গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে সন্ত্রাস নতুন সমস্যা -সাক্ষাৎকার: মুনিরুজ্জামান by মিজানুর রহমান খান
মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক |
বাংলাদেশে
আইএস–বিতর্ক : দুই বিদেশি হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আইএসের
অস্তিত্ব নিয়ে চলছে বিতর্ক। এর মধ্যে হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে দুজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান এবং ড. সিগফ্রিড ও. উলফ প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: হোসেনি দালানের বিস্ফোরণকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মুনিরুজ্জামান: ধর্মীয় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে সন্ত্রাসের জড়িত হওয়াটা একটি নতুন উদ্বেগজনক দিক উন্মুক্ত করল আমাদের জন্য। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে এই সম্পৃক্ততা এর আগে ছিল না। ধর্মীয় গোষ্ঠীগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো, যেটা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিতে পারে।
প্রথম আলো: ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শিয়াবিরোধী অবস্থানের দিক থেকে তাদের নামে এবারের ঘটনার দাবি করাটা তো মনে হচ্ছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
মুনিরুজ্জামান: হ্যাঁ। তবে এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না।
প্রথম আলো: সরকার ১৫ জনকে আইএস সন্দেহে ধরেছিল। আবার বলছে আইএস নেই। এই স্ববিরোধিতাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী চোখে দেখছে?
মুনিরুজ্জামান: বিষয়টি খুব গুরুতর। এটি জাতীয় নিরাপত্তাগত প্রশ্ন। আমি মনে করি, এভাবে নাকচ করে দেওয়া উচিত নয়। এটা আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করে খতিয়ে দেখা উচিত। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া—এ রকম পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশের একটি সহযোগিতার সম্পর্ক আছে।
প্রথম আলো: এর আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তাঁদের কাছে আগাম তথ্য ছিল এবং তাঁরা বাংলাদেশকে অবহিত করেছিলেন।
মুনিরুজ্জামান: সেটাই কিন্তু স্বাভাবিক। তবে এ বিষয়ে আমরা এখনো পুরোপুরি তথ্য জানতে পারিনি।
প্রথম আলো: ওয়াশিংটনভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের লিসা কার্টিজ কথিত জঙ্গি উত্থানের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করছেন। তাঁর সঙ্গে কি আপনি একমত?
মুনিরুজ্জামান: আমি অনেকটা একমত। আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছি, এই সংকটের মূলে আছে রাজনৈতিক সমস্যা। সে কারণে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উগ্রবাদীরা একটা সুযোগের সন্ধান করছে।
প্রথম আলো: কিন্তু উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ থেকেও তো আইএসে যোগদানের ঘটনা ঘটেছে। তার ব্যাখ্যা কী?
মুনিরুজ্জামান: বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। সেটা একটির সঙ্গে অন্যটির মেলে না। বাংলাদেশের জন্য যা খাটে, সেটা অন্যদের জন্য খাটে না। যেমন চেচনিয়া থেকে যারা আইএসে গেছে, তারা সবাই স্বাধীনতাকামী জনগণ। যুক্তি হলো, সম্পূর্ণভাবে নিজেদের ওই সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি বলে তারা গেছে। তারা সংগ্রামই করছে, কিন্তু কেবল জায়গা বদল করেছে। বাংলাদেশের জন্য মূল সংকট তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। নাগরিক সমাজ ও বাকস্বাধীনতার জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, এখানে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শূন্যতার মধ্যেই উগ্রবাদীরা, তা সে যারাই হোক, তারা মাথাচাড়া দিচ্ছে। অতীতে হিযবুত তাহ্রীরের নামে যা প্রকাশ পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা এই রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে নিজেদের জন্য কাজে লাগানোর একটা অনুকূল পরিবেশ হিসেবে দেখছে এবং সেটাকে এখন তারা কাজে লাগাতে চায়।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক কালে আকস্মিকভাবে যে নাশকতা শুরু হয়ে গেল, তার কারণ কী? তারা কি কিছু পেতে চায়? ক্ষমতাকেন্দ্রিক কিছু কি?
