারণ করছে বলেই মনে হয়। বেশ কিছু বুদ্বিজীবী বলেছেন, হত্যা করা হয়েছে এমন বন্ধুদের বিষয়ে মুখ খুলতেও তারা আতঙ্কিত। ইসলামপন্থিরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিক্যবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপদজনক বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো নাস্তিক্যবাদ। মুহাম্মদ জসিমুদ্দিন রহমানি বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামের অবমাননাকারীদের হত্যা করতে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঢাকায় ফিরে নিজের স্ত্রীকে এই জসিমুদ্দিনের লেখা একটি বই পড়তে বলেছিল আকায়েদ উল্লাহ। তার এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল তার স্ত্রী ও ৬ মাস বয়সী ছেলেকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করা। দূরত্ব সত্ত্বেও স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধন। তার পরিবার বলেছে, দিনে ৫ থেকে ১০ বার স্ত্রীকে ফোন করতো আকায়েদ। কিন্তু শেষ সফরের সময় সে তার স্ত্রীকে বলেছে, জসিমুদ্দিন রহমানি ইসলাম সম্পর্কে যে কঠোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটাই হলো ইসলাম।
বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী অপারেশনের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতো আকায়েদ। আসলে তা কোথা থেকে তার মাঝে এসেছে এ বিষয়ে যথার্থভাবে আমরা জানি না। হতে পারে সে খুব ভালভাবে এর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে নি।
একটি ইসলামপন্থি গ্রুপের সাবেক সদস্য হাসান রফিক। তারা এখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করার চেষ্টা করছেন। হাসান রফিক বলেছেন, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি জঙ্গি গ্রুপগুলোর সদস্য সংগ্রহের জন্য বড় একটি স্থান হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শিবির। এখানেই সফর করেছে আকায়েদ। রফিক বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে আকায়েদকে ওই শিবিরগুলোতে কেউ সহায়তা করেছে। সে কে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
No comments