মাহফুজ আনামের উপলব্ধি, অতঃপর by ফরহাদ মজহার
এক
এগারোর সময় পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে নিজের ভূমিকার ভুলের কথা মাহফুজ আনাম
একটি টেলিভিশান টকশোতে স্বীকার করেছেন। তাঁর এই উপলব্ধিকে আন্তরিক মনে না
করার কোন যুক্তি নাই। সরকারপক্ষের টেলিভিশান চ্যানেলটি তাঁকে কথার ফাঁদে
ফেলবার জন্যই তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়েছিল কি না সেটাও আমরা ভাবতে পারি।
কিন্তু যে উপলব্ধির জায়গা থেকে মাহফুজ আনাম সম্প্রতি ভুল স্বীকার করেছেন
তাকে স্বাগত জানাবার জন্যই এই লেখাটি।
মাহফুজ আনামের উপলব্ধি ও স্বীকারোক্তি হচ্ছে এজেন্সির চাপের কাছে একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর নতি স্বীকার করা ঠিক হয়নি- এ কথা একটি টেলিভিশান চ্যানেলে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন। তবে তিনি যে শুধু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে এজেন্সির দেয়া তথ্য ছেপেছেন তা নয়, খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে তাঁর লেখালিখির কথা তিনি চেপে গিয়েছেন। এখনো উল্লেখ করেন নি। এটা অন্যায় এবং হিপোক্র্যাসি।
তারপরও আমি তাঁর এই উপলব্ধিকে স্বাগত জানাই। ফলে তাঁর এই উপলব্ধির সুযোগ নিয়ে তাঁকে অযথা হয়রানি ও তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলারও তীব্র নিন্দা জানাই।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে হয়রানি আমি একটা অশনি সংকেত হিসাবে দেখি। শেখ মুজিবর রহমান দলীয় পত্রিকা ছাড়া বাকশালী আমলে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যেভাবে একদলীয় শাসন চালাচ্ছেন তাতে তিনি এখনো দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকবেন কি না তা নিশ্চিত হতে পারছেন না। অতএব তিনি মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে তাঁদের এক এগারোর ভূমিকার জন্য এখন কাটছাঁট করে দেবেন। আওয়ামী লীগের দলীয় স্বার্থের অধীনস্থ না থাকলে কোনো গণমাধ্যমই শেখ হাসিনা রাখবেন না। এই পরিস্থিতি বাকশালের চেয়েও ভয়াবহ হবে। যারা নাগরিক ও মানবিক অধিকারে বিশ্বাস করেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁদের উচিত এই হয়রানির প্রতিবাদ জানানো। দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এই সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সব মামলার জামিন হবার পরেও নতুন মামলা দেখিয়ে তাঁকে এখনো কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের উচিত ছিল মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে সুদৃঢ় ভাবে দাঁড়ানো। তাঁরা নাম কা ওয়াস্তে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন নীতিগত দৃঢ়তা তাঁদের মধ্যে আমরা দেখি নি। কিন্তু সে কারণে তাঁকে যখন ক্ষমতাসীনরা হয়রানি করছে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না।
এক এগারোর সময় ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সেনা সমর্থিত সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্যে তাঁরা বদল ঘটাতে পেরেছিলেন। এটা তাঁদের শক্তির পরিচয় ছিল, সন্দেহ নাই। এর আগে থেকেই সিপিডিসহ এনজিওদের একাংশকে নিয়ে তাঁরা সৎ মানুষের খোঁজে জাতীয় রাজনীতি প্রবর্তনের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তখনই সুশীলসমাজ নামক সমাজের এই অংশের রাজনৈতিক অজ্ঞতা কিম্বা হিপোক্রাসি ধরা পড়তে শুরু করে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিছক সৎ মানুষের অভাব নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে ওঠার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। তারই ফল বাকশালী দুঃশাসন, সেনাশাসকদের কুকীর্তি এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতি। এগুলো বাইরের দিক। গোড়ায় রয়েছে আর্থসামাজিক সম্পর্ক ও ব্যবস্থা এবং পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তিক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রাম জয়-পরাজয়ের ইতিহাস।
তদুপরি ক্ষমতা, শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রকাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে সমাজের চিন্তাভাবনা অতিশয় দুর্বল। দলবাজি করা বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে অতি নিম্নপর্যায়ের দালালী ছাড়া কোন স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংবাদিকতার চর্চার দেখা পাওয়া কঠিন। ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসের মন্দ চরিত্রের দিকটা স্রেফ রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের দোষ হতে পারে না। বরং সেই ক্ষেত্রে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ যাদের আমরা ‘সুশীল’ বলে অভিহিত করি তাঁদের দায়িত্বটাই সমধিক। অথচ তাঁরা নিজেদের সবসময়ই সমাজ ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে ভেবেছেন এবং এখনও ভাবেন, যার ফলে বাংলাদেশের সকল মন্দের জন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলকেই শুধু দোষারোপ করেন। এটা একটা বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের ভূমিকা বিচার করে দেখবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ও প্রতিভা সুশীলদের মধ্যে দেখা যায় না। এদের চিন্তার দৌড় কতটা সংকীর্ণ সেটা আমরা বুঝতে শুরু করি যখন তারা এক এগারোর আগে দোর্দণ্ড প্রতাপে সৎ মানুষ খোঁজ করতে শুরু করেছিলেন এবং রাজনীতির দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের বিপরীতে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের আবিষ্কার করেছিলেন।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের দুটো দৈনিক পত্রিকা পড়লে আমরা বুঝতে পারি ইতিহাস ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর চিন্তাভাবনা কতটা অপরিপক্ব ও সংকীর্ণ। যদি তাঁরা আসলেই উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন চাইতেন এবং কিভাবে বাংলাদেশে তা কায়েম করা সম্ভব সে সম্পর্কে আন্তরিক ভাবে ভাবতেন তাহলে বাংলাদেশে আর যাই হোক একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সরকার কায়েম হোত না। সেই ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের চিন্তার সমস্যা কোথায় সেটা আগে তাঁরা নিজেরা পর্যালোচনা করতেন, কিম্বা নিদেন পক্ষে পর্যালোচনা করবার হিম্মত প্রদর্শন করতেন।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান দুটো ফর্মুলা নিয়ে কাজ করেছেন। এক. কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, সৎ মানুষদের রাজনীতিতে বসিয়ে দিলেই বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র, সাম্য, ইনসাফ ইত্যাদি মৌলিক রাজনৈতিক ধারণার বিকাশ ঘটানোরও কোন দরকার নাই। এদেশে বহুজাতিক কোম্পানি বা করপোরেট স্বার্থ কায়েম করা গেলেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এটা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের পক্ষে দাঁড়ান নি। বরং উল্টাটা করেছেন। দাঁড়িয়েছেন বিদেশী বহুজাতিক কম্পানির স্বার্থে। এমনকি সাধারণ মানুষের খাদ্য ব্যবস্থা রক্ষার ন্যূনতম দরদ আমরা তাঁদের মধ্যে দেখি না। ডেইলি স্টার তাদের প্রথম পাতায় মনসান্টোর বিটিবেগুন ও সিনজেন্টার গোল্ডেন রাইসের পক্ষে দাঁড়ায়। এই অবস্থান বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ ঘটায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও পরিবেশের সুরক্ষার দিক থেকে এই দু’টি পত্রিকার ভূমিকা এ কারণে নেতিবাচক। এই সমালোচনা আমরা করে যাবো। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পত্রিকা দু’টিকে হয়রানি করবে আমরা তা হতে দিতে পারি না।
