নতুন করে ‘অপারেশনাল সেল’ তৈরির চেষ্টায় নব্য জেএমবি
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির (জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) নব্যধারা (নব্য জেএমবি) নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। তবে তাদের কার্যক্রম এখনও বন্ধ হয়নি। এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ অভিযানে প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতাসহ ৬০ জঙ্গি নিহত হওয়ায় সংগঠনের নেতৃত্ব এখন তৃতীয় সারির নেতাদের হাতে। সংগঠনের সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছে ছদ্মবেশী জঙ্গি আইয়ুব বাচ্চু ওরফে লালভাই ওরফে সাজিদ। তার নেতৃত্বে নতুন করে অপারেশনাল সেল বা আত্মঘাতী সেল তৈরির মাধ্যমে নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করছে নব্য জেএমবি। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, এ মুহূর্তে তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। নতুন করে হামলার সক্ষমতা তাদের নেই। জঙ্গি বিষয়ে খোঁজ রাখেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একাধিক কর্মকর্তারা জানান, জেএমবির নব্য ধারাটি মূল সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে কার্যক্রম শুরু করে ২০১১ সালে। ব্যাপকভাবে মাঠে নামে ২০১৫ সালে। তারা নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট) বলে দাবি করে আসছে। তবে আইএস’র সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। তারা আইএস’র ভাবাদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। পুরান জেএমবি থেকে আলাদা হয়ে নতুন ভাবধারায় পরিচালিত হচ্ছে। এ ভাবধারায় অনুপ্রাণীত হয়ে অনেকেই কথিত জিহাদের নামে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিডেঁরায় চলে গেছে। দুর্বল সংগঠনকে চাঙা করতে নতুন করে বড় হামলার পরিকল্পনা করছে নব্য জেএমবির সমন্বয়ক আইয়ুব বাচ্চু। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে অপারেশনাল সেল তৈরির চেষ্টা করছে সে।
সম্প্রতি বনানী থেকে নিখোঁজ চার তরুণকে কোনো অপারেশনাল সেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানের ফলে নব্য জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। তবে তাদের পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। এখনও সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ১০ জঙ্গি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তাদের মধ্যে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট, রাশেদ ওরফে র্যাশ, মামুনুর রশীদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ অন্যতম। পুলিশের বিশেষায়িত বিভাগ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা পলাতক রয়েছে। তাদের মধ্যে সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র্যাশ ও বাশারুজ্জামান অন্যতম। নব্য জেএমবির হামলার সক্ষমতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আগে জঙ্গি দমনে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করত। তবে গুলশান হামলার পর একটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে পরিবার, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। ধর্মীয় দিক থেকেও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান তৈরি হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের ২৯ মার্চ মৌলভীবাজারে সিটিটিসির অপারেশন হিটব্যাকে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম মুসা নিহত হয়। সে ছিল সংগঠনের দ্বিতীয় সারির নেতা। মুসার মৃত্যুর পর আইয়ুব বাচ্চু সংগঠনের হাল ধরেছে। বাচ্চু জঙ্গি নেতা মুসার বিশ্বস্ত সহযোগী ছিল। সে মুসার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল। নব্য জেএমবির জঙ্গিদের মনোবল বাড়াতে তারা এক সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সফর করেছে। বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে সদস্য সংগ্রহ করেছে তারা। গুলশানের হামলার দুই মাস পর নব্য জেএমবির সমন্বয়ক তামিম আাহমেদ চৌধুরী নিহত হয়। তারপর সংগঠনের হাল ধরে সারোয়ার জাহান মানিক। সেপ্টেম্বরে মানিকের মৃত্যুর পর মুসা সংগঠনের নেতৃত্বে চলে আসে। এদিকে র্যাবের একটি সূত্র জানায়, সাজিদ নামে নব্য জেএমবির এক জঙ্গির বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এ সাজিদই আইয়ুব বাচ্চু বলে র্যাবের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন। সম্প্রতি দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তারা সাজিদের বিষয়ে জানতে পারে। সে এখন নতুন সদস্য সংগ্রহ করে অপারেশনাল সেল বা আত্মঘাতী সেল তৈরি করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বনানী থেকে নিখোঁজ চার তরুণকে বাচ্চু অপারেশনাল সেলে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আদালতে দেয়া দুই জঙ্গির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও বনানী থেকে নিখোঁজ তরুণদের নাম এসেছে। এ বিষয়ে র্যাব-১১ সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলেপ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, দুই জঙ্গির জবানবন্দিতে সম্প্রতি বনানী থেকে নিখোঁজ চার তরুণের মধ্যে কারও কারও নাম এসেছে।
আইএসে যোগ দিয়ে দেশ ছেড়েছে অনেক জঙ্গি : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, কথিত জিহাদের নামে ঘর ছেড়েছে এমন অন্তত ৪৮ জন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ জনের বেশি সিরিয়ায় বা ইরাকে গেছে। চারজন সেখানে নিহত হয়েছে। কথিত হিজরতের নামে অনেক তরুণ ঘর ছেড়ে দেশের অভ্যন্তরেই জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয়েছে। এমন অন্তত ১৭ জন রয়েছে। সর্বশেষ জুনের প্রথম সপ্তাহে বনানী থেকে নিখোঁজ চার তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়েছে। তারা হল- তাওহিদুর রহমান, ইমাম হোসেন, হাসান মাহমুদ ও কামাল হোসেন। দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদে জড়ানো তরুণেরা অপারেশনাল সেলে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, জাপানে পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় মহিবুর রহমান। সে সাইফুল্লাহ ওজাকির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে যোগ দিয়ে সিরিয়া গমন করেছে। সংগীত শিল্পী তাহমিদ রহমান সাফি ও তার স্ত্রী সায়মা খান ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ায় যায়। সেখান থেকে তিন মাস পর এ দম্পতি সিরিয়ার চলে যায়। এর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দেশ ছাড়ে ডা. আরাফাত হোসেন (তুষার)। হলি আর্টিজানে হামলার পাঁচ দিন পর এক ভিডিও বার্তায় হামলাকারী জঙ্গিদের অভিনন্দন জানায় তাহমিদ ও আরাফাত। ওই ভিডিওটি সিরিয়ার রাকায় ধারণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ২০১৫ সালের জুন মাসে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রোকনুদ্দীন খন্দকার, তার স্ত্রী নাঈমা আক্তার, দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন ও রমিতা রোকন এবং এক মেয়ের স্বামী সাদ কায়েস সিরিয়ায় চলে যায়।
No comments