গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্যের একটি একাডেমিক জবাব- প্রসঙ্গ: ‘আল্লাহর ৯৯ নাম দেবতাদের নাম থেকে এডাপ্ট’ by তাইছির মাহমুদ
নিউ
ইয়র্কে সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর দেয়া ‘একাডেমিক’ বক্তব্যের একটি
একাডেমিক জবাব লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে
গিয়ে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তাই ভাবছিলাম আর লিখবো না, কিন্তু বিবেকের
তাড়নায় লিখতে হলো। কারণ গাফ্ফার চৌধুরী গত ২০শে জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে তার
একটি কলামে লিখেছেন ‘আমি যদি ভুল বলে থাকি, তাহলে নিশ্চয়ই আমার বক্তব্য কেউ
খ-ন করতে পারেন এবং আমিও ভুল শোধরাতে পারি।’ তাছাড়া তাঁর বক্তব্যের
স্বপক্ষে না বুঝে অনেকেই অনেক কিছু লিখছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে
তথ্যভিত্তিক একটি লেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি। তবে এ লেখার
মাধ্যমে তাঁকে শোধরানোর কোন দায়িত্ব বা উদ্দেশ্য আমার নেই। শুধু
কুরআন-হাদিসের আলোকে একটি দালিলিক জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো। এই লেখাটি পড়ে
মনঃপূত হলে গাফ্ফার চৌধুরী চিন্তা করে দেখতে পারেন তাঁর দেয়া বক্তব্য সঠিক
কি-না। আর সঠিক না হলে তাঁর করণীয় কী? আর দ্বিমত করলে একটি পাল্টা লেখা
পাঠাতে পারেন। অবশ্যই সেটি ছাপানো হবে- যদি তা কোরআন-হাদিসের সঙ্গে
সাংঘর্ষিক না হয়। গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে।
সাপ্তাহিক দেশ-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের অগে আমি দীর্ঘ প্রায় এক দশক
সাপ্তাহিক নতুন দিনের নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। তিনি এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা
সম্পাদক ছিলেন। আমার যোগদানের পর তিনি কিছুদিন নতুন দিনে নিয়মিত লিখেছেন।
এই সূত্রে তাঁর সাথে প্রায়শই যোগাযোগ হতো। তাঁর সাথে অনেক মজার মজার ঘটনা
আছে। সেটি কোনদিন সময়-সুযোগে প্রয়োজন হলে লিখবো। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন,
এখনও করেন কি-না জানি না! তবে একজন বর্ষীয়ান ও বিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে তাঁর
প্রতি আমার শ্রদ্ধার কোন কমতি নেই। গঠনমূলক সমালোচনার অর্থ কাউকে অশ্রদ্ধা
করা নয়। অতএব, তিনি এই আলোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখবেন বলে আশা রাখি। সে
যাক, এবার মূল আলোচনায় মনোনিবেশ করা যাক। গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য নিয়ে
আলোচনা শুরুর আগে তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তা পাঠকদের
সুবিধার্থে পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ৩রা জুলাই শুক্রবার বিকালে
জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে তিনি ‘বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক
এক আলোচনা সভায় একক বক্তব্য রাখেন। সভায় তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি, এর
ব্যবহার, হাজার বছর আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষা গ্রহণ ও বর্জনের
ইতিকথা তুলে ধরেন। বাংলা ভাষার বিবর্তনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
আল্লাহ্র যে ৯৯ নাম রয়েছে এগুলো কাফেরদের দেবতাদের নাম থেকে এডাপ্ট করা
হয়েছে। বাংলাদেশে আরবি ভাষায় সন্তানের নামকরণের প্রবণতা প্রসঙ্গে তিনি
বলেছেন, সবচেয়ে বেশি হাদিস সংগ্রহকারী আবু হুরায়রা নামের অর্থ হচ্ছে
বিড়ালের বাবা। আর আবু বকর নামের অর্থ হচ্ছেÑ ছাগলের বাবা। বাংলাদেশের মানুষ
অর্থ না জেনে এসব নাম রাখে। আরবে কোথাও এসব নাম পাওয়া যাবে না। বক্তৃতার
একপর্যায়ে বাঙালি মহিলাদের হিজাব পরার বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন- বাঙালি
নারীরা শাড়ি পরবেন, কপালে টিপ দেবেন, এটা আমাদের সংস্কৃতি। তাঁর এ
বক্তব্যের পর দেশে-বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলে তিনি নিউ ইয়র্কের
স্থানীয় একটি টেলিভিশনে তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেন। ব্যাখ্যায়
তিনি বলেন, আমি ভুল কিছু বলিনি। আমি বড় মুসলমান। তিনি আবারও বলেন, আল্লাহ্
নামতো আগে কাফেরদের দেবতার নাম ছিল। তা না হলে রাসূলের (সাঃ) পিতার নাম
আবদুল্লাহ কী করে হলো? এটা তো মুসলমান নাম নয়। তিনি আরও বলেন, হজও ইসলামের
হজ নয়। এটাও ২ হাজার ৩ হাজার বছর আগে কাফেরদের প্রবর্তিত হজ। সর্বশেষ গত
২০শে জুলাই সোমবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠে ‘নিউ ইয়র্কে আমার ঘটনা
এবং বন্ধুদের রটনা’Ñ শীর্ষক কলামে তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে বিস্তর
লিখেছেন। কলামে তিনি ঐদিন নিউ ইয়র্কে প্রকৃতপক্ষে কী বলেছিলেন তা তুলে
ধরেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘ভাষা-জাতীয়তা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমি বলেছি,
ভাষার কোন ধর্মীয় পরিচয় নেই। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবি ভাষা অমুসলিমদের ভাষা
ছিল। সেই ভাষাতেই কোরআন নাজিল হয়েছে এবং ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। আল্লাহ্র
বহু গুণবাচক নাম আরবি ভাষা থেকেই সংগৃহীত এবং আগে তা কা’বার দেবতাদের নাম
হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেবতাদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার পর এই নাম শুধু
আল্লাহ্র গুণবাচক নাম হয়ে দাঁড়ায়।’ তিনি ওই কলামে আরও লিখেছেন, তাঁর
বক্তব্য কাটছাঁট করে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে। তবে তিনি
দেখিয়ে দেননি কোথায় কাটছাঁট করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড
ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে। এটাতো কাটছাঁট করার কোন
সুযোগই নেই। তিনি কি বলতে চান ভিডিওটি কোন আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছেন। নাহ,
এমন অভিযোগ অবশ্য তিনি এখনও করেননি। আচ্ছা, ধরে নিলাম ভিডিওটিতে কাটছাঁট
করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এবার জনকণ্ঠে তাঁর কলামে স্বজ্ঞানে লিখেছেন-
আল্লাহ্র বহু গুণবাচক নাম আরবি ভাষা থেকেই সংগৃহীত এবং আগে তা কা’বার
দেবতাদের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেবতাদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার পর এই
নাম শুধু আল্লাহ্র গুণবাচক নাম হয়ে দাঁড়ায়। এটুকুই যথেষ্ট। আমি তাঁর
বক্তব্যের উপরোক্ত অংশের আলোকেই জবাবটি লিখতে চাই। তবে মূল বক্তব্যে যাওয়ার
আগে আল্লাহ্র গুণবাচক নাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা দিচ্ছি।
আল্লাহ্র গুণবাচক নামের উৎস কী? আল্লাহ্র ৯৯ নাম কোথা থেকে এলো? আমরা
কিভাবে জানতে পারলাম যে, আল্লাহ্তায়ালার ৯৯টি নাম আছে। অনেকের মনে নতুন করে
এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। তাই প্রথমে ৯৯ নামের ব্যাপারে একটি ভূমিকা দিতে
চাই। পবিত্র কোরআনের নবম পারায় সূরা আল-আরাফের ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
‘আল্লাহ্তায়ালার জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সেই নাম ধরেই তাঁকে ডাকো।
আর তাদেরকে বর্জন করো, যারা তাঁর নামে বিকৃতি ঘটায়। তারা নিজেদের
কৃতকর্মের ফল শিগগিরই পাবে।’ ৩০ পারা কোরআনের বিভিন্ন স্থানে
