ভারতীয় গণতন্ত্রে কলঙ্ক আফজাল গুরু by অরুন্ধতী রায়
দিল্লিতে
বসন্ত তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সূর্য তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। আর আইন
গতিশীল তার নিজের পথে। এমন একটা সময় এক ভোরে ভারত সরকার আফজাল গুরুর ফাঁসি
কার্যকর করল। ২০০১ সালে পার্লামেন্ট ভবনে হামলার প্রধান অভিযুক্ত তিনি। সে
বছরই গ্রেফতার করা হয় তাকে। দীর্ঘ ১২ বছর নির্জন এক সেলে একা ছিলেন। স্ত্রী
বা ছেলেকে তার কোনো খবর জানানো হয়নি। এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রসচিব
জানান, চিঠি দিয়ে তার পরিবারকে জানানো হয়েছে। তারা এ চিঠি পেয়েছেন কি না তা
খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জম্মু ও কাশ্মিরের পুলিশের মহাপরিচালককে।
তবে সে খবর তাদের কাছে পৌঁছেনি। এটা কোনো বড় বিষয় নয়, কারণ কাশ্মিরের এক
সন্ত্রাসী পরিবারকে তার ধরা পড়ার খবর জানানোর দায় সরকারের নেই।
এই ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে ভারতের প্রধান দলগুলোর মধ্যে বিস্ময়কর ঐক্যবদ্ধ মনোভাব দেখা গেছে। কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট) যেন এই একটি বিষয়ে আইনের শাসন কার্যকরে একেবারে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব বা যথাযথ সময় কোনো প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করেনি। ঘটনা নয়, ঘটনার প্রতিক্রিয়ার সরাসরি সম্প্রচার চলছিল টিভি চ্যানেলগুলো থেকে। স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে নানা কিছুর মিশেল ছিল। আর ছিল ‘গণতন্ত্রের জয়গান’। ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তার ফাঁসি উদযাপন করতে মিষ্টি বিলিয়েছে, কাশ্মিরিদের পিটিয়েছে (এ ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে)। এরা দিল্লিতে বিক্ষোভ করার জন্য জড়ো হয়েছিল। ততক্ষণে আফজাল গুরু মৃত। কিন্তু টিভি চ্যানেলগুলোর স্টুডিওতে গলাবাজদের কথার ঝড় আর রাস্তায় হঠকারীদের তৎপরতা দুই-ই সমানতালে চলছিল। তাদের এত বেশি কথা বলার বা তৎপরতার নেপথ্যে হয়তো বিষয়টি এমন যে, গভীর বোধে তাদের এ উপলব্ধি ছিল, কোথাও না কোথাও তারা ভুল করছে।
তাহলে সত্যটা কী? ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাঁচ ব্যক্তি একটি গাড়ি চালিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। ওই গাড়িতে বোমা ছিল। চ্যালেঞ্জ করা হলে গাড়ি থেকে বের হয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে তারা। তাদের গুলিতে আট নিরাপত্তারক্ষী ও এক মালী নিহত হন। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ওই পাঁচজনও। ধরা পড়ার পর পুলিশ হেফাজতে আফজাল গুরু নানা রকম স্বীকারোক্তি দেয়। বা বলা যেতে পারে, তার কাছ থেকে আদায় করা হয়। তার মধ্যে একটিতে সে জানায়, পার্লামেন্ট ভবনের অভিযানে অংশ নিয়েছিল মোহাম্মদ, রানা, রাজা, হামজা ও হায়দার। তাদের সম্পর্কে আমাদের হাতে থাকা তথ্য এটুকুই। এদের নামের কোনো প্রথমাংশ বা শেষাংশ নেই। তৎকালীন বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি বলেছিলেন, ‘দেখে মনে হয় এরা সবাই পাকিস্তানি (তিনি নিজে একজন সিন্ধি, কাজেই তিনি অবশ্যই জানেন পাকিস্তানিরা দেখতে কেমন)। শুধু গুরুর পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করে সরকার পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্্রদূতকে প্রত্যাহার করে। একই সাথে পাকিস্তান সীমান্তে প্রায় পাঁচ লাখ সেনা মোতায়েন করা হয়। দুই দেশের মধ্যে পরমাণুযুদ্ধের রবও ওঠে। বিদেশী দূতাবাসগুলো ভ্রমণ-সতর্কতার পাশাপাশি দিল্লিতে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করে। কয়েক মাস ধরে এই পরিস্থিতি চলতে থাকে। ভারত এসব নানাবিধ তৎপরতায় হাজার কোটি রুপি খরচ করে।