লক্ষণ তো দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু কারণটা যেন না ভুলি by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করায় অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী দোলা খাতুন (১৩) |
পথে-ঘাটে
মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এবং তাদের আত্মহত্যায় প্ররোচনাদান যে একটি অতি
সাংঘাতিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে তার খবর আমরা পাই এবং ব্যাপারটার ভয়াবহতা
চিন্তা করে আতঙ্কিত হই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন যেটি একটি
সুখবর বটে। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নিকট অতীতে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত
ব্যক্তিদের একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে শিক্ষামন্ত্রী সভাপতিত্ব
করেন। সভায় আমিও ছিলাম। পরামর্শগুলো শুনলাম, দু’একটি বাদ দিয়ে সবই যৌক্তিক ও
গ্রহণযোগ্য মনে হলো। সে সঙ্গে আমার কেবলই ধারণা হচ্ছিল যে, বখাটেদের এই
উৎপাত ব্যাধি ঠিকই, কিন্তু এ আবার একটি বড় ব্যাধির লক্ষণও বটে; সেই বড়
ব্যাধিটিকে ভুলে শুধু লক্ষণের চিকিৎসায় কিছুটা এবং সাময়িক ফল পাওয়া যাবে
হয়তো, কিন্তু স্বাস্থ্য তো ফিরে পাওয়া যাবে না। অসুখটি রয়েই যাবে, ওই মূল
অসুখটির বিষয়ে একটু পরে আসছি, তার আগে আলোচনা ও পরামর্শগুলোর কথা বলি।
সভার কার্যপত্রে ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকরণের ব্যাপারটার মাত্রা কতটা যে বেড়েছে তা চিহ্নিত করে যা বলা হয়েছে তা উদ্ধৃতিযোগ্য। ‘স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রীরা শিক্ষালয়ে যাওয়ার পথে বখাটেদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। এর জন্য কেউ কেউ লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বখাটেদের অত্যাচার এমন প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়াতে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। বখাটেদের অত্যাচারে শিক্ষার পরিবেশ হয়ে উঠেছে দূষণময়। তাছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে, নবম শ্রেণীতে ওঠার পর অনেক ছাত্রী শিক্ষাজীবন বন্ধ করে দিচ্ছে, যার কারণে শিক্ষার হার কমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বখাটেদের উৎপাত। এই বখাটেদের উৎপাত নারী নির্যাতনের একটি প্রবণতা এবং এর ভয়াবহতা মেয়েদের অভিভাবকদের মনে এক আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়ে অভিভাবকরা মেয়েটি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত যারপরনাই অস্থির হয়ে থাকেন।’
বলা বাহুল্য, এই বিবরণ সংবাদপত্রের নয়, সরকারি দফতরের এবং এতে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই। বখাটেদের এই উৎপাত যে নারী নির্যাতনেরই একটি রূপ সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত, সেটি খেয়াল না করলে উৎপাতের চরিত্রটি অস্পষ্ট থেকে যেত। পরে আলোচনায় অবশ্য এটাও দেখানো হয়েছে যে, হয়রানি করার ব্যাপারটি যে কেবল পথেঘাটে ঘটে তা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরও ঘটে থাকে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা নতুন কোনো ব্যাপার নয়, এটা অতিশয় পুরাতন বটে। কিন্তু এর মাত্রা এখন দুঃসহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে এবং ঘটনা যে শুধু যাতায়াতের পথে ঘটে তা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও ঘটছে। এমন হারে ঘটছে আগের কালে যা ছিল অকল্পনীয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। কেবল যে সহপাঠীদের হাতে তা নয়, শিক্ষকদের হাতেও। অধঃপতন আর কাকে বলে। বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় সত্যি সত্যি যদি কোনো দিন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তবে এসব তথ্য সে দিন মানুষকে বিস্মিত করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটা মাপার একটি নিরিখও হবে ওই বিস্ময়। প্রসঙ্গ এসেছিল সহশিক্ষার। সবাই একমত হলেন যে, সহশিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। পরস্পরের পাশাপাশি থেকে, এক সঙ্গে পড়াশোনা করে ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে শিখবে, তাদের সম্পর্ক হয়ে উঠবে স্বাভাবিক। আমার মনে পড়ল, জামায়াতে ইসলামীর কথা। এখন কী বলে জানি না, কিন্তু এক সময়ে তারা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও সহশিক্ষার বিরোধী ছিল, তাদের দাবি ছিল মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় থাকা চাই। স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক করে তোলাটাই ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিশ্বস্ত পুঁজি বটে।
