এমপিদের ঘুম হারাম
সংসদীয় দলের বৈঠক এবং দলের বর্ধিত সভার পর ঘুম হারাম হয়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক এমপির। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাদের। সম্ভাব্য মনোনয়ন ‘বিপর্যয়’ কাটাতে মাঠে নেমে পড়েছেন তারা। ছুটছেন নিজ নিজ এলাকায়। দিন রাত অবিরাম চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী এলাকা। দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেতাদের সাথে। তবে বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে খানিকটা খুশি হলেও অতীত ভুলতে রাজি নন তৃণমূল নেতারা। আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত এমপিদের আবারো মনোনয়ন দেয়া হলে দেখে নেয়ার হুমকিও দিচ্ছেন অনেকে। দলের কেন্দ্রীয় এবং মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন এমন একাধিক সংসদ সদস্য তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, এমপিদের কাছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাওয়া-পাওয়ার কোনো সীমারেখা নেই। কিন্তু আমাদের মতা অসীম নয়, তাই সব চাওয়া পূরণ করা সম্ভব হয় না। আসলে সংসদ সদস্যদের জনপ্রিয় হওয়া অনেক কঠিন। সে জন্য মনোনয়ন পাওয়ার েেত্র তৃণমূলের কাছে জনপ্রিয়তাই একমাত্র মানদণ্ড হলে অনেক হেভিওয়েট নেতারই মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, গত ৭ মে অনুষ্ঠিত সংসদীয় দলের সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিদের কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনে কোনো এমপিকে বিজয়ী করে আনার দায়িত্ব আমি নেবো না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও কঠিন হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
কিন্তু আগামী নির্বাচনে আপনাদের নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হবে। এবার আমি কারও দায়িত্ব নিতে পারব না। যেই হোন না কেন, জনপ্রিয়তা না থাকলে মনোনয়ন দেবো না। আপনারা কে কী করছেন, প্রত্যেকের খতিয়ান আছে আমার কাছে। ছয় মাস পরপর তথ্য নিই। যার অবস্থা ভালো তাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। সংসদীয় দলের এ বৈঠকের পর গত ২০ মে বিশেষ বর্ধিত সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। গণভবনে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ সভায় দলের সাধারণ সম্পাদকসহ মন্ত্রী এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন তৃণমূল নেতারা। তারা বিভিন্ন জেলার রাজনৈতিক চিত্র, দলের ভেতরে বিভিন্ন অসঙ্গতি, এমপি-মন্ত্রীদের সাথে নেতাকর্মীদের দূরত্ব, দলের ভেতরে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। দলীয় মুখপাত্র নিয়েও কথা বলেন তৃণমূল নেতারা। এ সময় দলের ভেতরে আবারো খোন্দকার মেশতাকরা ঢুকে গেছে বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ। তারা অনৈক্যের কথা তুলে ধরে অবিলম্বে দলে শৃঙ্খলা এনে দিতে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি তোলেন। সভায় ময়মনসিংহ জেলা সভাপতি জহিরুল হক খোকা বলেন, আওয়ামী লীগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খোন্দকার মোশতাক ঢুকে গেছে। নেত্রী আপনি বারবার এসব মাফ করে দেন। ফলে অপরাধীরা সাহস সঞ্চয় করে। আর মাফ করবেন না। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে এমপিরা কি করছেন, সেই প্রশ্ন আসবে। সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সমালোচনা করে বলেন, এমপি-মন্ত্রীদের ঘিরে একটি বলয়ের সৃষ্টি হয়। ওই বলয়ের বাইরে তারা আসতে পারেন না। খুলনা জেলা সভাপতি হারুন উর রশীদ এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমপিরা নির্বাচিত হয়ে বলয়ের বাইরে যেতে পারেন না। আর বলয়ের কারণে অমুককে তমুককে দিয়ে কমিটি দেয়া হয়। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হন।
তারা কাদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের ঢুকছেন তা তদন্ত করে দেখতে হবে। এগুলো শক্ত হাতে দমন না করলে আমার মতো আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতারা টিকে থাকতে পারবেন না। সিলেট মহানগর সভাপতি বদরুদ্দিন কামরান বলেন, আমাদের সিলেট বিভাগে মোট ১৯টি আসন। সেখানে যারা বিজয়ী হয়েছেন তাদের বিজয়ী করতে তৃণমূলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর ঘাম ঝরেছে। কিন্তু বিজয়ী হয়ে সেসব এমপির সাথে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় আগামীতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। চট্টগ্রাম দণি জেলার সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, আমাদের সরকারের টানা দুই মেয়াদে মতায় থাকার ফলে যে উন্নয়ন হয়েছে সে হিসাবে আমরা জাগরণ সৃষ্টি করতে পারিনি। এমপিদের সাথে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সৃষ্ট দূরত্ব কাটিয়ে তুলতে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। পরে সবার বক্তব্য শুনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা আবারো এমপিসহ নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে তৃণমূলকে নিয়ে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেন। তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর এই সতর্কতায় ব্যাপক উজ্জীবিত হলেও দলের এমপিদের ভেতরে দুশ্চিন্তা ভর করেছে। আগামী নির্বাচনে দলের টিকিট কপালে জুটবে কি না তা নিয়ে ব্যাপক টেনশনে রয়েছেন অভিযুক্তরা। দলটির তৃণমূলের নেতারা জানান, এমপিদের দেয়া আওয়ামী লীগ সভাপতির সতর্কবার্তায় উজ্জীবিত তারা। জেলাপর্যায়ের বেশ কিছু নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন,
‘তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ নেতাকর্মীদের সাথে সময় দেয়া দূরে থাক, অনেক সংসদ সদস্য ঢাকা ছেড়ে এলাকায় আসেননি গত তিন বছর। দলের নেতাকর্মীদের জেলে বন্দী হওয়ার পেছনেও অনেক এমপির ষড়যন্ত্র আছে। দুই ডজনেরও বেশি জেলায় পাওয়া যাবে এমন নজির। এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিভাগের একটি জেলার সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তৃণমূল নেতাদের সাথে সংসদ সদস্যদের দূরত্ব রয়েছে। এমপিরা নিজেদের একটি বলয় তৈরি করে সেটি নিয়েই ব্যস্ত। তারা মাঠ নেতাকর্মীদের খবরই রাখেন না। আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন দেয়া হলে যত কঠোর নির্দেশনাই থাকুক নেতাকর্মীদের মাঠে পাবেন না। তবে নির্বাচনের আগে এমপিদের প্রতি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সতর্কবার্তা তৃণমূলকে সত্যিই উজ্জীবিত করেছে। তার হুঁশিয়ারি দলকে ঐক্যবদ্ধ করার েেত্র সহায়ক হবে। সংসদ সদস্যদের প্রতি দলীয় প্রধানের হুঁশিয়ারি বার্তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন লক্ষ্মীপুর, শেরপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। তাদের আশা, তৃণমূলকে প্রাধান্য দিয়ে শেখ হাসিনার সতর্কবার্তা নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে। এ দিকে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিমূলক বক্তব্য প্রায় সব এমপিকেই দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। মনোনয়ন নিশ্চিত করতে নিজ নিজ এলাকামুখী হয়েছেন তারা।
শুধু শুক্র, কিংবা শনিবারই নয় যেকোনো কর্মদিবসে তারা যাচ্ছেন এলাকায়। চষে বেড়াচ্ছেন মাঠঘাট। নেতাকর্মীদের মন জয় করে মনোনয়ন পেতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন তারা। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন নিয়মিত। গত তিন দিনে এ রকম অনেক এমপির খবর পাওয়া গেছে যারা নিজ নিজ এলাকায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, সংসদীয় দলের সভায় এমপিদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে যার যার কর্মফল মনোনয়নের েেত্র ভূমিকা রাখবে। এতে তার কিছু করার নেই। যে জনপ্রিয় সে মনোনয়ন পাবে। দলীয় সভাপতির বক্তব্য অনেকের ভেতরে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি মানুষের জন্য, তাই মানুষের সংস্পর্শে যেসব এমপি আছেন, যারা এলাকায় কাজ করেছেন তারাই আবার মনোনয়ন পাবেন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মনোনয়ন পাওয়ার েেত্র তৃণমূলে জনপ্রিয়তাকে ধরা হবে অন্যতম মাপকাঠি। এটাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। তার সাফ কথা, জনবিচ্ছিন্ন কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না আগামী নির্বাচনে। এই হুঁশিয়ারি অনেক এমপির মধ্যে দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। তবে যারা ভালো কাজ করেছেন তাদের পুরস্কারও নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেবেন।
No comments