বাংলাদেশের উপন্যাস : নারী চরিত্র by আশরাফুল আলম
চিরদিনই
কবিতা বা নাটকের চেয়ে অনেক বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে এসেছে উপন্যাস। উপন্যাসে
লেখক জীবনের গল্প বলতে গিয়ে উপন্যাসে ছড়িয়ে দেন জীবন সম্পর্কে তার মনোভাব ও
দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের গল্পে উঠে এসেছে তাদের সমকালের নারী ও পুরুষের
সম্পর্কের গল্প। তাদের আখ্যানের নায়িকা তাদের সমকালেরই নারী।
নারী ভাবমুর্তি হচ্ছে নারীর ব্যক্তিত্ব ও লৈঙ্গিক ভূমিকা বিষয়ক পুরুষতন্ত্র পরিকল্পিত কতগুলো ছকের সমষ্টি। নারী ভাবমূর্তির স্রষ্টা নারী নিজে নয়, এর স্রষ্টা পুরুষ। পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে পুরুষ শ্রেষ্ঠ ও শক্তিমান আর নারী অবলা ও নিকৃষ্ট। পুরুষতন্ত্র নারীর চারটি ভাবমূর্তি কল্পনা করেছে, নারীর জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছে চারটি ভূমিকা। নারী কখনোই শুধু নারীমাত্র নয়, সে হয় পতœী, মাতা, কন্যা, নয় তো বিনোদিনী অনষক। নারীর ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়ার পাশাপাশি পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য তৈরি করেছে আচার আচরণ, প্রবণতা, অঙ্গভঙ্গি, জীবনের লক্ষ্য ও গন্তব্য বিষয়ক অসংখ্য বিধি বিধান। পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিরা পুরুষতন্ত্র রচিত ওই নারী ধারণাকে রূপায়িত করে রেখেছে পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য।
শরৎচন্দ্র প্রথাক্ষুব্ধ কিন্তু নারীর মিত্র নন তিনি। তার কাছে নারীত্ব বলে গণ্য হয়ে মর্ষকামিতা, সহিষ্ণুতা, সেবা, ত্যাগ ও আত্মবিসর্জনে কুণ্ঠাহীনতা এবং একনিষ্ঠতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য। তিনি পুরাণের সতী সাবিত্রী ও তপস্বিনী পার্বতী ও বেহুলার মিশ্রণে তৈরি করেন মর্ষকামী নারী ভাবমূর্তি। বিভূতিভূষণ অনুকরণ করেছেন শরৎচন্দ্রকে; বিভূতিভূষণের নারী চরিত্রের সেবা, আত্মত্যাগ, সহিষ্ণুতা, মর্ষকামিতা ও সতীত্বের তেজ শরৎচন্দ্রের নারীদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তিরিশ আধুনিকদের অনেকে; যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ নারীর নিষ্ক্রিয় প্রেমিক ভাবমূর্তিটি রূপায়িত করেন। এ গোত্রের লেখকরা নারীকে রহস্যময়ী, দুর্বোধ্য ও প্রতীক্ষা কাতর রূপে তুলে ধরে সুখীবোধ করেন।
জননী, সূর্যদীঘল বাড়ি, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে পুরুষতন্ত্রের এই জননী ধারণা। নারীর জননী ভাবমূর্তির যে ছকগুলো উপন্যাসিকেরা তৈরি করেছেন সেগুলো হচ্ছে জননী বসুন্ধরার মতো যৌন সর্বংসহা, চির মমতাময়ী, কিন্তু প্রতিদান প্রত্যাশাহীন। এই দীক্ষা প্রবলভাবে প্রচার করেছেন বিপ্লবী সর্বহারাদের মহান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কিও। তিনি নারীর মিত্র নন, মিত্রের ছদ্মবেশধারী শত্রু। তার