লক্ষণ তো দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু কারণটা যেন না ভুলিমেয়েদের একটি কলেজের অধ্যক্ষ বললেন, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে আসতে মেয়েদের কোনো অসুবিধা হয় না, কেননা তিনি তার কলেজের চারশ’ গজের মধ্যে কোনো ধরনের দোকানপাট রাখতে দেন না, কেউ যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকবে কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডার নামে মেয়েদের যাতায়াতের ওপর চোখ রাখবে এমনটা সেখানে সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য নিজেই স্বীকার করলেন যে, চারশ’ গজের বাইরে কী ঘটে সেটার ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ওই চারশ’ গজ ফাঁকা জায়গাই বা ব্যস্ত শহরে কোথায় পাওয়া যাবে, এ প্রশ্ন উঠল এবং জবাব পাওয়া গেল না। রাস্তাঘাটের অবস্থা সম্পর্কে অন্য একজন শিক্ষাবিদ তার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। মফস্বল শহরে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে দেখেন কলেজপড়–য়া দুটি কিশোরী গায়ে বোরখা চাপাচ্ছে, ঘটনা কী জিজ্ঞাসা করায় বিস্ময় ও কৌতুকের সঙ্গে জানতে পারলেন যে, তারা কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বাভাবিক পোশাকে যাতায়াত করা নাকি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সাবধানের মার নেই।
যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল তেমনিভাবে আইনকে কঠোর করার প্রস্তাব এলো। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কোনো কোনো রাজ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকে জামিনের অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়, তেমনটা আমাদের এখানেও করা যেতে পারে। সাদা পোশাকে পুলিশ প্রহরার প্রস্তাব এলো। কিন্তু কথা তো থাকে এবং রইলও, বললেনও কেউ কেউ যে আইনের প্রয়োগ নিয়েই তো মস্ত সমস্যা বিদ্যমান। বখাটেরা গ্রেফতার হয়, তারপর বিভিন্ন ধরনের চাপ এবং যোগাযোগের দরুন তারা সাফল্যের সঙ্গে বের হয়ে আসে, অনেক ক্ষেত্রে এমনকি জামিন বা মুচলেকারও দরকার পড়ে না এবং বেরিয়ে আসতে পারলে তাদের তৎপরতা সুদে-আসলে মিলে অন্তত দ্বিগুণ হয়। আদালতে হাজির করলেও দুর্বৃত্তরা জামিন পেয়ে যায় এবং যাবে যে সেটা পুলিশ জানে। তাই গা করে না। গা করলে পুরস্কার পাওয়া দূরের কথা পরিণতি যে ভালো হবে না, এটাও তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে। বদলি করে দেয়া হতে পারে, এমনও ঘটা সম্ভব যে প্রাণটিই চলে যাবে, যেমনটি গৌতম রায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, এই রাজধানীতেই। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের তল্লাশি করতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন। সামাল দিয়ে চলা, পারতপক্ষে তৎপর না হওয়া, এই শিক্ষাটা পুলিশের লোকেরা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই পেয়ে যান, বইপত্র পড়তে হয় না। তাছাড়া যে ব্যাধি সমাজের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও কি তার নাগালের বাইরে? সেটা কী করে সম্ভব? তাদের মধ্যে এমন বুদ্ধিমান সদস্যরা রয়েছেন যারা দুর্বৃত্তদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন এবং তাতে তাদের বৈষয়িক উন্নতি ঘটে। তাদের দৃষ্টান্তে অন্যরা যদি অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন তবে দোষ দেব কাকে?
বখাটেদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের অত্যাবশ্যকতার বিষয়টি সভার কার্যপত্রে ছিল এবং আলোচকরাও তার সুপারিশ করতে ভোলেননি। সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থাকে। সামাজিক প্রতিরোধ তো ব্যক্তিগতভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সেটিকেও সামাজিক হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিতে গেলে জীবন বিপন্ন হবে, যার দৃষ্টান্ত সহজলভ্য। পুলিশ অফিসারই যেখানে প্রাণ হারান সেখানে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসবে কোন সাহসে, শুনি? সামাজিক প্রতিরোধের জন্য সামাজিক সংগঠন দরকার। আর সে ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারেন স্থানীয় সরকারের প্রধানরা। কিন্তু সেটা যে সম্ভব হবে না, তার নিশ্চিত লক্ষণ তো এটা যে, স্থানীয় সরকারকে মোটেই জোরদার করা হচ্ছে না, উল্টো তাদের ক্ষমতা যেটুকু পাওয়ার কথা ছিল নির্মমভাবে তা হরণ করা হচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান চলে গেছেন উপদেষ্টা এমপি এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অধীনে; একদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় সরকার দাঁড়াবে কেমন করে?
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা খুবই জরুরি। কথাটা চকিতে উঠেছিলও। রাষ্ট্র যদি দৃঢ় অবস্থান না নেয়, যদি দল নিরপেক্ষভাবে বখাটেদের শায়েস্তা করার প্রশাসনকে সেভাবে নির্দেশ না দেয় এবং সর্বোপরি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনে উপজেলায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ও স্থানীয় নেতৃত্ব গঠন করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে না দেয় তাহলে বখাটেদের প্রতিরোধ করা দুঃসাধ্য হবে বৈকি।
আলোচনায় আমার কথা বলার পালা যখন এলো তখন আমি অস্পষ্টভাবে ও চকিতে উপস্থাপিত রাজনৈতিক প্রশ্নটিতে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। বিশদভাবে বলার সময় ছিল না; তাই শুধু এটাই বললাম যে, এই যে এত বড় একটা সামাজিক সমস্যা, এ নিয়ে আমাদের প্রধান যে দুই রাজনৈতিক দল তাদের ভেতর তো কোনো উদ্বেগ দেখি না, তারা যে একত্র হয়ে এর চিকিৎসা করবেন তার তো কোনো লক্ষণ নেই। এমপি সাহেবরা অনেক বিষয়ে বলেন, কিন্তু এ বিষয়ে বলতে চান না। সরকারি এবং সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলই নারী নির্যাতন রোধের ব্যাপারে এগিয়ে আসে না। বরং নারী নির্যাতনকারী বখাটেদের তারা প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়ে থাকে; বখাটেদের তারা ব্যবহার করে, দলীয় কাজে। কিন্তু যে কথাটি আমার বিশেষভাবে বলার ছিল সেটা হলো এই যে, বখাটেপনা একটা সমস্যা বটে, অসুখও বলা যায়। কিন্তু এটা মূল ব্যাধি নয়, মূল ব্যাধি রয়েছে অন্যত্র; যেটি এক ও অভিন্ন, যার প্রবাহ সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে। সেটি হলো পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। আলোচনা সভার কার্যপত্রে
বখাটেদের উৎপাতকে যে নারী নির্যাতন প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়েছে সেটা অত্যন্ত সঠিক বৈকি। নারী আজো ঘরে-বাইরে, সমাজে-সংসারে, কর্মস্থলে-শিক্ষায়তনে, পথে-ঘাটে সর্বত্র নির্যাতিত হচ্ছে, শিকার হচ্ছে সহিংসতার, বাধ্য হচ্ছে আত্মহননে। এটা হলো সেই বৈষম্য যা পুঁজিবাদ সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদ বৈষম্য সৃষ্টি করেই যে শান্ত থাকে তা নয়, সে সঙ্গে দুর্বলকে নানাভাবে পীড়ন করে।
সভার কার্যপত্রে ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকরণের ব্যাপারটার মাত্রা কতটা যে বেড়েছে তা চিহ্নিত করে যা বলা হয়েছে তা উদ্ধৃতিযোগ্য। ‘স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রীরা শিক্ষালয়ে যাওয়ার পথে বখাটেদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। এর জন্য কেউ কেউ লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বখাটেদের অত্যাচার এমন প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়াতে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। বখাটেদের অত্যাচারে শিক্ষার পরিবেশ হয়ে উঠেছে দূষণময়। তাছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে, নবম শ্রেণীতে ওঠার পর অনেক ছাত্রী শিক্ষাজীবন বন্ধ করে দিচ্ছে, যার কারণে শিক্ষার হার কমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বখাটেদের উৎপাত। এই বখাটেদের উৎপাত নারী নির্যাতনের একটি প্রবণতা এবং এর ভয়াবহতা মেয়েদের অভিভাবকদের মনে এক আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়ে অভিভাবকরা মেয়েটি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত যারপরনাই অস্থির হয়ে থাকেন।’
বলা বাহুল্য, এই বিবরণ সংবাদপত্রের নয়, সরকারি দফতরের এবং এতে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই। বখাটেদের এই উৎপাত যে নারী নির্যাতনেরই একটি রূপ সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত, সেটি খেয়াল না করলে উৎপাতের চরিত্রটি অস্পষ্ট থেকে যেত। পরে আলোচনায় অবশ্য এটাও দেখানো হয়েছে যে, হয়রানি করার ব্যাপারটি যে কেবল পথেঘাটে ঘটে তা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরও ঘটে থাকে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা নতুন কোনো ব্যাপার নয়, এটা অতিশয় পুরাতন বটে। কিন্তু এর মাত্রা এখন দুঃসহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে এবং ঘটনা যে শুধু যাতায়াতের পথে ঘটে তা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও ঘটছে। এমন হারে ঘটছে আগের কালে যা ছিল অকল্পনীয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। কেবল যে সহপাঠীদের হাতে তা নয়, শিক্ষকদের হাতেও। অধঃপতন আর কাকে বলে। বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় সত্যি সত্যি যদি কোনো