আশুরার দর্শন by মাওলানা মুহাম্মদ মিযানুর রহমান
হিজরি
সন তথা ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম মাস মহররম। আরবি মহররম
শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য
স্মৃতির সঙ্গে জড়িত, যে স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা
সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহররম মাসের ১০ তারিখকে আরবিতে আশুরা
বলা হয়। এই দিবসটি অত্যন্ত বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিক বিভিন্ন
বর্ণনা থেকে জানা যায়, আশুরার দিনে অতীতের অনেক দাম্ভিক জালিমশাহি ও
কাফেরের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে এবং পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কিরাম
আল্লাহপাকের সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর শুকরিয়া হিসেবে তাঁরা এই দিনে
রোজা পালন করতেন।
বুখারি শরিফের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনায় এলেন, তখন তিনি সেখানকার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা পালন করতে দেখলেন। তিনি জানতে চাইলেন, এই দিনে তোমাদের রোজা পালনের কারণ কী? তারা বলল, এটা তো এক মহা সম্মানিত দিন। এই দিনে আল্লাহপাক হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর উম্মতকে নাজাত দিয়েছেন। আর ফেরাউন ও তার বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন। তাই হজরত মুসা (আ.) এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিনে রোজা পালন করেছেন বিধায় আমরাও এই দিনে রোজা রাখি। এটা শুনে রাসুলে করিম (সা.) বললেন, হজরত মুসা (আ.)-এর নাজাতে কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি উপযুক্ত ও অধিক হকদার। অতঃপর রাসুলে করিম (সা.) নিজেও আশুরার রোজা পালন করেন এবং সাহাবাগণকেও রোজা পালনের হুকুম দেন।
অবশ্য আশুরার রোজা পালনের ক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে পার্থক্য সৃষ্টি করার জন্য ১০ মহররমের আগে বা পরে মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। বুখারি শরিফের অপর বর্ণনামতে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে উম্মতের ওপর আশুরার রোজা ফরজ ছিল। অতঃপর রমজানের রোজা ফরজ হলে এই দিনের রোজা নফলে পরিণত হয়। কিন্তু ‘আশুরার রোজা’ নফল হওয়া সত্ত্বেও এর গুরুত্ব কমে যায়নি।
মহানবী (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পরে সর্বোত্তম হলো আশুরার রোজা। প্রিয় নবী (সা.) আরও বলেছেন, আমি আশা রাখি যে আশুরার দিনে রোজা পালন করলে আল্লাহ তাআলা পেছনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। কেননা, কবিরা গুনাহ মাফের জন্য তওবা করা আবশ্যক। তবে রোজা রাখার সঙ্গে সঙ্গে যদি তওবা-ইস্তিগফারও করা হয়, তাহলে ছগিরা-কবিরা সব গুনাহ মাফের আশা করা যায়।
আমাদের সমাজের অনেকেই মহররম মাসকে শোকের মাস হিসেবে পালন করেন। প্রকৃতপক্ষে মহররম তথা আশুরার দিবসে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মনোভাব সৃষ্টি করা উচিত। কেননা, পূর্ববর্তী মুমিন ও পয়গম্বরদের প্রতি আল্লাহপাকের অনুকম্পা ও নিয়ামত প্রকারান্তরে আমাদের জন্যও নিয়ামত। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রিয় নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম এই দিনে রোজা পালন করেছেন। আবার অনেকের মধ্যে এই ধারণাও রয়েছে যে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আশুরার তাৎপর্য। অথচ এ কথা বাস্তব যে আশুরার পবিত্র দিবসটি শুধু ইমাম হোসাইন (রা.) ও আহলে বাইতের কারবালা প্রান্তরে শাহাদতবরণের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠেনি। বরং হজরত হোসাইন (রা.) এমন একটি মোবারক দিবসে শাহাদতবরণ করেছেন, যে দিবসটির সঙ্গে ইতিহাসের বহু পুণ্যময় ঘটনা জড়িত। এতে তাঁর শাহাদতের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে বৈকি। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো দিবসের মূল্যায়ন সেভাবেই করতে হবে, প্রিয় নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম যেভাবে তা করে গেছেন। আমরা যারা প্রিয় নবী (সা.)-কে সত্যিকারভাবেই ভালোবাসি এবং তাঁকে অনুসরণ করি, তাদের সবার অন্তরে হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা তীব্র এক হাহাকার ও ব্যথাতুর অনুভূতির সঞ্চার করে। আর এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু খেলাফতে রাশেদার অবসানের পর ইয়াজিদ কর্তৃক পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে যেভাবে খেলাফতের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চলছিল, যদি হজরত হোসাইন (রা.) নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এর প্রতিবাদ না করতেন, তাহলে পরবর্তী যুগের মুসলমানরা খোলাফায়ে রাশেদিনের সত্যিকার যে আদর্শ, তা হয়তো ভুলেই যেত।
খোলাফায়ে রাশেদিন প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে সারা বিশ্বে সুশাসনের যে অনুপম নমুনা রেখে গেছেন, তার বিপরীতে ইয়াজিদের হুকুমত মেনে নিলে মুসলমানদের সামনে যে ভয়ানক পরিণতি ও আদর্শিক পরাজয় ঘটত, সেই সত্য অনুধাবন করে ইমাম হোসাইন (রা.) প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিরোধ-সংগ্রাম যদিও সঙ্গে সঙ্গেই জয়যুক্ত হয়নি, তবে যুগের পর যুগ ধরে তা মুসলমানদের হৃদয়ে প্রিয় নবীজি (সা.)–এর সত্যিকার আদর্শের খাঁটি অনুসারী হওয়ার আকুতি ও সাধনার মধ্যে অবশ্যই জয়যুক্ত হয়েছে—এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়।
কারাবালার প্রান্তরে হজরত হোসাইন (রা.) যেদিন নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, বলা যায় সেদিন থেকেই ইসলামি আদর্শ প্রকৃত প্রাণশক্তি অর্জন করেছে। সুতরাং কারবালার স্মৃতি মুসলিম হৃদয়ে কেবল শোকের আবহই জাগায় না, বরং সাধনা ও সাফল্যের এক নতুন উদ্দীপনাও জাগিয়ে তোলে। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শহীদি আত্মা চিরন্তন সত্যের কণ্ঠ নিয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে বিশ্ব মুসলিমকে সত্যের পথে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। অতএব আমরা যেন আশুরার মূল দর্শন অনুধাবন করে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরল-সঠিক পথের ওপর অবিচল থাকার সাধনা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারি; আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!
মাওলানা মুহাম্মদ মিযানুর রহমান: সিনিয়র পেশ ইমাম, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ঢাকা, বাংলাদেশ।
বুখারি শরিফের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনায় এলেন, তখন তিনি সেখানকার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা পালন করতে দেখলেন। তিনি জানতে চাইলেন, এই দিনে তোমাদের রোজা পালনের কারণ কী? তারা বলল, এটা তো এক মহা সম্মানিত দিন। এই দিনে আল্লাহপাক হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর উম্মতকে নাজাত দিয়েছেন। আর ফেরাউন ও তার বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন। তাই হজরত মুসা (আ.) এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিনে রোজা পালন করেছেন বিধায় আমরাও এই দিনে রোজা রাখি। এটা শুনে রাসুলে করিম (সা.) বললেন, হজরত মুসা (আ.)-এর নাজাতে কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি উপযুক্ত ও অধিক হকদার। অতঃপর রাসুলে করিম (সা.) নিজেও আশুরার রোজা পালন করেন এবং সাহাবাগণকেও রোজা পালনের হুকুম দেন।
অবশ্য আশুরার রোজা পালনের ক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে পার্থক্য সৃষ্টি করার জন্য ১০ মহররমের আগে বা পরে মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। বুখারি শরিফের অপর বর্ণনামতে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে উম্মতের ওপর আশুরার রোজা ফরজ ছিল। অতঃপর রমজানের রোজা ফরজ হলে এই দিনের রোজা নফলে পরিণত হয়। কিন্তু ‘আশুরার রোজা’ নফল হওয়া সত্ত্বেও এর গুরুত্ব কমে যায়নি।
মহানবী (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পরে সর্বোত্তম হলো আশুরার রোজা। প্রিয় নবী (সা.) আরও বলেছেন, আমি আশা রাখি যে আশুরার দিনে রোজা পালন করলে আল্লাহ তাআলা পেছনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। কেননা, কবিরা গুনাহ মাফের জন্য তওবা করা আবশ্যক। তবে রোজা রাখার সঙ্গে সঙ্গে যদি তওবা-ইস্তিগফারও করা হয়, তাহলে ছগিরা-কবিরা সব গুনাহ মাফের আশা করা যায়।
আমাদের সমাজের অনেকেই মহররম মাসকে শোকের মাস হিসেবে পালন করেন। প্রকৃতপক্ষে মহররম তথা আশুরার দিবসে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মনোভাব সৃষ্টি করা উচিত। কেননা, পূর্ববর্তী মুমিন ও পয়গম্বরদের প্রতি আল্লাহপাকের অনুকম্পা ও নিয়ামত প্রকারান্তরে আমাদের জন্যও নিয়ামত। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রিয় নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম এই দিনে রোজা পালন করেছেন। আবার অনেকের মধ্যে এই ধারণাও রয়েছে যে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আশুরার তাৎপর্য। অথচ এ কথা বাস্তব যে আশুরার পবিত্র দিবসটি শুধু ইমাম হোসাইন (রা.) ও আহলে বাইতের কারবালা প্রান্তরে শাহাদতবরণের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠেনি। বরং হজরত হোসাইন (রা.) এমন একটি মোবারক দিবসে শাহাদতবরণ করেছেন, যে দিবসটির সঙ্গে ইতিহাসের বহু পুণ্যময় ঘটনা জড়িত। এতে তাঁর শাহাদতের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে বৈকি। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো দিবসের মূল্যায়ন সেভাবেই করতে হবে, প্রিয় নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম যেভাবে তা করে গেছেন। আমরা যারা প্রিয় নবী (সা.)-কে সত্যিকারভাবেই ভালোবাসি এবং তাঁকে অনুসরণ করি, তাদের সবার অন্তরে হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা তীব্র এক হাহাকার ও ব্যথাতুর অনুভূতির সঞ্চার করে। আর এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু খেলাফতে রাশেদার অবসানের পর ইয়াজিদ কর্তৃক পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে যেভাবে খেলাফতের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চলছিল, যদি হজরত হোসাইন (রা.) নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এর প্রতিবাদ না করতেন, তাহলে পরবর্তী যুগের মুসলমানরা খোলাফায়ে রাশেদিনের সত্যিকার যে আদর্শ, তা হয়তো ভুলেই যেত।
খোলাফায়ে রাশেদিন প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে সারা বিশ্বে সুশাসনের যে অনুপম নমুনা রেখে গেছেন, তার বিপরীতে ইয়াজিদের হুকুমত মেনে নিলে মুসলমানদের সামনে যে ভয়ানক পরিণতি ও আদর্শিক পরাজয় ঘটত, সেই সত্য অনুধাবন করে ইমাম হোসাইন (রা.) প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিরোধ-সংগ্রাম যদিও সঙ্গে সঙ্গেই জয়যুক্ত হয়নি, তবে যুগের পর যুগ ধরে তা মুসলমানদের হৃদয়ে প্রিয় নবীজি (সা.)–এর সত্যিকার আদর্শের খাঁটি অনুসারী হওয়ার আকুতি ও সাধনার মধ্যে অবশ্যই জয়যুক্ত হয়েছে—এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়।
কারাবালার প্রান্তরে হজরত হোসাইন (রা.) যেদিন নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, বলা যায় সেদিন থেকেই ইসলামি আদর্শ প্রকৃত প্রাণশক্তি অর্জন করেছে। সুতরাং কারবালার স্মৃতি মুসলিম হৃদয়ে কেবল শোকের আবহই জাগায় না, বরং সাধনা ও সাফল্যের এক নতুন উদ্দীপনাও জাগিয়ে তোলে। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শহীদি আত্মা চিরন্তন সত্যের কণ্ঠ নিয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে বিশ্ব মুসলিমকে সত্যের পথে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। অতএব আমরা যেন আশুরার মূল দর্শন অনুধাবন করে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরল-সঠিক পথের ওপর অবিচল থাকার সাধনা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারি; আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!
মাওলানা মুহাম্মদ মিযানুর রহমান: সিনিয়র পেশ ইমাম, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ঢাকা, বাংলাদেশ।
No comments