‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর’
আমাদের জাতীয় জীবনের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো আমরা বরং ঘটা করে পালন করি। গণমাধ্যমেও প্রচার পায় ভালো। দলীয় নেতা-কর্মীদের উৎসাহও প্রচুর। অথচ যেসব দিন জাতির ইতিহাসে মাইলফলক, স্বর্ণাক্ষরে লেখা, সেগুলোর তাৎপর্য নিয়ে সাধারণের মধ্যে এবং একাডেমিক পর্যায়ে আলোচনা-গবেষণা যথেষ্ট নয়। সে রকম একটি দিন ১৭ এপ্রিল। একাত্তরের সেই ভয়াবহ সময়ে ওই দিনটির ঘটনাপ্রবাহ যারা স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা থেকে শুনেছেন এবং শুনে যেভাবে শিহরিত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তার বর্ণনা এখন কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা নামক স্থান, যার নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর’, সেখান থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ঘোষণা করেন ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এবং নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী ঐকান্তিকতা দ্বারা বাংলাদেশের এলাকায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।’ সেই অমূল্য ঐতিহাসিক ঘোষণায় আরও বলা হয়েছিল, ‘জনগণ কর্তৃক আমাদের উপর অর্পিত নির্দেশের প্রতি, যাহাদের নির্দেশই চূড়ান্ত, সশ্রদ্ধ অনুগত থাকায় আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আমাদের নিজেদেরকে লইয়া যথাযথভাবে সংবিধান রচনার গণপরিষদ গঠন করিলাম।’ বঙ্গবন্ধুকে সামরিক জান্তা গ্রেপ্তার করে পঁচিশে মার্চ রাতেই পাকিস্তানে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে অজ্ঞাত কারাগারে বন্দী রাখে। কিন্তু তার উপস্থিতিতেই হোক বা অনুপস্থিতিতেই হোক, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার ‘ঘোষণাপত্রে’ বলা হয়েছিল, ‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি এবং সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে-সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন।’ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এখন সেখানে অনেক কিছুই হয়েছে, কিন্তু আগে ওই জায়গাটিতে গেলে রোমাঞ্চিত হতে হতো। সেই আমবাগান যেন কথা বলত। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমি কয়েকবার হেলিকপ্টারে মুজিবনগরের আম্রকাননে গিয়েছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই স্থানটি অনন্য। অনেক বছর যাইনি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মুজিবনগর কমপ্লেক্সকে মনোরম করে গড়ে তুলেছে। পর্যটকেরা সেখানে প্রতিদিনই যান। হয়তো এখন দেখলে আমার অন্য রকম লাগবে। সেদিন আম্রকানন দেখে যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছি, এখন তা হবে না।
আমি অনেকবার টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছি, আমরা তাজউদ্দীনের অস্থায়ী সরকারকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বলে থাকি বটে, কিন্তু ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণ করা যে সরকার, সেটি আক্ষরিক অর্থে ‘প্রবাসী সরকার’ ছিল না। কারণ হিসেবে আমার যুক্তি হলো, যত প্রত্যন্ত জায়গাটিতেই হোক, ওই সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই শপথ নিয়েছিল। পরে তা পরিস্থিতির কারণে কলকাতার থিয়েটার রোডে গিয়ে অস্থায়ী কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে ভাষণ দেন, তার ঐতিহাসিক মূল্য বিরাট। তিনি তাঁর দীর্ঘ বেতার ভাষণে বলেছিলেন: ‘আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে আমরা তিতুমীর সূর্য সেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রান্ত হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্যে হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বোমারু বিমানের মোকাবিলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।’ স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন ও বেগম তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমি তাঁদের কাপাসিয়ার বাড়িতে গিয়ে এক রাত ছিলাম। অনেক কথা হতো। সুলিখিত বেতার ভাষণটির প্রসঙ্গেও কথা হয়েছে। উঠানে চেয়ারে বসে জোছনারাতে তাজউদ্দীন সাহেব বলেছেন, কর্মকর্তাদের দিয়ে তিনি ভাষণ লেখাতেন না। নিজের হাতে লিখতেন। ওই ভাষণ রচনায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের স্পিরিটকে গ্রহণ করেছিলেন, সে জন্যই স্বাধীনতার কথাও ছিল, মুক্তির কথাও ছিল। দীর্ঘস্থায়ী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন জাতিকে যাবতীয় বিষয় বিস্তারিতভাবে অবগত করেছিলেন। সুলিখিত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারে নির্মিত আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালির কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার এক পৈশাচিক উন্মত্ততায় মত্ত। আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। এ সমস্ত অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল বিদেশী শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য—বাংলার নিষ্পাপ শিশুদেরকে ও নিরপরাধ নরনারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্য নিশ্চয়ই এ অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি।’ আমেরিকা, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ব্রিটেনের প্রতি তাদের নাম না নিয়ে তিনি এ কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সমস্ত দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যারা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবেন না, এ বিশ্বাস আমাদের আছে।’ এই বক্তব্যে তিনি চীনকে ইঙ্গিত করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘আজ প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতাসংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বীর বাঙালি যোদ্ধারা এই স্বাধীনতাসংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাদের কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমরকৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে বাংলার এই মুক্তিবাহিনীকে শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’
তিনি বলেছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার কথাও। তাঁর ভাষায়, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের উপর। নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবল মুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে “মুক্ত এলাকা” বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লাহর উপর।...দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইপিআর-এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশোহর জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশোহর ক্যান্টনমেন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের উপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীর।’ সেদিনের অস্থায়ী সরকার গঠন এবং তার শপথ গ্রহণ বিশ্ববাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছিল। সে বার্তা হলো: জাতি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, অস্থায়ী সরকারপ্রধান জানিয়ে দেন যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃত্ব এক। আরও পরিষ্কার করে বলে দেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে সামরিক নেতৃত্ব কাজ করছে। এবং তাদের সঙ্গে রয়েছে জনগণ। তাজউদ্দীন তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন, যত দিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যত দিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, তত দিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে।’ সেদিন তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ বলে। শব্দব্যবহারে তাজউদ্দীন ছিলেন খুবই সতর্ক। এর মধ্যে ওই ১৭ এপ্রিলই পাকিস্তানের আরেক বিপর্যয় ঘটে। কলকাতায় তাদের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী তঁাদের অর্থ তহবিলসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দূতাবাস ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। দিল্লির হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কে এম শেহাবুদ্দিন তার আগে ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। অস্থায়ী সরকারের নেতাদের মধ্যে এবং সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে নানা সময় অনৈক্য ও বিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের হস্তক্ষেপে ও মধ্যস্থতায় সে বিরোধ মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি করতে পারেনি। এক দিন পর অস্থায়ী সরকার একটি ‘নির্দেশাবলী’ প্রচার করে। কলকাতা থেকে সেটা মুদ্রিত হয়েছিল, কিন্তু তার কপি বাংলাদেশের ভেতরে ছেপে প্রচার করা হয়। তার ওপরে লেখা ছিল, ‘আল্লাহু আকবর—স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী’। তাতে বলা হয়েছিল, ‘বাঙালীকে শোষণমুক্ত করে একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবার দৃপ্ত শপথ ও ব্রত নিয়ে বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও নেতৃত্বে গত ১২ই এপ্রিল রাত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে।’ ১০টি নির্দেশ শেষ করা হয় পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের অংশ দিয়ে, ‘“অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর”। বিশ্বাস রাখুন, “আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।”’
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
তিনি বলেছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার কথাও। তাঁর ভাষায়, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের উপর। নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবল মুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে “মুক্ত এলাকা” বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লাহর উপর।...দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইপিআর-এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশোহর জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশোহর ক্যান্টনমেন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের উপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীর।’ সেদিনের অস্থায়ী সরকার গঠন এবং তার শপথ গ্রহণ বিশ্ববাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছিল। সে বার্তা হলো: জাতি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, অস্থায়ী সরকারপ্রধান জানিয়ে দেন যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃত্ব এক। আরও পরিষ্কার করে বলে দেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে সামরিক নেতৃত্ব কাজ করছে। এবং তাদের সঙ্গে রয়েছে জনগণ। তাজউদ্দীন তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন, যত দিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যত দিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, তত দিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে।’ সেদিন তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ বলে। শব্দব্যবহারে তাজউদ্দীন ছিলেন খুবই সতর্ক। এর মধ্যে ওই ১৭ এপ্রিলই পাকিস্তানের আরেক বিপর্যয় ঘটে। কলকাতায় তাদের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী তঁাদের অর্থ তহবিলসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দূতাবাস ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। দিল্লির হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কে এম শেহাবুদ্দিন তার আগে ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। অস্থায়ী সরকারের নেতাদের মধ্যে এবং সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে নানা সময় অনৈক্য ও বিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের হস্তক্ষেপে ও মধ্যস্থতায় সে বিরোধ মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি করতে পারেনি। এক দিন পর অস্থায়ী সরকার একটি ‘নির্দেশাবলী’ প্রচার করে। কলকাতা থেকে সেটা মুদ্রিত হয়েছিল, কিন্তু তার কপি বাংলাদেশের ভেতরে ছেপে প্রচার করা হয়। তার ওপরে লেখা ছিল, ‘আল্লাহু আকবর—স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী’। তাতে বলা হয়েছিল, ‘বাঙালীকে শোষণমুক্ত করে একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবার দৃপ্ত শপথ ও ব্রত নিয়ে বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও নেতৃত্বে গত ১২ই এপ্রিল রাত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে।’ ১০টি নির্দেশ শেষ করা হয় পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের অংশ দিয়ে, ‘“অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর”। বিশ্বাস রাখুন, “আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।”’
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
No comments