মুনিরুজ্জামান: বাংলাদেশে এর আগে আইএসের মতাদর্শে কিছু ঘটেছে, তার কোনো চিহ্ন আমরা দেখতে পাইনি। আগে যেটা আমরা দেখেছি, সেটা হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের কেউ কেউ সিরিয়ায় গেছে। কিন্তু আমাদের ভূখণ্ডে কিছু ঘটেনি। এখন সংশয় তৈরি হয়েছে যে তারা বাংলাদেশে মনোনিবেশ করেছে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে চাইছে।
এ প্রসঙ্গে কেউ হয়তো এটা উল্লেখ করবেন যে আমাদের এই উপমহাদেশে যেসব বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের ভেতরে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২০১৪ সালের জুনে আইএস প্রতিষ্ঠার তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে আল-কায়েদার নেতা আইমান আল জাওয়াহিরি ৫৫ মিনিটের একটি ভিডিওর মাধ্যমে একিউআইএস, অর্থাৎ আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের শাখা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই এই অঞ্চলে আল-কায়েদা ও আইএসকেন্দ্রিক জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে আমরা একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ করি।
প্রথম আলো: তাহলে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব কি ছড়িয়ে পড়তে পারে?
মুনিরুজ্জামান: আমরা আশঙ্কা করতে পারি যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটা তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তারা এখন নিজ নিজ প্রভাববলয় বাড়ানোর একটা প্রয়াস চালাবে। সেই প্রয়াসেরই অংশ হিসেবে দুই বিদেশি হত্যা এবং হোসেনি দালানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে সতর্কতার সঙ্গেই আশঙ্কা ব্যক্ত করছি। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের জায়গা থেকে এই যুক্তির অবতারণা। একেই ষোলোআনা ভাবার দরকার নেই। আমি আশা করব, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ফল শিগগির আমরা জানতে পারব। আর তাতে সন্দেহ-সংশয়েরও অবসান ঘটবে।
প্রথম আলো: যুক্তির খাতিরেই প্রশ্ন তোলা যায় যে বিদেশি হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু করেছিল। এবার কিন্তু দেশের মানুষ হত্যার মধ্যে এসে গেল। তাহলে কি কেউ এমনটা ভাবতে পারেন যে উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে ইতালি বা জাপান সরকারের কোনো ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কারণে আগের দুই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে?
মুনিরুজ্জামান: এ রকম কিছু এখন মনে হচ্ছে না। তবে এমন ধারণায় অনেকেই একমত হতে পারেন যে এটা তারা হঠাৎ ঘটায়নি, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে মনে হচ্ছে। টার্গেট বাছাইয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, জাপান তার নাগরিকদের ব্যাপারে সব সময় শক্ত ভূমিকা নিয়ে থাকে। জাপানি হত্যা করা হলে বড় আলোড়ন সৃষ্টি হবে, সেটা হয়তো বিবেচনায় থাকতে পারে। জঙ্গিরা সাধারণত আকস্মিকভাবে কিছু করে না। অঘটন একটা ঘটালে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা আগাম বিশ্লেষণ করে তবেই তারা অভিযানে নামে। কে জানে এমনও হতে পারে, ইতালি ও জাপানি নাগরিক বেছে নিয়ে তারা হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের নজর কাড়তে চেয়েছে।
প্রথম আলো: আইএস তার ভূখণ্ডের বাইরে এর আগে কোথাও কি এমন কিছু করেছে?
মুনিরুজ্জামান: আইএস তার এলাকার বাইরে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অভিযান চালায়নি। তবে প্রভাববলয় সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের যে প্রচেষ্টা, সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেটা আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। তারা ঘোষণা দিয়েছে, যেখানেই মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে, যেখানে মুসলমানদের ওপরে আঘাত আসতে পারে বা আসছে, সেখানেই তারা তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টি করবে। চেচনিয়ায় একজন গভর্নরকে নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা তাদের সেই নীতিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তবে এটা ঠিক, মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাংলাদেশেই এই প্রথম কোনো সহিংসতায় দায় স্বীকারের দাবির কথা জানা যাচ্ছে। আমরা মনে রাখব, তারা কিন্তু এটাও বলেছে, বাস্তবে অ্যাকশনে যেতে সরাসরি আইএসের যোদ্ধা না হলেও চলবে। ঘটনা ঘটাবে আদর্শের সৈনিকেরা, পরে তারা সেটার স্বীকৃতি দেবে।
প্রথম আলো: বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কি তারা যোগাযোগ রাখে?