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিল্লির স্পেশাল পুলিশ সেল (অযথাই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য এদের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে, সন্ত্রাসী সন্দেহে এরা বহু লোককে ‘এনকাউন্টার’ করেছে) জানায়, এই মামলা তারা মীমাংসা করে ফেলেছে। ১৫ ডিসেম্বর তারা এ ঘটনার ‘নাটের গুরু’ অধ্যাপক স্যার গিলানিকে দিল্লি থেকে এবং শওকত গুরু ও তার খালাতো ভাই আফজাল গুরুকে কাশ্মিরের শ্রীনগর থেকে গ্রেফতার করে। শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুকেও আটক করা হয়। তবে ভারতের গণমাধ্যম সে সময় অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশে বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। কিছু শিরোনাম ছাপা হয় অনেকটা এমন, ‘দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষকের সন্ত্রাসী পরিকল্পনা’, ‘ফিদায়িনদের পথনির্দেশনায় ভার্সিটি ডন’, ‘ক্লাসের বাইরে সন্ত্রাসের শিক্ষক ছিলেন ডন’। দেশজুড়ে প্রচারিত জিটিভি ওই সময় ‘১৩ ডিসেম্বর’ নামে একটি ‘ডকুড্রামা’ প্রচার করে। তাদের দাবি, ‘পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এই সত্যনির্ভর নাটক তারা নির্মাণ করেছে (পুলিশের বক্তব্যই সঠিক হবে তাহলে আর আদালতের কী প্রয়োজন)। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদভানি প্রকাশ্যে এই নাটকের প্রশংসা করেন। সর্বোচ্চ আদালতও এর প্রচার স্থগিত করার আবেদন বাতিল করে দেন। তাদের বক্তব্য ছিল, গণমাধ্যম বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। দ্রুত বিচার আদালত গিলানি, আফজাল ও শওকতকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে এটি প্রচার করা হয়। পরবর্তীকালে আদালত অবশ্য গিলানি ও আফসান গুরুকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে মুক্তি দেন। সুপ্রিম কোর্টও এই রায় বহাল রাখেন। তবে ২০০৫ সালের ৫ আগস্ট আদালত আফজাল গুরুকে তিন দফা যাবজ্জীবন ও ডাবল মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
বিজেপি এই রায়ের তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন দাবি করে। তাদের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম স্লোগান ছিল, ‘দেশ আভি শারমিন্দা হ্যায়, আফজাল আভি জিন্দা হ্যায়’। অর্থাৎ আফজাল বেঁচে থাকায় ভারত লজ্জিত। এর মধ্যেই গণমাধ্যমে নতুন প্রচার শুরু হয়। বর্তমানে বিজেপির এমপি চন্দন মিত্র সে সময় পাইওনিয়ার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি লেখেন, ‘২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় আফজাল গুরুই প্রথম গুলি ছুড়তে শুরু করেন। তার গুলিতেই ছয় রক্ষীর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়।’ এমনকি পুলিশের অভিযোগপত্রেও আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়নি।
প্রশ্ন জাগে, পার্লামেন্টে হামলার মামলায় আমাদের সম্মিলিত মত কে তৈরি করে দিলো? পত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছে সেটাই কি একমাত্র সত্য? অথবা যে নাটক আমরা টিভিতে দেখেছি সেটা? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জয় উদযাপনের আগে আসুন একটু দেখার চেষ্টা করি, ওই সময় কী ঘটেছিল? যারা আফজালের ফাঁসিকে আইনের শাসন হিসেবে দেখছেন তাদের যুক্তি হলো, গিলানিকে মুক্তি দেয়াতেই প্রমাণ হয়, বিচার নিরপেক্ষ হয়েছে। তাই কি?
