মৌলবাদের আর্থিক ভিত্তি
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জনকল্যাণকামী রাজনৈতিক শক্তির কাক্সিক্ষত বিকাশ ত্বরান্বিত হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতায় ঘুরেফিরে এসেছে স্বৈরতন্ত্র অথবা কালো টাকার স্বার্থবাহী সংসদ। দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে অর্থনীতি, আর তা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কার্যকর চাহিদা বৃদ্ধি করেছে। অর্থনীতি ও রাজনীতির এ দুর্বৃত্তায়নের হোতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পরসম্পদ লুণ্ঠনকারী-পরজীবীদের দলূ Rent Seekers, যারা আবার সরকার ও রাজনীতিকে তাদের অধীন দাস-সত্তায় পরিণত করেছে। এসবই বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির মর্মবস্তু। আমাদের দেশে রেন্ট-সিকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নির্দেশকসমূহ হল : গত চার দশকে (১৯৭৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশে সরকারিভাবে যে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণ-অনুদান এসেছে তার ৭৫ শতাংশ লুট করেছে দুর্বৃত্তরা (যাদের সংখ্যা আসলে ২ লাখ আর পরিবার-পরিজনসহ ১০ লাখ মানুষ); এরা এখন বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি করে (যার ক্রমপুঞ্জীভূত পরিমাণ হবে ৬-৭ লাখ কোটি টাকা), এরাই বছরে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অবৈধ অর্থ স্থানান্তর/পাচারের (money laundering) সঙ্গে সম্পৃক্ত; এরাই বছরে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত; এরাই কমপক্ষে ১ লাখ কোটি টাকার ঋণখেলাপি; এরাই সব ধরনের বড় মাপের অবৈধ অস্ত্র ও ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত; এরা দেশের কমপক্ষে দেড় কোটি বিঘা খাস জমি ও জলাভূমি অবৈধভাবে দখল করে আছে; এরাই উপকূলীয় অঞ্চলে বৃহৎ চিংড়িঘের ও ব্যাক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে; যে কোনো সরকারি কেনাকাটায় (মূলত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায়) অথবা বড় ধরনের বিনিয়োগে এদেরকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় ইত্যাদি।
আর রেন্ট-সিকার নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বহিঃপ্রকাশ বহুমুখী- অর্থনীতির দুর্বৃত্তরা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান এমনভাবে দখল করেন যেখানে সংবিধানের বিধি মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালন অসম্ভব। তারা মূল ধারার ক্ষমতার রাজনীতি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান-ব্যাক্তিকে ফান্ড করেন; তারা ঘুষ-দুর্নীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন; তারা রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ নির্ধারণ ও তা ভোগ করার বন্দোবস্ত করেন; তারা লুট করেন সবকিছুূ জমি, পানি, বাতাস এমনকি বিচারের রায়; এবং তারাই বিচারহীনতার সংস্কৃতির ধারক-বাহক-প্রভাবক-ত্বরান্বয়ক-উজ্জীবক। তারা ধর্মের লেবাস যত্রতত্র ব্যবহার করেনূ স্ব-ধার্মিকতা প্রদর্শনে হেন কাজ নেই যা তারা করেন না; এরা অর্থ-প্রতিপত্তি দিয়ে জাতীয় সংসদের আসন কিনে ফেলেনূ তারা জানেন স্থানভেদে ৫ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জাতীয় সংসদের একটি আসন ক্রয়-বিক্রয় সম্ভব এবং সেটা রীতিমতো চর্চা করেন। অর্থনীতি ও রাজনীতির এসব দুর্বৃত্তদের প্রতি মানুষের আত্মার গভীরে অনাস্থা আছে; মানুষের সামনে এখন আর রাজনৈতিক 'role model' বলে কিছু নেইূ এসব প্রবণতা যে হতাশা-নিরাশা সৃষ্টি করেছে, সেগুলোই হয়ে দাঁড়িয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের সংগঠন বিস্তৃতির সহায়ক উপাদান। প্রধানত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে মানুষ তথাকথিত গণতন্ত্রী রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন-হারিয়েছেন, আর প্রগতির ধারাও, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকশিত হয়নি-হচ্ছে না। মানুষ যখন ক্রমাগত বিপন্ন হতে থাকেন, হতে থাকেন হতাশ ও নিরাশ, মানুষ যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা হারান এবং আস্থাহীনতা যখন নিয়মে পরিণত হয় তখন ব্যাপক সাধারণ মানুষ উত্তরোত্তর অধিক হারে নিয়তিনির্ভর-ভাগ্যনির্ভর হতে বাধ্য হন। আর এ নিয়তিনির্ভরতা বাড়ছে কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে, যেখানে ৬০ ভাগ কৃষকই এখন ভূমিহীন, যে কৃষি ভিত্তির ওপরই এদেশে বিকশিত হয়েছে ধর্ম।
