নূর হোসেন যেন আমাদের দেখছেন by মঈনুল শাওন
গুলিতে নিহত হওয়ার আগে শহীদ নূর হোসেনের ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রতিবাদ। ছবি: পাভেল রহমান |
আশির
দশক। বাংলার রাজনীতির আকাশে তখন অযাচিত মেঘ। ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর নানা সামরিক ক্যুর ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে
জেনারেল জিয়াকে হত্যার সুবাদে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ
এরশাদের রাজনীতির পাদপ্রদীপে আগমন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০, প্রায় এক দশক, সামরিক
শাসনের জাঁতাকলে মানুষের জীবনে ওঠে নাভিশ্বাস। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস,
শ্রমিক আন্দোলনে সুবিধাবাদ, কৃষকের ভূমি লুট, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ,
প্রশাসনের সামরিকায়ন, সর্বোপরি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন—অপশাসনের একটি
দিক। অন্যদিকে এর বিপরীতে দানা বেঁধে ওঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে
রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বারবার নির্মমভাবে দমনের চেষ্টা করে সামরিক
জান্তা। কিন্তু এই চরম স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ বরাবরই ছিল
সোচ্চার।
বেড়ে ওঠো দাউ দাউ অগ্নির পালক
স্বৈরশাসনের করাল থাবায় অর্থনীতির দৈন্য বুঝতে, পুরান ঢাকার বনগ্রামের অন্ধকার গলিতে এক দরিদ্র তরুণ নূর হোসেনের বেড়ে ওঠার বয়ান উপযোগী। মাত্র দুই কামরার ছোট একটি ঘরে প্রায় আট-নয়জনের পরিবারের বেঁচে থাকা কতটা দুঃসহনীয়, স্বচক্ষে না দেখলে তা বিশ্বাস করা দায়। দিনব্যাপী বাড়ির কর্তা মজিবুর রহমানের ট্যাক্সি চালানোর আয়ে এতগুলো মুখের অন্নের জোগান। এর মধ্যেই শিশুদের পড়াশোনার প্রচেষ্টা অব্যাহত। বনগ্রাম প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক পাস করে সদরঘাট নাইট স্কুলে ভর্তি হওয়া। একান্নবর্তী ঘরের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নূর হোসেনের ব্যক্তিগত স্থানের ভীষণ অভাব। আলাদা একটা পড়ার কক্ষ দরকার। অভাবের চৌকাঠে একটু উন্নত পরিধান বা ভালোমন্দ খাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও উঁকি দেয় প্রায়শ। মায়ের কাছে এ নিয়ে প্রায়ই নানা অনুযোগ।
বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেন, নতুন জীবনের জাল বোনেন নূর হোসেন। দেশের অগণিত গরিবের মতো ভাবেন, দারিদ্র্যের এই গরাদ ভেঙে বেরিয়ে পড়তে হবে একদিন। বেরিয়ে পড়েছিলেনও তিনি। কিন্তু খুব দূরে নয়, বনগ্রাম থেকে মতিঝিল। মুক্তির পথে যেন দুই কদম আগানো। কাজ, একটা কাজ ভীষণ দরকার। মুক্তির পথ গড়ার উপায়, মরা শ্রমকে উৎপাদনের হাতিয়ারে পরিণত করা। না, কারখানায় মজুরির চাকরি নেননি তিনি। বরং ড্রাইভিং লাইসেন্স নিলেন বন্ধু-বড় ভাইয়ের পরামর্শে। পরিণত হলেন পরিবহনশ্রমিকে। পণ্য পরিবহনের কাজ দিয়ে শুরু। এরপর দাপ্তরিক গাড়ির চালক। কিন্তু এর মাঝে মতিঝিল বা পল্টনের স্লোগান কানে আসে নূর হোসেনের। পিতা মজিবুর রহমানের সুবাদে পূর্বেই জেনেছেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। দেখতে দেখতে আন্দোলনের প্রতি তাঁর ভক্তি গেল বেড়ে। মিছিল তাঁকে টানে। স্থানীয় সভা-সমাবেশ নূর হোসেনের নাম জানে। ভোরে পত্রিকা পড়া হতো। বাংলার বাণী ছিল তাঁর প্রিয় খবরের বাহক। এখন নূর হোসেন অনেক পরিণত। তিনি জানেন, সমস্ত অবিচার আর দেশব্যাপী অশান্তির মূলে স্বৈরাচার আর বুর্জোয়া শাসক এরশাদ। তাকে যেকোনো মূল্যে হঠাতে হবে। মুক্তির পথে এখন সে–ই একমাত্র বাধা।
ডেটলাইন ১০ নভেম্বর
এই দিন তৎকালীন বিরোধী তিন জোটের আহ্বানে ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচি মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় স্বৈরাচারী সরকার। রাজধানীর চারদিকে বিভিন্ন ব্যারিকেড ও বাধা সৃষ্টি করে আটকে দেওয়া হয় ঢাকাভিমুখী লাখো মানুষের গতিপথ। এরপরও ঢাকার অভ্যন্তরে আট দল, সাত দল আর পাঁচদলীয় জোটের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরোধী আন্দোলন ধারণ করে জঙ্গিতম রূপ। মূলত সচিবালয়কে কেন্দ্রে রেখে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। সরকারের সশস্ত্র পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের পুরোভাগে একটি রৌদ্রদীপ্ত মুখ, উদোম গায়ে অঙ্কিত একটি শাণিত স্লোগান সেদিন দৃষ্টি কাড়ে মানুষের। শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান এঁকে জিরো পয়েন্টে লড়াইয়ের কেন্দ্রে দীপ্ত শপথে উজ্জীবিত বনগ্রামের নূর হোসেন। অনেকেই সেদিন তাঁকে কোমরে বাঁধা লাল শার্ট পরিধানের অনুরোধ করেন, যাতে তাঁর দেহে অঙ্কিত স্লোগান হন্তারক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু কোনো কিছুর পরোয়া নূর হোসেন করেননি, স্বৈরাচার এরশাদের পতন ছাড়া বাড়ি না ফেরার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাঁর। ফেরা আর কখনো হয়নি। এর কয় মুহূর্ত পর স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনীর লক্ষ্যভেদী বুলেটে শহীদ হন দুপুরের খররোদে আন্দোলনরত এই সর্বহারা শ্রমিক। তাঁর মৃত্যু সেদিন দ্রোহের দাবানলের আগুনকে দ্বিগুণ করে।
গণতন্ত্রের গুহামানব
এরশাদবিরোধী আন্দোলন বা আমাদের এই জনপদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে অন্য অনেকের মাঝে নূর হোসেনের অবস্থান যেন কিছুটা ভিন্ন। তাঁর আত্মত্যাগের আঙ্গিকে যেন রয়েছে শৈল্পিক আবহ। আর এই আবহ বা আদলের মর্ম বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে আধুনিক দর্শনের গোড়ায়। ফরাসি দার্শনিক জাক রাঁচিয়ের (Jacques Ranciere) বলেছেন, রাজনীতির যেমন একটা নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব আছে, নন্দনতত্ত্বেরও আছে অনুরূপ নিজস্ব রাজনীতি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নূর হোসেনের রাজনৈতিক আদর্শের প্রকাশ কিন্তু শিল্পের ভঙ্গিমায়। দেহকে বানিয়েছেন ক্যানভাস। কাঁচা রং দিয়ে মুদ্রিত করেছেন প্রাণের চিৎকার। আবার তার শৈল্পিক জীবনবোধের সন্ধান তিনি খুঁজেছেন রাজনীতির কাছে। দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে নূর হোসেনের অভিনব রাজনৈতিক আত্মত্যাগ তাই সমকালীন রাজনৈতিক দর্শনের একটা জ্বলজ্বলে ব্যবহারিক উদাহরণ। প্রায় দুই দশক পূর্বে রচিত তার বিয়োগান্ত জীবনগাথা বা মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম দোল খায় আধুনিক দর্শনের শক্ত পাটাতনে।
অন্যদিকে, বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন্নবী বলেছেন, মানুষের শরীরে যখন কিছু আঁকা হয়, সে অঙ্কন শরীরের মাংসপেশিগুলোর সঙ্গে আন্দোলিত হয়ে একটি ত্রিমাত্রিক আবহ নেয়। যদিও মানবদেহে প্রাচীনকাল থেকেই অঙ্কনের একটি সাপোর্ট হিসেবে স্বীকৃত, তথাপি দেহের জমিনে দাবি আদায়ের জন্য আঁকা স্লোগান তাকে করে তোলে অনন্য; বিশেষ করে যখন শরীরে অঙ্কিত সেই দাবি পরিণত হয় অত্যাচারী শাসকের সুনিপুণ নিশানায়। সেই অর্থে বলা যায়, শিল্পের কাজ যদি হয় প্রগতির লড়াই অথবা স্থাণু বর্তমানকে ভেঙে মুক্ত আগামীর বিনির্মাণ, তখন রাজপথের এই রাজনৈতিক শিল্পী অনেক প্রথিতযশা শিল্পীর চেয়েও ব্যবহারিক অর্থে অনেক বেশি বেগবান।
এই ব্যতিক্রমী আত্মত্যাগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছে যেমন সাধারণ মানুষকে, তেমনি দেশের শ্রেষ্ঠ কবিরা তাঁকে নিয়ে রচনা করেছেন অনবদ্য সব কবিতা, শিল্পীরা গেয়েছেন গান, করেছেন নাটক। মনে পড়ে, কবি শামসুর রাহমানের সেই অনবদ্য কবিতা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ অথবা কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘নূর হোসেন’ কবিতা অথবা নাট্যজন শংকর সাঁওজালের রাজপথের নির্মাণ ‘জাগে লক্ষ নূর হোসেন’ অথবা তৎকালীন সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক (প্রথম আলোর সম্পাদক) মতিউর রহমানের সেই সময় প্রকাশিত বেশ কিছু আবেগাপ্লুত লেখা নূর হোসেন এবং তাঁর পিতা মজিবুর রহমানকে ঘিরে। অগ্রজদের এসব নির্মাণ কিছুকাল আগে এই লেখককেও উদ্বুদ্ধ করেছিল এই বীরকে ঘিরে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিনির্মাণের। কালের পরিক্রমায় নূর হোসেন এখন আমাদের জাতীয় মুক্তি ও প্রেরণার প্রতীক।
মৃত্যুর আদর্শ বনাম আদর্শের মৃত্যু
অথচ আশ্চর্য রকম সত্য, ইতিহাসের এই অমর নায়কের স্বপ্ন এখনো অধরা। পুনরাবৃত্তির উপাখ্যান চারদিকে। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রাণের দাবিগুলোর অপূর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের পৌনঃপুনিকতা, লাগামহীন দুর্নীতি-সামাজিক অবিচার আর রাষ্ট্রীয় শোষণ প্রশ্নবিদ্ধ করে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় পতিত স্বৈরাচার বনে যান গণতন্ত্রের বিশেষ দূত। চিন্তার ধারহীন এই মেকি উন্নয়নের তথাকথিত গণতান্ত্রিক অবয়বের তলায় নীরবে সুসংগঠিত হয় অশুভ ধারালো ছায়া। সাম্যের লড়াই ব্যাহত হয় মুক্তচিন্তার অস্তিত্ব রক্ষার আতঙ্কে।
এই আপাত জটিল প্রেক্ষাপটে দূর থেকে দাঁড়িয়ে নূর হোসেন যেন আমাদের দেখছেন, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নিয়ে। আরও একজন অথবা বহু মহানায়কের আবির্ভাবই ঘোচাতে পারে ঘনিয়ে আসা এই অন্ধকার। আরেক ফরাসি দার্শনিক এলা বাদিউর (Alain Badiou) দ্বারস্থ হই। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেন বিপ্লবের খোয়াবের এতিম’। মানে রাজনীতি ও আদর্শের এই আকালে শুধু বিপ্লব সশরীরে অনুপস্থিত নয়, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাও ভুলে গেছে মানুষ। এই বিস্মৃতির বিপরীতে যে কজন তাঁদের কর্ম ও ত্যাগ দিয়ে আমাদের স্মৃতি আর বর্তমানকে নিয়ত উসকানি দিতে থাকেন, নূর হোসেন তাঁদের একজন। কারণ, তাঁর স্বপ্নের শোষণহীন সমাজ এখনো অধরা। যে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ নূর হোসেন খুঁজেছেন, তা নির্মাণের ব্যবস্থা নিয়ত বহাল রেখে, ব্যক্তি স্বৈরাচারের পতনে কখনো মিলবে না কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত গণতন্ত্র। তাহলে মুক্তির পথ কী এবং কোথায়? এটুকুই শুধু বলি, ‘লড়াইয়ের মাঠ ছাড়া গরিবের আর কোনো পথ নাই, সূর্যের তীক্ষ্ণ রেখায় জ্বলে তার গাঢ় সম্ভাবনাই...’ শূন্যের মাঝে নূর হোসেন আমাদের সেই আগুন সম্ভাবনা।
সূত্র: ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ (চলচ্চিত্র) ২০১২, পরিচালক: মঈনুল শাওন ও হাছান আবিদুর রেজা জুয়েল। ‘শহীদ নূর হোসেন’ মতিউর রহমান এবং শামসুর রাহমান, ২০১৩ (১৯৯০), প্রথমা প্রকাশন। Badiou, A. 2013. Cinema, Susan Spitzer (trans.), Cambridge, Polity। Ranciere, J. 2004 (2000). The Politics of Aesthetics, Gabriel Rockhill (trans.), New York, Continuum.