দৃষ্টিতে মা অসামান্য কারন তার মর্ষকামিতা অসামান্য। পুত্রের জন্য দুঃসহ দুঃখবরণ, পুত্রের মাপমতো হয়ে ওঠার কঠোর সাধনা, নিজেকে বিলীন করে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টার নাম হচ্ছে গোর্কির মা। শওকত ওসমানের জননী সন্তানের জন্য নিজেকে বলি দেয় । এই জননীর নাম দরিয়া বিবি। পুরুষতন্ত্রের চোখে ধর্ষণকারী পুরুষ ও অপরাধী নয়, পাপী নয়। পাপী যে সে নারী। অপরাধী সে, তাই শাস্তি পাবে নারী। দীক্ষা অনুসারে দরিয়া বিবিও এ কথাই বিশ্বাস করে। দ্বিতীয় স্বামী আজাহার খাঁর মৃত্যুর পর ব্যবসায়ী দূরসম্পর্কিত দেবর ইয়াকুব এক দিন অতর্কিতে দরিয়া বিবিকে বলাৎকার করে। তার পর প্রায়ই হানা দিয়ে সে এই পীড়ন চালিয়ে যেতে থাকে। দরিয়া বিবি এই আক্রমণ পীড়নে হতবিহ্বল হয়, নিজের ওপর তার ঘৃণা জন্মে; কিন্তু পীড়নকারীকে যেমন প্রতিরোধ সে করে না, তেমনি তাকে শায়েস্তা করার কোন উদ্যোগও নেয় না। কেবলই সহ্য করে জননী। নিরুপায় সর্বংসহা ধরণীর মতো। কারণ এই লম্পট পুরুষটির কাছে থেকেই তাকে নিতে হয় প্রথম স্বামীর সন্তান মোনাদিরের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহের অর্থ। জননীর এই অসাধ্য সাধনের ব্রতটিকে মহিমান্বিত করে তোলার জন্য শওকত ওসমান অসম্ভব, বানোয়াট গল্প ফাঁদতে ও দ্বিধান্বিত হননি। তিনি দেখান জননী তার শরীরে রাশি রাশি কাপড় জড়িয়ে গোপন রাখছে তার গর্ভাবস্থা।
উগ্র পুরুষতান্ত্রিক হচ্ছে আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার তেইশ নম্বর তৈলচিত্রের উপন্যাসের নায়িকা ছবি। কুমারী অবস্থায় তাকেও একদিন অতর্কিতে বলাৎকার করে লম্পট পুরুষ। ছবি সন্তানসম্ভবা হয়। সে গর্ভপাতের সম্মত হয় না। কারণ সে জানে মাতৃত্বই নারী জীবনের পরিণাম। তার বক্তব্য এমনÑ জানি এই একমাত্র পন্থা। কিন্তু তবু মনটা এমন করছে কেন, যে এসেছে তার তো কোনো অপরাধ নেই। সে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ। ফুলকালির মধ্যে থাকতেই তাকে ছিঁড়ে পিষে ফেলা। সমাজ আছে; কিন্তু তার চেয়ে বড় বিবেকও তো মরে যায়নি? আসলে বিবেকও নয়, বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে যে গড়ে উঠেছে তার প্রতি কেমন একটা দুর্বোধ্য টান। আমি আস্তে আস্তে বললাম বৌদি, আমি পালিয়ে যাই; কিংবা দূরে কোনো শহরে ব্যবস্থা করে দাও। আমার জীবনটা তো নষ্ট হলো। অন্য একটা জীবন বাঁচুক। আবু ইসহাকের জননীও নিজেকে উৎসর্গ করে সন্তানের জন্য। এই জননী জয়গুন পরম মর্ষকামী।
শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ (ষষ্ঠ মুদ্রণ ১৯৭৩) উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে ওই সাধ্বী, পতিনিষ্ঠ, সর্বংসহা স্ত্রী ভাবমূর্তি। এই নারী সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও পতিনিষ্ঠায় বিবি রহিমা আর রূপযৌবনে বেহেশতি হুরি। আবু রূশদের নোঙর (পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৯৭০) উপন্যাসটিতে