এ ভ্যাকুয়াম-টাই ব্যবহার করছে মৌলবাদী রাজনীতি। তারা অতীতে চোখের সামনে দেখেছেন কেমন করে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এমনকি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকাল গণতন্ত্র চর্চার স্থান ভারতেও দু’চারটে সংসদ আসন দখল করে ১০/১৫ বছর পরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল এবং মানুষ এই এখনও অনুরূপ দৃশ্য লক্ষ করছেন। অন্যান্য অনেক উদাহরণসহ এটাও বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে আরোহনে তাদের স্বপ্নকে বাস্তব করবে বলে তারা মনে করে। আর তারা স্পষ্ট জানে, দলীয় রাজনীতিকে স্বয়ম্ভর করতে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক শক্ত ভিত প্রয়োজন। অন্যথায় ক্যাডারভিত্তিক দল গঠন ও পরিচালন এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের মডেল চর্চা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এখন ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির সহায়তায় মৌলবাদ যেসব আর্থ-রাজনৈতিক মডেলের তুলনামূলক কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, তার মধ্যে ১২-টি বৃহৎ বর্গ হল নিম্নরূপ : ১. আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩. ওষুধ শিল্প ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, ৪. ধর্ম প্রতিষ্ঠান, ৫. ব্যবসায়িক-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, ৬. যোগাযোগ-পরিবহন ব্যবস্থা সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান, ৭. জমি ও রিয়েল এস্টেট, ৮. সংবাদ মাধ্যম ও তথ্য প্রযুুক্তি, ৯. স্থানীয় সরকার, ১০. বেসরকারি সংস্থা, ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন, ১১. ইসলামি জঙ্গি সংগঠন (যেমন বাংলাভাই, জেএমবি, হুজি-বি এবং অনুরূপ কর্মসূচিভিত্তিক সংগঠন/সংস্থা/গ্রপ); এবং ১২. কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সমিতির কর্মকাণ্ড কেন্দি ক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই আনুষ্ঠানিক অর্থে মুনাফা অর্জনযোগ্য নয় (যেমন স্থানীয় সরকার ও পেশাজীবী সমিতি)। এক্ষেত্রে ক্রস-ভর্তুকি দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে মুনাফা-অযোগ্য প্রতিষ্ঠানেও তারা উচ্চ মুনাফা করেন (যেমন বাংলাভাই জাতীয় প্রকল্প যেখানে ভূমি খাজনা, চাঁদাবাজি প্রতিষ্ঠা করা হয়; এমনকি কোনো কোনো অঞ্চলে মাদ্রাসাতেও অত্যুচ্চ মুনাফা অর্থাৎ বছর শেষে ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হয়)। মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ব্যবহার করে আপাতদৃষ্টিতে মুনাফাঅযোগ্য প্রতিষ্ঠানে মুনাফা সৃষ্টির নিরঙ্কুশ তুলনামূলক সুবিধা (absolute comparative advantage) তাদের আছে।
মৌলবাদের অর্থনীতির উল্লিখিত মডেলগুলোর ব্যবস্থাপনা-পরিচালন কৌশল সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি-কৌশল থেকে অনেক দিক থেকে ভিন্ন। তাদের অর্থনৈতিক মডেল পরিচালন কৌশলের অন্যতম কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
১. প্রতিটি মডেলই রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ উচ্চমানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক রাজনৈতিক লক্ষ্যার্জনে নিয়োজিত।
২. প্রতিটি মডেলে বহুস্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যেখানে নির্দিষ্ট স্তরের মূল নীতি-নির্ধারণী কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনস্থ।
৩. বিভিন্ন মডেলের মধ্যে কো-অর্ডিনেশন থাকলেও উচ্চস্তরের কো-অর্ডিনেটরদের পরস্পর পরিচিতি যথেষ্ট গোপন রাখা হয় (এক ধরনের গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি বলা চলে)।
৪. প্রতিটি মডেলই সামরিক শৃংখলার আদলে পরিচালিত সুসংবদ্ধ-সুশৃংখল ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠান।
