মামলার তদন্তই শেষ হয়নি
আজ ১ জুলাই। রাজধানীর গুলশানের হোলে আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ উগ্রবাদী হামলার এক বছর। দেশের সবচেয়ে ভয়াবহতম উগ্রবাদী হামলার বছর পূর্ণ হলেও এ মামলায় এখনো চার্জশিট প্রদান করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর ওই হামলার ঘটনায় সরাসরি জড়িত উগ্রবাদী এবং পরিকল্পনাকারীদের সবাই নিহত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চারজন গ্রেফতার হয়েছে। এর বাইরে আরো পাঁচজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনকে গ্রেফতার করতে পারলে এ মামলার চার্জশিট প্রদান করা হবে। এ তিনজন হলো সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র্যাশ ও বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট। এ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, হোলে আর্টিজান রেস্তোরাঁয় উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় শিগগিরই নির্ভুল ও নিখুঁত চার্জশিট দাখিল করা হবে। গত বছরের এই দিনে গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর রোডের আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় বন্দুকধারী উগ্রবাদীরা। দেশের উগ্রবাদীদের এটাই সবচে বড় নাশকতা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং ১৭ জন বিদেশী নাগরিকসহ নিহত হয় ২৩ জন। আর সেখানে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় ৫ হামলাকারী ও এক সন্দেহভাজন। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। গুলশান হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে সিআইডি যেসব আলামত পরীার জন্য নিয়েছে তার রিপোর্ট এক বছরেও হাতে পায়নি কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্তকারী সূত্র জানায়, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে যারা নিহত হয়েছে বা আটক হয়েছে তারা সবাই কোনো-না-কোনোভাবে আর্টিজান হামলায় জড়িত। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এ পর্যন্ত দুইজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তারা হলো নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক হাসনাত রেজা করিম এবং কল্যাণপুরে উগ্রবাদবিরোধী অভিযানে আটক রাকিব ওরফে রিগ্যান। পাশাপাশি এ ঘটনা তদন্তে প্রায় ১০০ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এদের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া ৩২ জন প্রত্যদর্শী হিসেবে তাদের জবানবন্দী দিয়েছেন। ঘটনা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ধারণা, এ হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডা প্রবাসী তামিম আহমেদ চৌধুরী। পরে তদন্তে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানতে পারেন, তামিম আহমেদ চৌধুরী হোলে আর্টিজানের হামলায় অপারেশন কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছে। হামলায় ব্যবহƒত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার একটি অস্ত্র কারখানায় তৈরি করা হয়েছিল এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তপথ দিয়ে ট্রাকে আমের ঝুড়িতে করে সেগুলো ঢাকায় আনা হয় বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। গোয়েন্দা সূত্র মতে, উগ্রবাদী সোহেল মাহফুজ গুলশান হামলার অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের মূল হোতা। সে জেএমবির পুরনো ধারার সাথে যুক্ত ছিল। জেএমবির শীর্ষ ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হলে সংগঠনটির আমির হয় সাইদুর রহমান। ওই সময় জেএমবির শূরা (নীতিনির্ধারণী) কমিটির সদস্য পদ পায় মাহফুজ। আরেক উগ্রবাদী রাশেদ ওরফে র্যাশ গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন। পাঁচ উগ্রবাদীকে হামলার আগে রাজধানীর বসুন্ধরার যে বাসায় রাখা হয়েছিল, ওই বাসায় রাশেদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। উগ্রবাদী বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট গুলশান হামলার জন্য দুবাই থেকে আসা ১৪ লাখ টাকা বাংলাদেশে গ্রহণ করে বলে তথ্য রয়েছে তদন্ত সংস্থার কাছে। দুবাইয়ে পলাতক মুফতি শফিকুর রহমান নব্য জেএমবিকে নিয়মিত অর্থ সহায়তা করত বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। বাশারুজ্জামান ওই অর্থ সংগ্রহ করে মূল সমন্বয়ক তামিমের কাছে দিত। বাকি দুই উগ্রবাদীর মধ্যে একজন সপরিবারে সিরিয়ায় পলাতক ডাক্তার রোকন। গুলশানে উগ্রবাদী হামলার আগে নব্য জেএমবির তহবিলে টাকা দেয় ডাক্তার রোকন। সংগঠনটির শূরা বোর্ডের এক সদস্য টাকা গ্রহণ করে। দুই দেশ ঘুরে হাত বদল হয়ে এ টাকা বাংলাদেশে পৌঁছায়। নব্য জেএমবির ছোট মিজান গুলশান হামলাসহ নব্য জেএমবির দেশব্যাপী হামলায় ব্যবহƒত অস্ত্র ও গ্রেনেডের জোগানদাতা। পুলিশ জানায়, মিজানের নেতৃত্বে গুলশান হামলার অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়। তাদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তাদের একজন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানÑ যাকে এরই মধ্যে গুলশান হামলার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
এখন ছোট মিজানকে খুঁজছে পুলিশ। এ দিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির এডিশনাল কমিশনার মনিরুল ইসলাম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আর্টিজান হামলায় যারা সরাসরি জড়িত ছিল তারা কেউ জীবিত নেই, তারা ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। এর বাইরে এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী, সহযোগিতাকারী এবং নানাভাবে যারা ভূমিকা রেখেছে এই রকম অনেককে চিহ্নিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে আরো আটজন। জীবিত থাকলে হোলে আর্টিজান মামলার আসামি হতো তারা। এর বাইরে এ চারজন গ্রেফতার রয়েছে। তাদের তিনজন ইতোমধ্যে তাদের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তিনি বলেন, তারা আরো অন্তত পাঁচজনকে খুঁজছেন। তার মধ্যে অন্তত দু’জনকে গ্রেফতার করতে পারলে তদন্ত শেষ করবেন। তা না হলেও এই বছরের মধ্যেই তদন্ত শেষ করবেন। আর্টিজান হামলায় নিহত ১৭ বিদেশীর মধ্যে একজন ভারতীয়, নয়জন ইতালীয় ও সাতজন জাপানি। প্রায় ১২ ঘণ্টার ওই পণবন্দী সঙ্কট শেষ হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান অপারেশন থান্ডারবোল্টের মধ্য দিয়ে। এ সময় অভিযান চালাতে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকেই র্যাব-পুলিশের সদস্য। তাদের কয়েকজন বলেছেন, উগ্রবাদীদের সেই হামলার ক্ষত এখনো তারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। এ দিকে উগ্রবাদী হামলার পরে অনেক রাষ্ট্র তাদের নাগরিককে বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে। ব্যবসায় বাণিজ্যেও অনেকটা ধস নামে। বিশেষ করে ওই এলাকার হোটেল ব্যবসায় এখনো জমে ওঠেনি। বিদেশীরা এখনো সতর্কতার সাথে রাতে ঘোরাফেরা করেন বলে একাধিক সূত্র জানায়।
No comments