দ্রুত বিচার আদালত কাজ শুরু করেন ২০০২ সালের মে মাসে। তখনো বিশ্ব ৯/১১-এর ধাক্কায় দুলছিল। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার আফগানিস্তানে তারা বিজয়ী হয়েছে বলে দাবি করে। যে জয় প্রকৃতপক্ষে ছিল অপরিণত। গুজরাটে পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় মুসলিম নিধন চলছিল। পুরো পরিবেশ আর বাতাস সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় ভারী হয়েছিল। এ দিকে পার্লামেন্টে হামলার মামলাটিও চলছিল। জটিল এক ফৌজদারি মামলা। এই মামলায় নির্জন কারাগারে বন্দী আফজাল গুরুর কোনো আইনজীবী ছিল না- এমনটি বলাই যুক্তিযুক্ত। আদালত একজন জুনিয়র আইনজীবীকে তার পক্ষে নিয়োগ করেন। তিনি কখনো আফজাল গুরুর সাথে দেখা করেননি। কোনো সাক্ষীকে ডাকেননি। সাক্ষ্য দিতে আসা লোকদের জেরাও করেননি। প্রমাণ উপস্থাপন, সাক্ষীকে জেরা, যুক্তি উপস্থাপন- সবই চলছিল এ অবস্থাতেই। তার পরও মামলাটি ধুঁকছিল। এর বহু উদাহরণ রয়েছে। দু’টি দেয়া যাক- আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে পাওয়া প্রমাণগুলোর অন্যতম ছিল তাকে গ্রেফতারের সময় জব্দ তার সেলফোন ও ল্যাপটপ। এগুলো পাওয়ার পরপরই সিল করা হয়নি। নিয়মানুযায়ী যা স্বাভাবিক ছিল। বিচারকাজ চলার সময় জানা গেল জব্দ করার পর হার্ডডিস্কে কাজ করা হয়েছে। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের জাল পাস এবং পার্লামেন্টে হামলাকারীদের জাল পরিচয় পাওয়া যায়। জিটিভির নাটকে যেমনটি দেখানো হয়েছিল। পুলিশের দাবি ছিল, গুরু তার সব তথ্য মুছে ফেলে শুধু এ দু’টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেখে দিয়েছিল! পুলিশের উপস্থিত করা এক সাক্ষী জানান, তিনি গুরুর কাছে ফোনের সিমকার্ড বিক্রি করেছিলেন। এই সিমকার্ড দিয়েই গুরু সব ‘সন্ত্রাসীর’ সাথে যোগাযোগ করেন। সেটা ২০০১ সালের ৪ ডিসেম্বর। তবে প্রসিকিউশনের রেকর্ডে দেখা যায়, সে বছর ৬ ডিসেম্বর সিম চালু করা হয়।
তাহলে আফজাল পর্যন্ত পুলিশ কী করে পৌঁছল? পুলিশের দাবি, গিলানির কাছ থেকে তারা আফজালের তথ্য পান। তবে আদালতের নথিতে দেখা যায়, গিলানিকে আটক করার আগেই আফজালকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত একে ‘তথ্যগত বিভ্রান্তি’ হিসেবে অভিহিত করলেও বিষয়টি নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেননি।
গিলানির গ্রেফতারি স্মারকে দেখা যায়, তার ভাই বিসমিল্লাহর স্বাক্ষর। তিনি দিল্লিতে থাকেন। জব্দ তালিকায় সই করেন জম্মু ও কাশ্মির পুলিশের দুই ব্যক্তি।
এই মামলায় এ ধরনের বিভ্রান্তি অসংখ্য। প্রমাণগুলো মিথ্যা আর বিভ্রান্তিতে ভরা। এসব বিভ্রান্তি আর মিথ্যাচারের জন্য পুলিশকে মৃদু তিরস্কার ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। পার্লামেন্টে হামলার রহস্য উদঘাটনে আগ্রহী হলে যে-কারো পক্ষে এসব বিভ্রান্তি বোঝা সম্ভব। তবে সে চেষ্টাতে কেউ যায়নি। যার ফলাফল হলো, এই বীভৎস ঘটনার প্রকৃত রচয়িতা অচেনা-আজানা থেকে তদন্তের বাইরেই রয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছে এবং আফজাল গুরুর দুর্ভাগ্য শুধু আদালত কক্ষে আটকে থাকার বিষয় নয়। বাস্তব জানতে আমাদের যেতে হবে কাশ্মির উপত্যকায়। বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকা এটি। প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা এখানে দায়িত্ব পালন করে (প্রতি চারজন কাশ্মিরির জন্য একজন করে সেনা)। এখানে সেনাক্যাম্প ও নির্যাতনশিবিরের পরিস্থিতি আবুগারিব কারাগারকেও ছাপিয়ে যাবে। কাশ্মিরিদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র শেখানোর কেন্দ্র হচ্ছে এগুলো। ১৯৯০ সাল থেকে কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সশস্ত্র হয়। এর পর থেকে উপত্যকার ৬৮ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। নিখোঁজ হয়েছে ১০ হাজার আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরো অন্তত এক লাখ মানুষ। এসব লোকের চেয়ে গুরুর মৃত্যু একটু অন্য রকম। গুরু তাদের মতো কারাগারের আঁধারে প্রাণ হারায়নি। তার জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা হয়েছে দিনের আলোয়। যেখানে ভারতের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল। শুধু খেলা নয়, তার মৃত্যুতেও প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রেখেছে।
তার মৃত্যু কার্যকরের পর কি আমাদের বিবেক শান্তি পেয়েছে, নাকি আমাদের রক্তভর্তি পেয়ালা কেবল অর্ধেক পূর্ণ হলো?