বিচ্ছিন্নভাবে নামগুলো সুবিন্যস্ত রয়েছে। যেমন রাহমান, রাহিম, গাফ্ফার,
হাকিম, কাদির, রাজ্জাক ইত্যাদি। সূরা হাশরের শেষ আয়াতগুলোতে একত্রে বেশ
কয়েকটি নাম উল্লেখ রয়েছে। তবে নামের প্রকৃত সংখ্যা কত- এ সম্পর্কে
নির্দিষ্ট করে কোরআনে কিছু বলা হয়নি। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশুদ্ধ
হাদিসগ্রন্থ বোখারী ও মুসলিম শরীফের ২৭৩৬ ও ২৬৭৭ নং হাদিসে রাসূল (সাঃ)
বলেছেন, ‘আল্লাহ্তায়ালার ৯৯টি নাম রয়েছে। এক কম একশ’। যে ব্যক্তি নামগুলো
গণনা (পাঠ) করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ এখানে হাদিসে নামের সংখ্যা
উল্লেখ করা হলেও কোন্ কোন্ নাম আল্লাহ্র গুণবাচক নাম- এ ব্যাপারে স্পষ্ট
করে কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন পুস্তকাদিতে যে ৯৯ নামের তালিকা রয়েছে
এগুলো কোন হাদিসে পাওয়া যায়নি। কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থান থেকে
নির্ভরযোগ্য নামগুলো নিয়ে হয়তো ইসলামী চিন্তাবিদরা ৯৯ নামের একটি তালিকা
তৈরি করেছেন। এসব নামের পৃথক পৃথক অর্থ রয়েছে। যেমন রহমান অর্থ দয়াশীল,
গাফুর অর্থ ক্ষমাশীল, কাদির অর্থ শক্তিশালী ইত্যাদি। আল্লাহতায়ালা এসব
গুণের অধিকারী বলেই এসব নামে তাঁকে ডাকতে বলেছেন। আর যারা এসব নাম নিয়ে
আজে-বাজে কথা বলে, নামের বিকৃতি ঘটায় তাদেরকে বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার ৯৯ নামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এখন আলোচনায় আসা যাক
সাংবাদিক আŸদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন, এই ৯৯ নাম
কাফেরদের দেবতা বা মূর্তির নাম ছিল। সেখান থেকেই নামগুলো ইসলামে সংযোজন করা
হয়েছে। যেহেতু কোরআন ইসলামের উৎস সেহেতু তাঁর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়,
হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কাফেরদের দেবতাদের নামানুসারে এই নামগুলো পবিত্র কোরআনে
সুবিন্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ, রাসূল (সাঃ) নিজেই কোরআন রচনা করেছেন
(নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহ্র ৯৯ নাম যে কোথাও থেকে সংযোজন করা হয়নি, বরং তা
অনন্তকাল ধরে ছিল তার কিছু প্রমাণ ও যৌক্তিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই।
এক. আল্লাহ্ নিজেই যেহেতু পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তাঁর অনেক সুন্দর সুন্দর
নাম রয়েছে। সুতরাং আমাদের আর বলার কোন সুযোগ নেই যে, এই নামগুলো সংযোজন করা
হয়েছে। কারণ এই বিশ্ব সৃষ্টির আগে অনন্তকাল থেকে যেমন আল্লাহতায়ালা ছিলেন
তেমনি তাঁর নামগুলোও বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে অন্য কারো কাছ থেকে এসব নাম
হাওলাত করে নেয়া বা সংযোজন করার প্রশ্নই ওঠে না। দুই. পবিত্র কোরআনে
আল্লাহ্র গুণবাচক নামগুলোর উল্লেখ রয়েছে। আর কোরআন শরীফ আজ থেকে ১৪০৬ বছর
আগে ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ হলেও এই গ্রন্থ
অনন্তকাল থেকেই লওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত ছিল। আর কোরআন শরীফ যখন লওহে
মাহ্ফুজে সংরক্ষিত ছিল, তাহলে আল্লাহ্র নামগুলোও সেখানেই সংরক্ষিত ছিল।
এক্ষেত্রে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কোরআন শরীফ তো প্রয়োজন অনুসারে
জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে কিছু কিছু করে ২৩ বছরে নাজিল হলো। তাহলে এটি লওহে
মাহ্ফুজে সংরক্ষিত ছিল কিভাবে? এর জবাব কোরআন শরীফেই দেয়া হয়েছে। পবিত্র
কোরআনের ৩০তম পারায় সূরা কদরের প্রথম আয়াতে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ইন্না
আনজালনাহু ফি লাইলাতিল কাদর। অর্থাৎ আমি ইহা (কোরআন) কদরের রাত্রে নাজিল
করেছি। কদর বলতে আমরা কী বুঝি? হাদিস অনুযায়ী লাইলাতুল কদর হচ্ছে এমন একটি
মর্যাদাকর রাত্রি, যে রাত হাজারও মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূল (সাঃ) এই রাতকে
রামাদানের শেষ ১০ দিনের যে কোন বিজোড় রাতে খুঁজতে বলেছেন। এজন্যই রামাদানের
শেষ দশ রাতে বেশি করে ইবাদত করতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শবেকদর যাতে
হাতছাড়া না হয় এজন্য শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতেকাফ করার বিধান রয়েছে। এই
শবেকদরের রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। মুফাস্সিরগণ এই আয়াতের তাফসিরে
বলেছেন, আরবিতে আনজালা শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোন কিছু একসঙ্গে অবতীর্ণ করা
অর্থে। আর নাজ্জালা ব্যবহৃত হয় অংশবিশেষ করে (সামান্য সামান্য) নাজিল করা
অর্থে। কদরের রাতে লওহে মাহ্ফুজ থেকে একসাথে পূর্ণ কুরআন শরীফ প্রথম আসমানে
নাজিল করা হয়েছে বলেই সূরা কদরে আনজালনা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এবং
পরবর্তীতে প্রথম আসমান থেকে এক আয়াত দুই আয়াত করে প্রয়োজন অনুযায়ী মুহাম্মদ
(সাঃ)-এর উপর নাজিল হয়। এজন্য সূরা আল-ইমরানের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্
তায়ালা বলেছেনÑ ‘নাহনু নাজ্জালনাল কোরআনা’। অর্থাৎ আমরা কোরআন নাজিল
করেছি। এখানে নাজ্জালা শব্দটি সামান্য সামান্য করে নাজিল করা অর্থে ব্যবহৃত
হয়েছে। তাহলে এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় কোরআন নতুন কোন ঐশীবাণী নয়। এটি
আগে থেকেই লওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত ছিল। আর কেয়ামত পর্যন্ত এটি লওহে
মাহ্ফুজেই সংরক্ষিত থাকবে। সংরক্ষণের ব্যাপারে আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র
কোরআনের ৩০তম পারায় সূরা আল-বুরুজের ২১ ও ২২ নং আয়াতে বলছেন- ‘বাল হুয়া
কোরআনুম মাজিদ, ফি লওহিম মাহফুজ’। অর্থাৎ- ‘বরং এটি কোরআন মজিদ, লওহে
মাহ্ফুজে সংরক্ষিত রয়েছে।’ সুতরাং এই বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয় কোরআন শরীফ
লওহে মাহ্ফুজে অনন্তকাল ধরে সংরক্ষিত ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সুতরাং
কোন যুক্তিতেই বিশ্বাস করার সুযোগ নেই যে, কোরআনে এই নামগুলো কাফেরদের
দেবতাদের নাম থেকে সংযোজন করা হয়েছে। কোরআন যেমন অনন্তকাল ধরে সংরক্ষিত
ছিল, তেমনি আল্লাহ্তায়ালার নামগুলোও কোরআনে সংরক্ষিত ছিল।
তিন. হযরত নুহ (আঃ)-এর মহাপ্লাবনের পর থেকে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)- এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে মক্কা নগরীতে কোন মানুষের বসতি ছিলো না। বোখারী শরীফের ৮৩৩ নং হাদিসে এব্যাপারে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। হাদিসের সারসংক্ষেপ হচ্ছেÑ যখন ইব্রাহিম (আঃ)-এর স্ত্রী সারাহ ও হাজেরার মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন তিনি আল্লাহতায়ালার নির্দেশে হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে নির্বাসনে পাঠাতে মক্কা নগরীতে নিয়ে গেলেন এবং বর্তমান জমজম কূপের পাশে জনমানবহীন ভূমিতে একা রেখে ফিরে গেলেন। তখন সেখানে কোন পানি ছিলো না। ইব্রাহিম (আঃ) তাঁদেরকে যে সামান্য খেজুর ও পানি দিয়েছিলেন তা কিছু দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পানি পান করানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সাফা ও মারওয়া পর্বত দুটোর উপরে উঠে সমতল ভূমির দিকে লক্ষ্য করে মানুষের খোঁজ করতে থাকেন। এভাবে তিনি সাফা ও মারওয়া পর্বতের একটি থেকে অপরটিতে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন (এ জন্য পরবর্তী হজের সময় হাজীদের ৭ বার দৌড়ানো অপরিহার্য হয়ে যায়)। একসময় তিনি একটি শব্দ শুনতে পান এবং একজন ফেরেশতা দেখতে পান। ঐ ফেরেশতা পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন। এতে করে কূপের সৃষ্টি হয় এবং মাটি ফেটে পানি বের হতে শুরু থাকে। এটাই হলো আজকের জমজম কূপ। পরবর্তীতে জমজম কূপ এলাকায় পাখির উড়াউড়ি দেখে দূর থেকে একদল লোক অনুমান করে সেখানে সম্ভবত পানি থাকতে পারে। তারা পানির অনুসন্ধানে সেখানে ছুটে আসে এবং পানি পেয়ে যায়। একসময় হাজেরার অনুমতি নিয়ে তাঁরা সেখানে বসবাস শুরু করে। ওরা ছিলো জুরহুম সম্প্রদায়ের লোক। ইসমাইল (আঃ) তাদের কাছ থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। এভাবেই মক্কা নগরীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়। পরবর্তীতে ইব্রাহিম (আঃ) ফিরে আসেন। তিনি ও পুত্র ইসমাইল মিলে কাবাঘর নির্মাণ করেন। তিনি শরীয়তপ্রাপ্ত হন এবং আল্লাহর একাত্ববাদ প্রচার শুরু করেন। তখন মক্কা নগরীর মানুষ এক আল্লাহর উপাসনা করতো। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করতো না। কাবাঘরে কোন মূর্তি কিংবা দেবতা ছিলো না। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর অনেক অনুসারী ধর্মকে বিকৃত করে মূর্তিপূজা শুরু করে। তারা কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে প্রত্যেকটির পৃথক পৃথক নামকরণ করে। আরবের বিভিন্ন স্থানে তারা লাত, ওজ্জা ও মানাত নামে তিনটি বড় দেবতা স্থাপন করে। কাফেররা বলতো এগুলো আল্লাহতায়ালার নাম। তাই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের ২৭ নং পারায় সূরা আল-নজমের ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর আয়াতে এই তিনটি মূর্তির কথা উল্লেখ করে ঘোষণা দেন এসব নামের সঙ্গে তাঁর ন্যূনতম কোন সম্পৃক্ততা নেই। আল্লাহতায়ালা উক্ত তিনটি আয়াতে বলেন “তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাত ও ওজ্জা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি (দেবী) মানাত সম্পর্কে? (মূলত) এগুলো কতিপয় (দেব-দেবীর) নাম ছাড়া কিছুই নয়, যা তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা ঠিক করে নিয়েছো। আল্লাহতায়ালা এর (নামে) সমর্থনে কোন রকম দলিল প্রমাণ নাজিল করেননি। সুতরাং, আল্লাহর গুণবাচক নাম আগে থেকেই ছিলো। কাফেররা মূর্তি তৈরি ও পূজা শুরু করে ইব্রাহিম (আঃ)-এর ইন্তিকালের অনেক পরে। সুতরাং দেবতার নাম থেকে আল্লাহর নামকরণের কোন সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহর নাম অনেক আগে, দেবতা তৈরি ও পূজা শুরু হয় অনেক পরে। আর হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত হয়, আরবি ভাষা ছিলো ঐ জুরহুম সম্প্রদায়ের ভাষা। ইসমাইল (আঃ) তাদের কাছ থেকে ভাষা শিখেছিলেন। তাহলে আরবি কাফেরদের ভাষা ছিলো না, কাফেররা পরবর্তীতে এ ভাষায় কথা বলে। আর লাত, ওজ্জা ও মানাত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তাফসীরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, লাত নামে জাহিলিয়াত যুগে একজন সৎ লোক ছিলেন। তিনি হজ মওসুমে পানির সঙ্গে পাউডার মিশিয়ে হাজীদের পান করাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর লোকজন তাঁর কবরের সেবা শুরু করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার ইবাদত শুরু করে। এভাবেই তখনকার আরবে সৎ মানুষের নামে মূর্তি তৈরি করে লোকজন তাদের এবাদত (মূর্তিপূজা) করতো। চার. ইসলাম আসার আগে কি আরবে আল্লাহর গুণবাচক নামের ব্যবহার ছিলো? এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই দেখা দিতে পারে। হ্যাঁ, ইসলাম আসার আগেও আরবে আল্লাহর অনেক নামের ব্যবহার ছিলো। কারণ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগে আরও লক্ষাধিক নবী পৃথিবীতে এসেছেন। কেউ নতুন শরীয়ত পেয়েছেন, কেউ পুরাতন শরীয়ত প্রচার করেছেন। কারো উপরে বড় ধর্মগ্রন্থ, আবার কারো উপর ছোট ধর্মগ্রন্থ (সহিফা) নাজিল হয়েছে। এসব ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর গুণবাচক নামগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং আরবে এর প্রচলন ছিলো। এতো সাধারণ একটি বিষয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো একজন বিজ্ঞ সাংবাদিকের কাছে কেন পরিষ্কার নয়, এটা আমার বোধগম্য নয়। তবে ধর্ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে এই সাধারণ ভুলগুলো যে কারো ক্ষেত্রেই হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অতিসম্প্রতি যেমনটি করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রেডিওকার্বন বিভাগের একদল গবেষক। বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত পবিত্র কোরআনের প্রাচীনতম পা-ুলিপিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁরা ৯৫ ভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলেছেন, এটি ৫৬৮ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়ে লেখা। কিন্তু আমার মতে পা-ুলিপিটি যতই প্রাচীন হোক এটি ৬০৯ খ্রিস্টাব্দের আগে লিপিবদ্ধ করার কোন সুযোগই নেই। কারণ রাসুল (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। আর ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন তখন নবুয়ত (কোরআন নাজিল শুরু হয়) লাভ করেন। অর্থাৎ ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে কোরআন শরীফ অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) তা পরিপূর্ণ হয়। তাহলে বলতে হবে ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অথবা এরও অনেক পরে কোন এক সময় এই পা-ুলিপি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ একটি বিষয় হলেও পাশ্চাত্যের গবেষকদের তা বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ হয়তো তাদের ইসলামবিষয়ক জ্ঞান একেবারেই সীমিত। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বেলায়ও এমনটি হতে পারে। তিনি সাংবাদিক হিসেবে বিজ্ঞ হতে পারেন। তাঁর লেখার শত শত পাঠক থাকতে পারে। কিন্তু এজন্য তিনি যে সব বিষয়েই পারদর্শী হবেনÑএমন কথা বলা যাবে না। যে যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়েই কাজ করা উচিত। সারাবিশ্বে সাংবাদিকতায় বিট (নির্দিষ্ট বিভাগ) পদ্ধতি আছে। অর্থনীতি বিটের সাংবাদিককে যেমন পলিটিক্যাল বিটে রিপোর্টিংয়ে পাঠানো হয় না, তেমনি রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে কোন স্পোর্টস রিপোর্টারকে নিউজ লিখতে বলা হবে না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একাডেমিক’ আলোচনায় কোরআন-হাদিস নিয়ে নাড়াচাড়া না করলেই পারতেন। কারণ এটি তার বিট-এর আওতায় নয়। আবু হোরায়রা ও আবু বকর নামের অর্থ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রাসুল (সাঃ)-এর সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নামের অর্থ ব্যাখ্যা করে এসব নাম কেন রাখা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ এসব নামের অর্থ না জেনে, না বুঝেই রাখে। আরবের মানুষ এই নামগুলো ব্যবহার করেন না। তিনি নামের অর্থ অনুবাদ করেছেন এভাবেÑ আবু হোরায়রা অর্থ বিড়ালের বাবা, আবু বকর অর্থ ছাগলের বাবা। এখানে তিনি কী ভুল করেছেন নিচের নামবিষয়ক আলোচনা থেকে পরিষ্কার হবে। প্রতিটি ভাষায় একটি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। তেমনি আরবি ভাষায়ও একটি শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। কোন কোন সময় একটি শব্দের ১০-১২টি অর্থও হয়। ‘আবু’ শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে পিতা। কিন্তু এর একাধিক অর্থ রয়েছে। আবু হোরায়রা নামের ক্ষেত্রে আবু শব্দটি ওয়ালা বা অধিকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই আরবি ভাষাবিদরা অভিমত দিয়েছেন। আর হোরায়রা অর্থ বিড়াল। সুতরাং আবু হোরায়রা নামের অর্থ বিড়ালওয়ালা অথবা বিড়ালের মালিক। আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর প্রকৃত নাম ছিলো আবদুল্লাহ বা আবদুর রহমান। তিনি বিড়াল ও বিড়ালের বাচ্চা খুব বেশি পছন্দ করতেন। একদিন তিনি রাসুল (সাঃ)-এর সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ তার আস্তিন বা জামার ভেতর থেকে একটি বিড়ালের বাচ্চা বের হয়। এ দেখে রাসুল (সাঃ) তাঁকে মৃদু হেসে বলে উঠেন, হে আবু হোরায়রা। অর্থাৎ হে বিড়ালওয়ালা বা বিড়ালের মালিক। এখানে রাসুল তাঁকে বিড়ালের বাবা অর্থে সম্বোধন করেন নি। অনুরূপ আবু বকর নামটিরও সুন্দর অর্থ রয়েছে। বকর শব্দটি বুকরা থেকে নির্গত। বুকরা অর্থ প্রত্যুষ। আবু বকর অর্থ যিনি প্রত্যুষে বা সর্বাগ্রে চলেন। যিনি অগ্রগামী। আর আবু শব্দটি যেহেতু ওয়ালা অর্থে ব্যবহৃত হয় তাই আবু বকর অর্থ হচ্ছে যিনি আগে চলেন। শুদ্ধ বাংলায় বললে অর্থ দাঁড়াবে অগ্রপথিক। এছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে বকর শব্দটি যুবক উট অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে আবু বকর শব্দযুগলের অর্থ দাঁড়াবে উটওয়ালা বা উটের মালিক। কিন্তু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কেন আবু বকর নামের অর্থ ছাগলের বাবা বললেন জানি না। সাধারণত বাংলাদেশে ছাগলকে বকরি বলা হয়। তিনি সম্ভবত বাংলাদেশী তরজমাটি গ্রহণ করে বলেছেন, আবু বকর অর্থ ছাগলের বাবা। তিনি আরও বলেছেন, এসব নামে আরবে কোন মানুষের নাম নেই। কিন্তু অনুসন্ধানে এই নামে শত শত মানুষ পাওয়া যাবে। আবু বকর আল রাজি, আবু বকর আল জাযায়েরী, আবু বকর আল জাস্সাস নামক শিক্ষক ও প-িত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে আরবে। আবু হোরায়রা ছিলেন রাসুল (সাঃ)-এর একজন বিশ্বস্ত সহচর। তিনি সার্বক্ষণিক রাসুল (সাঃ)-এর সাহচর্যে থাকতেন। চরম ক্ষুধায় ছটফট করলেও মসজিদে নববীতে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)কে একা ফেলে তিনি কখনো ঘরে ফিরে যেতেন না। কারণ আল্লাহর রাসুল কখন কী বলেন, আর তিনি যদি না শুনেন তাহলে তা হয়তো পরবর্তীতে হাদিস হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে না, এই ভয়ে। তাইতো তিনি আজ বোখারী মুসলিমসহ সকল হাদিস গ্রন্থের শিরোমণি। সিংহভাগ হাদিসের শুরুতেই “আন আবি হোরায়রাতা (রাঃ) আনহু...” বলে হাদিস শুরু করতে হয়। অন্যদিকে হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। যে ১০ সাহাবা আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর কাছ থেকে বেহেশতের সার্টিফিকেট পেয়েছেন তাদের মধ্যে আবু বকর হচ্ছেন একজন। সুতরাং নামের শাব্দিক অর্থ বিবেচনা না করে বরং মর্যাদার দিক বিবেচনা করে এই দুই নামে যদি কেউ নিজের সন্তানের নামকরণ করে থাকে, তাহলে মন্দের কিছু দেখি না। নাম দুটো নিয়ে উপহাসের ছলে কথা বলারও কোন কারণ দেখতে পাই না। বরং দুইজন বড় সাহাবী হিসেবে তাঁদের নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করা উচিত ছিলো। গাফ্ফার চৌধুরী এই দুই সাহাবীর নাম নিয়ে কথা বলার সময় রাদিয়াল্লাহু আনহু (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট) শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তিনি বরং বলেছেন, রাসুল (সাঃ) ঠাট্টা করে আবু হোরায়রা বলেছেন। রাসুল (সাঃ) তো এভাবে কাউকে নিয়ে কখনো ঠাট্টা করেন নি। তিনি বরং আদর করেই প্রখ্যাত এই সাহাবীকে আবু হোরায়রা বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর কাছেও সেই সম্বোধনটি ছিলো খুব প্রিয়। তাই এই নামেই তিনি পরিচিত হতে পছন্দ করতেন। রাসুলের পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হলো? গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিউ ইয়র্কের একটি টেলিভিশনকে বলেছেন, “আল্লাহ নামতো আগে কাফেরদের দেবতার নাম ছিলো। তা না হলে রাসুলের পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হলো? এটা তো মুসলমান নাম নয়।” আরবে কোথাও কোন দেবতার নাম আল্লাহ ছিলোÑএমন কোন দলিল- প্রমাণ নেই। তাছাড়া গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, রাহমান, রাহিম, গাফুর এগুলো দেবতার নাম ছিলো। কিন্তু এর পক্ষে তিনি কোন রেফারেন্স কিংবা প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। ধর্মীয় বিষয়ে হাদিস ও কোরআনের রেফারেন্স ছাড়া মনগড়া কোন ব্যাখ্যা দেয়া গর্হিত অন্যায়। আল্লাহ শব্দটি আল্লাহতায়ালার মূল নাম। আর আবদুন শব্দের অর্থ বান্দা বা দাস। সুতরাং আবদুল্লাহ নামের অর্থ আল্লাহর বান্দা। রাসুলের (সাঃ) পিতা যদি কাফেরও হয়ে থাকেন তাহলে তার নামটি তো কোরআনিক নাম। একজন কাফেরের ইসলামিক নাম হতেই পারে। যেমনÑ কোন নাস্তিক ব্যক্তির নাম যদি আহমদ শরীফ হয়, তাহলে তাঁর নামটি তো আর নাস্তিক বা কাফের হয়ে যায় না। আহমদ তো মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আরও একটি নাম ছিলো। এখানে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিতা-মাতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা দিতে চাই। রাসুলের জন্মের ছয় মাস আগে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তিকাল করেন। আর জন্মের ৬ মাস পরে ইন্তিকাল করেন তাঁর মা আমেনা। তাঁর পিতা-মাতার পরকালীন অবস্থা কী হতে পারেÑ তা দুটি হাদিস থেকে পরিষ্কার হওয়া যেতে পারে। মুসলিম শরীফের ২০৩ নং হাদিসে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুল (সাঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললোÑ হে আল্লাহর রাসুল আমার (মৃত) পিতা কোথায়? জবাবে রাসুল (সাঃ) বললেন, দোজখে। এ কথা শুনে লোকটি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন রাসুল (সাঃ) তাঁকে ডাকলেন এবং বললেন, নিশ্চয় আমার পিতা ও তোমার পিতা দোজখে। মুসলিম শরীফের ১৭৬৩ নম্বর হাদিসে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসুল (সাঃ) তাঁর মা’র কবর জেয়ারত করতে গেলেন, তিনি সেখানে কাঁদলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও কাঁদলেন। এব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আমার মায়ের রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে অনুমতি চেয়েছিলাম, আমাকে দোয়ার অনুমতির পরিবর্তে শুধু কবর জেয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে তোমরা কবর জেয়ারত করো, এতে তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ হবে। এই হলো হাদিসের ভাষ্য। তবে এব্যাপারে অর্থাৎ রাসুলের পিতা-মাতা সম্পর্কে কোন ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। হিজাবের পরিবর্তে শাড়ি পরা ও কপালে টিপ দেয়া বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার জন্য হিজাব না পরে বরং শাড়ি এবং কপালে টিপ পরতে বলেছেন সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। হিজাব হচ্ছে পর্দার একটি অনুষঙ্গ। ইসলাম আসার আগে আরবে মহিলারা পর্দাহীন চলাফেরা করতেন। এমনকি রাসুলের (সাঃ) স্ত্রীরাও পর্দা করতেন না। পঞ্চম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরিতে পর্দার বিধান নাজিল হয়। সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, “হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার মেয়েদেরকে ও বিশ্বাসীদের স্ত্রীদেরকে বলুন, ‘‘তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে করে তাঁদের চেনা সহজতর হবে (তাঁরা যে মুসলমান নারী) এবং তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে মূলত মহিলারা নিজেদেরকে আবৃত বা পর্দা করতে শুরু করেন। পর্দা শরীয়তের একটি অর্ডার বা ফরজ বিধান। ফরজ কাজ ছাড়লে শাস্তি প্রাপ্য হয়। তবে কেউ কাফের বা অমুসলমান হয়ে যায় না। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহতায়ালার বিধানের ব্যাপারে সাংঘর্ষিক কোন বক্তব্য দেয় অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে বলে তখন প্রতীয়মান হয় তিনি ফরজকেই অস্বীকার করছেন। হজ কি কাফেরদের দ্বারা প্রবর্তিত? আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরও বলেছেন, হজও ইসলামের হজ নয়। এটাও ২ হাজার ৩ হাজার বছর আগে কাফেরদের প্রবর্তিত হজ। ইসলামে পূর্ণ হজরীতি ফরজ হয়েছে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু হজ তো মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সময়েও ছিলো। আদম (আঃ) পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করে তওয়াফ চালু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন নবীর সময়ে বিভিন্ন নিয়মে হজের প্রচলন ছিলো। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) হজ পুনঃপ্রবর্তন করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা হাজ্জ-এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন “হে ইব্রাহিম, মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও...।” কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর ধর্মকে বিকৃত করে অনুসারীরা মূর্তিপূজা শুরু করে। চালু করে ভিন্ন প্রক্রিয়ার হজ। কাফেররা উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তওয়াফ করতো এবং সাফা ও মারওয়া পর্বতে দৌড়াতো। আল্লাহতায়ালাই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর ওহি নাজিল করে হজের সঠিক পন্থা শিখিয়ে দেন। সুতরাং কাফেরদের হজ অনুসারে হজ প্রবর্তন হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। কোন প্রমাণাদিও নেই। কোরআন আল্লাহতায়ালার বাণী। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর এটি অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহতায়ালার। জিবরাইল (আঃ) এসে রাসুল (সাঃ)কে বলেছেন। রাসুল (সাঃ) কথাগুলো মুখস্থ করেছেন। পরে তাঁর সঙ্গীদের জানিয়েছেন। মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করেছেন। রাসুল (সাঃ) তাঁর মনগড়া কোন কিছু বলেন নি, করেন নি। এখন কেউ যদি বলেন, হজ কাফেরদের প্রবর্তিত। তাহলে প্রতীয়মান হবে কাফেরদের হজ থেকেই এই বিধান রাসুল (সাঃ) কোরআনে এডাপ্ট (সংযোজন) করেছেন। অর্থাৎ এটি আল্লাহতায়ালার বিধান নয়, মুহাম্মদ (সাঃ) কাফেরদের থেকে এটি প্রচলন করেছেন। আলোচনা আর দীর্ঘ করতে চাই না। অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। আশাকরি এই আলোচনা বুঝতে সহায়তা করবে সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য কোরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না? পাদটীকা: যেহেতু লেখাটি অনেক অমুসলিমও পড়তে পারেন, যাদের কোরআন-হাদিস সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের জন্য একটি পাদটীকা সংযোজনের প্রয়োজন বোধ করছি। কোরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহতায়ালার। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে জিবরাইল আলাইহিস সালামের (ফেরেশতা বা দূতের নাম) মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাঁর কথাগুলো জানিয়ে দেন। ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দীর্ঘ ২৩ বছর সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সামান্য সামান্য করে ৩০ পারা কোরআন অবতীর্ণ হয়। আর হাদিস হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাণী। অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) তাঁর জীবনে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, যেসব কাজ করেছেন অথবা সমর্থন দিয়েছেন সেগুলোই হচ্ছে হাদিস। রাসুলের (সাঃ) জীবনের যাবতীয় কর্মকা- একাধিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতে সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ হচ্ছেÑ বোখারী, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসাঈ। এই ছয়টির মধ্যে বোখারী ও মুসলিম হচ্ছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ। এ লেখায় আমি বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিশুদ্ধ হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছি। মুসলমান মাত্র কোরআন-হাদিসের সবগুলো কথা বা নির্দেশনার প্রতি অবশ্যই শতভাগ বিশ্বাস থাকতে হবে। এছাড়াও এ লেখায় কিছু আরবি বাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। এব্যাপারে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। যেমন (সাঃ) শব্দটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে। এর অর্থ ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর শান্তি প্রেরণ করুন।’ (সাঃ) বাক্যটি শুধুমাত্র রাসুলের নাম উচ্চারণের পর বলতে হয়। (রাঃ) শব্দটি রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সংক্ষিপ্ত রূপ। এর অর্থ ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট’। সাহাবা অর্থাৎ রাসুলের সঙ্গীদের (যেমন: আবু বকর, আবু হোরায়রা, ওমর) নাম উচ্চারণ করার পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করতে হয়। (রাহঃ) বাক্যটি রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’র সংক্ষিপ্ত রূপ। বাক্যটির অর্থ তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। সাধারণত এই বাক্যটি বিশিষ্ট আলেম ও চিন্তাবিদদের (ইমাম আবু হানিফা, হযরত শাহজালাল, হযরত শাহপরান প্রমুখ) নাম উচ্চারণ করার পর বলতে হয়। আর (আঃ) বাক্যটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে আলাইহিস সালাম থেকে। এই বাক্যের অর্থ আল্লাহ তাঁর উপর করুণা করুন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছাড়া অন্যান্য নবী- রাসুলদের নামের পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করা হয় যেমন: ইব্রাহিম (আঃ), ইসা (আঃ), দাউদ (আঃ)। লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন
তিন. হযরত নুহ (আঃ)-এর মহাপ্লাবনের পর থেকে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)- এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে মক্কা নগরীতে কোন মানুষের বসতি ছিলো না। বোখারী শরীফের ৮৩৩ নং হাদিসে এব্যাপারে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। হাদিসের সারসংক্ষেপ হচ্ছেÑ যখন ইব্রাহিম (আঃ)-এর স্ত্রী সারাহ ও হাজেরার মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন তিনি আল্লাহতায়ালার নির্দেশে হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে নির্বাসনে পাঠাতে মক্কা নগরীতে নিয়ে গেলেন এবং বর্তমান জমজম কূপের পাশে জনমানবহীন ভূমিতে একা রেখে ফিরে গেলেন। তখন সেখানে কোন পানি ছিলো না। ইব্রাহিম (আঃ) তাঁদেরকে যে সামান্য খেজুর ও পানি দিয়েছিলেন তা কিছু দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পানি পান করানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সাফা ও মারওয়া পর্বত দুটোর উপরে উঠে সমতল ভূমির দিকে লক্ষ্য করে মানুষের খোঁজ করতে থাকেন। এভাবে তিনি সাফা ও মারওয়া পর্বতের একটি থেকে অপরটিতে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন (এ জন্য পরবর্তী হজের সময় হাজীদের ৭ বার দৌড়ানো অপরিহার্য হয়ে যায়)। একসময় তিনি একটি শব্দ শুনতে পান এবং একজন ফেরেশতা দেখতে পান। ঐ ফেরেশতা পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন। এতে করে কূপের সৃষ্টি হয় এবং মাটি ফেটে পানি বের হতে শুরু থাকে। এটাই হলো আজকের জমজম কূপ। পরবর্তীতে জমজম কূপ এলাকায় পাখির উড়াউড়ি দেখে দূর থেকে একদল লোক অনুমান করে সেখানে সম্ভবত পানি থাকতে পারে। তারা পানির অনুসন্ধানে সেখানে ছুটে আসে এবং পানি পেয়ে যায়। একসময় হাজেরার অনুমতি নিয়ে তাঁরা সেখানে বসবাস শুরু করে। ওরা ছিলো জুরহুম সম্প্রদায়ের লোক। ইসমাইল (আঃ) তাদের কাছ থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। এভাবেই মক্কা নগরীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়। পরবর্তীতে ইব্রাহিম (আঃ) ফিরে আসেন। তিনি ও পুত্র ইসমাইল মিলে কাবাঘর নির্মাণ করেন। তিনি শরীয়তপ্রাপ্ত হন এবং আল্লাহর একাত্ববাদ প্রচার শুরু করেন। তখন মক্কা নগরীর মানুষ এক আল্লাহর উপাসনা করতো। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করতো না। কাবাঘরে কোন মূর্তি কিংবা দেবতা ছিলো না। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর অনেক অনুসারী ধর্মকে বিকৃত করে মূর্তিপূজা শুরু করে। তারা কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে প্রত্যেকটির পৃথক পৃথক নামকরণ করে। আরবের বিভিন্ন স্থানে তারা লাত, ওজ্জা ও মানাত নামে তিনটি বড় দেবতা স্থাপন করে। কাফেররা বলতো এগুলো আল্লাহতায়ালার নাম। তাই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের ২৭ নং পারায় সূরা আল-নজমের ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর আয়াতে এই তিনটি মূর্তির কথা উল্লেখ করে ঘোষণা দেন এসব নামের সঙ্গে তাঁর ন্যূনতম কোন সম্পৃক্ততা নেই। আল্লাহতায়ালা উক্ত তিনটি আয়াতে বলেন “তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাত ও ওজ্জা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি (দেবী) মানাত সম্পর্কে? (মূলত) এগুলো কতিপয় (দেব-দেবীর) নাম ছাড়া কিছুই নয়, যা তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা ঠিক করে নিয়েছো। আল্লাহতায়ালা এর (নামে) সমর্থনে কোন রকম দলিল প্রমাণ নাজিল করেননি। সুতরাং, আল্লাহর গুণবাচক নাম আগে থেকেই ছিলো। কাফেররা মূর্তি তৈরি ও পূজা শুরু করে ইব্রাহিম (আঃ)-এর ইন্তিকালের অনেক পরে। সুতরাং দেবতার নাম থেকে আল্লাহর নামকরণের কোন সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহর নাম অনেক আগে, দেবতা তৈরি ও পূজা শুরু হয় অনেক পরে। আর হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত হয়, আরবি ভাষা ছিলো ঐ জুরহুম সম্প্রদায়ের ভাষা। ইসমাইল (আঃ) তাদের কাছ থেকে ভাষা শিখেছিলেন। তাহলে আরবি কাফেরদের ভাষা ছিলো না, কাফেররা পরবর্তীতে এ ভাষায় কথা বলে। আর লাত, ওজ্জা ও মানাত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তাফসীরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, লাত নামে জাহিলিয়াত যুগে একজন সৎ লোক ছিলেন। তিনি হজ মওসুমে পানির সঙ্গে পাউডার মিশিয়ে হাজীদের পান করাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর লোকজন তাঁর কবরের সেবা শুরু করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার ইবাদত শুরু করে। এভাবেই তখনকার আরবে সৎ মানুষের নামে মূর্তি তৈরি করে লোকজন তাদের এবাদত (মূর্তিপূজা) করতো। চার. ইসলাম আসার আগে কি আরবে আল্লাহর গুণবাচক নামের ব্যবহার ছিলো? এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই দেখা দিতে পারে। হ্যাঁ, ইসলাম আসার আগেও আরবে আল্লাহর অনেক নামের ব্যবহার ছিলো। কারণ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগে আরও লক্ষাধিক নবী পৃথিবীতে এসেছেন। কেউ নতুন শরীয়ত পেয়েছেন, কেউ পুরাতন শরীয়ত প্রচার করেছেন। কারো উপরে বড় ধর্মগ্রন্থ, আবার কারো উপর ছোট ধর্মগ্রন্থ (সহিফা) নাজিল হয়েছে। এসব ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর গুণবাচক নামগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং আরবে এর প্রচলন ছিলো। এতো সাধারণ একটি বিষয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো একজন বিজ্ঞ সাংবাদিকের কাছে কেন পরিষ্কার নয়, এটা আমার বোধগম্য নয়। তবে ধর্ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে এই সাধারণ ভুলগুলো যে কারো ক্ষেত্রেই হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অতিসম্প্রতি যেমনটি করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রেডিওকার্বন বিভাগের একদল গবেষক। বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত পবিত্র কোরআনের প্রাচীনতম পা-ুলিপিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁরা ৯৫ ভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলেছেন, এটি ৫৬৮ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়ে লেখা। কিন্তু আমার মতে পা-ুলিপিটি যতই প্রাচীন হোক এটি ৬০৯ খ্রিস্টাব্দের আগে লিপিবদ্ধ করার কোন সুযোগই নেই। কারণ রাসুল (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। আর ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন তখন নবুয়ত (কোরআন নাজিল শুরু হয়) লাভ করেন। অর্থাৎ ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে কোরআন শরীফ অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) তা পরিপূর্ণ হয়। তাহলে বলতে হবে ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অথবা এরও অনেক পরে কোন এক সময় এই পা-ুলিপি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ একটি বিষয় হলেও পাশ্চাত্যের গবেষকদের তা বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ হয়তো তাদের ইসলামবিষয়ক জ্ঞান একেবারেই সীমিত। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বেলায়ও এমনটি হতে পারে। তিনি সাংবাদিক হিসেবে বিজ্ঞ হতে পারেন। তাঁর লেখার শত শত পাঠক থাকতে পারে। কিন্তু এজন্য তিনি যে সব বিষয়েই পারদর্শী হবেনÑএমন কথা বলা যাবে না। যে যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়েই কাজ করা উচিত। সারাবিশ্বে সাংবাদিকতায় বিট (নির্দিষ্ট বিভাগ) পদ্ধতি আছে। অর্থনীতি বিটের সাংবাদিককে যেমন পলিটিক্যাল বিটে রিপোর্টিংয়ে পাঠানো হয় না, তেমনি রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে কোন স্পোর্টস রিপোর্টারকে নিউজ লিখতে বলা হবে না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একাডেমিক’ আলোচনায় কোরআন-হাদিস নিয়ে নাড়াচাড়া না করলেই পারতেন। কারণ এটি তার বিট-এর আওতায় নয়। আবু হোরায়রা ও আবু বকর নামের অর্থ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রাসুল (সাঃ)-এর সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নামের অর্থ ব্যাখ্যা করে এসব নাম কেন রাখা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ এসব নামের অর্থ না জেনে, না বুঝেই রাখে। আরবের মানুষ এই নামগুলো ব্যবহার করেন না। তিনি নামের অর্থ অনুবাদ করেছেন এভাবেÑ আবু হোরায়রা অর্থ বিড়ালের বাবা, আবু বকর অর্থ ছাগলের বাবা। এখানে তিনি কী ভুল করেছেন নিচের নামবিষয়ক আলোচনা থেকে পরিষ্কার হবে। প্রতিটি ভাষায় একটি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। তেমনি আরবি ভাষায়ও একটি শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। কোন কোন সময় একটি শব্দের ১০-১২টি অর্থও হয়। ‘আবু’ শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে পিতা। কিন্তু এর একাধিক অর্থ রয়েছে। আবু হোরায়রা নামের ক্ষেত্রে আবু শব্দটি ওয়ালা বা অধিকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই আরবি ভাষাবিদরা অভিমত দিয়েছেন। আর হোরায়রা অর্থ বিড়াল। সুতরাং আবু হোরায়রা নামের অর্থ বিড়ালওয়ালা অথবা বিড়ালের মালিক। আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর প্রকৃত নাম ছিলো আবদুল্লাহ বা আবদুর রহমান। তিনি বিড়াল ও বিড়ালের বাচ্চা খুব বেশি পছন্দ করতেন। একদিন তিনি রাসুল (সাঃ)-এর সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ তার আস্তিন বা জামার ভেতর থেকে একটি বিড়ালের বাচ্চা বের হয়। এ দেখে রাসুল (সাঃ) তাঁকে মৃদু হেসে বলে উঠেন, হে আবু হোরায়রা। অর্থাৎ হে বিড়ালওয়ালা বা বিড়ালের মালিক। এখানে রাসুল তাঁকে বিড়ালের বাবা অর্থে সম্বোধন করেন নি। অনুরূপ আবু বকর নামটিরও সুন্দর অর্থ রয়েছে। বকর শব্দটি বুকরা থেকে নির্গত। বুকরা অর্থ প্রত্যুষ। আবু বকর অর্থ যিনি প্রত্যুষে বা সর্বাগ্রে চলেন। যিনি অগ্রগামী। আর আবু শব্দটি যেহেতু ওয়ালা অর্থে ব্যবহৃত হয় তাই আবু বকর অর্থ হচ্ছে যিনি আগে চলেন। শুদ্ধ বাংলায় বললে অর্থ দাঁড়াবে অগ্রপথিক। এছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে বকর শব্দটি যুবক উট অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে আবু বকর শব্দযুগলের অর্থ দাঁড়াবে উটওয়ালা বা উটের মালিক। কিন্তু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কেন আবু বকর নামের অর্থ ছাগলের বাবা বললেন জানি না। সাধারণত বাংলাদেশে ছাগলকে বকরি বলা হয়। তিনি সম্ভবত বাংলাদেশী তরজমাটি গ্রহণ করে বলেছেন, আবু বকর অর্থ ছাগলের বাবা। তিনি আরও বলেছেন, এসব নামে আরবে কোন মানুষের নাম নেই। কিন্তু অনুসন্ধানে এই নামে শত শত মানুষ পাওয়া যাবে। আবু বকর আল রাজি, আবু বকর আল জাযায়েরী, আবু বকর আল জাস্সাস নামক শিক্ষক ও প-িত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে আরবে। আবু হোরায়রা ছিলেন রাসুল (সাঃ)-এর একজন বিশ্বস্ত সহচর। তিনি সার্বক্ষণিক রাসুল (সাঃ)-এর সাহচর্যে থাকতেন। চরম ক্ষুধায় ছটফট করলেও মসজিদে নববীতে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)কে একা ফেলে তিনি কখনো ঘরে ফিরে যেতেন না। কারণ আল্লাহর রাসুল কখন কী বলেন, আর তিনি যদি না শুনেন তাহলে তা হয়তো পরবর্তীতে হাদিস হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে না, এই ভয়ে। তাইতো তিনি আজ বোখারী মুসলিমসহ সকল হাদিস গ্রন্থের শিরোমণি। সিংহভাগ হাদিসের শুরুতেই “আন আবি হোরায়রাতা (রাঃ) আনহু...” বলে হাদিস শুরু করতে হয়। অন্যদিকে হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। যে ১০ সাহাবা আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর কাছ থেকে বেহেশতের সার্টিফিকেট পেয়েছেন তাদের মধ্যে আবু বকর হচ্ছেন একজন। সুতরাং নামের শাব্দিক অর্থ বিবেচনা না করে বরং মর্যাদার দিক বিবেচনা করে এই দুই নামে যদি কেউ নিজের সন্তানের নামকরণ করে থাকে, তাহলে মন্দের কিছু দেখি না। নাম দুটো নিয়ে উপহাসের ছলে কথা বলারও কোন কারণ দেখতে পাই না। বরং দুইজন বড় সাহাবী হিসেবে তাঁদের নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করা উচিত ছিলো। গাফ্ফার চৌধুরী এই দুই সাহাবীর নাম নিয়ে কথা বলার সময় রাদিয়াল্লাহু আনহু (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট) শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তিনি বরং বলেছেন, রাসুল (সাঃ) ঠাট্টা করে আবু হোরায়রা বলেছেন। রাসুল (সাঃ) তো এভাবে কাউকে নিয়ে কখনো ঠাট্টা করেন নি। তিনি বরং আদর করেই প্রখ্যাত এই সাহাবীকে আবু হোরায়রা বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর কাছেও সেই সম্বোধনটি ছিলো খুব প্রিয়। তাই এই নামেই তিনি পরিচিত হতে পছন্দ করতেন। রাসুলের পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হলো? গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিউ ইয়র্কের একটি টেলিভিশনকে বলেছেন, “আল্লাহ নামতো আগে কাফেরদের দেবতার নাম ছিলো। তা না হলে রাসুলের পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হলো? এটা তো মুসলমান নাম নয়।” আরবে কোথাও কোন দেবতার নাম আল্লাহ ছিলোÑএমন কোন দলিল- প্রমাণ নেই। তাছাড়া গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, রাহমান, রাহিম, গাফুর এগুলো দেবতার নাম ছিলো। কিন্তু এর পক্ষে তিনি কোন রেফারেন্স কিংবা প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। ধর্মীয় বিষয়ে হাদিস ও কোরআনের রেফারেন্স ছাড়া মনগড়া কোন ব্যাখ্যা দেয়া গর্হিত অন্যায়। আল্লাহ শব্দটি আল্লাহতায়ালার মূল নাম। আর আবদুন শব্দের অর্থ বান্দা বা দাস। সুতরাং আবদুল্লাহ নামের অর্থ আল্লাহর বান্দা। রাসুলের (সাঃ) পিতা যদি কাফেরও হয়ে থাকেন তাহলে তার নামটি তো কোরআনিক নাম। একজন কাফেরের ইসলামিক নাম হতেই পারে। যেমনÑ কোন নাস্তিক ব্যক্তির নাম যদি আহমদ শরীফ হয়, তাহলে তাঁর নামটি তো আর নাস্তিক বা কাফের হয়ে যায় না। আহমদ তো মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আরও একটি নাম ছিলো। এখানে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিতা-মাতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা দিতে চাই। রাসুলের জন্মের ছয় মাস আগে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তিকাল করেন। আর জন্মের ৬ মাস পরে ইন্তিকাল করেন তাঁর মা আমেনা। তাঁর পিতা-মাতার পরকালীন অবস্থা কী হতে পারেÑ তা দুটি হাদিস থেকে পরিষ্কার হওয়া যেতে পারে। মুসলিম শরীফের ২০৩ নং হাদিসে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুল (সাঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললোÑ হে আল্লাহর রাসুল আমার (মৃত) পিতা কোথায়? জবাবে রাসুল (সাঃ) বললেন, দোজখে। এ কথা শুনে লোকটি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন রাসুল (সাঃ) তাঁকে ডাকলেন এবং বললেন, নিশ্চয় আমার পিতা ও তোমার পিতা দোজখে। মুসলিম শরীফের ১৭৬৩ নম্বর হাদিসে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসুল (সাঃ) তাঁর মা’র কবর জেয়ারত করতে গেলেন, তিনি সেখানে কাঁদলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও কাঁদলেন। এব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আমার মায়ের রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে অনুমতি চেয়েছিলাম, আমাকে দোয়ার অনুমতির পরিবর্তে শুধু কবর জেয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে তোমরা কবর জেয়ারত করো, এতে তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ হবে। এই হলো হাদিসের ভাষ্য। তবে এব্যাপারে অর্থাৎ রাসুলের পিতা-মাতা সম্পর্কে কোন ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। হিজাবের পরিবর্তে শাড়ি পরা ও কপালে টিপ দেয়া বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার জন্য হিজাব না পরে বরং শাড়ি এবং কপালে টিপ পরতে বলেছেন সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। হিজাব হচ্ছে পর্দার একটি অনুষঙ্গ। ইসলাম আসার আগে আরবে মহিলারা পর্দাহীন চলাফেরা করতেন। এমনকি রাসুলের (সাঃ) স্ত্রীরাও পর্দা করতেন না। পঞ্চম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরিতে পর্দার বিধান নাজিল হয়। সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, “হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার মেয়েদেরকে ও বিশ্বাসীদের স্ত্রীদেরকে বলুন, ‘‘তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে করে তাঁদের চেনা সহজতর হবে (তাঁরা যে মুসলমান নারী) এবং তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে মূলত মহিলারা নিজেদেরকে আবৃত বা পর্দা করতে শুরু করেন। পর্দা শরীয়তের একটি অর্ডার বা ফরজ বিধান। ফরজ কাজ ছাড়লে শাস্তি প্রাপ্য হয়। তবে কেউ কাফের বা অমুসলমান হয়ে যায় না। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহতায়ালার বিধানের ব্যাপারে সাংঘর্ষিক কোন বক্তব্য দেয় অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে বলে তখন প্রতীয়মান হয় তিনি ফরজকেই অস্বীকার করছেন। হজ কি কাফেরদের দ্বারা প্রবর্তিত? আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরও বলেছেন, হজও ইসলামের হজ নয়। এটাও ২ হাজার ৩ হাজার বছর আগে কাফেরদের প্রবর্তিত হজ। ইসলামে পূর্ণ হজরীতি ফরজ হয়েছে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু হজ তো মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সময়েও ছিলো। আদম (আঃ) পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করে তওয়াফ চালু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন নবীর সময়ে বিভিন্ন নিয়মে হজের প্রচলন ছিলো। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) হজ পুনঃপ্রবর্তন করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা হাজ্জ-এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন “হে ইব্রাহিম, মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও...।” কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর ধর্মকে বিকৃত করে অনুসারীরা মূর্তিপূজা শুরু করে। চালু করে ভিন্ন প্রক্রিয়ার হজ। কাফেররা উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তওয়াফ করতো এবং সাফা ও মারওয়া পর্বতে দৌড়াতো। আল্লাহতায়ালাই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর ওহি নাজিল করে হজের সঠিক পন্থা শিখিয়ে দেন। সুতরাং কাফেরদের হজ অনুসারে হজ প্রবর্তন হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। কোন প্রমাণাদিও নেই। কোরআন আল্লাহতায়ালার বাণী। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর এটি অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহতায়ালার। জিবরাইল (আঃ) এসে রাসুল (সাঃ)কে বলেছেন। রাসুল (সাঃ) কথাগুলো মুখস্থ করেছেন। পরে তাঁর সঙ্গীদের জানিয়েছেন। মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করেছেন। রাসুল (সাঃ) তাঁর মনগড়া কোন কিছু বলেন নি, করেন নি। এখন কেউ যদি বলেন, হজ কাফেরদের প্রবর্তিত। তাহলে প্রতীয়মান হবে কাফেরদের হজ থেকেই এই বিধান রাসুল (সাঃ) কোরআনে এডাপ্ট (সংযোজন) করেছেন। অর্থাৎ এটি আল্লাহতায়ালার বিধান নয়, মুহাম্মদ (সাঃ) কাফেরদের থেকে এটি প্রচলন করেছেন। আলোচনা আর দীর্ঘ করতে চাই না। অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। আশাকরি এই আলোচনা বুঝতে সহায়তা করবে সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য কোরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না? পাদটীকা: যেহেতু লেখাটি অনেক অমুসলিমও পড়তে পারেন, যাদের কোরআন-হাদিস সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের জন্য একটি পাদটীকা সংযোজনের প্রয়োজন বোধ করছি। কোরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহতায়ালার। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে জিবরাইল আলাইহিস সালামের (ফেরেশতা বা দূতের নাম) মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাঁর কথাগুলো জানিয়ে দেন। ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দীর্ঘ ২৩ বছর সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সামান্য সামান্য করে ৩০ পারা কোরআন অবতীর্ণ হয়। আর হাদিস হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাণী। অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) তাঁর জীবনে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, যেসব কাজ করেছেন অথবা সমর্থন দিয়েছেন সেগুলোই হচ্ছে হাদিস। রাসুলের (সাঃ) জীবনের যাবতীয় কর্মকা- একাধিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতে সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ হচ্ছেÑ বোখারী, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসাঈ। এই ছয়টির মধ্যে বোখারী ও মুসলিম হচ্ছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ। এ লেখায় আমি বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিশুদ্ধ হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছি। মুসলমান মাত্র কোরআন-হাদিসের সবগুলো কথা বা নির্দেশনার প্রতি অবশ্যই শতভাগ বিশ্বাস থাকতে হবে। এছাড়াও এ লেখায় কিছু আরবি বাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। এব্যাপারে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। যেমন (সাঃ) শব্দটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে। এর অর্থ ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর শান্তি প্রেরণ করুন।’ (সাঃ) বাক্যটি শুধুমাত্র রাসুলের নাম উচ্চারণের পর বলতে হয়। (রাঃ) শব্দটি রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সংক্ষিপ্ত রূপ। এর অর্থ ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট’। সাহাবা অর্থাৎ রাসুলের সঙ্গীদের (যেমন: আবু বকর, আবু হোরায়রা, ওমর) নাম উচ্চারণ করার পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করতে হয়। (রাহঃ) বাক্যটি রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’র সংক্ষিপ্ত রূপ। বাক্যটির অর্থ তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। সাধারণত এই বাক্যটি বিশিষ্ট আলেম ও চিন্তাবিদদের (ইমাম আবু হানিফা, হযরত শাহজালাল, হযরত শাহপরান প্রমুখ) নাম উচ্চারণ করার পর বলতে হয়। আর (আঃ) বাক্যটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে আলাইহিস সালাম থেকে। এই বাক্যের অর্থ আল্লাহ তাঁর উপর করুণা করুন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছাড়া অন্যান্য নবী- রাসুলদের নামের পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করা হয় যেমন: ইব্রাহিম (আঃ), ইসা (আঃ), দাউদ (আঃ)। লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন
No comments