পথে নামার এখনই সময় by হাসান ফেরদৌস
ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার প্রতিবাদ |
খুন-জখম
বা রাহাজানি বাংলাদেশে হয়, হরহামেশাই হয়। গাড়িচাপা পড়ে মানুষ মরে,
অভাবে-রোগশোকেও মানুষ মরে। সেসব মৃত্যু অধিকাংশের চোখে পরিসংখ্যান ছাড়া
অন্য কিছু নয়। কিন্তু যখন সুপরিকল্পিতভাবে ভরদুপুরে বইয়ের দোকানে ঢুকে একদল
লোক—লোকই তো, নাকি অন্য কিছু—চাপাতি দিয়ে, ছুরি দিয়ে কারও গলা কেটে, তাকে
রক্তের সাগরে ভাসিয়ে সে ঘরে তালা ঝুলিয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যায়, তখন আমাদের
প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
প্রথম ও প্রধান প্রতিক্রিয়া—ভয়। আমরা কেউ নিরাপদ নই, যে কেউ যেকোনো সময় হামলার শিকার হতে পারি এবং আশপাশে উর্দি পরা কেউ নেই যে আমাদের রক্ষা করবে। এই জাতীয় রাজনৈতিক খুন আগেও ঘটেছে, তার সুরাহা হয়নি। যারা এই সর্বশেষ খুনের জন্য দায়ী, তাদের কেউ ধরা পড়বে কি না, সে ব্যাপারে গভীর সংশয় থেকে যায়।
সবচেয়ে যা আমাদের বিস্মিত করেছে, যাঁরা ক্ষমতাধর, এই ঘটনায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া। নিজের পুত্রকে ঘাতকের খঞ্জরে হারানোর পর এক পিতা ক্ষোভে, বেদনায় ও তীব্র ধিক্কারে বলেছেন, তিনি বিচার চান না। তাঁর সে কথা শুনে ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা বলেছেন, সম্ভবত সেই পিতাও ঘাতকদের মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল। ‘যারা তাঁর পুত্রকে হত্যা করেছে, তাঁর বাবা অধ্যাপক সাহেব হয়তো ওই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। ওনার দলের লোকজনদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না বলেই উনি এ ধরনের কথা বলছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক।’ পরে অবশ্য তিনি এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু দুঃখ প্রকাশই কি যথেষ্ট?
পিতা নিহত পুত্রের বিচার কেন চাইছেন না, সরকারি দলের নেতা এ কথা বোঝেননি অথবা বুঝতে চাননি। কার কাছে তিনি বিচার চাইবেন? একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সেসবের সমাধান তো দূরের কথা, বরং সেসব খুনের ঘটনাবলি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশে্য ব্যবহারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সরকারি দলের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি এমন কথাও বলেছেন, আমেরিকার মতো দেশে হরহামেশাই খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে। কই, সেসব নিয়ে তো কোনো মাতামাতি নেই! স্পষ্টতই এই সব কর্তাব্যক্তি জানেন না প্রতিটি খুনের ঘটনা নিয়ে সে দেশে ঠিক কী পরিমাণ মাতামাতি হয়। তার চেয়েও বড় কথা, এমন কোনো খুনের ঘটনা নেই, যা এখানে দিনের পর দিন অমীমাংসিত পড়ে থাকে। খুনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে, অথচ খুনের সুরাহা করার বদলে সে ঘটনা নিয়ে জল ঘোলা করা হবে, এমন ঘটনা আমেরিকায় কার্যত অসম্ভব। কিন্তু এসবই অবান্তর কথা। আমেরিকায় যদি সরকার তার নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তো সেটাই হবে আমাদের মডেল? সে ব্যর্থতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করব নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে?
বস্তুত, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এত লাশ গুনেছি, এত মৃত্যু দেখেছি যে এখন দু-দশটি লাশ পড়ার ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে না। একদিকে সহিংসতার সামাজিকীকরণ ঘটেছে। অর্থাৎ সহিংসতাকে আমরা নিজেদের জীবনের আরেকটি দৈনন্দিন ঝুটঝামেলা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। যানজট যেমন ঝুটঝামেলা, এ নিয়ে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই, কিন্তু ব্যাপারটাকে নিয়মিত একটি বাস্তবতা বলে মেনে নিয়েছি। আমাকে সরকারি দলের এক নেতা যানজট প্রসঙ্গেই বলেছিলেন, এ হচ্ছে নতুন জুতো পরার পর পায়ের বুড়ো আঙুলে টনটনে ব্যথার মতো। কিছুদিন পর ও ব্যথা গা-সওয়া হয়ে যায়। অনুমান করি, সহিংসতাও সে রকম একটা ব্যাপার। সে বিপদ যতক্ষণ না আমার-আপনার দোরগোড়ায় এসে আঘাত হানছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
অন্যদিকে, আমরা সহিংসতার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতাকে নাগরিক সংস্কৃতির অঙ্গীভূত করে নিয়েছি। ধর্ম থেকে রাজনীতি, নাগরিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা কোনো রকম ভিন্নমতকে মেনে নিতে অভ্যস্ত নই। ভিন্নমত ধারণ করে এমন কাউকে আমরা নির্দ্বিধায় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলি। অসহিষ্ণুতার যে সংস্কৃতি রাজনীতিতে এত দিন নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়েছে, অবাক কি নাগরিক জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার ছাপ থাকবে।
সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা—যা বস্তুত পয়সার এপিঠ আর ওপিঠ—তার উভয়ের ক্ষেত্রেই সরাসরি অথবা অলক্ষ্য সমর্থন এসেছে দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই অভিযোগ করেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিদেশি হত্যার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তার পক্ষে তথ্য–প্রমাণ হাজির করতে দেখি না। তাঁর এই কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। সত্যিই তো, যারা জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি করে, তারা অধিক রাজনৈতিক ফায়দা মিলবে—সেই হিসাব থেকে বিদেশি বা ব্লগারদের খুনও করতে পারে।
একটি চূড়ান্ত দায়বদ্ধহীন পরিস্থিতি (বা স্টেট অব ইম্পিউনিটি) থেকেই ব্লগার হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। শুধু একদল ধর্মান্ধ ও কূপমণ্ডূক ব্যক্তির ওপর সে ঘটনার সব দোষ চাপালে নিজেরা কম দোষী বোধ করতে পারি বটে, কিন্তু তাতে অবস্থা বদলাবে না। সংকটটা সমাজের, কেবল সে সমাজভুক্ত ব্যক্তিবিশেষ বা দলের নয়। এই পরিস্থিতির বদল যদি চাই তো সবার আগে স্বীকার করতে হবে, এই অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি নির্মাণে আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। আর সে সংস্কৃতির যদি পরিবর্তন চাই, তাও সম্ভব শুধু আমাদের সবার সচেতন অংশগ্রহণে। আজকের সহিংস ও অসহিষ্ণু সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি, তার পরিবর্তনও একদিনে সম্ভব নয়। সে পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব বিপদ কেবল বাড়াবেই।
কিন্তু ঠিক কী ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি?
এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হলো এসব খুনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, অবিলম্বে তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। শুধু প্রতিশ্রুতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়। কাগজে-কলমে সে দায়িত্ব পালনের প্রমাণ রাখতে হবে। সরকারের হাতে নিরাপত্তা প্রহরার সব হাতিয়ার মজুত রয়েছে। অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন আট মাস আগে। এখনো সে হত্যার সুরাহা হয়নি। একের পর এক নির্বিকার এসব খুনের সুরাহায় অব্যাহত ব্যর্থতার অর্থ, যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা হয় অযোগ্য অথবা দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী। এই দুই অবস্থাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
অন্য জরুরি কাজ সহিংস ও অসহিষ্ণু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জাতীয় সংলাপ। এই কাজটি সম্পাদনে দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা ইতিবাচক ও সাহসী। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অনেক কর্তাব্যক্তি নাখোশ হবেন জেনেও তারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারে নিরলস। সরকারের যে কর্তাব্যক্তিটি অধ্যাপক আবুল কাসেমকে ঘাতকদের দোসর বলে বিষোদ্গার করেছিলেন, পত্রিকার পাতায় সেই ভিডিওটি থেকেই এই কথার প্রমাণ মিলেছে। সেই একই সাহস আমাদের প্রধান বুদ্ধিজীবীরাও দেখাবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ভারতের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীরা ঠিক সেই কাজটিই শুরু করেছেন। সরকার নাখোশ হবে জেনেও অসহিষ্ণুতাকে উসকে দেওয়ার প্রধান অভিযোগ তার বিরুদ্ধেই তুলেছেন।
আমাদের আশা, দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা, যাঁদের অনেকেই হয় সরকার নয়তো বিরোধী দলগুলো থেকে আমটা-কলাটা সময় সময় চেয়ে নিচ্ছেন, তাঁরা এই বিষয়টি পরিষ্কার করবেন যে মুক্তবুদ্ধির গলা টিপে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষিত হবে না, তেমনি হবে না গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার।
আমাদের চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পথে নামার এখনই সময়।
হাসান ফেরদৌস, নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
প্রথম ও প্রধান প্রতিক্রিয়া—ভয়। আমরা কেউ নিরাপদ নই, যে কেউ যেকোনো সময় হামলার শিকার হতে পারি এবং আশপাশে উর্দি পরা কেউ নেই যে আমাদের রক্ষা করবে। এই জাতীয় রাজনৈতিক খুন আগেও ঘটেছে, তার সুরাহা হয়নি। যারা এই সর্বশেষ খুনের জন্য দায়ী, তাদের কেউ ধরা পড়বে কি না, সে ব্যাপারে গভীর সংশয় থেকে যায়।
সবচেয়ে যা আমাদের বিস্মিত করেছে, যাঁরা ক্ষমতাধর, এই ঘটনায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া। নিজের পুত্রকে ঘাতকের খঞ্জরে হারানোর পর এক পিতা ক্ষোভে, বেদনায় ও তীব্র ধিক্কারে বলেছেন, তিনি বিচার চান না। তাঁর সে কথা শুনে ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা বলেছেন, সম্ভবত সেই পিতাও ঘাতকদের মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল। ‘যারা তাঁর পুত্রকে হত্যা করেছে, তাঁর বাবা অধ্যাপক সাহেব হয়তো ওই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। ওনার দলের লোকজনদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না বলেই উনি এ ধরনের কথা বলছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক।’ পরে অবশ্য তিনি এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু দুঃখ প্রকাশই কি যথেষ্ট?
পিতা নিহত পুত্রের বিচার কেন চাইছেন না, সরকারি দলের নেতা এ কথা বোঝেননি অথবা বুঝতে চাননি। কার কাছে তিনি বিচার চাইবেন? একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সেসবের সমাধান তো দূরের কথা, বরং সেসব খুনের ঘটনাবলি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশে্য ব্যবহারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সরকারি দলের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি এমন কথাও বলেছেন, আমেরিকার মতো দেশে হরহামেশাই খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে। কই, সেসব নিয়ে তো কোনো মাতামাতি নেই! স্পষ্টতই এই সব কর্তাব্যক্তি জানেন না প্রতিটি খুনের ঘটনা নিয়ে সে দেশে ঠিক কী পরিমাণ মাতামাতি হয়। তার চেয়েও বড় কথা, এমন কোনো খুনের ঘটনা নেই, যা এখানে দিনের পর দিন অমীমাংসিত পড়ে থাকে। খুনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে, অথচ খুনের সুরাহা করার বদলে সে ঘটনা নিয়ে জল ঘোলা করা হবে, এমন ঘটনা আমেরিকায় কার্যত অসম্ভব। কিন্তু এসবই অবান্তর কথা। আমেরিকায় যদি সরকার তার নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তো সেটাই হবে আমাদের মডেল? সে ব্যর্থতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করব নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে?
বস্তুত, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এত লাশ গুনেছি, এত মৃত্যু দেখেছি যে এখন দু-দশটি লাশ পড়ার ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে না। একদিকে সহিংসতার সামাজিকীকরণ ঘটেছে। অর্থাৎ সহিংসতাকে আমরা নিজেদের জীবনের আরেকটি দৈনন্দিন ঝুটঝামেলা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। যানজট যেমন ঝুটঝামেলা, এ নিয়ে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই, কিন্তু ব্যাপারটাকে নিয়মিত একটি বাস্তবতা বলে মেনে নিয়েছি। আমাকে সরকারি দলের এক নেতা যানজট প্রসঙ্গেই বলেছিলেন, এ হচ্ছে নতুন জুতো পরার পর পায়ের বুড়ো আঙুলে টনটনে ব্যথার মতো। কিছুদিন পর ও ব্যথা গা-সওয়া হয়ে যায়। অনুমান করি, সহিংসতাও সে রকম একটা ব্যাপার। সে বিপদ যতক্ষণ না আমার-আপনার দোরগোড়ায় এসে আঘাত হানছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
অন্যদিকে, আমরা সহিংসতার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতাকে নাগরিক সংস্কৃতির অঙ্গীভূত করে নিয়েছি। ধর্ম থেকে রাজনীতি, নাগরিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা কোনো রকম ভিন্নমতকে মেনে নিতে অভ্যস্ত নই। ভিন্নমত ধারণ করে এমন কাউকে আমরা নির্দ্বিধায় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলি। অসহিষ্ণুতার যে সংস্কৃতি রাজনীতিতে এত দিন নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়েছে, অবাক কি নাগরিক জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার ছাপ থাকবে।
সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা—যা বস্তুত পয়সার এপিঠ আর ওপিঠ—তার উভয়ের ক্ষেত্রেই সরাসরি অথবা অলক্ষ্য সমর্থন এসেছে দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই অভিযোগ করেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিদেশি হত্যার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তার পক্ষে তথ্য–প্রমাণ হাজির করতে দেখি না। তাঁর এই কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। সত্যিই তো, যারা জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি করে, তারা অধিক রাজনৈতিক ফায়দা মিলবে—সেই হিসাব থেকে বিদেশি বা ব্লগারদের খুনও করতে পারে।
একটি চূড়ান্ত দায়বদ্ধহীন পরিস্থিতি (বা স্টেট অব ইম্পিউনিটি) থেকেই ব্লগার হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। শুধু একদল ধর্মান্ধ ও কূপমণ্ডূক ব্যক্তির ওপর সে ঘটনার সব দোষ চাপালে নিজেরা কম দোষী বোধ করতে পারি বটে, কিন্তু তাতে অবস্থা বদলাবে না। সংকটটা সমাজের, কেবল সে সমাজভুক্ত ব্যক্তিবিশেষ বা দলের নয়। এই পরিস্থিতির বদল যদি চাই তো সবার আগে স্বীকার করতে হবে, এই অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি নির্মাণে আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। আর সে সংস্কৃতির যদি পরিবর্তন চাই, তাও সম্ভব শুধু আমাদের সবার সচেতন অংশগ্রহণে। আজকের সহিংস ও অসহিষ্ণু সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি, তার পরিবর্তনও একদিনে সম্ভব নয়। সে পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব বিপদ কেবল বাড়াবেই।
কিন্তু ঠিক কী ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি?
এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হলো এসব খুনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, অবিলম্বে তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। শুধু প্রতিশ্রুতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়। কাগজে-কলমে সে দায়িত্ব পালনের প্রমাণ রাখতে হবে। সরকারের হাতে নিরাপত্তা প্রহরার সব হাতিয়ার মজুত রয়েছে। অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন আট মাস আগে। এখনো সে হত্যার সুরাহা হয়নি। একের পর এক নির্বিকার এসব খুনের সুরাহায় অব্যাহত ব্যর্থতার অর্থ, যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা হয় অযোগ্য অথবা দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী। এই দুই অবস্থাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
অন্য জরুরি কাজ সহিংস ও অসহিষ্ণু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জাতীয় সংলাপ। এই কাজটি সম্পাদনে দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা ইতিবাচক ও সাহসী। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অনেক কর্তাব্যক্তি নাখোশ হবেন জেনেও তারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারে নিরলস। সরকারের যে কর্তাব্যক্তিটি অধ্যাপক আবুল কাসেমকে ঘাতকদের দোসর বলে বিষোদ্গার করেছিলেন, পত্রিকার পাতায় সেই ভিডিওটি থেকেই এই কথার প্রমাণ মিলেছে। সেই একই সাহস আমাদের প্রধান বুদ্ধিজীবীরাও দেখাবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ভারতের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীরা ঠিক সেই কাজটিই শুরু করেছেন। সরকার নাখোশ হবে জেনেও অসহিষ্ণুতাকে উসকে দেওয়ার প্রধান অভিযোগ তার বিরুদ্ধেই তুলেছেন।
আমাদের আশা, দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা, যাঁদের অনেকেই হয় সরকার নয়তো বিরোধী দলগুলো থেকে আমটা-কলাটা সময় সময় চেয়ে নিচ্ছেন, তাঁরা এই বিষয়টি পরিষ্কার করবেন যে মুক্তবুদ্ধির গলা টিপে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষিত হবে না, তেমনি হবে না গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার।
আমাদের চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পথে নামার এখনই সময়।
হাসান ফেরদৌস, নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments