‘বাম জাগছে: সত্যি না কল্পনা’ by নূহ-উল-আলম লেনিন
৮
অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত হাসান ফেরদৌসের ‘বাম জাগছে: সত্যি না কল্পনা’
শীর্ষক উপসম্পাদকীয়টি পড়লাম। নিঃসন্দেহে তাঁর লেখা আমাকে আকৃষ্ট করে এবং
ঔৎসুক্য জাগায়। হাসান ফেরদৌসের এই লেখাটিও চিন্তা উদ্রেক করার মতো। এ জন্য
তাঁকে ধন্যবাদ।
ফেরদৌস তাঁর নিজস্ব অবস্থান থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে লিখেছেন। বাংলাদেশে ও বিশ্বপরিসরে বামপন্থার ভবিষ্যৎ ও ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত এবং গভীর আলোচনা দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিশ্ব-সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কার্যকারণ নিয়ে কমিউনিস্ট ও বাম দলগুলো এখন পর্যন্ত তেমন বস্তুনিষ্ঠ ও আত্মসমালোচনামূলক আলোচনা বা মূল্যায়ন করেছে—এমনটি আমার চোখে পড়েনি। আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যানুসন্ধান এবং নতুন করে একটি ভেদ-বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ নির্মাণের পথনির্দেশও করতে পারেননি বামপন্থার অনুসারীরা।
আমি মনে করি, ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ হলেও বাস্তবায়নযোগ্য বা প্র্যাগমেটিক নতুন কোনো স্বপ্নের ঠিকানা আমরা এখনো খুঁজে পাইনি। বামপন্থার একাংশ এখনো মতান্ধতার ফাঁদে বন্দী। তারা ‘তত্ত্ব ঠিক, প্রয়োগে ভুল ছিল’ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে এবং পুরোনো ছিন্ন পতাকা হাতে অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকু নিঃশেষিত করছে। অন্য একটি অংশ পথানুসন্ধানে ব্রতী হয়ে নানা মাত্রার সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বা ধনতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত মূলধারার বুর্জোয়া বা ঐতিহ্যবাহী অকমিউনিস্ট বা নন-মার্ক্সিস্ট এবং পুরোনো ঘরানার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলগুলোর মধ্যেও পরিবর্তনকামী প্রবণতা জোরদার হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্রিস ও স্পেনের একসময়ের কমিউনিস্টদের নতুন ধরনের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে তোলাও একটি নতুন প্রপঞ্চ। লেখক যে ‘নয়া বাম’ ও বাম জাগরণের কথা বলছেন, সম্ভবত তা শেষোক্ত ধারার।
মানবজাতি এখন একটা ভাবাদর্শগত সংকটকাল অতিক্রম করছে। বিদ্যমান বিশ্বায়িত অর্থনীতি বা করপোরেট পুঁজিবাদের কোনো বিকল্প দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ অথবা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতাজনিত ভাবাদর্শগত শূন্যতা এবং অন্য কোনো অগ্রসর ভাবাদর্শ বা চিন্তাধারা দ্বারা পূরণ হয়নি। উত্তরাধুনিক বাস্তবতা নিয়ে নানা মাত্রার অনুসন্ধিৎসা ও ডিসকোর্স অবশ্য লক্ষণীয়। কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য তাত্ত্বিক রূপরেখা বা ছক চোখে পড়ে না।
আমরা যারা ‘কেটে পড়েছি’, তারা যে এই পরিণতির জন্য অপেক্ষা করিনি, বরং অযুতসংখ্যক মানুষের মধ্যে থেকে পরিবর্তনের জন্য লড়তে পারছি, এতেই আমরা সন্তুষ্ট সম্ভবত কোনো একটা নির্দিষ্ট ছকবাঁধা পথে ইতিহাস এগোবে না। আমাদের অজানা-অভাবিত নানা বিচিত্র পথে সভ্যতার রথ আগানোর চেষ্টা করবে। সভ্যতার একটা নিজস্ব নিয়ম ও ডায়নামিকস আছে—সেটা যে কী, তার যথার্থ উপলব্ধিই হয়তো রথের চালিকা হয়ে উঠবে। আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, তবে নিশ্চেষ্ট হয়ে নয়। দৃষ্টিসীমার মধ্যে হলেও রথের রশি আমাদের টেনে নিতেই হবে। আমরা যারা সমাজ পরিবর্তনে এবং একটা ভেদ-বৈষম্যহীন মানবিক সমাজে বিশ্বাসী, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সে চেষ্টাই করছি।
হাসান ফেরদৌসের লেখায় বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের (সিপিবি) মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন, তাঁদের প্রতি একটা খোঁচা আছে। তিনি লিখেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, তিনি (সেলিম) এগিয়ে এসেছেন। তাঁর চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান সতীর্থরা অবশ্য সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন মন্ত্রী বাহাদুর। অনুমান করি, চাইলে তিনিও সে কোটায় ঢুকে পড়তে পারতেন।’
