রমজান সামনে : বেড়েছে ১৬ পণ্যের দাম
পবিত্র রমজানকে সামনের রেখে অস্থির হয়ে উঠেছে রাজধানীর নিত্যপণ্যের বাজার। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে চাল, চিনি, মুরগি ও খেজুরসহ ১৬টি রমজাননির্ভর পণ্যের দাম। এতে তপ্ত রোদ আর বাজারের উত্তাপে হাঁসফাঁস করছেন সাধারণ ক্রেতারা। কিন্তু দামে শৃঙ্খলা ফেরানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আমাদের মোবাইল কোর্ট দিয়ে জরিমানা করে লাভ নেই। গোড়ায় আগে ঠিক করতে হবে। তাহলে সব জায়গায়ই ঠিক হবে। আমদানিকারক ও মিলমালিকদের কারণেই এ অবস্থা। আমরা তো যে দামে কিনে আনি তার চেয়ে কিছুটা লাভ রেখে বিক্রি করি। কিন্তু যত বিপদ সব আমাদের ঘারে। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা বরাবরের মতোই বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন। শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও শেওড়াপাড়া বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র। বাজারভেদে দামেও ছিল ভিন্নতা। দাম বৃদ্ধির তালিকায় থাকা অন্য পণ্যগুলো হচ্ছে ছোলা, বেসন, মাছ, ধনেপাতা, বেগুন, কাঁচামরিচ, মুড়ি, চিড়া, রসুন, আদা, লেবু ও শসা। ঢাকার বাজারে খেজুর বিক্রি হয়েছে, দাবাস খেজুর প্রতিকেজি ২০০-২২০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। ব্ল্যাক মরিয়ম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৮০০ টাকা। এক্ষেত্রে কেজিতে বেড়েছে ২০০ টাকা। সাদা মরিয়ম খেজুর বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৬০০ টাকা। এক্ষেত্রেও বেড়েছে কেজিতে ২০০ টাকা।
এছাড়া লুলু খেজুর, নাগাল, বারালি, ফরিদা, আলজেরিয়া, ইরাকি, তিউনিশিয়া এবং তিউনিশিয়া বোটাসহ সব ধরনের খেজুরে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। শেওড়াপাড়া বাজারের খেজুর বিক্রেতা রাহাত বলেন, আমি ১৫ দিন আগে পাইকারি খেজুর কিনেছি। তখনও বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে। এখন নতুন করে কিনতে গেলে বেশি দামে কিনতে হবে। ফলে খুচরা বাজারে কেজিতে ৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরাও জানান, পাইকারি বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা। বাজারে নতুন চাল উঠলেও আবারও বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। পারিজাত চাল কেজিতে ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৭-৪৮ টাকা। নাজিরশাইল চালে কেজিতে ৬ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫৪ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৮ টাকা। গুটি স্বর্ণা চালে ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা কেজি, যা আগে ছিল ৪৬ টাকা। বি আর-২৮ চালের ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকা কেজি, যা আগে ছিল ৪৮-৫০ টাকা। মিনিকেট চাল কেজিতে ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৬ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৩-৫৪ টাকা। চিনিগুড়া পোলাওয়ের চালের দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৮৫-৯০ টাকায়া, যা গত সপ্তাহে ছিল ৮০ টাকা। কারওয়ান বাজারের চাল বিক্রেতা বাচ্চু মিয়া জানান, বাজারে নতুন চাল বিআর-২৮ এবং মিনিকেট উঠেছে। কিন্তু তারপরও দাম কমছে না। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। খোলা চিনির দাম বেড়েছে আরেক দফা। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৭৩-৭৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৭০ টাকা। এক্ষেত্রে কেজিতে বেড়েছে ৩-৫ টাকা। তবে প্যাকেট চিনি বিক্রি হয়েছে গত সপ্তাহের (৭২ টাকা কেজি) দামেই। কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মামুন জানান, খোলা চিনি কিনতে গিয়েও ফিরে এসেছি। গত সপ্তাহে যে ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার ২০০ টাকায় কিনেছিলেন, সেই বস্তাই পাইকাররা নিচ্ছেন ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া রয়েছে পরিবহন খরচও। তিনি বলেন, পাইকারি ৭০ টাকা কেনা পড়লে কাস্টমারদের কাছে কত বিক্রি করব? তাছাড়া বাড়তি দাম নিলেও পাইকারি ব্যবসায়ীরা কোনো স্লিপ দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, নিলে নেও না নিলে নাই। এক্ষেত্রে মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। শেওড়াপাড়া বাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী সামদানির সঙ্গে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, রোজা রেখে ইবাদত বন্দেগি করব, নাকি জিনিসপত্রের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা করব?