৫. কোনো মডেল যখনই আর্থ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে অন্য মডেলের তুলনায় অধিক ফলপ্রদ মনে করা হয়, তখনই তা যথাসাধ্য দ্রুত অন্যস্থানে বাস্তবায়িত (replicate) করা হয়। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, মৌলবাদীরা তাদের অর্থনৈতিক মডেল বাস্তবায়নে ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে’ রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ সচেতন এবং তা বাস্তবায়নে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে তারা তাদের মতো করে ঢেলে সাজাতে সচেষ্ট। এ থেকে এও প্রতীয়মান হয় যে, মৌলবাদীর মূলে আছে ভীতি ও আবেগ। আর এ আবেগ আসে ক্রমবর্ধমান অসমতা থেকে, তথাপি এসব আবেগানুভূতি কেবল সেকেলে এবং পিছুটান নয় বরং তারা সৃজনশীল ও ‘আধুনিকতা’র ধারক বাহকও। অনেকেই মনে করেন এ দেশে সশস্ত্র জঙ্গি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনে সব অর্থ বিদেশ থেকেই পেয়ে থাকে। এ ধারণা বহুলাংশে মিথ্যা হতে পারে, যদিও সম-মতাদর্শী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তাদের যৌথ উদ্যোগের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। আর সেই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি সংস্থাসমূহের অনুদানের বড় অংশ বিদেশ থেকেই আসে। উল্লিখিত ধারণা বহুলাংশে সত্য নয় এজন্য যে, মৌলবাদ ইতিমধ্যে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক শক্ত ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আর এসব ঘটনা যে প্রক্রিয়ায় যেভাবে ঘটেছে এবং ঘটছে তা হল এরকম- উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বাহক শক্তিটি ১৯৭১-এর মু্িক্তযুদ্ধে জনগণের সম্পদ হরিলুট করেছে এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনে ১৯৭০-৮০-র দশকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক অর্থ সরবরাহ পেয়েছে; এসব অর্থসম্পদ তারা সংশ্লিষ্ট আর্থ-রাজনৈতিক মডেল গঠনে বিনিয়োগ করেছে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিনিয়োজিত প্রতিষ্ঠান উচ্চ মুনাফা করছে;
মৌলবাদের অর্থনীতির উল্লিখিত মডেলগুলোর ব্যবস্থাপনা-পরিচালন কৌশল সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি-কৌশল থেকে অনেক দিক থেকে ভিন্ন। তাদের অর্থনৈতিক মডেল পরিচালন কৌশলের অন্যতম কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
১. প্রতিটি মডেলই রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ উচ্চমানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক রাজনৈতিক লক্ষ্যার্জনে নিয়োজিত।
২. প্রতিটি মডেলে বহুস্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যেখানে নির্দিষ্ট স্তরের মূল নীতি-নির্ধারণী কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনস্থ।
৩. বিভিন্ন মডেলের মধ্যে কো-অর্ডিনেশন থাকলেও উচ্চস্তরের কো-অর্ডিনেটরদের পরস্পর পরিচিতি যথেষ্ট গোপন রাখা হয় (এক ধরনের গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি বলা চলে)।
৪. প্রতিটি মডেলই সামরিক শৃংখলার আদলে পরিচালিত সুসংবদ্ধ-সুশৃংখল ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠান।
৫. কোনো মডেল যখনই আর্থ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে অন্য মডেলের তুলনায় অধিক ফলপ্রদ মনে করা হয়, তখনই তা যথাসাধ্য দ্রুত অন্যস্থানে বাস্তবায়িত (replicate) করা হয়। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, মৌলবাদীরা তাদের অর্থনৈতিক মডেল বাস্তবায়নে ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে’ রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ সচেতন এবং তা বাস্তবায়নে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে তারা তাদের মতো করে ঢেলে সাজাতে সচেষ্ট। এ থেকে এও প্রতীয়মান হয় যে, মৌলবাদীর মূলে আছে ভীতি ও আবেগ। আর এ আবেগ আসে ক্রমবর্ধমান অসমতা থেকে, তথাপি এসব আবেগানুভূতি কেবল সেকেলে এবং পিছুটান নয় বরং তারা সৃজনশীল ও ‘আধুনিকতা’র ধারক বাহকও। অনেকেই মনে করেন এ দেশে সশস্ত্র জঙ্গি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনে সব অর্থ বিদেশ থেকেই