এই নারী ধারণার রূপায়ণ দেখা যায়। লেখক বিশ্বাস করেন স্ত্রী পুরুষকে তৃপ্ত করবে শরীর দিয়ে, সেবা দিয়ে, আনুগত্য দিয়ে, নিষ্ঠা দিয়ে। আমাদের পুরুষ লেখকদের বড় অংশের পছন্দ নারী অশ্রুময়ী, লাজুক, উৎকণ্ঠিত ও অক্রিয় প্রেমিকা ভাবমূর্তি। এ ভঙ্গুর সুন্দরের স্তব পাওয়া যায় শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শহীদল্লাহ কায়সার, জহীর রায়হান, আনোয়ার পাশা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, বিপ্রদাস বড়–য়ার উপন্যাসে। শামুসদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যার (১৩৬১) লাজুক, নিঃশব্দ, কল্যাণী প্রেমিকা মেহেরজান। তার ডাগর চোখের আকুল দৃষ্টি প্রেমিক পুরুষকে জীবনযুদ্ধে প্রবলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। আর মেহেরজান শুধু প্রতীক্ষা করে, অশ্রুসজল হয়, এ প্রতীক্ষাই তার জীবন।
জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে (চতুর্থ সংস্করণ ১৯৮৪) উপন্যাসে হাজার বছর ধরে বহমান গ্রামীণ জীবনের অনন্তধারার সুষমা ও মাধুর্য তুলে ধরা লেখকের লক্ষ্য। এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতীর দুর্বল অনুকরণ এবং লেখকের ভাবালুতার শব্দরূপ। এ উপন্যাসে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তৃপ্ত করাই নারীর কাজ, সে যেখানেই বাস করুক না কেন, তৃপ্তিদায়িনী বিনোদনী ছাড়া সে তার কিছু নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিলে কোঠার সেপাই (১৯৮৬) উপাখ্যানে অস্বাভাবিক পুরুষের আখ্যান বর্ণনার পাশাপাশি বর্ণনা করেন এক নিভৃতবাসী প্রেমিকার রূপ। তার মুখে উচ্চারিত হয় গোঁড়া পুরুষতান্ত্রিক ওই বিশ্বাস যে নারী একবার পুরুষ সংসর্গে এলেই সে হারায় তার সতীত্ব, হয়ে ওঠে পোকায় খাওয়া। পুরুষ দেবতার প্রথম ভোগ হওয়া চাই অনাঘ্রাত কুমারী।
সৈয়দ শামসুল হক তুমি সেই তরবারি সন্ধানী (১৯৭৮) উপন্যাসে রূপায়িত করেছেন একই নারীর স্ত্রী ও প্রেমিকা ভাবমূর্তি এবং প্রচার করেছেন পুরুষতন্ত্রের ওই বিধানটি সংসারই নারীর গন্তব্য। সকিনার বক্তব্য এমন-
আমাকে এভাবে কেউ কখনো ডাকেনি, কাশেমও না। তবু সেই কাশেমের কাছে আমি ফিরে যাবো। ... তোমার ভালবাসা আছে, কাশেমের তাও নেই। ও আমাকে ভালো না বাসুক, আমি তো বেসেছি। না ওর জন্য আমার যা তাকে আর ভালোবাসা বলব না, সেটি সম্পূর্ণ অন্য। সেই সম্পূর্ণ অন্য কিছুর সাথে বাস করা যায়, ভালোবাসার সাথে হয়তো যায় না।
শওকত আলী ও নারীর জন্য একই রকম ক্ষতিকর এবং বিভ্রান্তির্ক দক্ষিণায়নের দিন (১৯৯৫) উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে এই উদ্ভ্রান্ত নারীর আখ্যান। রাখী ইতিহাসে মাস্টার্স করেছে, কিন্তু আজীবন লক্ষ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত। উদ্ভ্রান্ত কন্যা বারবার বাবার কাছে ছুটে আসে পথনির্দেশ পাওয়ার জন্য। সে চায় বাবার মতো শক্তিমান কোনো পুরুষের প্রেম; কিন্তু এ চাওয়া তার নিজের কাছেই অজ্ঞাত থাকে। তাই উচ্চ বেতনের চাকরি তার বিস্বাদ লাগে। অধ্যাপক প্রেমিকের আচরণ হাস্যকর লাগে। কারণ ওই প্রেমিক, তার পরম পুরুষ নয়, বাবার মতো নয়।
রশিদ করিম ও রাহাত খানের উপন্যাসে ঘটেছে পরজীবী অক্রিয় নারী ভাবমূর্তির রূপায়ণ। রশীদ করিমের যে তিনটি উপন্যাসে এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত, উত্তম পুরুষ (১৯৬১), আমার যত গ্লানি (১৯৭৩), চিনি না (১৯৯০) সব ক’টিই উচ্চবিত্ত নারী পুরুষের আখ্যান। রাহাত খানের উপন্যাস নেয়া হয়েছে একটি কোলাহল বিচিত্রা (১৯৮১)। এটি ও উচ্চবিত্ত নরনারীর অ্যাখ্যান। পুরুষতন্ত্রই তাদের দেখতে চায় সুন্দরতম ‘শোপিস’ হিসেবে, তারা তাই হয় ও তাদের তাই হতে দীক্ষা দেয়া হয়। তারা স্বামীর সাথে পার্টিতে যায়, ক্লাবে যায়, কোমল ও কড়া সব ধরনের পানীয়ই পান করে, বহু পুরুষের সাথে মেশে, স্বামীর সাথে তাদের সম্পর্ক আবেগশূন্য, নিরুত্তাপ, অপ্রেমে পরিপূর্ণ। স্বামীকে ঘৃণা করে; কিন্তু সংসার ভাঙা বা স্বামীকে ত্যাগ করার কথা কখনোই ভাবে না, কেন না নিরাপত্তা, বিলাশ ব্যসনের অঢেল সুযোগ, অর্থের প্রাচুর্য, সুবিধা, আরামই তাদের জীবন। ডিভোর্স করলে এসব হারাতে হবে। রশীদ করিমের চোখে নারী কাম সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্ষণ তার কাছে পৌরুষের নামান্তর। তার উপন্যাস তার অবদমিত কাম ও বিকারের মুদ্রিত রূপ।
রাহাত খানের পরজীবী নারীও অক্রিয়, প্রসাধন চর্চিত, সুবেশধারিনী, সংসারের শোভা, দুর্মূল্য এন্টিক। এরা সংসারে বাস করে রাজহংসের মতো, পুরুষের অর্থে পুরুষের মুদ্রায় গড়া সম্পন্ন সংসারে পরগাছা এরা। এই নারীরা শুধু আলগোছে তত্ত্বাবধান করে সংসার, ফ্যাশানের পর ফ্যাশন বদলায়, পর পুরুষের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে না। সীমা লঙ্ঘন মানে অন্য পুরুষের প্রেমে পড়া কিংবা স্বামীকে ডিভোর্স করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া।
নিরবয়ব নারী ভাবমূর্তির রূপকার সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। নারী তার কাছে নিরবয়ব, নিরাকার, তুচ্ছ, উপেক্ষণীয়, দুরূহ, জঞ্জাল। তার প্রথম উপন্যাস লালসালু (১৯৪৮) তে নারীকে পাওয়া যায় পুরুষ প্রভুর সংসারের দাসীরূপে। চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) সম্পূর্ণ নারীবর্জিত অ্যাখ্যান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রথা বিরোধী নন; বরং বড়ই প্রথাশাসিত তিনি। কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮) উপন্যাসেও নারীর সংসারের জন্য খাটে এবং সংসারেই বাস করে, কিন্তু সে নিরবয়ব। এ উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র সকিনা খাতুনের কোনো অবয়ব নেই; সে ব্যক্তি নয়। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যদি পুরুষের পৃথিবী থেকে নারীকে সম্পূর্ণ বিদায় করে দিতে পারতেন তাহলেই বোধহয় সবচেয়ে স্বস্তি পেতেন।