বাজার মনিটরিং করা যাদের দায়িত্ব তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান? কারওয়ান বাজারে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষক তোফায়েল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজার জুড়ে অরাজকতা চলছে। ভিকটিম হচ্ছি আমরা। দাম বেড়েছে ইফতারি তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ বেসনের। বুটের ডালের বেসন বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৩০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১২০ টাকা। কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। অ্যাংকর ডালের বেসন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি, গত সপ্তাহে ছিল ৭০ টাকা। কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। বেগুনি তৈরির অন্যতম উপাদান লম্বা বেগুন বিক্রি হয়েছে ৬০-৭০ টাকা কেজি, গত সপ্তাহে ছিল ৪০-৫০ টাকা। এক্ষেত্রে কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। ধনেপাতা বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি, যা সপ্তাহে ছিল ৭০ টাকা। এক্ষেত্রে কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা। কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে বাজারভেদে ৫০ থেকে ৮০ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৩৫-৪০ টাকা। কেজিতে বেড়েছে ১৫-৪০ টাকা পর্যন্ত। শসা বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২০ টাকা। রমজানে শরবতের অন্যতম উপাদান লেবু বিক্রি হয়েছে প্রতি হালি ৩০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ২০ টাকা। মুড়ি বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৬৫ টাকা। চিড়া বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৪০-৪২ টাকা। আমদানি রসুন বিক্রি হয়েছে ২৮০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৩৫ টাকা। দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ১২০ টাকা। আদা বাজারভেদে বিক্রি হয়েছে ৮০-১০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৭০ টাকা। কারওয়ান বাজারের মুড়ি ব্যবসায়ী আহমেদ মিয়া বলেন, রোজা আসায় মুড়ির চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে।
ফলে দামও বেড়েছে। পাইকারি দাম বাড়ায় খুচরায়ও কিছুটা বেড়েছে। প্রত্যেক বছরই রোজার সময় এ রকম হয়। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৬০-১৬৫ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৫০ টাকা। লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৬৫ টাকা, সাদা লেয়ার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৪০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য মুরগির দামও কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। তবে গরু ও খাসির মাংস আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হয়। গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৪৮০-৫০০ টাকা কেজি, খাসির মাংস ৭৫০ টাকা, বকরির মাংস ৬৫০ টাকা। রাজধানীর মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজার কারণে নয়, সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বলছেন, রোজার মাস সামনে রেখে মানুষ প্রচুর মাছ কিনছেন, তাই ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কম থাকার অজুহাতে দাম বাড়িয়েছেন। মাছ ব্যবসায়ী শুকুর আলী জানান, ৭শ’ গ্রামের ইলিশ একজোড়া বিক্রি হয়েছে ১৬শ’ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১২শ’ টাকা। ৯শ’ গ্রাম ওজনের একজোড়া ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৪শ’ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৬শ’ টাকা। অন্য মাছের মধ্যে কই, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, সিলভারকাপ, বিভিন্ন আকারের গলদা চিংড়ি, বিভিন্ন আকারের রূপচাদা, রুই, কাতলা, নলা ও তেলাপিয়াসহ সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে বাজারভেদে কেজিতে ২০-৫০ টাকা।
No comments