রবিউলের ছবি আঁকড়ে বেঁচে আছে পরিবার
“এখনও কথা ফোটেনি ১১ মাসের শিশু কামরুন নাহার রায়নার মুখে। কোনো রকম শব্দ করতে শিখেছে। কাউকে দেখলে তার মুখ দিয়ে একটি শব্দই বের হয়, সেটি ‘বাবা’। দিন কাটে তার সেই ‘বাবা’ ডেকে ডেকে। বাবার ছবির ওপর বসে, ছবিতে হাত দিয়ে, ছবির সঙ্গে খেলতে খেলতে পার হয় তার দিনের বেশির ভাগ সময়।” যুগান্তরের কাছে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন উম্মে সালমা। গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিমের স্ত্রী তিনি। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর জঙ্গিদের বুলেটে নিহত হন রবিউল। শুধু রায়না নয়, পুরো পরিবার এখন বেঁচে আছে রবিউলের ছবি আঁকড়ে। জন্মের পর বাবাকে দেখা হয়নি রায়নার। পাওয়া হয়নি আদর। এখন যেন ছবি দেখেই বাবাকে চেনা। আরেক সন্তান সাত বছরের সাজিদুল করিম সামি এখনও খোঁজে বাবাকে। উম্মে সালমা বলেন, সামি মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যায়। খেলতে খেলতে হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়লে জিজ্ঞাসা করে- ‘মা, বাবা কখন আসবে?’ আবার বলে, ‘আমাদের আর কখনো ঈদের আনন্দ হবে না!’ সন্তানের এই প্রশ্ন হয়তো আজীবন শুনে যেতে হবে। সাভারের ভাড়াবাড়িতে বসে ২৪ জুন কথা হয় পুলিশের মেধাবী কর্মকর্র্তা রবিউল করিমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। মা, ভাবি, ভাতিজা-ভাতিজিকে নিয়ে সেখানে থাকেন রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস। বাবা আবদুল মালেক মারা গেছেন ১৩ বছর আগে। পরিবারের অভিভাবক এখন তাই শামসই। রবিউলের বিষয়ে জানতে চাইলে মা করিমুন নেছা চোখ মুছতে থাকেন। বলেন, ছেলে হারানোর যন্ত্রণা বুঝবে না বাবা। সন্তানের বাবা-মা হও তখন বুঝবা। রবিউল যেদিন ইন্তেকাল করে (১ জুলাই) ওই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার তিনবার কথা হয়। সকালে আমি ওকে বলেছিলাম, বাবা রমজান মাস গেল, আমার সঙ্গে ইফতার করলি না, আজ করবি। সে রাজি হয়। বিকালে ফোন করে জিজ্ঞাসা করি- বাবা তুমি আসছ? তখনও সে বলে, আমি আসব মা। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে অথচ না আসায় আমি তাকে আবারও ফোন করি। তখন রবিউল বলে, মা জরুরি কাজ আছে। গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসছে। আমার মনে হয় যাওয়া হবে না। তখন আমি তার প্রতি অভিমান করে কথা না বলে চুপ থাকি। এ সময় রবিউল বলে, দেখ, তোমাদের সঙ্গে আমার ঈদ করা হয় কিনা? আমি জিজ্ঞেস করি, এমন কথা কেন বলছ? আমি কেঁদে ফেলি। কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দেই। মা করিমুন নেছা বলেন, তার মতো মানুষ এ পৃথিবীতে খুব কম জন্মাবে। খুবই ভালো ছিল। বাড়ির মানুষ থেকে শুরু করে গ্রামের প্রতিটি মানুষ তাকে ভালোবাসত। ঈদ এলে বাড়ির সবার জন্য নতুন কাপড়-চোপড় আনত। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিবন্ধী স্কুলের ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন জামা-পাঞ্জাবি কিনে নিজ হাতে ওদের পরিয়ে দিত। সে নিজেকে নিয়ে যতটা না ভাবত, তার চেয়ে বেশি ভাবত দেশ নিয়ে।
তাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে আছি এটা কিভাবে বুঝাব! এখন রবিউলের দুই সন্তানের মাঝে ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কেমন আছেন জানতে চাইলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন উম্মে সালমা। দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বলেন, এরাই আমার অবলম্বন। আমি এদের নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। মায়ের কান্না দেখে কেঁদে ফেলে দুই সন্তানও। মুহূর্তেই পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। একটু পর নিজেকে সামলে উম্মে সালমা বলেন, ঈদ এলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আনন্দ হতো আমাদের পরিবারে। গত বছর থেকে সেটি আর হয় না। শাশুড়ি ছেলের জন্য অধিকাংশ সময় কেঁদে কেঁদে দিন কাটান। সন্তানদের চোখ-মুখও অন্ধকার। কিভাবে যাবে আগামীর দিনগুলো- তা নিয়েই শঙ্কায় দিন কাটে আমাদের। শামসুজ্জামান শামস বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। ভাবি দিনের বেশির ভাগ সময় নিজের রুমে ভাইয়ের ছবি দেখে সময় কাটায়। ভাইয়ের কথা মনে পড়লে মা স্থির থাকতে পারেন না। তার চোখের পানি পরিবারের অন্যরাও সহ্য করতে পারেন না। আর শিশুদের কথা কী বলব- ওরা তো এখনও কিছু বুঝতে শেখেনি। সামি তার বাবার জন্য বেশি অস্থির হয়ে যায়। শামস আরও বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা ও ভালোবাসা পাচ্ছি। সেটাই আমাদের এখনকার শক্তি। উম্মে সালমার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ভাবির এ মুহূর্তে প্রয়োজন একটি কাজে ঢোকা। সরকার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাবিকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেটি হলে অনেক ভালো হবে। কাজের মধ্যে থাকলে তিনি দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারবেন। রবিউল করিমের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের কাটিগ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশে যোগ দেন তিনি।
No comments