মুনিরুজ্জামান: তাদের শক্তিশালী মিডিয়া সেল আছে। সামাজিক মিডিয়াকে তারা ব্যবহার করে। আইএসের সন্দেহভাজন ওয়েবসাইটগুলো পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিনিয়ত বন্ধ করে দেয়। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে যারা আইএসে যোগ দিয়েছে, সেটা কিন্তু প্রধানত সাইবার মাধ্যমেই ঘটেছে। এবং বাংলাদেশে তাদের সংশ্লেষ ঘটে থাকলে তা-ও সাইবার নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ঘটে থাকতে পারে।
মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান: প্রেসিডেন্ট , বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এণ্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ।
প্রথম আলো: হোসেনি দালানের বিস্ফোরণকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মুনিরুজ্জামান: ধর্মীয় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে সন্ত্রাসের জড়িত হওয়াটা একটি নতুন উদ্বেগজনক দিক উন্মুক্ত করল আমাদের জন্য। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে এই সম্পৃক্ততা এর আগে ছিল না। ধর্মীয় গোষ্ঠীগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো, যেটা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিতে পারে।
প্রথম আলো: ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শিয়াবিরোধী অবস্থানের দিক থেকে তাদের নামে এবারের ঘটনার দাবি করাটা তো মনে হচ্ছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
মুনিরুজ্জামান: হ্যাঁ। তবে এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না।
প্রথম আলো: সরকার ১৫ জনকে আইএস সন্দেহে ধরেছিল। আবার বলছে আইএস নেই। এই স্ববিরোধিতাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী চোখে দেখছে?
মুনিরুজ্জামান: বিষয়টি খুব গুরুতর। এটি জাতীয় নিরাপত্তাগত প্রশ্ন। আমি মনে করি, এভাবে নাকচ করে দেওয়া উচিত নয়। এটা আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করে খতিয়ে দেখা উচিত। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া—এ রকম পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশের একটি সহযোগিতার সম্পর্ক আছে।
প্রথম আলো: এর আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তাঁদের কাছে আগাম তথ্য ছিল এবং তাঁরা বাংলাদেশকে অবহিত করেছিলেন।
মুনিরুজ্জামান: সেটাই কিন্তু স্বাভাবিক। তবে এ বিষয়ে আমরা এখনো পুরোপুরি তথ্য জানতে পারিনি।
প্রথম আলো: ওয়াশিংটনভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের লিসা কার্টিজ কথিত জঙ্গি উত্থানের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করছেন। তাঁর সঙ্গে কি আপনি একমত?
মুনিরুজ্জামান: আমি অনেকটা একমত। আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছি, এই সংকটের মূলে আছে রাজনৈতিক সমস্যা। সে কারণে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উগ্রবাদীরা একটা সুযোগের সন্ধান করছে।
প্রথম আলো: কিন্তু উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ থেকেও তো আইএসে যোগদানের ঘটনা ঘটেছে। তার ব্যাখ্যা কী?
মুনিরুজ্জামান: বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। সেটা একটির সঙ্গে অন্যটির মেলে না। বাংলাদেশের জন্য যা খাটে, সেটা অন্যদের জন্য খাটে না। যেমন চেচনিয়া থেকে যারা আইএসে গেছে, তারা সবাই স্বাধীনতাকামী জনগণ। যুক্তি হলো, সম্পূর্ণভাবে নিজেদের ওই সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি বলে তারা গেছে। তারা সংগ্রামই করছে, কিন্তু কেবল জায়গা বদল করেছে। বাংলাদেশের জন্য মূল সংকট তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। নাগরিক সমাজ ও বাকস্বাধীনতার জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, এখানে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শূন্যতার মধ্যেই উগ্রবাদীরা, তা সে যারাই হোক, তারা মাথাচাড়া দিচ্ছে। অতীতে হিযবুত তাহ্রীরের নামে যা প্রকাশ পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা এই রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে নিজেদের জন্য কাজে লাগানোর একটা অনুকূল পরিবেশ হিসেবে দেখছে এবং সেটাকে এখন তারা কাজে লাগাতে চায়।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক কালে আকস্মিকভাবে যে নাশকতা শুরু হয়ে গেল, তার কারণ কী? তারা কি কিছু পেতে চায়? ক্ষমতাকেন্দ্রিক কিছু কি?
মুনিরুজ্জামান: বাংলাদেশে এর আগে আইএসের মতাদর্শে কিছু ঘটেছে, তার কোনো চিহ্ন আমরা দেখতে পাইনি। আগে যেটা আমরা দেখেছি, সেটা হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের কেউ কেউ সিরিয়ায় গেছে। কিন্তু আমাদের ভূখণ্ডে কিছু ঘটেনি। এখন সংশয় তৈরি হয়েছে যে তারা বাংলাদেশে মনোনিবেশ করেছে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে চাইছে।
এ প্রসঙ্গে কেউ হয়তো এটা উল্লেখ করবেন যে আমাদের এই উপমহাদেশে যেসব বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের ভেতরে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২০১৪ সালের জুনে আইএস প্রতিষ্ঠার তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে আল-কায়েদার নেতা আইমান আল জাওয়াহিরি ৫৫ মিনিটের একটি ভিডিওর মাধ্যমে একিউআইএস, অর্থাৎ আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের শাখা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই এই অঞ্চলে আল-কায়েদা ও আইএসকেন্দ্রিক জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে আমরা একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ করি।
প্রথম আলো: তাহলে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব কি ছড়িয়ে পড়তে পারে?
মুনিরুজ্জামান: আমরা আশঙ্কা করতে পারি যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটা তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তারা এখন নিজ নিজ প্রভাববলয় বাড়ানোর একটা প্রয়াস চালাবে। সেই প্রয়াসেরই অংশ হিসেবে দুই বিদেশি হত্যা এবং হোসেনি দালানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে সতর্কতার সঙ্গেই আশঙ্কা ব্যক্ত করছি। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের জায়গা থেকে এই যুক্তির অবতারণা। একেই ষোলোআনা ভাবার দরকার নেই। আমি আশা করব, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ফল শিগগির আমরা জানতে পারব। আর তাতে সন্দেহ-সংশয়েরও অবসান ঘটবে।
প্রথম আলো: যুক্তির খাতিরেই প্রশ্ন তোলা যায় যে বিদেশি হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু করেছিল। এবার কিন্তু দেশের মানুষ হত্যার মধ্যে এসে গেল। তাহলে কি কেউ এমনটা ভাবতে পারেন যে উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে ইতালি বা জাপান সরকারের কোনো ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কারণে আগের দুই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে?
মুনিরুজ্জামান: এ রকম কিছু এখন মনে হচ্ছে না। তবে এমন ধারণায় অনেকেই একমত হতে পারেন যে এটা তারা হঠাৎ ঘটায়নি, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে মনে হচ্ছে। টার্গেট বাছাইয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, জাপান তার নাগরিকদের ব্যাপারে সব সময় শক্ত ভূমিকা নিয়ে থাকে। জাপানি হত্যা করা হলে বড় আলোড়ন সৃষ্টি হবে, সেটা হয়তো বিবেচনায় থাকতে পারে। জঙ্গিরা সাধারণত আকস্মিকভাবে কিছু করে না। অঘটন একটা ঘটালে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা আগাম বিশ্লেষণ করে তবেই তারা অভিযানে নামে। কে জানে এমনও হতে পারে, ইতালি ও জাপানি নাগরিক বেছে নিয়ে তারা হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের নজর কাড়তে চেয়েছে।
প্রথম আলো: আইএস তার ভূখণ্ডের বাইরে এর আগে কোথাও কি এমন কিছু করেছে?
মুনিরুজ্জামান: আইএস তার এলাকার বাইরে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অভিযান চালায়নি। তবে প্রভাববলয় সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের যে প্রচেষ্টা, সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেটা আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। তারা ঘোষণা দিয়েছে, যেখানেই মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে, যেখানে মুসলমানদের ওপরে আঘাত আসতে পারে বা আসছে, সেখানেই তারা তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টি করবে। চেচনিয়ায় একজন গভর্নরকে নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা তাদের সেই নীতিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তবে এটা ঠিক, মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাংলাদেশেই এই প্রথম কোনো সহিংসতায় দায় স্বীকারের দাবির কথা জানা যাচ্ছে। আমরা মনে রাখব, তারা কিন্তু এটাও বলেছে, বাস্তবে অ্যাকশনে যেতে সরাসরি আইএসের যোদ্ধা না হলেও চলবে। ঘটনা ঘটাবে আদর্শের সৈনিকেরা, পরে তারা সেটার স্বীকৃতি দেবে।
প্রথম আলো: বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কি তারা যোগাযোগ রাখে?
মুনিরুজ্জামান: তাদের শক্তিশালী মিডিয়া সেল আছে। সামাজিক মিডিয়াকে তারা ব্যবহার করে। আইএসের সন্দেহভাজন ওয়েবসাইটগুলো পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিনিয়ত বন্ধ করে দেয়। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে যারা আইএসে যোগ দিয়েছে, সেটা কিন্তু প্রধানত সাইবার মাধ্যমেই ঘটেছে। এবং বাংলাদেশে তাদের সংশ্লেষ ঘটে থাকলে তা-ও সাইবার নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ঘটে থাকতে পারে।
মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান: প্রেসিডেন্ট , বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এণ্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ।
No comments