এ ছাড়া প্রায় সব কথাশিল্পীই উপন্যাসে তাদের নারী ভাবমূর্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এবং অত্যন্ত শক্তভাবেই নারীকে পরগাছায় দাঁড় করিয়েছেন।
নারী ভাবমুর্তি হচ্ছে নারীর ব্যক্তিত্ব ও লৈঙ্গিক ভূমিকা বিষয়ক পুরুষতন্ত্র পরিকল্পিত কতগুলো ছকের সমষ্টি। নারী ভাবমূর্তির স্রষ্টা নারী নিজে নয়, এর স্রষ্টা পুরুষ। পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে পুরুষ শ্রেষ্ঠ ও শক্তিমান আর নারী অবলা ও নিকৃষ্ট। পুরুষতন্ত্র নারীর চারটি ভাবমূর্তি কল্পনা করেছে, নারীর জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছে চারটি ভূমিকা। নারী কখনোই শুধু নারীমাত্র নয়, সে হয় পতœী, মাতা, কন্যা, নয় তো বিনোদিনী অনষক। নারীর ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়ার পাশাপাশি পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য তৈরি করেছে আচার আচরণ, প্রবণতা, অঙ্গভঙ্গি, জীবনের লক্ষ্য ও গন্তব্য বিষয়ক অসংখ্য বিধি বিধান। পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিরা পুরুষতন্ত্র রচিত ওই নারী ধারণাকে রূপায়িত করে রেখেছে পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য।
শরৎচন্দ্র প্রথাক্ষুব্ধ কিন্তু নারীর মিত্র নন তিনি। তার কাছে নারীত্ব বলে গণ্য হয়ে মর্ষকামিতা, সহিষ্ণুতা, সেবা, ত্যাগ ও আত্মবিসর্জনে কুণ্ঠাহীনতা এবং একনিষ্ঠতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য। তিনি পুরাণের সতী সাবিত্রী ও তপস্বিনী পার্বতী ও বেহুলার মিশ্রণে তৈরি করেন মর্ষকামী নারী ভাবমূর্তি। বিভূতিভূষণ অনুকরণ করেছেন শরৎচন্দ্রকে; বিভূতিভূষণের নারী চরিত্রের সেবা, আত্মত্যাগ, সহিষ্ণুতা, মর্ষকামিতা ও সতীত্বের তেজ শরৎচন্দ্রের নারীদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তিরিশ আধুনিকদের অনেকে; যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ নারীর নিষ্ক্রিয় প্রেমিক ভাবমূর্তিটি রূপায়িত করেন। এ গোত্রের লেখকরা নারীকে রহস্যময়ী, দুর্বোধ্য ও প্রতীক্ষা কাতর রূপে তুলে ধরে সুখীবোধ করেন।
জননী, সূর্যদীঘল বাড়ি, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে পুরুষতন্ত্রের এই জননী ধারণা। নারীর জননী ভাবমূর্তির যে ছকগুলো উপন্যাসিকেরা তৈরি করেছেন সেগুলো হচ্ছে জননী বসুন্ধরার মতো যৌন সর্বংসহা, চির মমতাময়ী, কিন্তু প্রতিদান প্রত্যাশাহীন। এই দীক্ষা প্রবলভাবে প্রচার করেছেন বিপ্লবী সর্বহারাদের মহান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কিও। তিনি নারীর মিত্র নন, মিত্রের ছদ্মবেশধারী শত্রু। তার দৃষ্টিতে মা অসামান্য কারন তার মর্ষকামিতা অসামান্য। পুত্রের জন্য দুঃসহ দুঃখবরণ, পুত্রের মাপমতো হয়ে ওঠার কঠোর সাধনা, নিজেকে বিলীন করে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টার নাম হচ্ছে গোর্কির মা। শওকত ওসমানের জননী সন্তানের জন্য নিজেকে বলি দেয় । এই জননীর নাম দরিয়া বিবি। পুরুষতন্ত্রের চোখে ধর্ষণকারী পুরুষ ও অপরাধী নয়, পাপী নয়। পাপী যে সে নারী। অপরাধী সে, তাই শাস্তি পাবে নারী। দীক্ষা অনুসারে দরিয়া বিবিও এ কথাই বিশ্বাস করে। দ্বিতীয় স্বামী আজাহার খাঁর মৃত্যুর পর ব্যবসায়ী দূরসম্পর্কিত দেবর ইয়াকুব এক দিন অতর্কিতে দরিয়া বিবিকে বলাৎকার করে। তার পর প্রায়ই হানা দিয়ে সে এই পীড়ন চালিয়ে যেতে থাকে। দরিয়া বিবি এই আক্রমণ পীড়নে হতবিহ্বল হয়, নিজের ওপর তার ঘৃণা জন্মে; কিন্তু পীড়নকারীকে যেমন প্রতিরোধ সে করে না, তেমনি তাকে শায়েস্তা করার কোন উদ্যোগও নেয় না। কেবলই সহ্য করে জননী। নিরুপায় সর্বংসহা ধরণীর মতো। কারণ এই লম্পট পুরুষটির কাছে থেকেই তাকে নিতে হয় প্রথম স্বামীর সন্তান মোনাদিরের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহের অর্থ। জননীর এই অসাধ্য সাধনের ব্রতটিকে মহিমান্বিত করে তোলার জন্য শওকত ওসমান অসম্ভব, বানোয়াট গল্প ফাঁদতে ও দ্বিধান্বিত হননি। তিনি দেখান জননী তার শরীরে রাশি রাশি কাপড় জড়িয়ে গোপন রাখছে তার গর্ভাবস্থা।
উগ্র পুরুষতান্ত্রিক হচ্ছে আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার তেইশ নম্বর তৈলচিত্রের উপন্যাসের নায়িকা ছবি। কুমারী অবস্থায় তাকেও একদিন অতর্কিতে বলাৎকার করে লম্পট পুরুষ। ছবি সন্তানসম্ভবা হয়। সে গর্ভপাতের সম্মত হয় না। কারণ সে জানে মাতৃত্বই নারী জীবনের পরিণাম। তার বক্তব্য এমনÑ জানি এই একমাত্র পন্থা। কিন্তু তবু মনটা এমন করছে কেন, যে এসেছে তার তো কোনো অপরাধ নেই। সে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ। ফুলকালির মধ্যে থাকতেই তাকে ছিঁড়ে পিষে ফেলা। সমাজ আছে; কিন্তু তার চেয়ে বড় বিবেকও তো মরে যায়নি? আসলে বিবেকও নয়, বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে যে গড়ে উঠেছে তার প্রতি কেমন একটা দুর্বোধ্য টান। আমি আস্তে আস্তে বললাম বৌদি, আমি পালিয়ে যাই; কিংবা দূরে কোনো শহরে ব্যবস্থা করে দাও। আমার জীবনটা তো নষ্ট হলো। অন্য একটা জীবন বাঁচুক। আবু ইসহাকের জননীও নিজেকে উৎসর্গ করে সন্তানের জন্য। এই জননী জয়গুন পরম মর্ষকামী।
শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ (ষষ্ঠ মুদ্রণ ১৯৭৩) উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে ওই সাধ্বী, পতিনিষ্ঠ, সর্বংসহা স্ত্রী ভাবমূর্তি। এই নারী সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও পতিনিষ্ঠায় বিবি রহিমা আর রূপযৌবনে বেহেশতি হুরি। আবু রূশদের নোঙর (পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৯৭০) উপন্যাসটিতে এই নারী ধারণার রূপায়ণ দেখা যায়। লেখক বিশ্বাস করেন স্ত্রী পুরুষকে তৃপ্ত করবে শরীর দিয়ে, সেবা দিয়ে, আনুগত্য দিয়ে, নিষ্ঠা দিয়ে। আমাদের পুরুষ লেখকদের বড় অংশের পছন্দ নারী অশ্রুময়ী, লাজুক, উৎকণ্ঠিত