অনুবাদ : তানজিলা কাওকাব
এই ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে ভারতের প্রধান দলগুলোর মধ্যে বিস্ময়কর ঐক্যবদ্ধ মনোভাব দেখা গেছে। কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট) যেন এই একটি বিষয়ে আইনের শাসন কার্যকরে একেবারে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব বা যথাযথ সময় কোনো প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করেনি। ঘটনা নয়, ঘটনার প্রতিক্রিয়ার সরাসরি সম্প্রচার চলছিল টিভি চ্যানেলগুলো থেকে। স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে নানা কিছুর মিশেল ছিল। আর ছিল ‘গণতন্ত্রের জয়গান’। ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তার ফাঁসি উদযাপন করতে মিষ্টি বিলিয়েছে, কাশ্মিরিদের পিটিয়েছে (এ ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে)। এরা দিল্লিতে বিক্ষোভ করার জন্য জড়ো হয়েছিল। ততক্ষণে আফজাল গুরু মৃত। কিন্তু টিভি চ্যানেলগুলোর স্টুডিওতে গলাবাজদের কথার ঝড় আর রাস্তায় হঠকারীদের তৎপরতা দুই-ই সমানতালে চলছিল। তাদের এত বেশি কথা বলার বা তৎপরতার নেপথ্যে হয়তো বিষয়টি এমন যে, গভীর বোধে তাদের এ উপলব্ধি ছিল, কোথাও না কোথাও তারা ভুল করছে।
তাহলে সত্যটা কী? ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাঁচ ব্যক্তি একটি গাড়ি চালিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। ওই গাড়িতে বোমা ছিল। চ্যালেঞ্জ করা হলে গাড়ি থেকে বের হয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে তারা। তাদের গুলিতে আট নিরাপত্তারক্ষী ও এক মালী নিহত হন। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ওই পাঁচজনও। ধরা পড়ার পর পুলিশ হেফাজতে আফজাল গুরু নানা রকম স্বীকারোক্তি দেয়। বা বলা যেতে পারে, তার কাছ থেকে আদায় করা হয়। তার মধ্যে একটিতে সে জানায়, পার্লামেন্ট ভবনের অভিযানে অংশ নিয়েছিল মোহাম্মদ, রানা, রাজা, হামজা ও হায়দার। তাদের সম্পর্কে আমাদের হাতে থাকা তথ্য এটুকুই। এদের নামের কোনো প্রথমাংশ বা শেষাংশ নেই। তৎকালীন বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি বলেছিলেন, ‘দেখে মনে হয় এরা সবাই পাকিস্তানি (তিনি নিজে একজন সিন্ধি, কাজেই তিনি অবশ্যই জানেন পাকিস্তানিরা দেখতে কেমন)। শুধু গুরুর পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করে সরকার পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্্রদূতকে প্রত্যাহার করে। একই সাথে পাকিস্তান সীমান্তে প্রায় পাঁচ লাখ সেনা মোতায়েন করা হয়। দুই দেশের মধ্যে পরমাণুযুদ্ধের রবও ওঠে। বিদেশী দূতাবাসগুলো ভ্রমণ-সতর্কতার পাশাপাশি দিল্লিতে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করে। কয়েক মাস ধরে এই পরিস্থিতি চলতে থাকে। ভারত এসব নানাবিধ তৎপরতায় হাজার কোটি রুপি খরচ করে।