স্থানীয় নির্বাচনের নীরব প্রস্তুতি বিএনপির তৃণমূলে by কাফি কামাল
স্থানীয়
সরকার নির্বাচনের নীরব প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বিএনপির তৃণমূলে। দলের
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে ‘দলীয় প্রতীকে’ স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত
বাতিলের দাবি জানানো হলেও থেমে নেই নেতাকর্মীরা। এটাকে ‘সরকারের ফাঁদ’ মনে
করলেও খালি মাঠে গোল দিতে নারাজ বিরোধী জোটের তৃণমূল। নির্বাচনে সরকারদলীয়
প্রার্থীদের প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনের অসহযোগিতার ব্যাপারে তারাও ভুগছেন
নানা আশঙ্কায়। দলীয়ভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে কেন্দ্রের তরফে কি সিদ্ধান্ত
আসছে সেটা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। তারপরও প্রস্তুতি শুরু করেছেন বিএনপির
সমর্থন প্রত্যাশী সম্ভাব্য প্রার্থীরা। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার
নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের দ্বিমত থাকলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে
পোষণ করছেন ইতিবাচক মানসিকতা। নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও দলের সমর্থনকে কাজে
লাগিয়ে তারা শুরু করেছেন প্রাক-প্রস্তুতি। মামলার শিকার নেতারা জামিনের
জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন উচ্চ আদালতে। এদিকে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনায় মুখর
হলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ বৃহত্তর রাজনীতির স্বার্থে কৌশলগতভাবে
নির্বাচনে যুক্ত থাকার পক্ষে। সরকারের কৌশলের পাল্টা কৌশল নিয়েও কথাবার্তা
হচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় মহলে। তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের চাপ ও কেন্দ্রীয়
নেতৃত্বের একাংশের ইতিবাচক মনোভাব সম্ভাব্য প্রার্থীদের যোগাচ্ছে উৎসাহ।
তবে শেষ পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাকেই সমর্থন
করবেন তারা। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে
ইতিবাচক মনোভাব ও প্রস্তুতির কথা জানা গেছে। তারা বলছেন, বর্তমান সরকার ও
নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। দলীয় প্রতীকে
স্থানীয় নির্বাচনের নেপথ্যে রয়েছে জোর করে ফলাফল অনুকূলে নেয়া এবং সেটাকে
জনপ্রিয়তা হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রচারের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। কিন্তু
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। এছাড়া ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন
বর্জনের বাস্তব ফলাফল অনুকূলে না আসা ও আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে তৃণমূলে
হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত কর্মী-সমর্থকদের
ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন। তার চেয়ে নির্বাচনের মাঠে মুখোমুখি হলে তৃণমূলে মনোবল
চাঙ্গা হবে। বিএনপি দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নিলেও
কৌশলগতভাবে মাঠে থাকার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া শেষ মুহূর্তে দলীয় প্রতীকে
নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে দেখা যাবে প্রস্তুতি ও সমন্বয়হীনতা।
তৃণমূল নেতারা আশা করছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
গ্রহণে দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে দল। বিশেষ করে প্রার্থী বাছাইয়ের ওপর নির্ভর
করবে নির্বাচনের অর্ধেক ফলাফল। নেতাকর্মীরা জানান, মামলা-হামলায় জর্জরিত
অনেক নেতাকর্মী এখনও আত্মগোপনে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে
অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা ফিরবে। তৃণমূল পুনর্গঠনেও গতি
আসবে। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা
সৃষ্টির পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের সমর্থন নিশ্চিত করতে নিষ্ক্রিয়
নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নেবেন। কেউ কেউ বলছেন, ধানের শীষ প্রতীক
নিয়ে নির্বাচন দলের নেতাকর্মীদের একটি স্বপ্ন। তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনে
দলীয় প্রতীকের ব্যবহার বিএনপির জন্য শাপে বর হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে পৌর মেয়র সমিতির মহাসচিব ও নাটোরের সিংড়া পৌর বিএনপির সভাপতি শামীম আল রাজী বলেন, প্রথমত আমি দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের বিপক্ষে নই। তবে দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্তের আগে সরকারের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও যাচাই-বাছাই করা দরকার ছিল। এখন যেভাবে সিদ্ধান্তটি এসেছে তাতে অনেক জটিলতা থেকে গেছে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের অর্থবণ্টন ও ক্ষমতায়ন প্রশ্নে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এ পদ্ধতি টেকসই হবে না। শামীম আল রাজী বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। প্রতিনিয়ত নানা কাজে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজন হয় সাধারণ মানুষের। ফলে সার্বিক বিচারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।
হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও পৌর বিএনপির সভাপতি আমিনুর রশীদ এমরান আগামী নির্বাচনে পৌর মেয়র পদে নির্বাচনে আগ্রহী। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে বর্তমান সরকারের একটি ফাঁদ। এখন বিএনপি দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী দেয়ার পর সরকার যদি সফলভাবে নিজেদের ফাঁদকে ব্যবহার করে ফলাফল পক্ষে নিতে পারে তবে তারা দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে চাইবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সঠিক। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারছি না এবং আশঙ্কা করছি, সরকার জোর করে নিজেদের প্রার্থীদের পাস দেখাবে। এমরান বলেন, এটাও সত্য যে- জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার বঞ্চিত সাধারণ মানুষ ও দলের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনের পক্ষে। কোন অবস্থাতেই সরকারকে আর ওয়াকওভার দেয়া যাবে না। দলীয়ভাবে অংশ না নিলে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীর প্রতি সমর্থন দিয়েও বিএনপি নির্বাচনে যুক্ত হতে পারে। এতে পাল্টা কৌশলে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনার মাধ্যমে হতাশ হয়ে পড়া কর্মী-সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা করা যাবে। এখন দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে সরকারের ফাঁদে সরকার ফেলা যায়।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহিল মোস্তাক বিগত দুইটি পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আগামী নির্বাচনেও দলের সিদ্ধান্ত পেলে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, প্রথমত দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা একমত নই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্রসহ বিভিন্ন মতের প্রার্থীরা যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বিজয়ী হতেন সেটা বন্ধ করে দেয়ার জন্যই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে ভোট না পেলেও কেবল প্রতীক পাওয়ার কারণে নিজ দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সব চেষ্টাই করবে সরকার। এছাড়া তৃণমূলের চেয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের পছন্দই গুরুত্ব পাবে সবখানে। মোস্তাক বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে বাস্তবতার নিরিখেই বিএনপির তরফে সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করি। বিএনপি একটি গণমানুষের দল হিসেবে বারবার নির্বাচন থেকে দূরে থাকা কতটুকু সঠিক সিদ্ধান্ত হবে সেটা শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন। বিএনপি যদি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে না যায় সেক্ষেত্রেও কৌশলগতভাবে নির্বাচনে যুক্ত থাকতে পারে। তিনি বলেন, বিগত দুটি পৌর নির্বাচনে আমি ফলাফলে দ্বিতীয় হয়েছি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রার্থীর কারণে। এখন দল যদি নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয় সেক্ষেত্রে ফলাফল অনুকূলে আনতে প্রার্থী বাছাই হবে একটি মুখ্য বিষয়। প্রার্থী বাছাইয়েই অনেক কিছু নির্ধারণ হয়ে যাবে।
ময়মনসিংহের ভালুকা থানা বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও সদর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলহাজ হাতেম খান ভালুকা পৌর মেয়র পদে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, তৃণমূলে বিএনপির জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে থাকলেও বর্তমান সরকারের অধীনে এবং দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হলে ফলাফল অনুকূলে আনতে পারবো কিনা আশঙ্কা রয়েছে। সরকার জনগণের মতের মূল্য প্রকাশ হতে দেবে কিনা সে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। আবার বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও দলের সাংগঠনিক ক্ষতি, বিশেষ করে তৃণমূল নেতৃত্বে জটিলতা তৈরি হবে। বিষয়টি অনেকটা জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘের মতো অবস্থা। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে পরিস্থিতি প্রতিকূলে হলেও নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। সরকার স্থানীয় নির্বাচনে জোর করে ফল কেড়ে নিয়ে সেটা সাধারণ মানুষ দেখবে। এতে বিএনপি প্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে দল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহন হবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শামিল। এতে সরকার দলীয় ক্যাডার ও প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধী নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হয়ে পড়বে। তৃণমূলে বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে ভয়ভীতি কেটে যাবে, যা আন্দোলনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কৃষক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আতিকুর ইসলাম লতিফী মীরসরাই পৌর মেয়র পদে নির্বাচনে আগ্রহী। তিনি বলেন, বিএনপির একটি ক্রান্তিকাল চলছে। বিএনপিকে ধ্বংস করতে এমন কোন কৌশল নেই যা সরকার নিচ্ছে না। দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তেমনি একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনমুখী দল এবং আমরা গণমানুষের রাজনীতি করি। নির্বাচনের বিষয়েও আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে। দল নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে আমরা তার জন্য প্রস্তুত।
বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সামান্য ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও উপজেলা বিএনপির সদস্য আলহাজ আবদুল বারী। সদর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে এবারও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দল যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের জন্য আমি আগ্রহী। সন্দেহ নেই সরকার তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সবধরনের প্রভাব খাটাবে। কিন্তু কারচুপি করেও তৃণমূলে বিএনপির মজবুত অবস্থানকে ভাঙতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিলে তৃণমূলে দল আরও শক্তিশালী হবে।
মঠবাড়িয়া পৌর বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির বিশেষ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বিগত পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হয়েছিলেন মাত্র ৫৬ ভোটে। বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি কারচুপির মাধ্যমে তাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। নেতাকর্মীদের সে ক্ষোভ এখনও প্রশমিত হয়নি। তিনি বলেন, দলীয়ভিত্তিতে নির্বাচন করে সরকার তাদের দলের লোকজনকে স্থানীয় সরকারেও জোর করে বসিয়ে দিতে চায়। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনমুখী দল তাই নির্বাচনে যাওয়ার বিকল্প নেই। সরকার কারচুপি করলে তা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য হলেও নির্বাচনে যাওয়া দরকার। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রভাবের পাশাপাশি গুরুত্ব পায় আত্মীয়তার প্রভাব। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে পারলে ফল ছিনিয়ে নেয়া কঠিন হবে। হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মঠবাড়িয়া পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের কমিটি গঠনও সম্পন্ন হয়েছে।
সোনারগাঁও উপজেলার বারাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে আগ্রহী উপজেলা যুবদলের গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক কবির মৃধা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে কোন ধরনের নির্বাচনই সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার দলীয় লোকজন জোর করে ফলাফল অনুকূলে নিয়েছে। সামনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে দলীয়করণ ও নৈরাজ্য বাড়বে। কিন্তু নির্বাচনমুখী দল হিসেবে বিএনপির কর্মী সমর্থকরাও নির্বাচনের জন্য উন্মুখ। এ অবস্থায় দলের সিদ্ধান্তকেই আমরা স্বাগত জানাবো।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে পৌর মেয়র সমিতির মহাসচিব ও নাটোরের সিংড়া পৌর বিএনপির সভাপতি শামীম আল রাজী বলেন, প্রথমত আমি দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের বিপক্ষে নই। তবে দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্তের আগে সরকারের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও যাচাই-বাছাই করা দরকার ছিল। এখন যেভাবে সিদ্ধান্তটি এসেছে তাতে অনেক জটিলতা থেকে গেছে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের অর্থবণ্টন ও ক্ষমতায়ন প্রশ্নে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এ পদ্ধতি টেকসই হবে না। শামীম আল রাজী বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। প্রতিনিয়ত নানা কাজে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজন হয় সাধারণ মানুষের। ফলে সার্বিক বিচারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।
হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও পৌর বিএনপির সভাপতি আমিনুর রশীদ এমরান আগামী নির্বাচনে পৌর মেয়র পদে নির্বাচনে আগ্রহী। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে বর্তমান সরকারের একটি ফাঁদ। এখন বিএনপি দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী দেয়ার পর সরকার যদি সফলভাবে নিজেদের ফাঁদকে ব্যবহার করে ফলাফল পক্ষে নিতে পারে তবে তারা দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে চাইবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সঠিক। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারছি না এবং আশঙ্কা করছি, সরকার জোর করে নিজেদের প্রার্থীদের পাস দেখাবে। এমরান বলেন, এটাও সত্য যে- জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার বঞ্চিত সাধারণ মানুষ ও দলের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনের পক্ষে। কোন অবস্থাতেই সরকারকে আর ওয়াকওভার দেয়া যাবে না। দলীয়ভাবে অংশ না নিলে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীর প্রতি সমর্থন দিয়েও বিএনপি নির্বাচনে যুক্ত হতে পারে। এতে পাল্টা কৌশলে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনার মাধ্যমে হতাশ হয়ে পড়া কর্মী-সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা করা যাবে। এখন দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে সরকারের ফাঁদে সরকার ফেলা যায়।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহিল মোস্তাক বিগত দুইটি পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আগামী নির্বাচনেও দলের সিদ্ধান্ত পেলে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, প্রথমত দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা একমত নই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্রসহ বিভিন্ন মতের প্রার্থীরা যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বিজয়ী হতেন সেটা বন্ধ করে দেয়ার জন্যই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে ভোট না পেলেও কেবল প্রতীক পাওয়ার কারণে নিজ দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সব চেষ্টাই করবে সরকার। এছাড়া তৃণমূলের চেয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের পছন্দই গুরুত্ব পাবে সবখানে। মোস্তাক বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে বাস্তবতার নিরিখেই বিএনপির তরফে সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করি। বিএনপি একটি গণমানুষের দল হিসেবে বারবার নির্বাচন থেকে দূরে থাকা কতটুকু সঠিক সিদ্ধান্ত হবে সেটা শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন। বিএনপি যদি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে না যায় সেক্ষেত্রেও কৌশলগতভাবে নির্বাচনে যুক্ত থাকতে পারে। তিনি বলেন, বিগত দুটি পৌর নির্বাচনে আমি ফলাফলে দ্বিতীয় হয়েছি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রার্থীর কারণে। এখন দল যদি নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয় সেক্ষেত্রে ফলাফল অনুকূলে আনতে প্রার্থী বাছাই হবে একটি মুখ্য বিষয়। প্রার্থী বাছাইয়েই অনেক কিছু নির্ধারণ হয়ে যাবে।
ময়মনসিংহের ভালুকা থানা বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও সদর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলহাজ হাতেম খান ভালুকা পৌর মেয়র পদে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, তৃণমূলে বিএনপির জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে থাকলেও বর্তমান সরকারের অধীনে এবং দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হলে ফলাফল অনুকূলে আনতে পারবো কিনা আশঙ্কা রয়েছে। সরকার জনগণের মতের মূল্য প্রকাশ হতে দেবে কিনা সে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। আবার বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও দলের সাংগঠনিক ক্ষতি, বিশেষ করে তৃণমূল নেতৃত্বে জটিলতা তৈরি হবে। বিষয়টি অনেকটা জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘের মতো অবস্থা। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে পরিস্থিতি প্রতিকূলে হলেও নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। সরকার স্থানীয় নির্বাচনে জোর করে ফল কেড়ে নিয়ে সেটা সাধারণ মানুষ দেখবে। এতে বিএনপি প্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে দল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহন হবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শামিল। এতে সরকার দলীয় ক্যাডার ও প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধী নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হয়ে পড়বে। তৃণমূলে বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে ভয়ভীতি কেটে যাবে, যা আন্দোলনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কৃষক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আতিকুর ইসলাম লতিফী মীরসরাই পৌর মেয়র পদে নির্বাচনে আগ্রহী। তিনি বলেন, বিএনপির একটি ক্রান্তিকাল চলছে। বিএনপিকে ধ্বংস করতে এমন কোন কৌশল নেই যা সরকার নিচ্ছে না। দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তেমনি একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনমুখী দল এবং আমরা গণমানুষের রাজনীতি করি। নির্বাচনের বিষয়েও আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে। দল নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে আমরা তার জন্য প্রস্তুত।
বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সামান্য ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও উপজেলা বিএনপির সদস্য আলহাজ আবদুল বারী। সদর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে এবারও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দল যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের জন্য আমি আগ্রহী। সন্দেহ নেই সরকার তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সবধরনের প্রভাব খাটাবে। কিন্তু কারচুপি করেও তৃণমূলে বিএনপির মজবুত অবস্থানকে ভাঙতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিলে তৃণমূলে দল আরও শক্তিশালী হবে।
মঠবাড়িয়া পৌর বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির বিশেষ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বিগত পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হয়েছিলেন মাত্র ৫৬ ভোটে। বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি কারচুপির মাধ্যমে তাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। নেতাকর্মীদের সে ক্ষোভ এখনও প্রশমিত হয়নি। তিনি বলেন, দলীয়ভিত্তিতে নির্বাচন করে সরকার তাদের দলের লোকজনকে স্থানীয় সরকারেও জোর করে বসিয়ে দিতে চায়। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনমুখী দল তাই নির্বাচনে যাওয়ার বিকল্প নেই। সরকার কারচুপি করলে তা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য হলেও নির্বাচনে যাওয়া দরকার। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রভাবের পাশাপাশি গুরুত্ব পায় আত্মীয়তার প্রভাব। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে পারলে ফল ছিনিয়ে নেয়া কঠিন হবে। হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মঠবাড়িয়া পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের কমিটি গঠনও সম্পন্ন হয়েছে।
সোনারগাঁও উপজেলার বারাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে আগ্রহী উপজেলা যুবদলের গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক কবির মৃধা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে কোন ধরনের নির্বাচনই সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার দলীয় লোকজন জোর করে ফলাফল অনুকূলে নিয়েছে। সামনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে দলীয়করণ ও নৈরাজ্য বাড়বে। কিন্তু নির্বাচনমুখী দল হিসেবে বিএনপির কর্মী সমর্থকরাও নির্বাচনের জন্য উন্মুখ। এ অবস্থায় দলের সিদ্ধান্তকেই আমরা স্বাগত জানাবো।
No comments