ও অক্রিয় প্রেমিকা ভাবমূর্তি। এ ভঙ্গুর সুন্দরের স্তব পাওয়া যায় শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শহীদল্লাহ কায়সার, জহীর রায়হান, আনোয়ার পাশা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, বিপ্রদাস বড়–য়ার উপন্যাসে। শামুসদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যার (১৩৬১) লাজুক, নিঃশব্দ, কল্যাণী প্রেমিকা মেহেরজান। তার ডাগর চোখের আকুল দৃষ্টি প্রেমিক পুরুষকে জীবনযুদ্ধে প্রবলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। আর মেহেরজান শুধু প্রতীক্ষা করে, অশ্রুসজল হয়, এ প্রতীক্ষাই তার জীবন।
জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে (চতুর্থ সংস্করণ ১৯৮৪) উপন্যাসে হাজার বছর ধরে বহমান গ্রামীণ জীবনের অনন্তধারার সুষমা ও মাধুর্য তুলে ধরা লেখকের লক্ষ্য। এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতীর দুর্বল অনুকরণ এবং লেখকের ভাবালুতার শব্দরূপ। এ উপন্যাসে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তৃপ্ত করাই নারীর কাজ, সে যেখানেই বাস করুক না কেন, তৃপ্তিদায়িনী বিনোদনী ছাড়া সে তার কিছু নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিলে কোঠার সেপাই (১৯৮৬) উপাখ্যানে অস্বাভাবিক পুরুষের আখ্যান বর্ণনার পাশাপাশি বর্ণনা করেন এক নিভৃতবাসী প্রেমিকার রূপ। তার মুখে উচ্চারিত হয় গোঁড়া পুরুষতান্ত্রিক ওই বিশ্বাস যে নারী একবার পুরুষ সংসর্গে এলেই সে হারায় তার সতীত্ব, হয়ে ওঠে পোকায় খাওয়া। পুরুষ দেবতার প্রথম ভোগ হওয়া চাই অনাঘ্রাত কুমারী।
সৈয়দ শামসুল হক তুমি সেই তরবারি সন্ধানী (১৯৭৮) উপন্যাসে রূপায়িত করেছেন একই নারীর স্ত্রী ও প্রেমিকা ভাবমূর্তি এবং প্রচার করেছেন পুরুষতন্ত্রের ওই বিধানটি সংসারই নারীর গন্তব্য। সকিনার বক্তব্য এমন-
আমাকে এভাবে কেউ কখনো ডাকেনি, কাশেমও না। তবু সেই কাশেমের কাছে আমি ফিরে যাবো। ... তোমার ভালবাসা আছে, কাশেমের তাও নেই। ও আমাকে ভালো না বাসুক, আমি তো বেসেছি। না ওর জন্য আমার যা তাকে আর ভালোবাসা বলব না, সেটি সম্পূর্ণ অন্য। সেই সম্পূর্ণ অন্য কিছুর সাথে বাস করা যায়, ভালোবাসার সাথে হয়তো যায় না।
শওকত আলী ও নারীর জন্য একই রকম ক্ষতিকর এবং বিভ্রান্তির্ক দক্ষিণায়নের দিন (১৯৯৫) উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে এই উদ্ভ্রান্ত নারীর আখ্যান। রাখী ইতিহাসে মাস্টার্স করেছে, কিন্তু আজীবন লক্ষ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত। উদ্ভ্রান্ত কন্যা বারবার বাবার কাছে ছুটে আসে পথনির্দেশ পাওয়ার জন্য। সে চায় বাবার মতো শক্তিমান কোনো পুরুষের প্রেম; কিন্তু এ চাওয়া তার নিজের কাছেই অজ্ঞাত থাকে। তাই উচ্চ বেতনের চাকরি তার বিস্বাদ লাগে। অধ্যাপক প্রেমিকের আচরণ হাস্যকর লাগে। কারণ ওই প্রেমিক, তার পরম পুরুষ নয়, বাবার মতো নয়।
