লড়াইয়ের তিন দশক
প্রায়
তিন দশক গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন অং সান সু চি। সেই ১৯৮৮ সালের
এপ্রিলে শুরু তারপর কেটে গেছে প্রায় ২৮টি বছর। এ সময়ে দেশের জন্য,
গণতন্ত্রের জন্য তিনি বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। উর্দিধারীদের রক্তচক্ষুকে
উপেক্ষা করে তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। নানা মাত্রায় তার ওপর
চাপ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই পিছপা হন নি সু চি। তার হাত ধরে
মিয়ানমারের মানুষ ফিরে পেলো ভোটের অধিকার। সে জন্যই রোববার ভোররাতে ভোটাররা
ভিড় করেছিলেন ভোটকেন্দ্রে। বিদেশী মিডিয়ার খবর এসবের সাক্ষী। জীবনে
প্রথমবার ভোট দিতে পেরে আনন্দে কেঁদেছেন অনেকে। তাদের কাছে অং সান সু চি
গণতন্ত্রের প্রতীক। আজকের এই সু চি হয়ে ওঠা খুব সহজ ছিল না। ১৯৮৮ সালের
এপ্রিলে তিনি স্বামী-সন্তানদের বৃটেনে রেখে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য দেশে
ফিরেছিলেন। এ সময়েই দেশে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলন
দানা বেঁধে ওঠে। এ বছরের শেষের দিকে মারা যান তার মা। ৮ই আগস্ট থেকে ১১ই
আগস্ট পর্যন্ত মিয়ানমারজুড়ে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। নিরাপত্তারক্ষীরা
প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী মারা
যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়েই মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক অং সানের কন্যা
সু চির আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে। তিনি রেঙ্গুনের শোয়েডাগন
প্যাগোডার সামনে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। এতে যোগ দেন প্রায় পাঁচ লাখ
মানুষ। এ বছরের সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী স্টেট ল’ অ্যান্ড অর্ডার
রিস্টোরেশন কাউন্সিল সৃষ্টি করে তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সু চি গঠন করেন
বিরোধী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি। ১৯৮৯ সালের জুনে সরকার দেশের নাম
দেয় মিয়ানমার। ইয়াঙ্গুনকে ঘোষণা করে রাজধানী। সামরিক জান্তার তীব্র
সমালোচনা করার কারণে অং সান সু চি ও তার উপ- প্রধান টিন ও’কে গৃহবন্দি করা
হয়। এরপর ১১৯০ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে সামরিক সরকার। নির্বাচনে অংশ
নিয়ে সু চির এনএলডি ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ক্ষমতা হাতবদলে
অস্বীকৃতি জানায় সামরিক জান্তা। ১৯৯১ সালের অক্টোবরে সু চিকে সেনাবাহিনীর
বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ লড়াই করার কারণে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে তিনি গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু তাকে
থাকতে হয় মিয়ানমারেই। সামরিক জান্তাদের ভয় ছিল, তাকে একবার দেশের বাইরে
যেতে দিলে তিনি আর না-ও ফিরতে পারেন। ১৯৯৯ সালের মার্চে সু চির জীবনে বড় এক
আঘাত আসে। এ বছরই ক্যান্সারে আক্রান্ত তার স্বামী অরিস ইংল্যান্ডে মারা
যান। ১৯৯৫ সালের পর সু চির সঙ্গে তার আর দেখা হয় নি। কারণ, মিয়ানমারের
সামরিক জান্তা তাকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে
একটি রাজনৈতিক সভায় যোগ দেয়ার কথা ছিল সু চির। ওই সভায় বের হওয়ার পরই তাকে
আবার গৃহবন্দি করা হয়। ২০০২ সালের মে মাসে তিনি আবার গৃহবন্দি অবস্থা থেকে
মুক্তি পান। ২০০৩ সালের মে মাসে আবার তাকে গৃহবন্দি করা হয়। তাকে এবার
নিয়ে যাওয়া হয় ‘প্রতিরোধযোগ্য হেফাজতে’। সরকার সমর্থিত একদল দাঙ্গাবাজের
কবলে সু চির গাড়িবহর পড়ার পর এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২০০৭ সালের আগস্টে
জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ শুরু হয়। তা ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
১৯৮৮ সালের পর এবারই প্রথম তা গণতন্ত্রের দাবিতে রূপ নেয়। দিনের পর দিন
তার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ
জন্য এ আন্দোলন ‘স্যাফ্রোন রেভ্যুলুশন’ নামে পরিচিত। ২০০৯ সালের ১১ই আগস্ট
সু চির আটকাদেশ বাড়ানো হয় ১৮ মাস। এ সময় আমেরিকার এক আগন্তুককে তিনি আশ্রয়
দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ২০১০ সালের ৭ই নভেম্বর ২০ বছর পরে প্রথম
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মিয়ানমারে। এতে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে সামরিক
জান্তাপন্থি দল। ২০১০ সালের ১৩ই নভেম্বর সু চির আটকাদেশের মেয়াদ শেষ হয়।
তিনি মুক্ত হন। ২০১২ সালের ১৮ই জানুয়ারি তিনি নিবন্ধিত হন। এরপর ১লা এপ্রিল
উপ- নির্বাচনে বিজয়ী হন। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৬৬৪ আসনের পার্লামেন্টের
৪৫ আসনে। এর মাধ্যমে দীর্ঘ সময় লড়াই করে প্রথমবার তিনি পার্লামেন্টে
নির্বাচিত প্রতিনিধি হন। তারপর এবারের নির্বাচন।
No comments