পেয়ে থাকে। এ ধারণা বহুলাংশে মিথ্যা হতে পারে, যদিও সম-মতাদর্শী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তাদের যৌথ উদ্যোগের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। আর সেই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি সংস্থাসমূহের অনুদানের বড় অংশ বিদেশ থেকেই আসে। উল্লিখিত ধারণা বহুলাংশে সত্য নয় এজন্য যে, মৌলবাদ ইতিমধ্যে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক শক্ত ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আর এসব ঘটনা যে প্রক্রিয়ায় যেভাবে ঘটেছে এবং ঘটছে তা হল এরকম- উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বাহক শক্তিটি ১৯৭১-এর মু্িক্তযুদ্ধে জনগণের সম্পদ হরিলুট করেছে এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনে ১৯৭০-৮০-র দশকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক অর্থ সরবরাহ পেয়েছে; এসব অর্থসম্পদ তারা সংশ্লিষ্ট আর্থ-রাজনৈতিক মডেল গঠনে বিনিয়োগ করেছে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিনিয়োজিত প্রতিষ্ঠান উচ্চ মুনাফা করছে;
আর এ মুনাফার একাংশ তারা ব্যয় করছে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে, একাংশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রসারে, আর (কখনও কখনও) একাংশ নতুন খাত-প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে। আমার ২০১৫ সালের হিসাবে বাংলাদেশে মৌলবাদের অর্থনীতির বার্ষিক নিট মুনাফা আনুমানিক ২,৮৭৪ কোটি টাকা (প্রায় ৩৭ কোটি মার্কিন ডলার; যেখানে বিনিময় হার ১ ডলার = ৭৮.৪০ টাকা)। এ মুনাফার সর্বোচ্চ ২৭.৮ শতাংশ আসে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে (ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি ইত্যাদি); দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯.৪ শতাংশ আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাসহ ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন থেকে; বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে আসে ১০.৬ শতাংশ; ওষুধ শিল্প ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে আসে ১০.০ শতাংশ; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসে ৯.৪ শতাংশ; জমিসহ রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে আসে ৮.০ শতাংশ, সংবাদ মাধ্যম ও তথ্যপ্রযু্িক্ত থেকে আসে ৭.৪ শতাংশ, আর পরিবহন-যোগাযোগ ব্যবসা থেকে আসে ৭.৪ শতাংশ। নিট মুনাফার এ প্যাটার্ন কিছুটা অনুমাননির্ভর হলেও যথেষ্ট দিক নির্দেশনামূলকূ অর্থাৎ খাত-প্রতিষ্ঠানওয়ারি মৌলবাদের অর্থনীতির বিকাশধারা নির্দেশে যথেষ্ট সহায়ক। সেই সঙ্গে মৌলবাদের অর্থনীতির খাত-প্রতিষ্ঠানওয়ারি নিট মুনাফার যে ধারা দেখা যায়, তা মূল স্রোতের অর্থনীতির সঙ্গেও যথেষ্ট সাযুজ্যপূণর্, যেখানে ইতিমধ্যেই রেন্ট সিকিং উদ্ভূত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নিয়ামক ভূমিকায় অবতীর্ণ। বাংলাদেশে মৌলবাদের অর্থনীতি যদি বছরে ২,৮৭৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা সৃষ্টি করে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে অর্থনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ মাত্রা (degree of communalization of economy)- যা মৌলবাদের অর্থনীতির শক্তি-মাত্রা নির্দেশ করেূ হবে নিম্নরূপ:
১. দেশের মোট বার্ষিক জাতীয় বিনিয়োগের (চলতি মূল্যে) ১.০২ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
২. দেশের মোট বার্ষিক বেসরকারি বিনিয়োগের ১.৩১ শতাংশের এর সমপরিমাণ, অথবা
৩. সরকারের মোট বার্ষিক রাজস্ব আয়ের ২.১ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
৪. দেশের বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ১.৫৪ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
৫. সরকারের মোট বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের ৫.৫৮ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