হাসান ফেরদৌস জ্ঞানী মানুষ। নিঃসন্দেহে সবকিছু জেনেবুঝেই তিনি লিখেছেন। তবে তিনি জানেন কি, সিপিবি যখন দ্বিধাবিভক্ত হয়, তখন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বাধীন অংশটি ছিল সংখ্যালঘু, দলের সভাপতি, সাধারণ-সম্পাদকসহ সভাপতিমণ্ডলীর তিন-চারজন ছাড়া আর সবাই এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ‘রূপান্তরিত কমিউনিস্ট’ পার্টির পতাকাতলে সমবেত হন। প্রথমে তঁাদের তরফে কমিউনিস্ট পার্টিকে একটি কর্মসূচিভিত্তিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলে। কিন্তু নানা কারণে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। অতঃপর রূপান্তরকামীরা কার্যত আবারও বিভক্ত হন। প্রধান অংশটি গণফোরামে যোগদান করে (আমার ও অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও)। অজয় রায় ও ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান পৃথক ‘কমিউনিস্ট কেন্দ্র’ গঠন করেন। দুজন সাংসদসহ ক্ষুদ্র একটি অংশ বিএনপিতে যোগদান করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে গণফোরাম কার্যত কার্যকারিতা হারায়। নির্বাচনের আগেই দুজন সাংসদসহ নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে একটি অংশ আওয়ামী লীগে যোগদান করে। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণফোরাম থেকে বেরিয়ে রূপান্তরিত কমিউনিস্টদের প্রধান অংশটি আওয়ামী লীগে যোগদান করে। এরাই ছিল সিপিবির মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। না, এঁদের কেউই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ অথবা মন্ত্রী-এমপি হননি (অবশ্য এমপি-মন্ত্রী হওয়া কি অপরাধ? এতে তো জাত যাওয়ার কথা নয়)। এখনো তাঁরা সততার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
হাসান ফেরদৌসের ভাষায় যাঁরা ‘কেটে পড়েন’, তাঁরা কেউই সেলিমের চেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ নন। সেলিম আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন এবং অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কেটে পড়ারা’ কেবল মন্ত্রিত্বের লোভে আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি। হাসান ফেরদৌসের মতে, আমেরিকা-ইউরোপের মূলধারার দলগুলোতেও যদি পরিবর্তনকামী শক্তি থেকে থাকে, তাহলে যে দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, যে দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং যে দলটি এমডিজি অর্জনসহ সামাজিক-মানবিক খাতে, অমর্ত্য সেনের ভাষায়, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ সূচক অর্জন করেছে (দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা, গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার কমিয়ে আনা প্রভৃতি সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে থাকা, শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো), সেই দলটি কি পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করছে না?
ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি যদি পারে, তবে হতদরিদ্র বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কেন পারবে না? পুঁজিবাদের (নিঃসন্দেহে অপুষ্ট ও দুর্বৃত্তায়িত পুঁজিবাদ) কাঠামোর মধ্যেই আমাদের এসব জনকল্যাণমূলক কাজ, উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিতে হচ্ছে। সোভিয়েত তাত্ত্বিকদের দেওয়া পুঁজিবাদ এড়িয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের (বাই পাসিং ক্যাপিটালিজম) তত্ত্ব তো এখন আর কেউ বলছে না। তেমন তত্ত্ব লেখকের জানা থাকলে জানাবেন, উপকৃত হব।
যা হোক, হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে বাহাসে লিপ্ত হওয়ার লক্ষ্য থেকে আমি লিখছি না। আমাদের নির্বুদ্ধিতাকে তিনি উপহাস করতেই পারেন। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেন—যেখানেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে, দেশটা চিড়ে-ছিবড়ে খেয়ে তারপর মানুষের দাবড়ানি খেয়ে ইঁদুরের গর্তে ঢুকেছে।’ আমরা যারা ‘কেটে পড়েছি’, তারা যে এই পরিণতির জন্য অপেক্ষা করিনি, বরং অযুতসংখ্যক মানুষের মধ্যে থেকে পরিবর্তনের জন্য লড়তে পারছি, এতেই আমরা সন্তুষ্ট। বন্ধু সেলিম ‘চুলায় ভাত রান্না’ করুক, তাতে কারও আপত্তি নেই। শুধু দেখার বিষয়—পাত্রে চাল আছে কি না, নাকি কেবল পানি সেদ্ধ হচ্ছে? লেখককে পুনশ্চ ধন্যবাদ।
নূহ-উল-আলম লেনিন: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
ফেরদৌস তাঁর নিজস্ব অবস্থান থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে লিখেছেন। বাংলাদেশে ও বিশ্বপরিসরে বামপন্থার ভবিষ্যৎ ও ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত এবং গভীর আলোচনা দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিশ্ব-সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কার্যকারণ নিয়ে কমিউনিস্ট ও বাম দলগুলো এখন পর্যন্ত তেমন বস্তুনিষ্ঠ ও আত্মসমালোচনামূলক আলোচনা বা মূল্যায়ন করেছে—এমনটি আমার চোখে পড়েনি। আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যানুসন্ধান এবং নতুন করে একটি ভেদ-বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ নির্মাণের পথনির্দেশও করতে পারেননি বামপন্থার অনুসারীরা।
আমি মনে করি, ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ হলেও বাস্তবায়নযোগ্য বা প্র্যাগমেটিক নতুন কোনো স্বপ্নের ঠিকানা আমরা এখনো খুঁজে পাইনি। বামপন্থার একাংশ এখনো মতান্ধতার ফাঁদে বন্দী। তারা ‘তত্ত্ব ঠিক, প্রয়োগে ভুল ছিল’ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে এবং পুরোনো ছিন্ন পতাকা হাতে অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকু নিঃশেষিত করছে। অন্য একটি অংশ পথানুসন্ধানে ব্রতী হয়ে নানা মাত্রার সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বা ধনতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত মূলধারার বুর্জোয়া বা ঐতিহ্যবাহী অকমিউনিস্ট বা নন-মার্ক্সিস্ট এবং পুরোনো ঘরানার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলগুলোর মধ্যেও পরিবর্তনকামী প্রবণতা জোরদার হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্রিস ও স্পেনের একসময়ের কমিউনিস্টদের নতুন ধরনের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে তোলাও একটি নতুন প্রপঞ্চ। লেখক যে ‘নয়া বাম’ ও বাম জাগরণের কথা বলছেন, সম্ভবত তা শেষোক্ত ধারার।
মানবজাতি এখন একটা ভাবাদর্শগত সংকটকাল অতিক্রম করছে। বিদ্যমান বিশ্বায়িত অর্থনীতি বা করপোরেট পুঁজিবাদের কোনো বিকল্প দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ অথবা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতাজনিত ভাবাদর্শগত শূন্যতা এবং অন্য কোনো অগ্রসর ভাবাদর্শ বা চিন্তাধারা দ্বারা পূরণ হয়নি। উত্তরাধুনিক বাস্তবতা নিয়ে নানা মাত্রার অনুসন্ধিৎসা ও ডিসকোর্স অবশ্য লক্ষণীয়। কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য তাত্ত্বিক রূপরেখা বা ছক চোখে পড়ে না।
আমরা যারা ‘কেটে পড়েছি’, তারা যে এই পরিণতির জন্য অপেক্ষা করিনি, বরং অযুতসংখ্যক মানুষের মধ্যে থেকে পরিবর্তনের জন্য লড়তে পারছি, এতেই আমরা সন্তুষ্ট সম্ভবত কোনো একটা নির্দিষ্ট ছকবাঁধা পথে ইতিহাস এগোবে না। আমাদের অজানা-অভাবিত নানা বিচিত্র পথে সভ্যতার রথ আগানোর চেষ্টা করবে। সভ্যতার একটা নিজস্ব নিয়ম ও ডায়নামিকস আছে—সেটা যে কী, তার যথার্থ উপলব্ধিই হয়তো রথের চালিকা হয়ে উঠবে। আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, তবে নিশ্চেষ্ট হয়ে নয়। দৃষ্টিসীমার মধ্যে হলেও রথের রশি আমাদের টেনে নিতেই হবে। আমরা যারা সমাজ পরিবর্তনে এবং একটা ভেদ-বৈষম্যহীন মানবিক সমাজে বিশ্বাসী, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সে চেষ্টাই করছি।
হাসান ফেরদৌসের লেখায় বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের (সিপিবি) মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন, তাঁদের প্রতি একটা খোঁচা আছে। তিনি লিখেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, তিনি (সেলিম) এগিয়ে এসেছেন। তাঁর চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান সতীর্থরা অবশ্য সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন মন্ত্রী বাহাদুর। অনুমান করি, চাইলে তিনিও সে কোটায় ঢুকে পড়তে পারতেন।’
হাসান ফেরদৌস জ্ঞানী মানুষ। নিঃসন্দেহে সবকিছু জেনেবুঝেই তিনি লিখেছেন। তবে তিনি জানেন কি, সিপিবি যখন দ্বিধাবিভক্ত হয়, তখন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বাধীন অংশটি ছিল সংখ্যালঘু, দলের সভাপতি, সাধারণ-সম্পাদকসহ সভাপতিমণ্ডলীর তিন-চারজন ছাড়া আর সবাই এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ‘রূপান্তরিত কমিউনিস্ট’ পার্টির পতাকাতলে সমবেত হন। প্রথমে তঁাদের তরফে কমিউনিস্ট পার্টিকে একটি কর্মসূচিভিত্তিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলে। কিন্তু নানা কারণে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। অতঃপর রূপান্তরকামীরা কার্যত আবারও বিভক্ত হন। প্রধান অংশটি গণফোরামে যোগদান করে (আমার ও অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও)। অজয় রায় ও ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান পৃথক ‘কমিউনিস্ট কেন্দ্র’ গঠন করেন। দুজন সাংসদসহ ক্ষুদ্র একটি অংশ বিএনপিতে যোগদান করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে গণফোরাম কার্যত কার্যকারিতা হারায়। নির্বাচনের আগেই দুজন সাংসদসহ নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে একটি অংশ আওয়ামী লীগে যোগদান করে। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণফোরাম থেকে বেরিয়ে রূপান্তরিত কমিউনিস্টদের প্রধান অংশটি আওয়ামী লীগে যোগদান করে। এরাই ছিল সিপিবির মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। না, এঁদের কেউই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ অথবা মন্ত্রী-এমপি হননি (অবশ্য এমপি-মন্ত্রী হওয়া কি অপরাধ? এতে তো জাত যাওয়ার কথা নয়)। এখনো তাঁরা সততার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
হাসান ফেরদৌসের ভাষায় যাঁরা ‘কেটে পড়েন’, তাঁরা কেউই সেলিমের চেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ নন। সেলিম আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন এবং অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কেটে পড়ারা’ কেবল মন্ত্রিত্বের লোভে আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি। হাসান ফেরদৌসের মতে, আমেরিকা-ইউরোপের মূলধারার দলগুলোতেও যদি পরিবর্তনকামী শক্তি থেকে থাকে, তাহলে যে দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, যে দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং যে দলটি এমডিজি অর্জনসহ সামাজিক-মানবিক খাতে, অমর্ত্য সেনের ভাষায়, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ সূচক অর্জন করেছে (দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা, গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার কমিয়ে আনা প্রভৃতি সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে থাকা, শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো), সেই দলটি কি পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করছে না?
ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি যদি পারে, তবে হতদরিদ্র বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কেন পারবে না? পুঁজিবাদের (নিঃসন্দেহে অপুষ্ট ও দুর্বৃত্তায়িত পুঁজিবাদ) কাঠামোর মধ্যেই আমাদের এসব জনকল্যাণমূলক কাজ, উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিতে হচ্ছে। সোভিয়েত তাত্ত্বিকদের দেওয়া পুঁজিবাদ এড়িয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের (বাই পাসিং ক্যাপিটালিজম) তত্ত্ব তো এখন আর কেউ বলছে না। তেমন তত্ত্ব লেখকের জানা থাকলে জানাবেন, উপকৃত হব।
যা হোক, হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে বাহাসে লিপ্ত হওয়ার লক্ষ্য থেকে আমি লিখছি না। আমাদের নির্বুদ্ধিতাকে তিনি উপহাস করতেই পারেন। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেন—যেখানেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে, দেশটা চিড়ে-ছিবড়ে খেয়ে তারপর মানুষের দাবড়ানি খেয়ে ইঁদুরের গর্তে ঢুকেছে।’ আমরা যারা ‘কেটে পড়েছি’, তারা যে এই পরিণতির জন্য অপেক্ষা করিনি, বরং অযুতসংখ্যক মানুষের মধ্যে থেকে পরিবর্তনের জন্য লড়তে পারছি, এতেই আমরা সন্তুষ্ট। বন্ধু সেলিম ‘চুলায় ভাত রান্না’ করুক, তাতে কারও আপত্তি নেই। শুধু দেখার বিষয়—পাত্রে চাল আছে কি না, নাকি কেবল পানি সেদ্ধ হচ্ছে? লেখককে পুনশ্চ ধন্যবাদ।
নূহ-উল-আলম লেনিন: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
No comments