তাঁদের দ্বিতীয় ফর্মুলা হচ্ছে পাশ্চাত্যের ওয়ার অন টেররের সঙ্গী হয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক ভাবে ক্ষমতাবান হওয়া। এদেশে তাদের মতাদর্শিক বা রাজনৈতিক দুষমন হিসাবে তারা তাই জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের মতো ইসলামকেই শত্রু গণ্য করেন। যে কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁরা বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিরোধী ছিলেন। বিএনপি ও ইসলামপন্থীদের অবশ্যই সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সেকুলারিজমের দোহাই দিয়ে তাঁরা সমর্থন করেছেন জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের। এই দুই সস্তা ফর্মুলা চর্চা করতে গিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্যে শেষাবধি বাংলাদেশে তাঁরা যে বদল ঘটালেন তার কুফলই তাঁরা এখন ভোগ করছেন। বিএনপি ও বিরোধীদলীয় জোটকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করবার কাজেও তাঁরা শেখ হাসিনার হাতকেই শক্ত করেছিলেন।
এই সব চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের গলদকে সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত না করে একজন সৎ মানুষকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই বাংলাদেশের রাজনীতির সমস্যা মিটে যাবে এর চেয়ে আজগুবি, অবাস্তব ও অদূরদর্শী চিন্তা আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশে ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন যেকোনো নাগরিকই তাদের সুশীল রাজনীতির এই ফাঁপা দিকটা বুঝতে পেরেছিল। সে ক্ষেত্রে সংস্কার নাকি খোলনলচে বদলে দিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয় হতে পারত। ধরে নিচ্ছি সেই তর্কে তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক, উদার ও অহিংস রাজনীতির পক্ষে থাকতেন। কারণ ক্ষমতা, রাষ্ট্রকাঠামো কিংবা সামাজিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতির পক্ষের মানুষ তাঁরা নন। এতে কোন দোষ নাই। কিন্তু পরাশক্তির স্বার্থের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা এবং তাঁদের ‘গুড গভর্নেসের’ রাজনীতির ফেরিওয়ালা বা নির্বিচার এজেন্ট হওয়া শুধু দোষের না বরং মারাত্মক অপরাধ। এক এগারোর সময় কোন সুনির্দিষ্ট অবস্থান না নিয়ে বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য কী ধরনের রাজনৈতিক পথ নেয়া যেতে পারে তা নিয়ে ফলপ্রসূ তর্কের পরিবেশ তাঁরা তৈরি করতে পারতেন। তার সমূহ সুযোগ ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই দুই পত্রিকার সম্পাদক সেসময় তার চর্চা করেননি। এখনো করেন না। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আদালতে এরা তাঁদের ভূমিকার কারণেই অপরাধী হিসাবেই থেকে যাবেন। এটাই ইতিহাস।
ফলে তাদের ‘সৎ মানুষের সন্ধান’ এবং ‘বদলে যাও বদলে দাও’ জাতীয় স্লোগান ও বিল বোর্ড সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। সেই সময় কূটনীতিক মহলের ‘ট্যুস ডে গ্রুপ’, বিভিন্ন কূটনীতিবিদদের হাঁকডাক, ক্ষমতাসীন বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করবার প্রতিটি প্রচেষ্টাই সাধারণ মানুষ বঙ্গীয় সুশীলদের বগলে নিয়ে পরাশক্তির ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখেছে। তাঁদের অনুমান মিথ্যা হয় নি। দেখা গেল সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মাহফুজ আনাম দাবি করলেন তাঁদের লেখালিখির কারণেই মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
সৎ মানুষ হিসাবে তারা ডক্টর ইউনূসকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ডক্টর ইউনূস প্রকাশ্যে না এসে পেছনে থেকে সমর্থন যুগিয়েছিলেন। এতে তাঁর মান আজও কিছুটা রক্ষিত আছে। কিন্তু এরাই তাঁকে জরুরী অবস্থার অধীনে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু একসময় সেই পথে আর এগোলেন না। বললেন, যাঁরা তাঁকে নামিয়েছিল তাঁরা তাঁকে নামিয়ে পিছু হটে গিয়েছে। সেটা রাজনৈতিক দল না করবার বাহানা হিসাবে হয়তো বলেছেন। এভাবে একটি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোন পরিবর্তন আনা যায় না, এই উপলব্ধি ডক্টর ইউনূসের আছে কি না জানি না। কিন্তু জরুরী অবস্থার অধীনে রাজনৈতিক দল না করে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারতেন। কিন্তু একটা সময়ে তিনি প্রকাশ্যে দলীয় রাজনীতিতে আগ্রহী নন সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ইউনূস-বিদ্বেষ উৎকট সন্দেহ নাই সময়ে তা মিথ্যা বেহুদা অভিযোগ হলেও ডক্টর ইউনূসের বিরুদ্ধে মুজিব কন্যার গোস্বা করবার সঙ্গত কারণ অবশ্যই আছে। যেখানে প্রধান প্রধান জাতীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ সেখানে ডক্টর ইউনূস তাদের স্থান পূরণ করতে রাজনৈতিক দল করতে নেমেছিলেন। এর ফলে তাঁর গায়ে যে ময়লা লেগে গিয়েছে সেটা টের পেয়ে তিনি রাজনীতি থেকে দ্রুত সরে এলেও এখনও তা ধুয়ে ফেলা যাচ্ছে না। তাঁকে যারা রাজনীতিতে নামিয়েছিল তাঁদের দলে মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানও আছেন। ডক্টর ইউনূস ছিলেন তাঁদের ‘সৎ মানুষ’ মার্কা রাজনৈতিক ক্যান্ডিডেট। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির টানাপড়েনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডক্টর ইউনূসের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ভুল রাজনৈতিক চিন্তা ও ভুল পদক্ষেপ তা নষ্ট করে দিয়ে গেছে। গণমাধ্যম সরকার গঠনে ও সরকার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। তেমনি রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাষ্ট্রগঠনেও গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আগামি দিনেও বাংলাদেশকে শক্ত হাতে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমের বিচক্ষণ ভূমিকার প্রয়োজন হবে। এর কোন বিকল্প নাই। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান অতীতে ভুল করেছেন বলে আগামিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন না বা রাখতে পারবেন না এটা আমি মনে করি না। এক এগারোতে কেন তাঁরা উদার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখেন নি তার ব্যাখ্যা তাঁরাই শুধু জানেন। নিয়ম কিংবা সাংবিধানিক বিধিবিধান না মেনে সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চড়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী ও ব্যবসায়ীদের কেন তাঁরা শায়েস্তা করতে নেমেছিলেন তার একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই তাঁদের আছে। এ ব্যাপারে তাঁদের উপলব্ধিও নিশ্চয়ই আছে।
গণমাধ্যমের ভুলত্রুটি কিম্বা অন্যের লেখালিখির পর্যালোচনা আমরা করতেই পারি। যখনই তা করি তার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে সামগ্রিক ভাবে চিন্তা বিকশিত করবার সুযোগগুলো –বিশেষত রাজনৈতিক পরিসর, রাজনৈতিকতা, ক্ষমতা, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে সমাজের চিন্তাচেতনা যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন করে তোলা। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা স্রেফ ক্ষমতার জোরে আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিরোধীদের নিগৃহীত করবে এটা মেনে নেওয়া হবে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আত্মঘাতী। আমি অতএব আহ্বান জানাবো যাঁরা ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর রাজনীতির বিরোধিতা করেন তাঁরাও নীতিগত জায়গা থেকে রাষ্ট্র যখন যাকে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবেন। এই অতি প্রাথমিক নীতিগত জায়গা বিনষ্ট হলে গণতন্ত্র দূরে থাকুক বাংলাদেশে কোন ভাবেই আমরা কোন প্রকার ‘রাজনৈতিক পরিসর’ নির্মাণ করতে পারবো না। আমি জানি মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান ভাবেন নি ক্ষমতাসীনরা যখন মাহমুদুর রহমানকে অন্যায় ভাবে শাস্তি দিচ্ছে, দীর্ঘ দিন কারাগারে বিচার ছাড়া আটকে রেখেছে... সেই প্রকার দুর্দশার শিকার তাঁরা হবেন না। মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তাদের যে দৃঢ় নীতিগত অবস্থান জারি রাখা জরুরি ছিল, সেই অবস্থান তাঁরা নেন নি। আজ তাঁরা নিজেরাই ক্ষমতাসীনদের রোষের শিকার হয়েছেন।
রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ হচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। এর সহজ অর্থ হচ্ছে সমাজে সমষ্টির স্বার্থ নিয়ে কথা বলবার পরিসর তৈরি করা। সমাজের অনেকের সঙ্গেই আমাদের চিন্তা, মত, সিদ্ধান্ত, ভাবনা ইত্যাদির বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু আমরা সকলেই যদি সমাজের অন্তর্গত হয়ে থাকি তাহলে যাঁদের মতের সঙ্গে আমাদের মতের বিরোধ চরম তাঁদের কথা শোনার ও কথা বলার পরিসর নির্মাণের গুরুত্বকে যেন আমরা উপেক্ষা না করি। পরস্পরের মধ্যে কথা বলার মধ্য দিয়েই সমষ্টির ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা রূপ লাভ করে। যদি আমরা মনে করি মতাদর্শিক ভাবে বিরোধীদের কথা বলার সুযোগ বন্ধ করে দিলেই সেই মতাদর্শ মরে যাবে তাহলে বুঝতে হবে আমরা গভীর কুয়াশার সাম্রাজ্যে বসবাস করছি। চিন্তাকে চিন্তা দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে আর তা করতে হলে সমাজে কথা বলার পরিসর শক্তিশালী করতে হবে। হবেই। এর কোনো বিকল্প নাই। আর এটা সফল ভাবে গণমাধ্যমই করে ও করতে পারে। কেন এক-এগারোর সময় মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি নির্মূল করবার জন্য মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে ক্ষমতায় আনলেন সে সম্পর্কে আমার নিজের ব্যাখ্যা আছে। দুই একটি লেখায় আমি তা উল্লেখও করেছি। সেটা হোল বাংলাদেশে লিবারেলিজম বা উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো উদার রাজনীতিতে আস্থাশীল নয়। এটা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে বড় সড় বিপদের জায়গা। তারা উদার রাজনৈতিক চিন্তার পক্ষের শক্তি নয়। এক এগারোর সময় দেখা গেলো তারা নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক চিন্তা-চেতনারও বিরোধী। দ্বিতীয়ত দুটো পত্রিকাই রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ এবং সমাজে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জারি রাখার গুরুত্বকে খাটো করে দেখে। সুশীলদের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে তারা রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করে, কিম্বা নিজেরা রাজনৈতিক দলের বিকল্প হতে চায়। এই উচ্চাশা ভয়ঙ্কর। এই দুটো পত্রিকার রাজনৈতিক চেতনার অভাব পত্রিকা দুটিকে এক এগারোর সময় আওয়ামী লীগের ভাষায় অসাংবিধানিক পথে রাজনৈতিক দল বিলোপ... বিশেষত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছিল। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি বাংলাদেশকে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনায় পর্যবসিত করেছে- এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তার সমাধান তাদের নির্মূল করা নয়। বরং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরো সচল ও সজীব করে তোলা। দলবাজি নয়, বরং রাজনীতির সজীব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই নতুন রাজনীতির পথ বের করে আনা। সেটা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব, যদি সুশীলদের বিরাজনীতিকরণের চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিতে পারি। তাঁদের আবেগ, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, সংকল্প, ইত্যাদির প্রতি মনোযোগী থেকে তাকে প্রকাশের ও তর্কবিতর্কের সুযোগ তৈরি করি। সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নির্মাণের প্রক্রিয়া জারি রাখি। ইত্যাদি। দৈনিক প্রথম আলোর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু এই শক্তিকে ইতিবাচক ভাবে কাজে না খাটিয়ে দৈনিক প্রথম আলো একদিকে তাদের পত্রিকার অভ্যন্তরে সক্রিয় আওয়ামী ও দিল্লি প্রেমিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটের বিরোধিতা করা তার খাসিলত হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে তাঁরা যুক্ত থেকেছে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পরিবারকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করবার তৎপরতায়। যার ফল কারো জন্যই শুভ হয়নি এটা খোদ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের কাজটাই গোড়ায় মেরে ফেলার শামিল।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপির রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশ ও গতিশীল উন্নয়নের পথে বাধা। নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার দিক থেকে দেখলেও এদের সমালোচনা বা বিরোধিতা মোটেও অযৌক্তিক নয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতির জায়গা থেকে দেখলে এই দুটি দলের রূপান্তর কিম্বা এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি ছাড়া বাংলাদেশের গতিশীল বিকাশ সম্ভব নয়। এসব নিয়ে তর্ক বা আপত্তি করবার কিছু নাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে। সেটা নিশ্চয়ই এই ধরনের দলের বিপরীতে সেনা সমর্থিত সরকার কায়েম করা নয়। এদের বিপরীতে জয়ী হতে হলে বাংলাদেশকে বেশ দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জারি রেখে তার ভেতরেই রাজনৈতিক সচেতনতা নির্মাণের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। একেই আমি রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ বলে থাকি। গণমাধ্যম এই ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো সে কাজে নিবিষ্ট না থেকে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছে। এই দুই সম্পাদকের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার রুষ্ট হবার এটাই প্রধান কারন। যদিও শেখ হাসিনা নিজেও দাবি করেছেন এক এগারো সরকার তাঁদেরই আন্দোলনের ফল। এবং এক এগারোর সরকারের সকল অপকর্ম তাঁরা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এরপর থেকে মাহফুজ আনামকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দোষে অভিযুক্ত করবার যুক্তি থাকে না। কিম্বা থাকলেও খাটো হয়ে যায়। শেখ হাসিনা যদি মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে ক্ষমা করে দিতে পারেন তো মাহফুজ মতিউরকে ক্ষমা করতে পারছেন না কেন?
এর একটা প্রহসনমূলক দিক আছে। মাঝে মধ্যে ইতিবাচক অর্থে উদার বা লিবারেল চিন্তাভাবনার নমুনা দেখালেও ডেইলি-স্টার প্রথম আলো শেষাবধি দুটো অঘটন ঘটায়। একটি হচ্ছে দলবাজ ভূমিকা পালন করার কাজে নিজেদের নামিয়ে আনা। সেটা তারা করে সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তাদের অনুমানের জন্য। এই অনুমান হচ্ছে বাংলাদেশে সেকুলারিজম রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে হবে। দাঁড়াতে হবে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে, এদের নির্মূলের কাজে। বাংলাদেশের সেকুলারদের জন্মগত অসুখের কারণে তাঁরা মনে করে ইসলামের সঙ্গে কিম্বা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে গণতন্ত্র ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ প্রশ্নে কোনো নেগোশিয়েশান্স, চিন্তার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের কোন সুযোগ নাই। ইসলামপন্থীদের সাথে কোন রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ, বোঝাপড়া তৈরি করার কোনো সুযোগ তৈরি করতে এরা চায় না। বরং তাঁদের কাজ হচ্ছে খেয়ে-না-খেয়ে ইসলাম সংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছুর বিরোধিতা করা। এটাই প্রহসনের জায়গা। দুটো পত্রিকাই মূলত বিএনপির রাজনীতির বিরোধিতা করে। কিন্তু তাতেও দুই সম্পাদক শেখ হাসিনার মন জয় করতে পারেননি। পারেননি কারণ তাঁরা খোদ শেখ হাসিনাকেই নির্মূল করে বোঝাতে চেয়েছেন শেখ হাসিনার ইসলাম নির্মূলের কাজটা তাঁরা আরো ভালো পারবেন।
ইদানীং প্রথম আলোতে দেখছি ইসলাম সম্পর্কে ভুল চিন্তা সামাল দেবার জন্য তাঁদের সম্পাদকীয় পাতায় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বয়ান দেওয়া। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লেখালিখি দেখে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু দেখলাম এটা নিছকই ধর্ম প্রচার মাত্র। ইসলামের আদৌ কোনো আদর্শগত ও রাজনৈতিক চিন্তা প্রথম আলোর উদার রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তার বিচার নয়। সম্ভবত তারা ইসলামপন্থীদের সহানুভূতি চাইছে। তবে সেটা করতে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পর্যালোচনামূলক লেখালিখি না করে ধর্ম শিক্ষা বা ধর্মপ্রচারকের ভূমিকায় নামাটা হচ্ছে প্রথম আলোর সবচেয়ে হাস্যকর ভূমিকা। এই সব জায়গাতেই প্রথম আলোর চূড়ান্ত হিপোক্রাসি ধরা পড়ে। সত্য এই যে ‘ইসলাম’ একাট্টা কিছু নয়। ইসলাম নানান কিসিমের নানান মতাদর্শের নানান রাজনীতির। প্রশ্ন হচ্ছে উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ইসলাম প্রণোদিত কী ধরনের চিন্তা ডেইলি স্টার বা প্রথম আলোর দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ? তাকে তারা কিভাবে হাজির করে সেটাই মুখ্য বিষয়। ইসলাম প্রচার তাদের কাজ না। ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সমাজে ইতিবাচক কথাবার্তা ও ডায়ালগের শর্ত তৈরি করা এখনও বড় একটি কাজ। যে কাজ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে ওঠার শর্ত নিশ্চিত করে। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের সমালোচনা অব্যাহত থাকবে। উভয়েই করপোরেট স্বার্থের পাহারাদার। সেটা ভিন্ন একটি বিতর্ক। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পর্ক বিচার না করে বিচ্ছিন্ন ভাবে শুধু দুটো পত্রিকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার চরিত্র আলোচনা সঙ্গত হবে না। বরং এখন মাহফুজ আনামকে যেভাবে ক্ষমতাসীনরা শায়েস্তা করতে চাইছে তার বিরোধিতা কর্তব্য।
শেষ করবার আগে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ‘দৈনিক আমার দেশ’ বন্ধ করে দেবার পর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ৩ জুন ২০১০ তারিখে মাহফুজ আনাম যে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন পাঠকদের তা মনে করিয়ে দিচ্ছি।
'As a newspaper upholding journalistic professionalism and freedom, we have, however, found it difficult at times to appreciate the brand of journalism that the Amar Desh was pursuing. Still it is our firm conviction that a dissenting voice, however venomous and thinly founded, must be allowed space because it is an integral part of a functioning democracy, a touchstone of free press and an axiom that the people will be the ultimate judge of all opinions. No matter how opaque or squinted or biased a report and a view-point maybe for or against somebodz it must get a free play not only to enrich environment of free press but also strengthen the institutions of democracy'.
‘যে সাংবাদিকতার পেশা ও স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাসী সেই দিক থেকে দৈনিক আমার দেশ-এর সাংবাদিকতা আমাদের পক্ষে সবসময় প্রশংসা করা কঠিন, তবুও এটা আমাদের বিশ্বাস যে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তা যতোই বিষোদ্গারী হোক ও হালকা ভিত্তির ওপর দাঁড়াক- তাকেও অবশ্যই জায়গা করে দিতে হবে। কারণ তা গণতন্ত্র সক্রিয় রাখার জন্য জরুরি, স্বাধীন সংবাদপত্র আছে কি না তা বিচারের কষ্টিপাথরও এটা আর জনগণই শেষ বিচারক এই নৈতিক মানদণ্ড কার্যকর কি না তার প্রমাণও এটাই। অস্পষ্ট, একচোখা অথবা পক্ষপাতদুষ্ট হোক বা না হোক সাংবাদিকতাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যেন শুধু মুক্ত সংবাদপত্রের পরিবেশ বিরাজ করা নয়, একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণতন্ত্রকেও তা শক্তিশালী করে’।
বলা হচ্ছে দৈনিক আমার দেশ এবং মাহমুদুর রহমানের সাংবাদিকতা অস্পষ্ট, অপরিচ্ছন্ন, একচোখা, পক্ষপাতদুষ্ট ইত্যাদি। বিরোধী মতাদর্শ হিসাবে দৈনিক আমার দেশও ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো সম্পর্কে একই কথা বলতে পারে। ভিন্ন মতাদর্শের বিরোধিতা ডেইলি স্টার করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ডেইলি স্টার কি আদৌ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সংহত করবার কাজ করে? বা করেছে? যে দাবি তারা করছে তা মোটেও সত্য নয়। যদি এটা সত্য হোত তাহলে গোয়েন্দাদের দেয়া প্রতিবেদন ছাপাতে ডেইলি স্টার অস্বীকার করত। কই, মাহমুদুর রহমান তো ছাপেন নি। এক এগারোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন মাহমুদুর রহমান। তাহলে সাংবাদিকতায় অস্পষ্ট, পক্ষপাতদুষ্ট ও একচক্ষু কারা? দৈনিক আমার দেশ নয়, বরং ডেইলি স্টার। ডেইলি স্টার এখানে যা লিখেছে তা তাদের হিপোক্র্যাসির একটা নজির, মাত্র। তার সঙ্গে আমি একমত নই, কিন্তু এখানে যে নীতিগত প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার জন্য তার মূল্য আছে। মাহমুদুর রহমানের সমালোচনার আগে ডেইলি স্টারকে ভাবতে হবে তাদের ইসলামবিদ্বেষের বিষ মোটেও কম ভয়ঙ্কর ও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কম ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এর বিচার জনগণকেই করতে দেওয়া উচিত। ডেইলি স্টার যা বলছে তা তারা নিজেরা মানে না জানি, তবু এই নীতির আমি দৃঢ় সমর্থক। এই কারণেও মাহফুজ আনামকে সমর্থন করা নাগরিক হিসাবে আমার নৈতিক কর্তব্য মনে করি। এটাই সকলের স্পিরিট হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে উদার বা সত্যকারের লিবারেল চিন্তাচেতনার ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ডেইলি স্টার ও দৈনিক প্রথম আলোর রাজনীতি যতোটা এই রাজনীতিকে সততার সঙ্গে বহন করতে পেরেছে তাদের সাফল্যও সেই মাত্রাতেই ঘটেছে। কিন্তু যখনই তারা উদার রাজনীতি পরিহার করে অনুদার রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল অবলম্বন করেছে তখনি তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে।
এই উপলব্ধিটুকু শুধু সবার ঘটুক, আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ১৩ ফাল্গুন ১৪২২। শ্যামলী।
মাহফুজ আনামের উপলব্ধি ও স্বীকারোক্তি হচ্ছে এজেন্সির চাপের কাছে একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর নতি স্বীকার করা ঠিক হয়নি- এ কথা একটি টেলিভিশান চ্যানেলে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন। তবে তিনি যে শুধু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে এজেন্সির দেয়া তথ্য ছেপেছেন তা নয়, খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে তাঁর লেখালিখির কথা তিনি চেপে গিয়েছেন। এখনো উল্লেখ করেন নি। এটা অন্যায় এবং হিপোক্র্যাসি।
তারপরও আমি তাঁর এই উপলব্ধিকে স্বাগত জানাই। ফলে তাঁর এই উপলব্ধির সুযোগ নিয়ে তাঁকে অযথা হয়রানি ও তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলারও তীব্র নিন্দা জানাই।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে হয়রানি আমি একটা অশনি সংকেত হিসাবে দেখি। শেখ মুজিবর রহমান দলীয় পত্রিকা ছাড়া বাকশালী আমলে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যেভাবে একদলীয় শাসন চালাচ্ছেন তাতে তিনি এখনো দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকবেন কি না তা নিশ্চিত হতে পারছেন না। অতএব তিনি মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে তাঁদের এক এগারোর ভূমিকার জন্য এখন কাটছাঁট করে দেবেন। আওয়ামী লীগের দলীয় স্বার্থের অধীনস্থ না থাকলে কোনো গণমাধ্যমই শেখ হাসিনা রাখবেন না। এই পরিস্থিতি বাকশালের চেয়েও ভয়াবহ হবে। যারা নাগরিক ও মানবিক অধিকারে বিশ্বাস করেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁদের উচিত এই হয়রানির প্রতিবাদ জানানো। দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এই সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সব মামলার জামিন হবার পরেও নতুন মামলা দেখিয়ে তাঁকে এখনো কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের উচিত ছিল মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে সুদৃঢ় ভাবে দাঁড়ানো। তাঁরা নাম কা ওয়াস্তে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন নীতিগত দৃঢ়তা তাঁদের মধ্যে আমরা দেখি নি। কিন্তু সে কারণে তাঁকে যখন ক্ষমতাসীনরা হয়রানি করছে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না।
এক এগারোর সময় ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সেনা সমর্থিত সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্যে তাঁরা বদল ঘটাতে পেরেছিলেন। এটা তাঁদের শক্তির পরিচয় ছিল, সন্দেহ নাই। এর আগে থেকেই সিপিডিসহ এনজিওদের একাংশকে নিয়ে তাঁরা সৎ মানুষের খোঁজে জাতীয় রাজনীতি প্রবর্তনের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তখনই সুশীলসমাজ নামক সমাজের এই অংশের রাজনৈতিক অজ্ঞতা কিম্বা হিপোক্রাসি ধরা পড়তে শুরু করে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিছক সৎ মানুষের অভাব নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে ওঠার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। তারই ফল বাকশালী দুঃশাসন, সেনাশাসকদের কুকীর্তি এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতি। এগুলো বাইরের দিক। গোড়ায় রয়েছে আর্থসামাজিক সম্পর্ক ও ব্যবস্থা এবং পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তিক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রাম জয়-পরাজয়ের ইতিহাস।
তদুপরি ক্ষমতা, শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রকাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে সমাজের চিন্তাভাবনা অতিশয় দুর্বল। দলবাজি করা বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে অতি নিম্নপর্যায়ের দালালী ছাড়া কোন স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংবাদিকতার চর্চার দেখা পাওয়া কঠিন। ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসের মন্দ চরিত্রের দিকটা স্রেফ রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের দোষ হতে পারে না। বরং সেই ক্ষেত্রে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ যাদের আমরা ‘সুশীল’ বলে অভিহিত করি তাঁদের দায়িত্বটাই সমধিক। অথচ তাঁরা নিজেদের সবসময়ই সমাজ ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে ভেবেছেন এবং এখনও ভাবেন, যার ফলে বাংলাদেশের সকল মন্দের জন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলকেই শুধু দোষারোপ করেন। এটা একটা বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের ভূমিকা বিচার করে দেখবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ও প্রতিভা সুশীলদের মধ্যে দেখা যায় না। এদের চিন্তার দৌড় কতটা সংকীর্ণ সেটা আমরা বুঝতে শুরু করি যখন তারা এক এগারোর আগে দোর্দণ্ড প্রতাপে সৎ মানুষ খোঁজ করতে শুরু করেছিলেন এবং রাজনীতির দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের বিপরীতে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের আবিষ্কার করেছিলেন।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের দুটো দৈনিক পত্রিকা পড়লে আমরা বুঝতে পারি ইতিহাস ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর চিন্তাভাবনা কতটা অপরিপক্ব ও সংকীর্ণ। যদি তাঁরা আসলেই উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন চাইতেন এবং কিভাবে বাংলাদেশে তা কায়েম করা সম্ভব সে সম্পর্কে আন্তরিক ভাবে ভাবতেন তাহলে বাংলাদেশে আর যাই হোক একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সরকার কায়েম হোত না। সেই ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের চিন্তার সমস্যা কোথায় সেটা আগে তাঁরা নিজেরা পর্যালোচনা করতেন, কিম্বা নিদেন পক্ষে পর্যালোচনা করবার হিম্মত প্রদর্শন করতেন।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান দুটো ফর্মুলা নিয়ে কাজ করেছেন। এক. কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, সৎ মানুষদের রাজনীতিতে বসিয়ে দিলেই বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র, সাম্য, ইনসাফ ইত্যাদি মৌলিক রাজনৈতিক ধারণার বিকাশ ঘটানোরও কোন দরকার নাই। এদেশে বহুজাতিক কোম্পানি বা করপোরেট স্বার্থ কায়েম করা গেলেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এটা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের পক্ষে দাঁড়ান নি। বরং উল্টাটা করেছেন। দাঁড়িয়েছেন বিদেশী বহুজাতিক কম্পানির স্বার্থে। এমনকি সাধারণ মানুষের খাদ্য ব্যবস্থা রক্ষার ন্যূনতম দরদ আমরা তাঁদের মধ্যে দেখি না। ডেইলি স্টার তাদের প্রথম পাতায় মনসান্টোর বিটিবেগুন ও সিনজেন্টার গোল্ডেন রাইসের পক্ষে দাঁড়ায়। এই অবস্থান বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ ঘটায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও পরিবেশের সুরক্ষার দিক থেকে এই দু’টি পত্রিকার ভূমিকা এ কারণে নেতিবাচক। এই সমালোচনা আমরা করে যাবো। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পত্রিকা দু’টিকে হয়রানি করবে আমরা তা হতে দিতে পারি না।
তাঁদের দ্বিতীয় ফর্মুলা হচ্ছে পাশ্চাত্যের ওয়ার অন টেররের সঙ্গী হয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক ভাবে ক্ষমতাবান হওয়া। এদেশে তাদের মতাদর্শিক বা রাজনৈতিক দুষমন হিসাবে তারা তাই জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের মতো ইসলামকেই শত্রু গণ্য করেন। যে কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁরা বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিরোধী ছিলেন। বিএনপি ও ইসলামপন্থীদের অবশ্যই সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সেকুলারিজমের দোহাই দিয়ে তাঁরা সমর্থন করেছেন জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের। এই দুই সস্তা ফর্মুলা চর্চা করতে গিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্যে শেষাবধি বাংলাদেশে তাঁরা যে বদল ঘটালেন তার কুফলই তাঁরা এখন ভোগ করছেন। বিএনপি ও বিরোধীদলীয় জোটকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করবার কাজেও তাঁরা শেখ হাসিনার হাতকেই শক্ত করেছিলেন।
এই সব চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের গলদকে সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত না করে একজন সৎ মানুষকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই বাংলাদেশের রাজনীতির সমস্যা মিটে যাবে এর চেয়ে আজগুবি, অবাস্তব ও অদূরদর্শী চিন্তা আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশে ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন যেকোনো নাগরিকই তাদের সুশীল রাজনীতির এই ফাঁপা দিকটা বুঝতে পেরেছিল। সে ক্ষেত্রে সংস্কার নাকি খোলনলচে বদলে দিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয় হতে পারত। ধরে নিচ্ছি সেই তর্কে তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক, উদার ও অহিংস রাজনীতির পক্ষে থাকতেন। কারণ ক্ষমতা, রাষ্ট্রকাঠামো কিংবা সামাজিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতির পক্ষের মানুষ তাঁরা নন। এতে কোন দোষ নাই। কিন্তু পরাশক্তির স্বার্থের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা এবং তাঁদের ‘গুড গভর্নেসের’ রাজনীতির ফেরিওয়ালা বা নির্বিচার এজেন্ট হওয়া শুধু দোষের না বরং মারাত্মক অপরাধ। এক এগারোর সময় কোন সুনির্দিষ্ট অবস্থান না নিয়ে বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য কী ধরনের রাজনৈতিক পথ নেয়া যেতে পারে তা নিয়ে ফলপ্রসূ তর্কের পরিবেশ তাঁরা তৈরি করতে পারতেন। তার সমূহ সুযোগ ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই দুই পত্রিকার সম্পাদক সেসময় তার চর্চা করেননি। এখনো করেন না। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আদালতে এরা তাঁদের ভূমিকার কারণেই অপরাধী হিসাবেই থেকে যাবেন। এটাই ইতিহাস।
ফলে তাদের ‘সৎ মানুষের সন্ধান’ এবং ‘বদলে যাও বদলে দাও’ জাতীয় স্লোগান ও বিল বোর্ড সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। সেই সময় কূটনীতিক মহলের ‘ট্যুস ডে গ্রুপ’, বিভিন্ন কূটনীতিবিদদের হাঁকডাক, ক্ষমতাসীন বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করবার প্রতিটি প্রচেষ্টাই সাধারণ মানুষ বঙ্গীয় সুশীলদের বগলে নিয়ে পরাশক্তির ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখেছে। তাঁদের অনুমান মিথ্যা হয় নি। দেখা গেল সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মাহফুজ আনাম দাবি করলেন তাঁদের লেখালিখির কারণেই মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
সৎ মানুষ হিসাবে তারা ডক্টর ইউনূসকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ডক্টর ইউনূস প্রকাশ্যে না এসে পেছনে থেকে সমর্থন যুগিয়েছিলেন। এতে তাঁর মান আজও কিছুটা রক্ষিত আছে। কিন্তু এরাই তাঁকে জরুরী অবস্থার অধীনে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু একসময় সেই পথে আর এগোলেন না। বললেন, যাঁরা তাঁকে নামিয়েছিল তাঁরা তাঁকে নামিয়ে পিছু হটে গিয়েছে। সেটা রাজনৈতিক দল না করবার বাহানা হিসাবে হয়তো বলেছেন। এভাবে একটি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোন পরিবর্তন আনা যায় না, এই উপলব্ধি ডক্টর ইউনূসের আছে কি না জানি না। কিন্তু জরুরী অবস্থার অধীনে রাজনৈতিক দল না করে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারতেন। কিন্তু একটা সময়ে তিনি প্রকাশ্যে দলীয় রাজনীতিতে আগ্রহী নন সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ইউনূস-বিদ্বেষ উৎকট সন্দেহ নাই সময়ে তা মিথ্যা বেহুদা অভিযোগ হলেও ডক্টর ইউনূসের বিরুদ্ধে মুজিব কন্যার গোস্বা করবার সঙ্গত কারণ অবশ্যই আছে। যেখানে প্রধান প্রধান জাতীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ সেখানে ডক্টর ইউনূস তাদের স্থান পূরণ করতে রাজনৈতিক দল করতে নেমেছিলেন। এর ফলে তাঁর গায়ে যে ময়লা লেগে গিয়েছে সেটা টের পেয়ে তিনি রাজনীতি থেকে দ্রুত সরে এলেও এখনও তা ধুয়ে ফেলা যাচ্ছে না। তাঁকে যারা রাজনীতিতে নামিয়েছিল তাঁদের দলে মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানও আছেন। ডক্টর ইউনূস ছিলেন তাঁদের ‘সৎ মানুষ’ মার্কা রাজনৈতিক ক্যান্ডিডেট। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির টানাপড়েনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডক্টর ইউনূসের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ভুল রাজনৈতিক চিন্তা ও ভুল পদক্ষেপ তা নষ্ট করে দিয়ে গেছে। গণমাধ্যম সরকার গঠনে ও সরকার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। তেমনি রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাষ্ট্রগঠনেও গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আগামি দিনেও বাংলাদেশকে শক্ত হাতে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমের বিচক্ষণ ভূমিকার প্রয়োজন হবে। এর কোন বিকল্প নাই। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান অতীতে ভুল করেছেন বলে আগামিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন না বা রাখতে পারবেন না এটা আমি মনে করি না। এক এগারোতে কেন তাঁরা উদার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখেন নি তার ব্যাখ্যা তাঁরাই শুধু জানেন। নিয়ম কিংবা সাংবিধানিক বিধিবিধান না মেনে সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চড়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী ও ব্যবসায়ীদের কেন তাঁরা শায়েস্তা করতে নেমেছিলেন তার একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই তাঁদের আছে। এ ব্যাপারে তাঁদের উপলব্ধিও নিশ্চয়ই আছে।
গণমাধ্যমের ভুলত্রুটি কিম্বা অন্যের লেখালিখির পর্যালোচনা আমরা করতেই পারি। যখনই তা করি তার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে সামগ্রিক ভাবে চিন্তা বিকশিত করবার সুযোগগুলো –বিশেষত রাজনৈতিক পরিসর, রাজনৈতিকতা, ক্ষমতা, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে সমাজের চিন্তাচেতনা যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন করে তোলা। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা স্রেফ ক্ষমতার জোরে আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিরোধীদের নিগৃহীত করবে এটা মেনে নেওয়া হবে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আত্মঘাতী। আমি অতএব আহ্বান জানাবো যাঁরা ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর রাজনীতির বিরোধিতা করেন তাঁরাও নীতিগত জায়গা থেকে রাষ্ট্র যখন যাকে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবেন। এই অতি প্রাথমিক নীতিগত জায়গা বিনষ্ট হলে গণতন্ত্র দূরে থাকুক বাংলাদেশে কোন ভাবেই আমরা কোন প্রকার ‘রাজনৈতিক পরিসর’ নির্মাণ করতে পারবো না। আমি জানি মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান ভাবেন নি ক্ষমতাসীনরা যখন মাহমুদুর রহমানকে অন্যায় ভাবে শাস্তি দিচ্ছে, দীর্ঘ দিন কারাগারে বিচার ছাড়া আটকে রেখেছে... সেই প্রকার দুর্দশার শিকার তাঁরা হবেন না। মাহমুদুর রহমানের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তাদের যে দৃঢ় নীতিগত অবস্থান জারি রাখা জরুরি ছিল, সেই অবস্থান তাঁরা নেন নি। আজ তাঁরা নিজেরাই ক্ষমতাসীনদের রোষের শিকার হয়েছেন।
রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ হচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। এর সহজ অর্থ হচ্ছে সমাজে সমষ্টির স্বার্থ নিয়ে কথা বলবার পরিসর তৈরি করা। সমাজের অনেকের সঙ্গেই আমাদের চিন্তা, মত, সিদ্ধান্ত, ভাবনা ইত্যাদির বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু আমরা সকলেই যদি সমাজের অন্তর্গত হয়ে থাকি তাহলে যাঁদের মতের সঙ্গে আমাদের মতের বিরোধ চরম তাঁদের কথা শোনার ও কথা বলার পরিসর নির্মাণের গুরুত্বকে যেন আমরা উপেক্ষা না করি। পরস্পরের মধ্যে কথা বলার মধ্য দিয়েই সমষ্টির ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা রূপ লাভ করে। যদি আমরা মনে করি মতাদর্শিক ভাবে বিরোধীদের কথা বলার সুযোগ বন্ধ করে দিলেই সেই মতাদর্শ মরে যাবে তাহলে বুঝতে হবে আমরা গভীর কুয়াশার সাম্রাজ্যে বসবাস করছি। চিন্তাকে চিন্তা দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে আর তা করতে হলে সমাজে কথা বলার পরিসর শক্তিশালী করতে হবে। হবেই। এর কোনো বিকল্প নাই। আর এটা সফল ভাবে গণমাধ্যমই করে ও করতে পারে। কেন এক-এগারোর সময় মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি নির্মূল করবার জন্য মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে ক্ষমতায় আনলেন সে সম্পর্কে আমার নিজের ব্যাখ্যা আছে। দুই একটি লেখায় আমি তা উল্লেখও করেছি। সেটা হোল বাংলাদেশে লিবারেলিজম বা উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো উদার রাজনীতিতে আস্থাশীল নয়। এটা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে বড় সড় বিপদের জায়গা। তারা উদার রাজনৈতিক চিন্তার পক্ষের শক্তি নয়। এক এগারোর সময় দেখা গেলো তারা নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক চিন্তা-চেতনারও বিরোধী। দ্বিতীয়ত দুটো পত্রিকাই রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ এবং সমাজে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জারি রাখার গুরুত্বকে খাটো করে দেখে। সুশীলদের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে তারা রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করে, কিম্বা নিজেরা রাজনৈতিক দলের বিকল্প হতে চায়। এই উচ্চাশা ভয়ঙ্কর। এই দুটো পত্রিকার রাজনৈতিক চেতনার অভাব পত্রিকা দুটিকে এক এগারোর সময় আওয়ামী লীগের ভাষায় অসাংবিধানিক পথে রাজনৈতিক দল বিলোপ... বিশেষত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছিল। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি বাংলাদেশকে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনায় পর্যবসিত করেছে- এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তার সমাধান তাদের নির্মূল করা নয়। বরং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরো সচল ও সজীব করে তোলা। দলবাজি নয়, বরং রাজনীতির সজীব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই নতুন রাজনীতির পথ বের করে আনা। সেটা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব, যদি সুশীলদের বিরাজনীতিকরণের চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিতে পারি। তাঁদের আবেগ, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, সংকল্প, ইত্যাদির প্রতি মনোযোগী থেকে তাকে প্রকাশের ও তর্কবিতর্কের সুযোগ তৈরি করি। সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নির্মাণের প্রক্রিয়া জারি রাখি। ইত্যাদি। দৈনিক প্রথম আলোর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু এই শক্তিকে ইতিবাচক ভাবে কাজে না খাটিয়ে দৈনিক প্রথম আলো একদিকে তাদের পত্রিকার অভ্যন্তরে সক্রিয় আওয়ামী ও দিল্লি প্রেমিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটের বিরোধিতা করা তার খাসিলত হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে তাঁরা যুক্ত থেকেছে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পরিবারকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করবার তৎপরতায়। যার ফল কারো জন্যই শুভ হয়নি এটা খোদ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের কাজটাই গোড়ায় মেরে ফেলার শামিল।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপির রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশ ও গতিশীল উন্নয়নের পথে বাধা। নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার দিক থেকে দেখলেও এদের সমালোচনা বা বিরোধিতা মোটেও অযৌক্তিক নয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতির জায়গা থেকে দেখলে এই দুটি দলের রূপান্তর কিম্বা এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি ছাড়া বাংলাদেশের গতিশীল বিকাশ সম্ভব নয়। এসব নিয়ে তর্ক বা আপত্তি করবার কিছু নাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে। সেটা নিশ্চয়ই এই ধরনের দলের বিপরীতে সেনা সমর্থিত সরকার কায়েম করা নয়। এদের বিপরীতে জয়ী হতে হলে বাংলাদেশকে বেশ দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জারি রেখে তার ভেতরেই রাজনৈতিক সচেতনতা নির্মাণের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। একেই আমি রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ বলে থাকি। গণমাধ্যম এই ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো সে কাজে নিবিষ্ট না থেকে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছে। এই দুই সম্পাদকের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার রুষ্ট হবার এটাই প্রধান কারন। যদিও শেখ হাসিনা নিজেও দাবি করেছেন এক এগারো সরকার তাঁদেরই আন্দোলনের ফল। এবং এক এগারোর সরকারের সকল অপকর্ম তাঁরা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এরপর থেকে মাহফুজ আনামকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দোষে অভিযুক্ত করবার যুক্তি থাকে না। কিম্বা থাকলেও খাটো হয়ে যায়। শেখ হাসিনা যদি মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে ক্ষমা করে দিতে পারেন তো মাহফুজ মতিউরকে ক্ষমা করতে পারছেন না কেন?
এর একটা প্রহসনমূলক দিক আছে। মাঝে মধ্যে ইতিবাচক অর্থে উদার বা লিবারেল চিন্তাভাবনার নমুনা দেখালেও ডেইলি-স্টার প্রথম আলো শেষাবধি দুটো অঘটন ঘটায়। একটি হচ্ছে দলবাজ ভূমিকা পালন করার কাজে নিজেদের নামিয়ে আনা। সেটা তারা করে সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তাদের অনুমানের জন্য। এই অনুমান হচ্ছে বাংলাদেশে সেকুলারিজম রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে হবে। দাঁড়াতে হবে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে, এদের নির্মূলের কাজে। বাংলাদেশের সেকুলারদের জন্মগত অসুখের কারণে তাঁরা মনে করে ইসলামের সঙ্গে কিম্বা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে গণতন্ত্র ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ প্রশ্নে কোনো নেগোশিয়েশান্স, চিন্তার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের কোন সুযোগ নাই। ইসলামপন্থীদের সাথে কোন রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ, বোঝাপড়া তৈরি করার কোনো সুযোগ তৈরি করতে এরা চায় না। বরং তাঁদের কাজ হচ্ছে খেয়ে-না-খেয়ে ইসলাম সংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছুর বিরোধিতা করা। এটাই প্রহসনের জায়গা। দুটো পত্রিকাই মূলত বিএনপির রাজনীতির বিরোধিতা করে। কিন্তু তাতেও দুই সম্পাদক শেখ হাসিনার মন জয় করতে পারেননি। পারেননি কারণ তাঁরা খোদ শেখ হাসিনাকেই নির্মূল করে বোঝাতে চেয়েছেন শেখ হাসিনার ইসলাম নির্মূলের কাজটা তাঁরা আরো ভালো পারবেন।
ইদানীং প্রথম আলোতে দেখছি ইসলাম সম্পর্কে ভুল চিন্তা সামাল দেবার জন্য তাঁদের সম্পাদকীয় পাতায় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বয়ান দেওয়া। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লেখালিখি দেখে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু দেখলাম এটা নিছকই ধর্ম প্রচার মাত্র। ইসলামের আদৌ কোনো আদর্শগত ও রাজনৈতিক চিন্তা প্রথম আলোর উদার রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তার বিচার নয়। সম্ভবত তারা ইসলামপন্থীদের সহানুভূতি চাইছে। তবে সেটা করতে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পর্যালোচনামূলক লেখালিখি না করে ধর্ম শিক্ষা বা ধর্মপ্রচারকের ভূমিকায় নামাটা হচ্ছে প্রথম আলোর সবচেয়ে হাস্যকর ভূমিকা। এই সব জায়গাতেই প্রথম আলোর চূড়ান্ত হিপোক্রাসি ধরা পড়ে। সত্য এই যে ‘ইসলাম’ একাট্টা কিছু নয়। ইসলাম নানান কিসিমের নানান মতাদর্শের নানান রাজনীতির। প্রশ্ন হচ্ছে উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ইসলাম প্রণোদিত কী ধরনের চিন্তা ডেইলি স্টার বা প্রথম আলোর দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ? তাকে তারা কিভাবে হাজির করে সেটাই মুখ্য বিষয়। ইসলাম প্রচার তাদের কাজ না। ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সমাজে ইতিবাচক কথাবার্তা ও ডায়ালগের শর্ত তৈরি করা এখনও বড় একটি কাজ। যে কাজ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে ওঠার শর্ত নিশ্চিত করে। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের সমালোচনা অব্যাহত থাকবে। উভয়েই করপোরেট স্বার্থের পাহারাদার। সেটা ভিন্ন একটি বিতর্ক। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পর্ক বিচার না করে বিচ্ছিন্ন ভাবে শুধু দুটো পত্রিকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার চরিত্র আলোচনা সঙ্গত হবে না। বরং এখন মাহফুজ আনামকে যেভাবে ক্ষমতাসীনরা শায়েস্তা করতে চাইছে তার বিরোধিতা কর্তব্য।
শেষ করবার আগে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ‘দৈনিক আমার দেশ’ বন্ধ করে দেবার পর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ৩ জুন ২০১০ তারিখে মাহফুজ আনাম যে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন পাঠকদের তা মনে করিয়ে দিচ্ছি।
'As a newspaper upholding journalistic professionalism and freedom, we have, however, found it difficult at times to appreciate the brand of journalism that the Amar Desh was pursuing. Still it is our firm conviction that a dissenting voice, however venomous and thinly founded, must be allowed space because it is an integral part of a functioning democracy, a touchstone of free press and an axiom that the people will be the ultimate judge of all opinions. No matter how opaque or squinted or biased a report and a view-point maybe for or against somebodz it must get a free play not only to enrich environment of free press but also strengthen the institutions of democracy'.
‘যে সাংবাদিকতার পেশা ও স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাসী সেই দিক থেকে দৈনিক আমার দেশ-এর সাংবাদিকতা আমাদের পক্ষে সবসময় প্রশংসা করা কঠিন, তবুও এটা আমাদের বিশ্বাস যে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তা যতোই বিষোদ্গারী হোক ও হালকা ভিত্তির ওপর দাঁড়াক- তাকেও অবশ্যই জায়গা করে দিতে হবে। কারণ তা গণতন্ত্র সক্রিয় রাখার জন্য জরুরি, স্বাধীন সংবাদপত্র আছে কি না তা বিচারের কষ্টিপাথরও এটা আর জনগণই শেষ বিচারক এই নৈতিক মানদণ্ড কার্যকর কি না তার প্রমাণও এটাই। অস্পষ্ট, একচোখা অথবা পক্ষপাতদুষ্ট হোক বা না হোক সাংবাদিকতাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যেন শুধু মুক্ত সংবাদপত্রের পরিবেশ বিরাজ করা নয়, একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণতন্ত্রকেও তা শক্তিশালী করে’।
বলা হচ্ছে দৈনিক আমার দেশ এবং মাহমুদুর রহমানের সাংবাদিকতা অস্পষ্ট, অপরিচ্ছন্ন, একচোখা, পক্ষপাতদুষ্ট ইত্যাদি। বিরোধী মতাদর্শ হিসাবে দৈনিক আমার দেশও ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো সম্পর্কে একই কথা বলতে পারে। ভিন্ন মতাদর্শের বিরোধিতা ডেইলি স্টার করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ডেইলি স্টার কি আদৌ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সংহত করবার কাজ করে? বা করেছে? যে দাবি তারা করছে তা মোটেও সত্য নয়। যদি এটা সত্য হোত তাহলে গোয়েন্দাদের দেয়া প্রতিবেদন ছাপাতে ডেইলি স্টার অস্বীকার করত। কই, মাহমুদুর রহমান তো ছাপেন নি। এক এগারোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন মাহমুদুর রহমান। তাহলে সাংবাদিকতায় অস্পষ্ট, পক্ষপাতদুষ্ট ও একচক্ষু কারা? দৈনিক আমার দেশ নয়, বরং ডেইলি স্টার। ডেইলি স্টার এখানে যা লিখেছে তা তাদের হিপোক্র্যাসির একটা নজির, মাত্র। তার সঙ্গে আমি একমত নই, কিন্তু এখানে যে নীতিগত প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার জন্য তার মূল্য আছে। মাহমুদুর রহমানের সমালোচনার আগে ডেইলি স্টারকে ভাবতে হবে তাদের ইসলামবিদ্বেষের বিষ মোটেও কম ভয়ঙ্কর ও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কম ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এর বিচার জনগণকেই করতে দেওয়া উচিত। ডেইলি স্টার যা বলছে তা তারা নিজেরা মানে না জানি, তবু এই নীতির আমি দৃঢ় সমর্থক। এই কারণেও মাহফুজ আনামকে সমর্থন করা নাগরিক হিসাবে আমার নৈতিক কর্তব্য মনে করি। এটাই সকলের স্পিরিট হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে উদার বা সত্যকারের লিবারেল চিন্তাচেতনার ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ডেইলি স্টার ও দৈনিক প্রথম আলোর রাজনীতি যতোটা এই রাজনীতিকে সততার সঙ্গে বহন করতে পেরেছে তাদের সাফল্যও সেই মাত্রাতেই ঘটেছে। কিন্তু যখনই তারা উদার রাজনীতি পরিহার করে অনুদার রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল অবলম্বন করেছে তখনি তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে।
এই উপলব্ধিটুকু শুধু সবার ঘটুক, আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ১৩ ফাল্গুন ১৪২২। শ্যামলী।
No comments