নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনীতিতে ঘটতে শুরু করেছে নানা মেরুকরণ। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার তৃতীয় বছর পার করার পর ক্ষমতাসীন দলের এখন মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার। ক্ষমতা ধরে রাখার এই পথে তারা প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে যেমন দুর্বল মনে করছে, তেমনি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানও তাদের তাড়া করে ফিরছে। পরবর্তী নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার কোনো অন্ত নেই। ৫ জানুয়ারির মতো আগামী নির্বাচনও একতরফা হতে পারে, এমন আশঙ্কা বিরোধী দলগুলোর। নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা কিংবা সমঝোতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সরকারি দল ক্ষমতায় টিকে থাকতে তৎপর। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার প্রথম দুই বছর কিছুটা টালমাটাল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও সরকার এখন বেশ শক্তিশালী বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সম্ভাবনা রয়েছে আগাম নির্বাচনেরও। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর যেমন প্রাধান্য পাচ্ছে, তেমনি হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের ‘সমঝোতা’, আগামী দিনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জাতীয় পার্টিকে ঘিরে নতুন জোট গঠনের বিষয়টি উঠে আসছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ঘটনার সাথে পরোক্ষভাবে আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষিত জড়িত রয়েছে।
২০০৯ সালে এক-এগারোর সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। দলটির এ ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট অতীতের সাথে বিস্তর ব্যবধান তৈরি করেছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দলটি চিরাচরিত প্রথা ও ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে একটি সেকুলার বলয় তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ ধারায় তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও শক্তি। পাশাপাশি মডারেট রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বিএনপিকেও তারা ঘোরতর প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। এর ফল যা দাঁড়ায়, তাতে আওয়ামী লীগ বিরোধী মত ও শক্তির সমর্থক কাউকেই বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে চায়নি। গত আট বছরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে বাম ও সেকুলার শক্তি ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতার খুদকুঁড়া দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে জোরদারভাবে, যদিও জাতীয় পার্টি জাতীয় রাজনীতিতে কার্যত গুরুত্বহীন। আওয়ামী লীগের এ নতুন যাত্রায় অতীতের আন্দোলনের সাথী কিংবা গণতান্ত্রিক সহযোদ্ধা কেউই কদম মেলাতে পারেনি। দলটির রাষ্ট্র পরিচালনাও ছিল বেশ চমকপ্রদ। ভিন্ন মতের কাউকেই ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। বাকস্বাধীনতা, নির্বাচন এবং ঘরে-বাইরে রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল নিয়ন্ত্রণাধীন। উন্নয়নের নতুন রাজনীতির স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে। এ অবস্থায় সরকারের সমালোচনার সব মেশিনারি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার মিত্রদের সাথে নিয়ে সরকারের প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার বিষয়টি মানতে পারেনি। ২০১৩ ও ১৪ সালে প্রবল আন্দোলন শুরু হলে বিএনপি জোট ধরেই নিয়েছিল সরকার টিকছে না। কিন্তু সরকার নিজেদের অধীনেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। ১৫৩ আসনে বিনা নির্বাচনে দলীয় জনপ্রতিনিধি ঘোষণা দিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেয়া হয়। ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনকে সাময়িকভাবে মেনে নেয়ার জন্য বিএনপির ওপর আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রবল চাপ তৈরি করা হয়। আন্দোলন থেকে বিএনপিকে ঘরে ফেরার শর্তে যত দ্রুত সম্ভব উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের আশ্বাস দেয়া হয়। রাজনীতির এই কূটকৌশলের ফাঁদে পড়ে বিএনপি জোট। ফলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। সরকার এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলকে ঘরছাড়া, মাঠছাড়া করে ফেলে। গত তিন বছরে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে সরকার বিরোধী দলকে আরো কোণঠাসা করে। কিন্তু রাজনীতির এই সহজ হিসাবের মধ্যেও সরকারি দল নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পাারেনি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে জনমতের বিরূপ প্রতিফলন হওয়ায় সরকার বিগড়ে যায়। আন্তর্জাতিক মহলও দেশের উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব, দমন-পীড়ন, সুশাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সুনাম রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সে সুনাম ুণœ হতে থাকে।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। সেকুলার শক্তির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা সরকারকেও জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করেন। বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমানে সমান। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোটারই ক্ষমতার রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। এই প্রায় ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ওপর অনেকটাই নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়া-না-যাওয়ার বিষয়টি। এ ভোটের ওপর রয়েছে ইসলামি শক্তির ব্যাপক প্রভাব। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন শুধু সেকুলার শক্তির সাথেই নয়, সরকার ইসলামি এই শক্তির সাথেও সমঝোতায় যেতে চায়, যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে হেফাজতে ইসলামকে কাছে টানার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিজেদের পূর্বাবস্থান থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতে সরে আসায় রাজনীতিতে অনেক বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সরকার। কেননা যে বাম ও সেকুলার শক্তির ওপর নির্ভর করে তারা আট বছর পাড়ি দিয়েছে, সেই শক্তি বিগড়ে গেছে। সরকারের ভেতরে থেকেও তারা সমালোচনা শুরু করেছে, যদিও জনসমর্থনের দিক থেকে এরা বিচ্ছিন্ন। সরকার এখন সেকুলার ও ইসলামপন্থী শক্তির মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে। রাজনীতির এই দ্বৈত মেরুকরণে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে সরকারকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি যেমন মাথায় রাখতে হচ্ছে, ঠিক তেমনি তৃতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হওয়ার বিষয়টিও ভাবতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপিও নির্বাচনের আগে এখনকার মতো স্তিমিত হয়ে বসে থাকবে না, তার হিসাবও কষতে হচ্ছে।
No comments