রশিদ করিম ও রাহাত খানের উপন্যাসে ঘটেছে পরজীবী অক্রিয় নারী ভাবমূর্তির রূপায়ণ। রশীদ করিমের যে তিনটি উপন্যাসে এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত, উত্তম পুরুষ (১৯৬১), আমার যত গ্লানি (১৯৭৩), চিনি না (১৯৯০) সব ক’টিই উচ্চবিত্ত নারী পুরুষের আখ্যান। রাহাত খানের উপন্যাস নেয়া হয়েছে একটি কোলাহল বিচিত্রা (১৯৮১)। এটি ও উচ্চবিত্ত নরনারীর অ্যাখ্যান। পুরুষতন্ত্রই তাদের দেখতে চায় সুন্দরতম ‘শোপিস’ হিসেবে, তারা তাই হয় ও তাদের তাই হতে দীক্ষা দেয়া হয়। তারা স্বামীর সাথে পার্টিতে যায়, ক্লাবে যায়, কোমল ও কড়া সব ধরনের পানীয়ই পান করে, বহু পুরুষের সাথে মেশে, স্বামীর সাথে তাদের সম্পর্ক আবেগশূন্য, নিরুত্তাপ, অপ্রেমে পরিপূর্ণ। স্বামীকে ঘৃণা করে; কিন্তু সংসার ভাঙা বা স্বামীকে ত্যাগ করার কথা কখনোই ভাবে না, কেন না নিরাপত্তা, বিলাশ ব্যসনের অঢেল সুযোগ, অর্থের প্রাচুর্য, সুবিধা, আরামই তাদের জীবন। ডিভোর্স করলে এসব হারাতে হবে। রশীদ করিমের চোখে নারী কাম সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্ষণ তার কাছে পৌরুষের নামান্তর। তার উপন্যাস তার অবদমিত কাম ও বিকারের মুদ্রিত রূপ।
রাহাত খানের পরজীবী নারীও অক্রিয়, প্রসাধন চর্চিত, সুবেশধারিনী, সংসারের শোভা, দুর্মূল্য এন্টিক। এরা সংসারে বাস করে রাজহংসের মতো, পুরুষের অর্থে পুরুষের মুদ্রায় গড়া সম্পন্ন সংসারে পরগাছা এরা। এই নারীরা শুধু আলগোছে তত্ত্বাবধান করে সংসার, ফ্যাশানের পর ফ্যাশন বদলায়, পর পুরুষের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে না। সীমা লঙ্ঘন মানে অন্য পুরুষের প্রেমে পড়া কিংবা স্বামীকে ডিভোর্স করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া।
নিরবয়ব নারী ভাবমূর্তির রূপকার সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। নারী তার কাছে নিরবয়ব, নিরাকার, তুচ্ছ, উপেক্ষণীয়, দুরূহ, জঞ্জাল। তার প্রথম উপন্যাস লালসালু (১৯৪৮) তে নারীকে পাওয়া যায় পুরুষ প্রভুর সংসারের দাসীরূপে। চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) সম্পূর্ণ নারীবর্জিত অ্যাখ্যান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রথা বিরোধী নন; বরং বড়ই প্রথাশাসিত তিনি। কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮) উপন্যাসেও নারীর সংসারের জন্য খাটে এবং সংসারেই বাস করে, কিন্তু সে নিরবয়ব। এ উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র সকিনা খাতুনের কোনো অবয়ব নেই; সে ব্যক্তি নয়। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যদি পুরুষের পৃথিবী থেকে নারীকে সম্পূর্ণ বিদায় করে দিতে পারতেন তাহলেই বোধহয় সবচেয়ে স্বস্তি পেতেন।
এ ছাড়া প্রায় সব কথাশিল্পীই উপন্যাসে তাদের নারী ভাবমূর্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এবং অত্যন্ত শক্তভাবেই নারীকে পরগাছায় দাঁড় করিয়েছেন।
No comments