ব্যাংক লুটপাটের জন্য অর্থমন্ত্রীই দায়ী
দেশের ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে, যা সমগ্র অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুধু এভাবে বক্তব্য দিয়েই দায় এড়াতে পারবেন না। এমন স্পষ্ট অভিমত দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের। তারা মনে করেন, ব্যাংকগুলোর এমন নাজুক পরিস্থিতির অন্যতম কারণ অর্থ লুটপাট। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এসব ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, উল্টো রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। বিপরীতে জনগণের ট্যাক্সের পয়সা ভর্তুকি দিয়ে ব্যাংকগুলোর হারানো মূলধনের জোগান দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রী তথা সরকার অদ্যাবধি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তাই ব্যাংক লুটপাটের দায় সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সরকারকেই নিতে হবে। বর্তমান সরকারও এ দায় এড়াতে পারবে না। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী সংসদে দেয়া বক্তৃতায় ব্যাংকের নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করে নেয়ায় প্রকারান্তরে তিনি এর দায়ও স্বীকার করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের সাফ কথা- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লুটপাটের পেছনে অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী। আর মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তার দায়ভার অর্থমন্ত্রীর ওপরই বর্তায়। মূলত বিচারহীনতার কারণে ব্যাংকিং খাতে এ বিপর্যয় নেমে এসেছে। যতদিন বড় বড় ঋণখেলাপি ও তাদের দোসরদের বিচারের মুখোমুখি না করা হবে, ততদিন এসব লুটপাট চলতেই থাকবে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের জন্য পরিচালকদের মেয়াদ ও একই পরিবারের ৪ জনকে পরিচালক থাকার প্রস্তাবিত আইনের বিরোধিতা করে তারা বলেন, এ আইন কার্যকর হলে সরকারি ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ডুববে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেয়া ‘দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক’ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার তারা যুগান্তরকে এসব কথা বলেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগে পুঁজি জোগানের জন্য দুটি খাত। একটি হল মুদ্রাবাজার বা ব্যাংক এবং অপরটি শেয়ারবাজার। বর্তমানে দুটি খাতই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন কেলেংকারির কারণে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের মোট ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ খেলাপি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণেই এসব ঋণ দেয়া হয়। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
অপরদিকে কেলেংকারির কারণে শেয়ারবাজারে চরম আস্থার সংকট বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীরা এখানে আসতে সাহস পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের এই দুরবস্থার কারণ হল বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এই দুই খাতে কেলেংকারির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কারও বিচার হয়নি। ফলে বর্তমানে যারা দেশে বিনিয়োগ করতে চায়, তারা সহজে পুঁজি পায় না। ঋণের সুদ বেশি। শেয়ারবাজারে রয়েছে বিভিন্ন অনিয়ম। এ অবস্থার উত্তরণে কেলেংকারির সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, তাদের অর্থ কেউ হাতিয়ে নিলে তার বিচার হবে। এটি নিশ্চিত করতে না পারলে এই দুরবস্থা কাটবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সবাই বুঝতে পারছে- ব্যাংকিং খাতের কারণে রিয়েল সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকিং খাতের এ অবস্থার কারণ হচ্ছে, এতদিন পর্যন্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলায় ব্যত্যয় ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি অন্য ব্যাংকগুলো মানছে না। সেন্ট্রাল ব্যাংকও কঠোর হচ্ছে না। তাছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়েরও কিছু ব্যাপার আছে। সবকিছু মিলিয়ে এ দায় সরকারের। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অনেক দুর্নীতি হয়েছে। সেইসঙ্গে আমলাদের প্রভাব তো আছেই। পেশাদারিত্ব না থাকা এবং ভালো লোকদের মূল্যায়ন না করায় এমনটা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সমস্যাটা জেনেও তা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এর দায়-দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়। গত কয়েক বছর ধরে বেসিক, সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও বিডিবিএলে লুটপাট হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ ব্যাংকগুলো কাজ করে। ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের ৪৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খোঁড়া করে নিজেরা দায়িত্ব নিয়েও তা পালন করেনি। উল্টো দুর্নীতি সহায়ক ভূমিকা এবং তাদের পরিচালনগত অদক্ষতার কারণে ব্যাংকগুলোর এ অবস্থা হয়েছে। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী এবং সে মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে অর্থমন্ত্রী নিজেও দায়ী। তিনি আরও বলেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এখনও সেটা দেখাচ্ছেন না। কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকের সংস্কারের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সংস্কারের কথা চিন্তা করছেন না। এতকিছুর পর তিনি নিজেই স্বীকারোক্তি দিলেন ব্যাংকের অবস্থা করুণ। তার পরও সংস্কার করতে চাচ্ছেন না। এতে মনে হয়, ইচ্ছা করেই অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাটে সহায়তা করছে। এটি বন্ধ করতে হবে। এখন ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা তাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করা উচিত। যদি প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি না দেন তাহলে ব্যাংকগুলো সুদিনে ফিরবে না। বেসরকারি ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা পরিচালকদের মেয়াদকাল বৃদ্ধি ও একই পরিবারের ৪ জন পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকও ডুববে। অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত বহন করছে। সংসদ সদস্যদের উচিত এ আইন পাসে সমর্থন না দেয়া। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, হঠাৎ করে নয়, দীর্ঘদিন থেকে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তখন তার ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংকের অর্থ লুট করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে একক কোনো সরকারের ওপর দায়ভার বর্তায় না। তবে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার দায়ভার বেশি। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার নয়। এসব ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট হচ্ছে, খেলাপি ঋণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সমাধান নেয়া হচ্ছে না। শুধু বাজেটের অধীনে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ব্যাংকগুলোকে অর্থ দেয়া না হলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। সে কারণে অর্থ দেয়া হচ্ছে। আসলে অর্থ ঘাটতি ব্যাংকগুলোর সমস্যার সমাধান না। ঘাটতি হচ্ছে সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। ঘাটতি সমস্যার কারণ না, ফলাফল। কারণটা হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা ব্যবহার করে যারা টাকা লুটপাট করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যতদিন সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিতে না পারবে ততদিন অর্থের জোগান দিয়েও সমস্যার সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে দু’ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। প্রথমত, খেলাপি ঋণের অর্থ আদায় বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অর্থ আদায়ের আইনি সংস্কার করতে হবে। যদি অর্থ ঋণ আদালতের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করা না যায় তাহলে তা সংস্কার অথবা নতুন আইন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, লোকসানি শাখা কমিয়ে এনে ব্যাংকের আকার ছোট করে আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের মেয়াদকাল দীর্ঘায়িত এবং একই পরিবারের ৪ জনকে পরিচালক। এতে সুশাসনগত দুর্বলতা সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকে ছড়িয়ে পড়বে। এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান এবং প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং খাতে যাওয়ার জন্য কমিশন করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে, যা সমগ্র অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এ জন্য যা যা পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তা নিতে হচ্ছে, যাতে অর্থনীতি ঝুঁকিতে না পড়ে। আর বিরোধীদলীয় এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বলেন, ব্যাংকগুলোর অবস্থা সংকটাপন্ন। বেশিরভাগ ব্যাংক পরিচালক নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগ করে নিচ্ছে। মালিক ও পরিচালকরা টাকা গিলে খাচ্ছে। কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘এই যে বেসরকারি ব্যাংকের সব ডিরেক্টর পারিবারিক, স্বতন্ত্র ডিরেক্টর নেই, লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক এখন লুটপাটের জায়গা হয়েছে। সরকারি ব্যাংক তো হয়েছেই। ব্যাংক আর ব্যাংক থাকবে না। ব্যাংকগুলো মুদি দোকান হয়ে যাবে।’ ফখরুল ইমাম বলেন, ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়। আর যারা ব্যাংক লুট করেছে, অর্থমন্ত্রী তাদের চিনবেন না, এটা হয় না।’
No comments