দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধের দামামা by রিচার্ড জাভেদ হেইডেরিয়ান
বহু
বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার জলসীমায় রাজত্ব করেছে, তার বিশাল নৌবহর
এমনভাবে এখানকার জলসীমা দাপিয়ে বেড়িয়েছে যে মনে হতো, তার রাশ টানার মতো
কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের প্রতি একই সঙ্গে সহৃদয় ও উদ্ধত ছিল।
তারা এই মহাদেশের সশস্ত্র অভ্যুত্থানে সমর্থন দিয়েছে। এশিয়ার সামরিক
ঘাঁটিগুলোতেও তার অবাধ যাতায়াত ছিল। আবার তারা রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয়
দুই ধরনের আক্রমণকারীদের হাত থেকে সমুদ্রপথের ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা করেছে।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। ফলে সব দেশই চায়, আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক। হ্যাঁ, বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কার্যত সমুদ্রপথে বৈশ্বিক যোগাযোগের পাহারাদারের কাজ করছে। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন নৌ-শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি।
নতুন এক নৌশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই আন্তর্জাতিক সমুদ্রব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে উল্টে দিচ্ছে। চীন তার মহাদেশীয় প্রতিবেশীদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, তার নৌশক্তিও ক্রমেই বাড়ছে, আবার তার হাতে বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র রয়েছে—এই বলে বলীয়ান হয়ে চীন পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জলপথে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি সংকুচিত করেছে। হলুদ সমুদ্র থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী তার আশপাশের সমুদ্রসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির উপস্থিতিকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীন কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে সামরিক স্থাপনার এক ছড়ানো-ছিটানো নেটওয়ার্ক ও বিমানঘাঁটি গড়ে তুলেছে। চীন পরবর্তীকালে এই ঘাঁটিকে সামরিক আক্রমণ শুরু করার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের একটি অংশ সামরিক শক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতী, এমনকি ওবামার মিত্ররাও এ ব্যাপারে সোচ্চার। তাদের চাপে পড়ে ওবামা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বেইজিংয়ের নৌশক্তি প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা আরও আগ্রাসী অবস্থান নেবে। কিন্তু তারা যে চীনের সৃষ্ট কৃত্রিম দ্বীপের কাছাকাছি নজরদারি করার জন্য জাহাজ পাঠিয়েছে, তাতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরও বাড়তে পারে।
আলফ্রেড থায়ার মাহান ১৮৯৭ সালে দ্য ইন্টারেস্ট অব আমেরিকা ইন সি পাওয়ার শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন ১৯ শতকের একজন অন্যতম নৌকৌশলবিদ। তিনি সেই বইয়ে বলেছেন, সমুদ্র-বাণিজ্য বা নৌশক্তি যেভাবেই হোক না কেন, সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকলে ‘পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কারণ, স্থলভূমিতে যত সম্পদই থাকুক না কেন, সমুদ্রপথে সম্পদ বিনিময় বা বাণিজ্য যত সহজ, অন্য পথে তা অত সহজ নয়।’
মাহান বলেন, একটি দেশ যদি দুনিয়াতে পরাশক্তি হতে চায়, তাহলে তাকে আশপাশের জলসীমায় প্রভুত্ব করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তাকে এমন এক অঞ্চল তৈরি করতে হবে, যাতে অন্যরা তাকে সমীহ করে এবং বহিঃশক্তিকে তার আশপাশ থেকে দূরে রাখা যায়। আজ চীন মাহানের নীতি অনুসরণ করছে, সে নিজের আশপাশের জলসীমায় প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
গত কয়েক বছরে চীন কী করেছে তার একটা ফিরিস্তি দিই। সে দক্ষিণ কোরিয়ার দাবির বিরুদ্ধে হলুদ সাগরের ওপর নিজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে, একইভাবে সে জাপানের বিরুদ্ধে পূর্ব চীন সাগর এবং ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেইয়ের বিরুদ্ধে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর নিজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
আবার সে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-উপস্থিতিকে সীমিত করার চেষ্টা করেছে, সাগরে তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য অভিযান চালিয়েছে। এর ফলে ২০১১ সালে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা জেট ফাইটার বিমান ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ইপি-৩ সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বিমানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রাসীভাবে চীনের সার্বভৌমত্বের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে, তার ওপরই এখন অনেক কিছু নির্ভর করবে আরও সম্প্রতি চীনা ফাইটার জেট ও আধা সামরিক বাহিনী ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও জাহাজকে হয়রানি করেছে। পূর্ব চীন সাগরে চীন জাপানের সঙ্গে সেনকাকু ও দিয়াও দ্বীপ নিয়ে এক তিক্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। বেইজিং সেখানে এক ‘এয়ার ডিফেন্স আইডেনটিফিকেশন জোন’ তৈরি করেছে, ফলে এখন অন্য দেশকে সেখান দিয়ে যেতে হলে তাদের অনুমতি নিতে হয়।
ওদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে গত দুই বছরে চীন ১৭ হাজার হেক্টর কৃত্রিম ভূমি পুনরুদ্ধার করেছে। সেই জমি হয়তো জোয়ারের সময় ডুবে যেত। এই ভূমির মধ্যে আরও আছে প্রবাল প্রাচীর ও পাথর, যেগুলোকে তারা পূর্ণাঙ্গ দ্বীপে পরিণত করেছে।