মঈনুল শাওন: চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র গবেষক।
বেড়ে ওঠো দাউ দাউ অগ্নির পালক
স্বৈরশাসনের করাল থাবায় অর্থনীতির দৈন্য বুঝতে, পুরান ঢাকার বনগ্রামের অন্ধকার গলিতে এক দরিদ্র তরুণ নূর হোসেনের বেড়ে ওঠার বয়ান উপযোগী। মাত্র দুই কামরার ছোট একটি ঘরে প্রায় আট-নয়জনের পরিবারের বেঁচে থাকা কতটা দুঃসহনীয়, স্বচক্ষে না দেখলে তা বিশ্বাস করা দায়। দিনব্যাপী বাড়ির কর্তা মজিবুর রহমানের ট্যাক্সি চালানোর আয়ে এতগুলো মুখের অন্নের জোগান। এর মধ্যেই শিশুদের পড়াশোনার প্রচেষ্টা অব্যাহত। বনগ্রাম প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক পাস করে সদরঘাট নাইট স্কুলে ভর্তি হওয়া। একান্নবর্তী ঘরের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নূর হোসেনের ব্যক্তিগত স্থানের ভীষণ অভাব। আলাদা একটা পড়ার কক্ষ দরকার। অভাবের চৌকাঠে একটু উন্নত পরিধান বা ভালোমন্দ খাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও উঁকি দেয় প্রায়শ। মায়ের কাছে এ নিয়ে প্রায়ই নানা অনুযোগ।
বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেন, নতুন জীবনের জাল বোনেন নূর হোসেন। দেশের অগণিত গরিবের মতো ভাবেন, দারিদ্র্যের এই গরাদ ভেঙে বেরিয়ে পড়তে হবে একদিন। বেরিয়ে পড়েছিলেনও তিনি। কিন্তু খুব দূরে নয়, বনগ্রাম থেকে মতিঝিল। মুক্তির পথে যেন দুই কদম আগানো। কাজ, একটা কাজ ভীষণ দরকার। মুক্তির পথ গড়ার উপায়, মরা শ্রমকে উৎপাদনের হাতিয়ারে পরিণত করা। না, কারখানায় মজুরির চাকরি নেননি তিনি। বরং ড্রাইভিং লাইসেন্স নিলেন বন্ধু-বড় ভাইয়ের পরামর্শে। পরিণত হলেন পরিবহনশ্রমিকে। পণ্য পরিবহনের কাজ দিয়ে শুরু। এরপর দাপ্তরিক গাড়ির চালক। কিন্তু এর মাঝে মতিঝিল বা পল্টনের স্লোগান কানে আসে নূর হোসেনের। পিতা মজিবুর রহমানের সুবাদে পূর্বেই জেনেছেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। দেখতে দেখতে আন্দোলনের প্রতি তাঁর ভক্তি গেল বেড়ে। মিছিল তাঁকে টানে। স্থানীয় সভা-সমাবেশ নূর হোসেনের নাম জানে। ভোরে পত্রিকা পড়া হতো। বাংলার বাণী ছিল তাঁর প্রিয় খবরের বাহক। এখন নূর হোসেন অনেক পরিণত। তিনি জানেন, সমস্ত অবিচার আর দেশব্যাপী অশান্তির মূলে স্বৈরাচার আর বুর্জোয়া শাসক এরশাদ। তাকে যেকোনো মূল্যে হঠাতে হবে। মুক্তির পথে এখন সে–ই একমাত্র বাধা।
ডেটলাইন ১০ নভেম্বর
এই দিন তৎকালীন বিরোধী তিন জোটের আহ্বানে ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচি মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় স্বৈরাচারী সরকার। রাজধানীর চারদিকে বিভিন্ন ব্যারিকেড ও বাধা সৃষ্টি করে আটকে দেওয়া হয় ঢাকাভিমুখী লাখো মানুষের গতিপথ। এরপরও ঢাকার অভ্যন্তরে আট দল, সাত দল আর পাঁচদলীয় জোটের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরোধী আন্দোলন ধারণ করে জঙ্গিতম রূপ। মূলত সচিবালয়কে কেন্দ্রে রেখে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। সরকারের সশস্ত্র পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের পুরোভাগে একটি রৌদ্রদীপ্ত মুখ, উদোম গায়ে অঙ্কিত একটি শাণিত স্লোগান সেদিন দৃষ্টি কাড়ে