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিল্লির স্পেশাল পুলিশ সেল (অযথাই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য এদের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে, সন্ত্রাসী সন্দেহে এরা বহু লোককে ‘এনকাউন্টার’ করেছে) জানায়, এই মামলা তারা মীমাংসা করে ফেলেছে। ১৫ ডিসেম্বর তারা এ ঘটনার ‘নাটের গুরু’ অধ্যাপক স্যার গিলানিকে দিল্লি থেকে এবং শওকত গুরু ও তার খালাতো ভাই আফজাল গুরুকে কাশ্মিরের শ্রীনগর থেকে গ্রেফতার করে। শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুকেও আটক করা হয়। তবে ভারতের গণমাধ্যম সে সময় অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশে বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। কিছু শিরোনাম ছাপা হয় অনেকটা এমন, ‘দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষকের সন্ত্রাসী পরিকল্পনা’, ‘ফিদায়িনদের পথনির্দেশনায় ভার্সিটি ডন’, ‘ক্লাসের বাইরে সন্ত্রাসের শিক্ষক ছিলেন ডন’। দেশজুড়ে প্রচারিত জিটিভি ওই সময় ‘১৩ ডিসেম্বর’ নামে একটি ‘ডকুড্রামা’ প্রচার করে। তাদের দাবি, ‘পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এই সত্যনির্ভর নাটক তারা নির্মাণ করেছে (পুলিশের বক্তব্যই সঠিক হবে তাহলে আর আদালতের কী প্রয়োজন)। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদভানি প্রকাশ্যে এই নাটকের প্রশংসা করেন। সর্বোচ্চ আদালতও এর প্রচার স্থগিত করার আবেদন বাতিল করে দেন। তাদের বক্তব্য ছিল, গণমাধ্যম বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। দ্রুত বিচার আদালত গিলানি, আফজাল ও শওকতকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে এটি প্রচার করা হয়। পরবর্তীকালে আদালত অবশ্য গিলানি ও আফসান গুরুকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে মুক্তি দেন। সুপ্রিম কোর্টও এই রায় বহাল রাখেন। তবে ২০০৫ সালের ৫ আগস্ট আদালত আফজাল গুরুকে তিন দফা যাবজ্জীবন ও ডাবল মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
বিজেপি এই রায়ের তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন দাবি করে। তাদের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম স্লোগান ছিল, ‘দেশ আভি শারমিন্দা হ্যায়, আফজাল আভি জিন্দা হ্যায়’। অর্থাৎ আফজাল বেঁচে থাকায় ভারত লজ্জিত। এর মধ্যেই গণমাধ্যমে নতুন প্রচার শুরু হয়। বর্তমানে বিজেপির এমপি চন্দন মিত্র সে সময় পাইওনিয়ার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি লেখেন, ‘২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় আফজাল গুরুই প্রথম গুলি ছুড়তে শুরু করেন। তার গুলিতেই ছয় রক্ষীর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়।’ এমনকি পুলিশের অভিযোগপত্রেও আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়নি।
প্রশ্ন জাগে, পার্লামেন্টে হামলার মামলায় আমাদের সম্মিলিত মত কে তৈরি করে দিলো? পত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছে সেটাই কি একমাত্র সত্য? অথবা যে নাটক আমরা টিভিতে দেখেছি সেটা? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জয় উদযাপনের আগে আসুন একটু দেখার চেষ্টা করি, ওই সময় কী ঘটেছিল? যারা আফজালের ফাঁসিকে আইনের শাসন হিসেবে দেখছেন তাদের যুক্তি হলো, গিলানিকে মুক্তি দেয়াতেই প্রমাণ হয়, বিচার নিরপেক্ষ হয়েছে। তাই কি?
দ্রুত বিচার আদালত কাজ শুরু করেন ২০০২ সালের মে মাসে। তখনো বিশ্ব ৯/১১-এর ধাক্কায় দুলছিল। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার আফগানিস্তানে তারা বিজয়ী হয়েছে বলে দাবি করে। যে জয় প্রকৃতপক্ষে ছিল অপরিণত। গুজরাটে পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় মুসলিম নিধন চলছিল। পুরো পরিবেশ আর বাতাস সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় ভারী হয়েছিল। এ দিকে পার্লামেন্টে হামলার মামলাটিও চলছিল। জটিল এক ফৌজদারি মামলা। এই মামলায় নির্জন কারাগারে বন্দী আফজাল গুরুর কোনো আইনজীবী ছিল না- এমনটি বলাই যুক্তিযুক্ত। আদালত একজন জুনিয়র আইনজীবীকে তার পক্ষে নিয়োগ করেন। তিনি কখনো আফজাল গুরুর সাথে দেখা করেননি। কোনো সাক্ষীকে ডাকেননি। সাক্ষ্য দিতে আসা লোকদের জেরাও করেননি। প্রমাণ উপস্থাপন, সাক্ষীকে জেরা, যুক্তি উপস্থাপন- সবই চলছিল এ অবস্থাতেই। তার পরও মামলাটি ধুঁকছিল। এর বহু উদাহরণ রয়েছে। দু’টি দেয়া যাক- আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে পাওয়া প্রমাণগুলোর অন্যতম ছিল তাকে গ্রেফতারের সময় জব্দ তার সেলফোন ও ল্যাপটপ। এগুলো পাওয়ার পরপরই সিল করা হয়নি। নিয়মানুযায়ী যা স্বাভাবিক ছিল। বিচারকাজ চলার সময় জানা গেল জব্দ করার পর হার্ডডিস্কে কাজ করা হয়েছে। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের জাল পাস এবং পার্লামেন্টে হামলাকারীদের জাল পরিচয় পাওয়া যায়। জিটিভির নাটকে যেমনটি দেখানো হয়েছিল। পুলিশের দাবি ছিল, গুরু তার সব তথ্য মুছে ফেলে শুধু এ দু’টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেখে দিয়েছিল! পুলিশের উপস্থিত করা এক সাক্ষী জানান, তিনি গুরুর কাছে ফোনের সিমকার্ড বিক্রি করেছিলেন। এই সিমকার্ড দিয়েই গুরু সব ‘সন্ত্রাসীর’ সাথে যোগাযোগ করেন। সেটা ২০০১ সালের ৪ ডিসেম্বর। তবে প্রসিকিউশনের রেকর্ডে দেখা যায়, সে বছর ৬ ডিসেম্বর সিম চালু করা হয়।
তাহলে আফজাল পর্যন্ত পুলিশ কী করে পৌঁছল? পুলিশের দাবি, গিলানির কাছ থেকে তারা আফজালের তথ্য পান। তবে আদালতের নথিতে দেখা যায়, গিলানিকে আটক করার আগেই আফজালকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত একে ‘তথ্যগত বিভ্রান্তি’ হিসেবে অভিহিত করলেও বিষয়টি নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেননি।
গিলানির গ্রেফতারি স্মারকে দেখা যায়, তার ভাই বিসমিল্লাহর স্বাক্ষর। তিনি দিল্লিতে থাকেন। জব্দ তালিকায় সই করেন জম্মু ও কাশ্মির পুলিশের দুই ব্যক্তি।
এই মামলায় এ ধরনের বিভ্রান্তি অসংখ্য। প্রমাণগুলো মিথ্যা আর বিভ্রান্তিতে ভরা। এসব বিভ্রান্তি আর মিথ্যাচারের জন্য পুলিশকে মৃদু তিরস্কার ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। পার্লামেন্টে হামলার রহস্য উদঘাটনে আগ্রহী হলে যে-কারো পক্ষে এসব বিভ্রান্তি বোঝা সম্ভব। তবে সে চেষ্টাতে কেউ যায়নি। যার ফলাফল হলো, এই বীভৎস ঘটনার প্রকৃত রচয়িতা অচেনা-আজানা থেকে তদন্তের বাইরেই রয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছে এবং আফজাল গুরুর দুর্ভাগ্য শুধু আদালত কক্ষে আটকে থাকার বিষয় নয়। বাস্তব জানতে আমাদের যেতে হবে কাশ্মির উপত্যকায়। বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকা এটি। প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা এখানে দায়িত্ব পালন করে (প্রতি চারজন কাশ্মিরির জন্য একজন করে সেনা)। এখানে সেনাক্যাম্প ও নির্যাতনশিবিরের পরিস্থিতি আবুগারিব কারাগারকেও ছাপিয়ে যাবে। কাশ্মিরিদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র শেখানোর কেন্দ্র হচ্ছে এগুলো। ১৯৯০ সাল থেকে কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সশস্ত্র হয়। এর পর থেকে উপত্যকার ৬৮ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। নিখোঁজ হয়েছে ১০ হাজার আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরো অন্তত এক লাখ মানুষ। এসব লোকের চেয়ে গুরুর মৃত্যু একটু অন্য রকম। গুরু তাদের মতো কারাগারের আঁধারে প্রাণ হারায়নি। তার জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা হয়েছে দিনের আলোয়। যেখানে ভারতের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল। শুধু খেলা নয়, তার মৃত্যুতেও প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রেখেছে।
তার মৃত্যু কার্যকরের পর কি আমাদের বিবেক শান্তি পেয়েছে, নাকি আমাদের রক্তভর্তি পেয়ালা কেবল অর্ধেক পূর্ণ হলো?
অনুবাদ : তানজিলা কাওকাব
No comments