না, চীনের কার্যক্রম শুধু আন্তর্জাতিক আইনেরই লঙ্ঘন নয়, তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে অন্য দাবিদাররাও বিরাট হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি সেখানে জাহাজ চালানোর স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে চীন এই বিতর্ককে সামরিকায়ন করে আরও অধিক হারে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এ ব্যাপারে চীন অতীতের নৌশক্তিগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। অতীতে নেদারল্যান্ডস ও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীন শুধু তার আশপাশের জলসীমায় প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায় না, সে এটাকে তার ভূমির সম্প্রসারণ হিসেবে গণ্য করছে, ‘নীল জমি’।
জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে চীন তার কুখ্যাত ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’ মতবাদের আলোকে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর তার ‘অন্তর্নিহিতি’ ও ‘তর্কাতীত’ দাবি রয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু ওই কনভেনশন বলে, উপকূলীয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলসীমায় নিজের অধিকার দাবি করতে পারে না। নিজের নৌ-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ও সেখানে চীনা ‘হ্রদ’ সৃষ্টি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র তার এশীয় মিত্রদের সঙ্গে নিরাপত্তা বন্ধন দৃঢ় করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আরও বেশি হারে প্রবেশের ব্যাপারে আলোচনা করেছে, চীনকে পাহারা দেওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সহায়তা পেয়েছে।
এই অক্টোবরের মধ্যভাগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র ওই এলাকায় চীনের সার্বভৌমত্বের দাবি চ্যালেঞ্জ করতে চীনের কৃত্রিম দ্বীপের ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ অভিযান পরিচালনা করবে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএস লাসেন (মিসাইল নিয়ন্ত্রিত ধ্বংসকারী) মোতায়েন করেছে।
ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের যুক্তি হচ্ছে, চীনের এই ভূমির বেশির ভাগই জোয়ারের সময় ডুবে যায়, সে কারণে জাতিসংঘের রীতি অনুসারে তার ওপর চীনের দাবি থাকতে পারে না। চীন আবার হুংকার দিয়েছে, ‘চীনা সীমানায় সমুদ্র ও আকাশপথে বিধি লঙ্ঘন করে কেউ ঢুকে পড়লে তার নিস্তার নেই।’ ফলে ওই এলাকায় সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে গেল।
যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রাসীভাবে চীনের সার্বভৌমত্বের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে, তার ওপরই এখন অনেক কিছু নির্ভর করবে। বৈশ্বিক গণমাধ্যম আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বৈরথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। তবে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতারাও ব্যাপক চাপের মুখে আছেন, তাঁদের সংকল্প ও প্রতিরোধ দেখাতে হবে। এশিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উপনীত হয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া
রিচার্ড জাভেদ হেইডেরিয়ান: এশীয় ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। ফলে সব দেশই চায়, আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক। হ্যাঁ, বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কার্যত সমুদ্রপথে বৈশ্বিক যোগাযোগের পাহারাদারের কাজ করছে। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন নৌ-শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি।
নতুন এক নৌশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই আন্তর্জাতিক সমুদ্রব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে উল্টে দিচ্ছে। চীন তার মহাদেশীয় প্রতিবেশীদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, তার নৌশক্তিও ক্রমেই বাড়ছে, আবার তার হাতে বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র রয়েছে—এই বলে বলীয়ান হয়ে চীন পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জলপথে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি সংকুচিত করেছে। হলুদ সমুদ্র থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী তার আশপাশের সমুদ্রসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির উপস্থিতিকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীন কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে সামরিক স্থাপনার এক ছড়ানো-ছিটানো নেটওয়ার্ক ও বিমানঘাঁটি গড়ে তুলেছে। চীন পরবর্তীকালে এই ঘাঁটিকে সামরিক আক্রমণ শুরু করার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের একটি অংশ সামরিক শক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতী, এমনকি ওবামার মিত্ররাও এ ব্যাপারে সোচ্চার। তাদের চাপে পড়ে ওবামা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বেইজিংয়ের নৌশক্তি প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা আরও আগ্রাসী অবস্থান নেবে। কিন্তু তারা যে চীনের সৃষ্ট কৃত্রিম দ্বীপের কাছাকাছি নজরদারি করার জন্য জাহাজ পাঠিয়েছে, তাতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরও বাড়তে পারে।
আলফ্রেড থায়ার মাহান ১৮৯৭ সালে দ্য ইন্টারেস্ট অব আমেরিকা ইন সি পাওয়ার শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন ১৯ শতকের একজন অন্যতম নৌকৌশলবিদ। তিনি সেই বইয়ে বলেছেন, সমুদ্র-বাণিজ্য বা নৌশক্তি যেভাবেই হোক না কেন, সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকলে ‘পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কারণ, স্থলভূমিতে যত সম্পদই থাকুক না কেন, সমুদ্রপথে সম্পদ বিনিময় বা বাণিজ্য যত সহজ, অন্য পথে তা অত সহজ নয়।’
মাহান বলেন, একটি দেশ যদি দুনিয়াতে পরাশক্তি হতে চায়, তাহলে তাকে আশপাশের জলসীমায় প্রভুত্ব করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তাকে এমন এক অঞ্চল তৈরি করতে হবে, যাতে অন্যরা তাকে সমীহ করে এবং বহিঃশক্তিকে তার আশপাশ থেকে দূরে রাখা যায়। আজ চীন মাহানের নীতি অনুসরণ করছে, সে নিজের আশপাশের জলসীমায় প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
গত কয়েক বছরে চীন কী করেছে তার একটা ফিরিস্তি দিই। সে দক্ষিণ কোরিয়ার দাবির বিরুদ্ধে হলুদ সাগরের ওপর নিজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে, একইভাবে সে জাপানের বিরুদ্ধে পূর্ব চীন সাগর এবং ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেইয়ের বিরুদ্ধে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর নিজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
আবার সে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-উপস্থিতিকে সীমিত করার চেষ্টা করেছে, সাগরে তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য অভিযান চালিয়েছে। এর ফলে ২০১১ সালে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা জেট ফাইটার বিমান ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ইপি-৩ সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বিমানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রাসীভাবে চীনের সার্বভৌমত্বের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে, তার ওপরই এখন অনেক কিছু নির্ভর করবে আরও সম্প্রতি চীনা ফাইটার জেট ও আধা সামরিক বাহিনী ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও জাহাজকে হয়রানি করেছে। পূর্ব চীন সাগরে চীন জাপানের সঙ্গে সেনকাকু ও দিয়াও দ্বীপ নিয়ে এক তিক্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। বেইজিং সেখানে এক ‘এয়ার ডিফেন্স আইডেনটিফিকেশন জোন’ তৈরি করেছে, ফলে এখন অন্য দেশকে সেখান দিয়ে যেতে হলে তাদের অনুমতি নিতে হয়।
ওদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে গত দুই বছরে চীন ১৭ হাজার হেক্টর কৃত্রিম ভূমি পুনরুদ্ধার করেছে। সেই জমি হয়তো জোয়ারের সময় ডুবে যেত। এই ভূমির মধ্যে আরও আছে প্রবাল প্রাচীর ও পাথর, যেগুলোকে তারা পূর্ণাঙ্গ দ্বীপে পরিণত করেছে।
না, চীনের কার্যক্রম শুধু আন্তর্জাতিক আইনেরই লঙ্ঘন নয়, তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে অন্য দাবিদাররাও বিরাট হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি সেখানে জাহাজ চালানোর স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে চীন এই বিতর্ককে সামরিকায়ন করে আরও অধিক হারে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এ ব্যাপারে চীন অতীতের নৌশক্তিগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। অতীতে নেদারল্যান্ডস ও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীন শুধু তার আশপাশের জলসীমায় প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায় না, সে এটাকে তার ভূমির সম্প্রসারণ হিসেবে গণ্য করছে, ‘নীল জমি’।
জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে চীন তার কুখ্যাত ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’ মতবাদের আলোকে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর তার ‘অন্তর্নিহিতি’ ও ‘তর্কাতীত’ দাবি রয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু ওই কনভেনশন বলে, উপকূলীয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলসীমায় নিজের অধিকার দাবি করতে পারে না। নিজের নৌ-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ও সেখানে চীনা ‘হ্রদ’ সৃষ্টি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র তার এশীয় মিত্রদের সঙ্গে নিরাপত্তা বন্ধন দৃঢ় করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আরও বেশি হারে প্রবেশের ব্যাপারে আলোচনা করেছে, চীনকে পাহারা দেওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সহায়তা পেয়েছে।
এই অক্টোবরের মধ্যভাগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র ওই এলাকায় চীনের সার্বভৌমত্বের দাবি চ্যালেঞ্জ করতে চীনের কৃত্রিম দ্বীপের ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ অভিযান পরিচালনা করবে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএস লাসেন (মিসাইল নিয়ন্ত্রিত ধ্বংসকারী) মোতায়েন করেছে।
ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের যুক্তি হচ্ছে, চীনের এই ভূমির বেশির ভাগই জোয়ারের সময় ডুবে যায়, সে কারণে জাতিসংঘের রীতি অনুসারে তার ওপর চীনের দাবি থাকতে পারে না। চীন আবার হুংকার দিয়েছে, ‘চীনা সীমানায় সমুদ্র ও আকাশপথে বিধি লঙ্ঘন করে কেউ ঢুকে পড়লে তার নিস্তার নেই।’ ফলে ওই এলাকায় সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে গেল।
যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রাসীভাবে চীনের সার্বভৌমত্বের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে, তার ওপরই এখন অনেক কিছু নির্ভর করবে। বৈশ্বিক গণমাধ্যম আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বৈরথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। তবে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতারাও ব্যাপক চাপের মুখে আছেন, তাঁদের সংকল্প ও প্রতিরোধ দেখাতে হবে। এশিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উপনীত হয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া
রিচার্ড জাভেদ হেইডেরিয়ান: এশীয় ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ।
No comments