মানুষের। শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান এঁকে জিরো পয়েন্টে লড়াইয়ের কেন্দ্রে দীপ্ত শপথে উজ্জীবিত বনগ্রামের নূর হোসেন। অনেকেই সেদিন তাঁকে কোমরে বাঁধা লাল শার্ট পরিধানের অনুরোধ করেন, যাতে তাঁর দেহে অঙ্কিত স্লোগান হন্তারক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু কোনো কিছুর পরোয়া নূর হোসেন করেননি, স্বৈরাচার এরশাদের পতন ছাড়া বাড়ি না ফেরার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাঁর। ফেরা আর কখনো হয়নি। এর কয় মুহূর্ত পর স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনীর লক্ষ্যভেদী বুলেটে শহীদ হন দুপুরের খররোদে আন্দোলনরত এই সর্বহারা শ্রমিক। তাঁর মৃত্যু সেদিন দ্রোহের দাবানলের আগুনকে দ্বিগুণ করে।
গণতন্ত্রের গুহামানব
এরশাদবিরোধী আন্দোলন বা আমাদের এই জনপদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে অন্য অনেকের মাঝে নূর হোসেনের অবস্থান যেন কিছুটা ভিন্ন। তাঁর আত্মত্যাগের আঙ্গিকে যেন রয়েছে শৈল্পিক আবহ। আর এই আবহ বা আদলের মর্ম বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে আধুনিক দর্শনের গোড়ায়। ফরাসি দার্শনিক জাক রাঁচিয়ের (Jacques Ranciere) বলেছেন, রাজনীতির যেমন একটা নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব আছে, নন্দনতত্ত্বেরও আছে অনুরূপ নিজস্ব রাজনীতি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নূর হোসেনের রাজনৈতিক আদর্শের প্রকাশ কিন্তু শিল্পের ভঙ্গিমায়। দেহকে বানিয়েছেন ক্যানভাস। কাঁচা রং দিয়ে মুদ্রিত করেছেন প্রাণের চিৎকার। আবার তার শৈল্পিক জীবনবোধের সন্ধান তিনি খুঁজেছেন রাজনীতির কাছে। দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে নূর হোসেনের অভিনব রাজনৈতিক আত্মত্যাগ তাই সমকালীন রাজনৈতিক দর্শনের একটা জ্বলজ্বলে ব্যবহারিক উদাহরণ। প্রায় দুই দশক পূর্বে রচিত তার বিয়োগান্ত জীবনগাথা বা মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম দোল খায় আধুনিক দর্শনের শক্ত পাটাতনে।
অন্যদিকে, বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন্নবী বলেছেন, মানুষের শরীরে যখন কিছু আঁকা হয়, সে অঙ্কন শরীরের মাংসপেশিগুলোর সঙ্গে আন্দোলিত হয়ে একটি ত্রিমাত্রিক আবহ নেয়। যদিও মানবদেহে প্রাচীনকাল থেকেই অঙ্কনের একটি সাপোর্ট হিসেবে স্বীকৃত, তথাপি দেহের জমিনে দাবি আদায়ের জন্য আঁকা স্লোগান তাকে করে তোলে অনন্য; বিশেষ করে যখন শরীরে অঙ্কিত সেই দাবি পরিণত হয় অত্যাচারী শাসকের সুনিপুণ নিশানায়। সেই অর্থে বলা যায়, শিল্পের কাজ যদি হয় প্রগতির লড়াই অথবা স্থাণু বর্তমানকে ভেঙে মুক্ত আগামীর বিনির্মাণ, তখন রাজপথের এই রাজনৈতিক শিল্পী অনেক প্রথিতযশা শিল্পীর চেয়েও ব্যবহারিক অর্থে অনেক বেশি বেগবান।
এই ব্যতিক্রমী আত্মত্যাগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছে যেমন সাধারণ মানুষকে, তেমনি দেশের শ্রেষ্ঠ কবিরা তাঁকে নিয়ে রচনা করেছেন অনবদ্য সব কবিতা, শিল্পীরা গেয়েছেন গান, করেছেন নাটক। মনে পড়ে, কবি শামসুর রাহমানের সেই অনবদ্য কবিতা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ অথবা কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘নূর হোসেন’ কবিতা অথবা নাট্যজন শংকর সাঁওজালের রাজপথের নির্মাণ ‘জাগে লক্ষ নূর হোসেন’ অথবা তৎকালীন সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক (প্রথম আলোর সম্পাদক) মতিউর রহমানের সেই সময় প্রকাশিত বেশ কিছু আবেগাপ্লুত লেখা নূর হোসেন এবং তাঁর পিতা মজিবুর রহমানকে ঘিরে। অগ্রজদের এসব নির্মাণ কিছুকাল আগে এই লেখককেও উদ্বুদ্ধ করেছিল এই বীরকে ঘিরে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিনির্মাণের। কালের পরিক্রমায় নূর হোসেন এখন আমাদের জাতীয় মুক্তি ও প্রেরণার প্রতীক।
মৃত্যুর আদর্শ বনাম আদর্শের মৃত্যু
অথচ আশ্চর্য রকম সত্য, ইতিহাসের এই অমর নায়কের স্বপ্ন এখনো অধরা। পুনরাবৃত্তির উপাখ্যান চারদিকে। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রাণের দাবিগুলোর অপূর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের পৌনঃপুনিকতা, লাগামহীন দুর্নীতি-সামাজিক অবিচার আর রাষ্ট্রীয় শোষণ প্রশ্নবিদ্ধ করে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় পতিত স্বৈরাচার বনে যান গণতন্ত্রের বিশেষ দূত। চিন্তার ধারহীন এই মেকি উন্নয়নের তথাকথিত গণতান্ত্রিক অবয়বের তলায় নীরবে সুসংগঠিত হয় অশুভ ধারালো ছায়া। সাম্যের লড়াই ব্যাহত হয় মুক্তচিন্তার অস্তিত্ব রক্ষার আতঙ্কে।
এই আপাত জটিল প্রেক্ষাপটে দূর থেকে দাঁড়িয়ে নূর হোসেন যেন আমাদের দেখছেন, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নিয়ে। আরও একজন অথবা বহু মহানায়কের আবির্ভাবই ঘোচাতে পারে ঘনিয়ে আসা এই অন্ধকার। আরেক ফরাসি দার্শনিক এলা বাদিউর (Alain Badiou) দ্বারস্থ হই। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেন বিপ্লবের খোয়াবের এতিম’। মানে রাজনীতি ও আদর্শের এই আকালে শুধু বিপ্লব সশরীরে অনুপস্থিত নয়, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাও ভুলে গেছে মানুষ। এই বিস্মৃতির বিপরীতে যে কজন তাঁদের কর্ম ও ত্যাগ দিয়ে আমাদের স্মৃতি আর বর্তমানকে নিয়ত উসকানি দিতে থাকেন, নূর হোসেন তাঁদের একজন। কারণ, তাঁর স্বপ্নের শোষণহীন সমাজ এখনো অধরা। যে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ নূর হোসেন খুঁজেছেন, তা নির্মাণের ব্যবস্থা নিয়ত বহাল রেখে, ব্যক্তি স্বৈরাচারের পতনে কখনো মিলবে না কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত গণতন্ত্র। তাহলে মুক্তির পথ কী এবং কোথায়? এটুকুই শুধু বলি, ‘লড়াইয়ের মাঠ ছাড়া গরিবের আর কোনো পথ নাই, সূর্যের তীক্ষ্ণ রেখায় জ্বলে তার গাঢ় সম্ভাবনাই...’ শূন্যের মাঝে নূর হোসেন আমাদের সেই আগুন সম্ভাবনা।
সূত্র: ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ (চলচ্চিত্র) ২০১২, পরিচালক: মঈনুল শাওন ও হাছান আবিদুর রেজা জুয়েল। ‘শহীদ নূর হোসেন’ মতিউর রহমান এবং শামসুর রাহমান, ২০১৩ (১৯৯০), প্রথমা প্রকাশন। Badiou, A. 2013. Cinema, Susan Spitzer (trans.), Cambridge, Polity। Ranciere, J. 2004 (2000). The Politics of Aesthetics, Gabriel Rockhill (trans.), New York, Continuum.
মঈনুল শাওন: চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র গবেষক।
No comments