৬. সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের অভ্যন্তরীণ সম্পদের ৮.৬২ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা বিগত চল্লিশ বছরে (১৯৭৫-২০১৫) মৌলবাদের অর্থনীতি সৃষ্ট ক্রমপুঞ্জীভূত নিট মুনাফার মোট পরিমাণ হবে বর্তমান বাজারমূল্যে কমপক্ষে ২ লাখ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে বিকাশ-বিস্তৃতির সম্ভাবনা নির্দেশে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, যেহেতু মৌলবাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (গত ২০ বছরের হিসাবে বার্ষিক গড়ে ১০ শতাংশ) মূল স্রোতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের (গত ২০ বছরের হিসাবে বার্ষিক গড়ে ৫ শতাংশ) তুলনায় অধিক (শুধু অধিক নয়, দ্বিগুণ বেশি), সেহেতু অর্থনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণূ অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেূ যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। মৌলবাদের অর্থনীতির গঠন প্রক্রিয়া, বিস্তৃতি ও সম্ভাবনা-প্রবণতা বিশ্লেষণে কয়েকটি গুরুত্ববহ বিষয় নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব,
১. দেশের মোট বার্ষিক জাতীয় বিনিয়োগের (চলতি মূল্যে) ১.০২ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
২. দেশের মোট বার্ষিক বেসরকারি বিনিয়োগের ১.৩১ শতাংশের এর সমপরিমাণ, অথবা
৩. সরকারের মোট বার্ষিক রাজস্ব আয়ের ২.১ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
৪. দেশের বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ১.৫৪ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
৫. সরকারের মোট বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের ৫.৫৮ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা
৬. সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের অভ্যন্তরীণ সম্পদের ৮.৬২ শতাংশের সমপরিমাণ, অথবা বিগত চল্লিশ বছরে (১৯৭৫-২০১৫) মৌলবাদের অর্থনীতি সৃষ্ট ক্রমপুঞ্জীভূত নিট মুনাফার মোট পরিমাণ হবে বর্তমান বাজারমূল্যে কমপক্ষে ২ লাখ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে বিকাশ-বিস্তৃতির সম্ভাবনা নির্দেশে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, যেহেতু মৌলবাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (গত ২০ বছরের হিসাবে বার্ষিক গড়ে ১০ শতাংশ) মূল স্রোতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের (গত ২০ বছরের হিসাবে বার্ষিক গড়ে ৫ শতাংশ) তুলনায় অধিক (শুধু অধিক নয়, দ্বিগুণ বেশি), সেহেতু অর্থনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণূ অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেূ যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। মৌলবাদের অর্থনীতির গঠন প্রক্রিয়া, বিস্তৃতি ও সম্ভাবনা-প্রবণতা বিশ্লেষণে কয়েকটি গুরুত্ববহ বিষয় নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব,
যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং মৌলবাদী জঙ্গিত্ব দমনের উপাদান হিসেবে দেখা উচিত। এতক্ষণ যা কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করা হল তা থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব যে, এ প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে ইসলাম ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ শুধু মূলধারার অর্থনীতির মধ্যে মৌলবাদের অর্থনীতিই সৃষ্টি ও বিকশিত করেনি, তারা সৃষ্টি করেছে ‘সরকারের মধ্যে সরকার’ এবং ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’ (রাষ্ট্রের হেন যন্ত্রাংশ নেই যেখানে তাদের উপস্থিতি সরব-সবল নয়)। এবং তাদের সৃষ্ট মিনি-অর্থনীতি, মিনি-সরকার ও মিনি-রাষ্ট্রের সম্মিলনে এবং বহিঃস্থ শক্তির সহায়তায় তারা ‘অর্থনৈতিক শক্তিভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’র মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতাকেই দখল করে নিতে চায়। আর এক্ষেত্রে মৌলবাদী জঙ্গিত্ব ওই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কার্যকর রণনীতি মাত্র।
ড. আবুল বারকাত : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. আবুল বারকাত : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments