জনগণ ও রাজনীতিক by এমাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশের
জনগণের কাছে গণতন্ত্রের আবেদন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের
দুর্বলতা প্রবল। যুগে যুগে তাই জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আদর্শ
ব্যবস্থা বলে সব সময় চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৈনিকরূপে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছে। ত্যাগ স্বীকারও করেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে
অংশীদার হয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রণোদনা লাভ করে
পাকিস্তানের বলদর্পী শাসনকারী এলিট গোষ্ঠী যখন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে
বিজয়ী পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার
পথ রুদ্ধ করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এভাবে যখন পেশিশক্তির
মাধ্যমে জনগণের রায়কে বিধ্বস্ত করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এখন পর্যন্ত
গণতন্ত্র রয়ে গেছে তাদের আকাঙ্ক্ষায়, তাদের প্রত্যাশায়। শুধু বিদ্যমান
রয়েছে তাদের দুচোখ ভরা স্বপ্নে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের কাছে এখনো সেই
মোহনীয় সোনার হরিণ। আকর্ষণীয় কিন্তু বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। কাক্সিক্ষত,
কিন্তু তাদের জীবনকে স্পর্শ করেনি।
পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র সফল হয়েছে প্রধানত দু’টি কারণে। এক. যে সামাজিক উপত্যকায় গণতন্ত্রের সুর ঝঙ্কৃত, তা মোটামুটিভাবে মসৃণ এবং সমতল। বৈষম্য, তা সম্পদসৃষ্ট হোক আর জাতিগত বা ধর্মের ভিন্নতাজনিত হোক, ওই সব সমাজে অনতিক্রম্য নয়। নয় অজেয়। আজ যিনি নির্ধন, আগামীকাল সমাজপ্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ফলে তিনিও শীর্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। জাতি-ধর্ম বা নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা তার অগ্রগতির অভিযাত্রা রুদ্ধ করতে সক্ষম নয়। তাই সমতল সমাজ ভূমিতে নাগরিকদের জীবন হয়ে উঠেছে শ্যামল, সমৃদ্ধ, সুষমামণ্ডিত।
দুই. অর্থনৈতিক সুখ-সুবিধাও ওই সব সমাজে এমনভাবে বিস্তৃত যে, প্রত্যেকেই জীবনের সর্বনিম্ন চাহিদা মিটিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। যার কোনো কর্মসংস্থান নেই, তিনিও দরিদ্র্যের অভিশাপে অভিশপ্ত নন। এসব ক্ষেত্রে সমাজই এগিয়ে আসে ওই সব দুস্থ ও দরিদ্র্যের সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য, সহায়তার ডালা সাজিয়ে। দেশের আইন এমনভাবে বিন্যস্ত যে, শুধু আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেই সবাই মানবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম। এসব সমাজে কাউকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয় না। সুতরাং উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হোন, দেখবেন গণতন্ত্রকে সফলভাবে বাস্তবায়নের সব শর্তই প্রায় সামাজিক, রাজনৈতিক নয়। নয় রাজনৈতিক কাঠামো বা রাজনৈতিক কার্যক্রম সংক্রান্ত।
কার্যত পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল সামাজিক এক ব্যবস্থারূপে। সমাজেই তার দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সার্থক প্রয়োগ ঘটে। আগে সমাজ গণতান্ত্রিক হয়েছে। দেখাদেখি পরে রাষ্ট্র হয়েছে গণতান্ত্রিক। বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্বের এই অংশে রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, বৈষম্যক্লিষ্ট হাজারো প্রকরণে বিভক্ত, জাতি-ধর্মের ভিন্নতাপীড়িত সমাজে। এসব জনপদে সামাজিক মূল্যবোধ এখনো গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি পারস্পরিক সমঝোতা ও সহিষ্ণুতার অমৃতরসে সিক্ত। সহনশীলতার পাঠ সমাজজীবনে এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তাই এসব সামাজিক মূল্যবোধহীন জনপদে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষণ টিকে রয়েছে টলটলায়মান অবস্থায়, হাজারো অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। তাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নির্দেশনা হলো- সৃজনশীল রাজনৈতিক নেতাদের গতিশীল নেতৃত্বের আলোকে গণতন্ত্রের সঠিক বিকাশের জন্য সমাজে গণতন্ত্রের জন্য উর্বর ক্ষেত্র রচনা করা। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক নেতারা এখনো তেমন সৃষ্টিশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এ দিকে দৃষ্টি দেয়ার সময়ও পাননি। এসব বিষয়ে খেয়ালও করেননি। এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের এমন মহামূল্যবান মণি-মুক্তা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তারা শুধু দেখেছেন ব্যক্তিগত এবং দলীয় পর্যায়ে প্রভাব-বৈভব অর্জনের মাধ্যমরূপে। কখনো ভেবে দেখেননি, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পুরো সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ভুলটি প্রায় সবাই কমবেশি করছেন এবং করেছেন। যারা ক্ষমতা দখলে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তারাও এ বিষয়ে সজ্ঞাত নন।
বাংলাদেশের জন্মক্ষণ থেকেই এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো পর্যায়ে এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে বলে মনে হয় না। পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনগণের সচেতনতা যতটুকু ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক নেতাদের গণতন্ত্রকে সফল করা তথা সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিকতাকে বাস্তবায়িত করার দৃঢ়সঙ্কল্প এবং সৃজনশীল মনমানসিকতার।
বাংলাদেশে প্রথমটি বিদ্যমান থাকলেও দ্বিতীয়টির বড় আকাল দেখা যায় সব সময়। এই অভাবটা পূরণ করতে হবে আমাদের রাজনীতিকদের। আমার বিশ্বাস, তারা তা পারবেন। তাদের শুধু একটু আকাশমুখী হতে হবে। মাত্র দুই হাজার ফুট উঁচুতে উঠে এই মাটিকে যেমন সুদৃশ্য ছবির মতো সুন্দর মনে হয়, তেমনি আদর্শিক অঙ্গীকারের খানিকটা ধারণ করে অগ্রসর হলে যে সমস্যাগুলোকে সবচেয়ে জটিল বলে মনে হয়, তা-ও নিয়ন্ত্রণে আসবে। পারবেন কি আমাদের রাজনীতিকেরা এ দেশের গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে? জনগণ কিন্তু চেয়ে রয়েছে তাদেরই দিকে।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র সফল হয়েছে প্রধানত দু’টি কারণে। এক. যে সামাজিক উপত্যকায় গণতন্ত্রের সুর ঝঙ্কৃত, তা মোটামুটিভাবে মসৃণ এবং সমতল। বৈষম্য, তা সম্পদসৃষ্ট হোক আর জাতিগত বা ধর্মের ভিন্নতাজনিত হোক, ওই সব সমাজে অনতিক্রম্য নয়। নয় অজেয়। আজ যিনি নির্ধন, আগামীকাল সমাজপ্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ফলে তিনিও শীর্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। জাতি-ধর্ম বা নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা তার অগ্রগতির অভিযাত্রা রুদ্ধ করতে সক্ষম নয়। তাই সমতল সমাজ ভূমিতে নাগরিকদের জীবন হয়ে উঠেছে শ্যামল, সমৃদ্ধ, সুষমামণ্ডিত।
দুই. অর্থনৈতিক সুখ-সুবিধাও ওই সব সমাজে এমনভাবে বিস্তৃত যে, প্রত্যেকেই জীবনের সর্বনিম্ন চাহিদা মিটিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। যার কোনো কর্মসংস্থান নেই, তিনিও দরিদ্র্যের অভিশাপে অভিশপ্ত নন। এসব ক্ষেত্রে সমাজই এগিয়ে আসে ওই সব দুস্থ ও দরিদ্র্যের সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য, সহায়তার ডালা সাজিয়ে। দেশের আইন এমনভাবে বিন্যস্ত যে, শুধু আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেই সবাই মানবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম। এসব সমাজে কাউকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয় না। সুতরাং উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হোন, দেখবেন গণতন্ত্রকে সফলভাবে বাস্তবায়নের সব শর্তই প্রায় সামাজিক, রাজনৈতিক নয়। নয় রাজনৈতিক কাঠামো বা রাজনৈতিক কার্যক্রম সংক্রান্ত।
কার্যত পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল সামাজিক এক ব্যবস্থারূপে। সমাজেই তার দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সার্থক প্রয়োগ ঘটে। আগে সমাজ গণতান্ত্রিক হয়েছে। দেখাদেখি পরে রাষ্ট্র হয়েছে গণতান্ত্রিক। বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্বের এই অংশে রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, বৈষম্যক্লিষ্ট হাজারো প্রকরণে বিভক্ত, জাতি-ধর্মের ভিন্নতাপীড়িত সমাজে। এসব জনপদে সামাজিক মূল্যবোধ এখনো গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি পারস্পরিক সমঝোতা ও সহিষ্ণুতার অমৃতরসে সিক্ত। সহনশীলতার পাঠ সমাজজীবনে এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তাই এসব সামাজিক মূল্যবোধহীন জনপদে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষণ টিকে রয়েছে টলটলায়মান অবস্থায়, হাজারো অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। তাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নির্দেশনা হলো- সৃজনশীল রাজনৈতিক নেতাদের গতিশীল নেতৃত্বের আলোকে গণতন্ত্রের সঠিক বিকাশের জন্য সমাজে গণতন্ত্রের জন্য উর্বর ক্ষেত্র রচনা করা। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক নেতারা এখনো তেমন সৃষ্টিশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এ দিকে দৃষ্টি দেয়ার সময়ও পাননি। এসব বিষয়ে খেয়ালও করেননি। এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের এমন মহামূল্যবান মণি-মুক্তা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তারা শুধু দেখেছেন ব্যক্তিগত এবং দলীয় পর্যায়ে প্রভাব-বৈভব অর্জনের মাধ্যমরূপে। কখনো ভেবে দেখেননি, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পুরো সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ভুলটি প্রায় সবাই কমবেশি করছেন এবং করেছেন। যারা ক্ষমতা দখলে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তারাও এ বিষয়ে সজ্ঞাত নন।
বাংলাদেশের জন্মক্ষণ থেকেই এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো পর্যায়ে এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে বলে মনে হয় না। পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনগণের সচেতনতা যতটুকু ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক নেতাদের গণতন্ত্রকে সফল করা তথা সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিকতাকে বাস্তবায়িত করার দৃঢ়সঙ্কল্প এবং সৃজনশীল মনমানসিকতার।
বাংলাদেশে প্রথমটি বিদ্যমান থাকলেও দ্বিতীয়টির বড় আকাল দেখা যায় সব সময়। এই অভাবটা পূরণ করতে হবে আমাদের রাজনীতিকদের। আমার বিশ্বাস, তারা তা পারবেন। তাদের শুধু একটু আকাশমুখী হতে হবে। মাত্র দুই হাজার ফুট উঁচুতে উঠে এই মাটিকে যেমন সুদৃশ্য ছবির মতো সুন্দর মনে হয়, তেমনি আদর্শিক অঙ্গীকারের খানিকটা ধারণ করে অগ্রসর হলে যে সমস্যাগুলোকে সবচেয়ে জটিল বলে মনে হয়, তা-ও নিয়ন্ত্রণে আসবে। পারবেন কি আমাদের রাজনীতিকেরা এ দেশের গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে? জনগণ কিন্তু চেয়ে রয়েছে তাদেরই দিকে।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments