উত্তপ্ত উপজেলা পরিষদ by উবায়দুল্লাহ বাদল
উপজেলা পরিষদে এবার শুরু হয়েছে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব। সংসদ সদস্য (এমপি), উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) দীর্ঘদিনের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে এই মুহূর্তে যুক্ত হয়েছেন উপজেলার ১৭ দফতর প্রধান। এসব দফতর প্রধান ও তাদের অধীনস্থ জনবলের বেতন-বিল উত্তোলন করতে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষর থাকা বাধ্যতামূলক করায় সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতির।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি) এবং ২৬টি ক্যাডার ও বিভিন্ন ফাংশনাল সার্ভিসের বিসিএস সমন্ব^য় কমিটি। এরই মধ্যে এসব সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে এটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় আগামী শনিবার ঢাকায় প্রতিনিধি সমাবেশ করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এই চতুর্মুখী দ্বন্দ্বে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সারা দেশের উপজেলা পরিষদ। এতে মাঠপর্যায়ে সরকারের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হতে পারে বলে আশংকা স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা যুগান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ আইন ও মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আদেশটি (ন্যস্তকৃত দফতর প্রধান ও তাদের অধীনস্থ জনবলের বেতন-বিল উত্তোলন করতে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষর থাকা সংক্রান্ত) জারি করা হয়েছে। আমরা বিধি-বিধান দেখে কাজ করি। আমাদের আইন ও বিধি-বিধান জানতে হবে। কারা আনরেস্ট করছে জানি না, তাদেরও এগুলো জানা দরকার আছে। আমরা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কীভাবে মালিকের সঙ্গে কথা বলবেন এটাও কিন্তু আইন-কানুনে বলা আছে।’
উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, স্থানীয় সংসদ সদস্য উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হবেন এবং উপদেষ্টার পরামর্শ শুনতে বাধ্য থাকবে পরিষদ। এমনকি পরিষদের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যের অনুমতি ছাড়া উপজেলা পরিষদ কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবে না। শুরু থেকেই এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্ব চলছে। চেয়ারম্যানদের অভিন্ন অভিযোগ, উপজেলা পরিষদের নামে টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হলে, তা সরকারি দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যরা নিয়ে যান। পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে এমপির পরামর্শ নেয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় এক্ষেত্রে চেয়ারম্যানরা একেবারেই অসহায়। অথচ বিধান অনুযায়ী, উপজেলার জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মধ্যে তা বিতরণ করার কথা। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনের বাজেট বরাদ্দ ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ারও বিধান রয়েছে। বাস্তবে তা সংসদ সদস্যের পরামর্শেই ইউএনও করে থাকেন। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় পর্যায়ের ১৭টি দফতর দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অদ্যাবধি হস্তান্তরিত দফতরগুলোর অধিকাংশ কমিটির প্রধান ইউএনও। প্রধান করা হয়নি চেয়ারম্যান অথবা ভাইস-চেয়ারম্যানদের। উল্লিখিত সব বিষয় নিয়ে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও’র মধ্যে গত প্রায় ছয় বছর ধরে চলছে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন সময়ে তাদের এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যেও চলে এসেছে, ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনাও। কোনো কোনো সময় এগুলো গণমাধমেও এসেছে।
তবে অনুসন্ধানে ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী উপজেলা পাওয়া গেছে। এসব উপজেলার স্থানীয় এমপিদের অধিকাংশই হচ্ছেন জাতীয় পার্টি ও জাসদের। সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যানরা অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এমপিদের হস্তক্ষেপ না থাকায় ইউএনও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ওপর অহেতুক দাপট দেখাতে পারেন না। এ বিষয়ে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খোন্দকার আবু আশফাক বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার এলাকার এমপি জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। আমাকে সঙ্গে নিয়েই তিনি স্থানীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি আমাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন, যা বিরল। তবে গত মেয়াদে নবাবগঞ্জের এমপি ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান। ওই মেয়াদের পাঁচ বছর তার কাছ থেকে সামান্যতম সহযোগিতা পাইনি।’
গত ৩১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, উপজেলা পর্যায়ে হস্তান্তরিত ১৭টি দফতরের জনবলের বেতন-ভাতা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের দেয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমা হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরে তা উত্তোলন করতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ অনুযায়ী সরকারের দেয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমা হওয়ার কথা থাকলেও এতদিন তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। তাদের দাবি, এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসে (বিএফআর) দেয়া ‘সেলফ ড্রয়িং কর্মকর্তা’র (নিজ স্বাক্ষরে বেতন উঠানো) ক্ষমতাকে খর্ব করা হবে। গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের ক্ষমতা অন্য কারও কাছে দেয়া বিধি পরিপন্থী ও অমর্যাদাকর। এ বিষয়ে তারা গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীকেও স্বারকলিপি দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি কবির আহমেদ ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলন নয়, এটা আমাদের যৌক্তিক দাবি। আগামী ২৪ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের সামনে সমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ উপজেলাকে কার্যকর করার নামে ইউএনওকে ৯৮ ভাগ ও চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছে মাত্র ২ ভাগ ক্ষমতা। এর মাধ্যমে কীভাবে উপজেলা পরিষদ কার্যকর হবে?’ প্রশ্ন তোলেন কবির আহমেদ।
জানতে চাইলে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব ফিরোজ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও যৌথ স্বাক্ষরে পরিষদে ন্যস্তকৃত জনবলের বেতন-বিল উত্তোলন করতে হবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ সংশোধন করতে হবে। এ আদেশের বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে খুলনা, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ন্যস্তকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানববন্ধন করেছেন। আমরা বৃহস্পতিবারও এ বিষয়ে বৈঠক করেছি। শুক্রবারও বৈঠক হতে পারে।’
প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সঙ্গে প্রায় সহমত পোষণ করেন উপজেলা চেয়ারম্যানদের অনেকে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘সংসদ সদস্য ও আমলাদের আঁতাতের ফলে আজ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে উপজেলা পরিষদ। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতার সবই ইউএনও’র হাতে, সবকিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরে ন্যস্তকৃত জনবলের বেতন-বিল দেয়ার সিদ্ধান্ত ইউএনওকে আরও ক্ষমতায়ন করা হয়েছে।’ উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দফতর প্রধানদের সঙ্গে ইউএনওর দ্বন্দ্বের কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে উপদেষ্টা) বদিউজ্জামান বাদশা এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি দুরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টির নতুন সংস্করণ। এমনভাবে আদেশ জারি করা হয়েছে যাতে নানামুখী প্রতিবাদের মুখে অফিস আদেশ বাতিল হয় এবং উপজেলা চেয়ারম্যানরা ক্ষমতাবঞ্চিত হন। এতে করে উপজেলা পরিষদে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপজেলা পরিষদকে আঁতুর ঘরেই রেখে দেয়ার ষড়যন্ত্র এটি।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধান লংঘন করে উপজেলা পরিষদ আইনে এমপিদের উপদেষ্টা বানানো হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি প্রতিষ্ঠানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার বিষয়টি কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না। ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের মুখ্য কর্মকর্তা বানিয়ে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বকে উসকে দেয়া হয়েছে। ফলে উপজেলা পরিষদে এখন এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং ন্যস্তকৃত দফতর প্রধানদের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হবে। আমরা চাই না তাদের আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বের কারণে উপজেলা পরিষদ উত্তপ্ত হোক।’
সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি) এবং ২৬টি ক্যাডার ও বিভিন্ন ফাংশনাল সার্ভিসের বিসিএস সমন্ব^য় কমিটি। এরই মধ্যে এসব সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে এটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় আগামী শনিবার ঢাকায় প্রতিনিধি সমাবেশ করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এই চতুর্মুখী দ্বন্দ্বে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সারা দেশের উপজেলা পরিষদ। এতে মাঠপর্যায়ে সরকারের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হতে পারে বলে আশংকা স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা যুগান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ আইন ও মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আদেশটি (ন্যস্তকৃত দফতর প্রধান ও তাদের অধীনস্থ জনবলের বেতন-বিল উত্তোলন করতে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষর থাকা সংক্রান্ত) জারি করা হয়েছে। আমরা বিধি-বিধান দেখে কাজ করি। আমাদের আইন ও বিধি-বিধান জানতে হবে। কারা আনরেস্ট করছে জানি না, তাদেরও এগুলো জানা দরকার আছে। আমরা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কীভাবে মালিকের সঙ্গে কথা বলবেন এটাও কিন্তু আইন-কানুনে বলা আছে।’
উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, স্থানীয় সংসদ সদস্য উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হবেন এবং উপদেষ্টার পরামর্শ শুনতে বাধ্য থাকবে পরিষদ। এমনকি পরিষদের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যের অনুমতি ছাড়া উপজেলা পরিষদ কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবে না। শুরু থেকেই এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্ব চলছে। চেয়ারম্যানদের অভিন্ন অভিযোগ, উপজেলা পরিষদের নামে টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হলে, তা সরকারি দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যরা নিয়ে যান। পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে এমপির পরামর্শ নেয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় এক্ষেত্রে চেয়ারম্যানরা একেবারেই অসহায়। অথচ বিধান অনুযায়ী, উপজেলার জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মধ্যে তা বিতরণ করার কথা। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনের বাজেট বরাদ্দ ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ারও বিধান রয়েছে। বাস্তবে তা সংসদ সদস্যের পরামর্শেই ইউএনও করে থাকেন। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় পর্যায়ের ১৭টি দফতর দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অদ্যাবধি হস্তান্তরিত দফতরগুলোর অধিকাংশ কমিটির প্রধান ইউএনও। প্রধান করা হয়নি চেয়ারম্যান অথবা ভাইস-চেয়ারম্যানদের। উল্লিখিত সব বিষয় নিয়ে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও’র মধ্যে গত প্রায় ছয় বছর ধরে চলছে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন সময়ে তাদের এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যেও চলে এসেছে, ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনাও। কোনো কোনো সময় এগুলো গণমাধমেও এসেছে।
তবে অনুসন্ধানে ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী উপজেলা পাওয়া গেছে। এসব উপজেলার স্থানীয় এমপিদের অধিকাংশই হচ্ছেন জাতীয় পার্টি ও জাসদের। সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যানরা অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এমপিদের হস্তক্ষেপ না থাকায় ইউএনও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ওপর অহেতুক দাপট দেখাতে পারেন না। এ বিষয়ে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খোন্দকার আবু আশফাক বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার এলাকার এমপি জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। আমাকে সঙ্গে নিয়েই তিনি স্থানীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি আমাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন, যা বিরল। তবে গত মেয়াদে নবাবগঞ্জের এমপি ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান। ওই মেয়াদের পাঁচ বছর তার কাছ থেকে সামান্যতম সহযোগিতা পাইনি।’
গত ৩১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, উপজেলা পর্যায়ে হস্তান্তরিত ১৭টি দফতরের জনবলের বেতন-ভাতা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের দেয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমা হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরে তা উত্তোলন করতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ অনুযায়ী সরকারের দেয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমা হওয়ার কথা থাকলেও এতদিন তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। তাদের দাবি, এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসে (বিএফআর) দেয়া ‘সেলফ ড্রয়িং কর্মকর্তা’র (নিজ স্বাক্ষরে বেতন উঠানো) ক্ষমতাকে খর্ব করা হবে। গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের ক্ষমতা অন্য কারও কাছে দেয়া বিধি পরিপন্থী ও অমর্যাদাকর। এ বিষয়ে তারা গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীকেও স্বারকলিপি দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি কবির আহমেদ ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলন নয়, এটা আমাদের যৌক্তিক দাবি। আগামী ২৪ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের সামনে সমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ উপজেলাকে কার্যকর করার নামে ইউএনওকে ৯৮ ভাগ ও চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছে মাত্র ২ ভাগ ক্ষমতা। এর মাধ্যমে কীভাবে উপজেলা পরিষদ কার্যকর হবে?’ প্রশ্ন তোলেন কবির আহমেদ।
জানতে চাইলে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব ফিরোজ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও যৌথ স্বাক্ষরে পরিষদে ন্যস্তকৃত জনবলের বেতন-বিল উত্তোলন করতে হবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ সংশোধন করতে হবে। এ আদেশের বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে খুলনা, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ন্যস্তকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানববন্ধন করেছেন। আমরা বৃহস্পতিবারও এ বিষয়ে বৈঠক করেছি। শুক্রবারও বৈঠক হতে পারে।’
প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সঙ্গে প্রায় সহমত পোষণ করেন উপজেলা চেয়ারম্যানদের অনেকে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘সংসদ সদস্য ও আমলাদের আঁতাতের ফলে আজ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে উপজেলা পরিষদ। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতার সবই ইউএনও’র হাতে, সবকিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরে ন্যস্তকৃত জনবলের বেতন-বিল দেয়ার সিদ্ধান্ত ইউএনওকে আরও ক্ষমতায়ন করা হয়েছে।’ উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দফতর প্রধানদের সঙ্গে ইউএনওর দ্বন্দ্বের কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে উপদেষ্টা) বদিউজ্জামান বাদশা এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি দুরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টির নতুন সংস্করণ। এমনভাবে আদেশ জারি করা হয়েছে যাতে নানামুখী প্রতিবাদের মুখে অফিস আদেশ বাতিল হয় এবং উপজেলা চেয়ারম্যানরা ক্ষমতাবঞ্চিত হন। এতে করে উপজেলা পরিষদে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপজেলা পরিষদকে আঁতুর ঘরেই রেখে দেয়ার ষড়যন্ত্র এটি।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধান লংঘন করে উপজেলা পরিষদ আইনে এমপিদের উপদেষ্টা বানানো হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি প্রতিষ্ঠানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার বিষয়টি কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না। ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের মুখ্য কর্মকর্তা বানিয়ে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বকে উসকে দেয়া হয়েছে। ফলে উপজেলা পরিষদে এখন এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং ন্যস্তকৃত দফতর প্রধানদের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হবে। আমরা চাই না তাদের আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বের কারণে উপজেলা পরিষদ উত্তপ্ত হোক।’
No comments