দিন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তবে এসব তথ্য সে দিন মানুষকে বিস্মিত করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটা মাপার একটি নিরিখও হবে ওই বিস্ময়। প্রসঙ্গ এসেছিল সহশিক্ষার। সবাই একমত হলেন যে, সহশিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। পরস্পরের পাশাপাশি থেকে, এক সঙ্গে পড়াশোনা করে ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে শিখবে, তাদের সম্পর্ক হয়ে উঠবে স্বাভাবিক। আমার মনে পড়ল, জামায়াতে ইসলামীর কথা। এখন কী বলে জানি না, কিন্তু এক সময়ে তারা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও সহশিক্ষার বিরোধী ছিল, তাদের দাবি ছিল মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় থাকা চাই। স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক করে তোলাটাই ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিশ্বস্ত পুঁজি বটে।
লক্ষণ তো দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু কারণটা যেন না ভুলিমেয়েদের একটি কলেজের অধ্যক্ষ বললেন, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে আসতে মেয়েদের কোনো অসুবিধা হয় না, কেননা তিনি তার কলেজের চারশ’ গজের মধ্যে কোনো ধরনের দোকানপাট রাখতে দেন না, কেউ যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকবে কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডার নামে মেয়েদের যাতায়াতের ওপর চোখ রাখবে এমনটা সেখানে সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য নিজেই স্বীকার করলেন যে, চারশ’ গজের বাইরে কী ঘটে সেটার ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ওই চারশ’ গজ ফাঁকা জায়গাই বা ব্যস্ত শহরে কোথায় পাওয়া যাবে, এ প্রশ্ন উঠল এবং জবাব পাওয়া গেল না। রাস্তাঘাটের অবস্থা সম্পর্কে অন্য একজন শিক্ষাবিদ তার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। মফস্বল শহরে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে দেখেন কলেজপড়–য়া দুটি কিশোরী গায়ে বোরখা চাপাচ্ছে, ঘটনা কী জিজ্ঞাসা করায় বিস্ময় ও কৌতুকের সঙ্গে জানতে পারলেন যে, তারা কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বাভাবিক পোশাকে যাতায়াত করা নাকি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সাবধানের মার নেই।
যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল তেমনিভাবে আইনকে কঠোর করার প্রস্তাব এলো। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কোনো কোনো রাজ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকে জামিনের অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়, তেমনটা আমাদের এখানেও করা যেতে পারে। সাদা পোশাকে পুলিশ প্রহরার প্রস্তাব এলো। কিন্তু কথা তো থাকে এবং রইলও, বললেনও কেউ কেউ যে আইনের প্রয়োগ নিয়েই তো মস্ত সমস্যা বিদ্যমান। বখাটেরা গ্রেফতার হয়, তারপর বিভিন্ন ধরনের চাপ এবং যোগাযোগের দরুন তারা সাফল্যের সঙ্গে বের হয়ে আসে, অনেক ক্ষেত্রে এমনকি জামিন বা মুচলেকারও দরকার পড়ে না এবং বেরিয়ে আসতে পারলে তাদের তৎপরতা সুদে-আসলে মিলে অন্তত দ্বিগুণ হয়। আদালতে হাজির করলেও দুর্বৃত্তরা জামিন পেয়ে যায় এবং যাবে যে সেটা পুলিশ জানে। তাই গা করে না। গা করলে পুরস্কার পাওয়া দূরের কথা পরিণতি যে ভালো হবে না, এটাও তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে। বদলি করে দেয়া হতে পারে, এমনও ঘটা সম্ভব যে প্রাণটিই চলে যাবে, যেমনটি গৌতম রায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, এই রাজধানীতেই। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের তল্লাশি করতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন। সামাল দিয়ে চলা, পারতপক্ষে তৎপর না হওয়া, এই শিক্ষাটা পুলিশের লোকেরা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই পেয়ে যান, বইপত্র পড়তে হয় না। তাছাড়া যে ব্যাধি সমাজের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও কি তার নাগালের বাইরে? সেটা কী করে সম্ভব? তাদের মধ্যে এমন বুদ্ধিমান সদস্যরা রয়েছেন যারা দুর্বৃত্তদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন এবং তাতে তাদের বৈষয়িক উন্নতি ঘটে। তাদের দৃষ্টান্তে অন্যরা যদি অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন তবে দোষ দেব কাকে?
বখাটেদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের অত্যাবশ্যকতার বিষয়টি সভার কার্যপত্রে ছিল এবং আলোচকরাও তার সুপারিশ করতে ভোলেননি। সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থাকে। সামাজিক প্রতিরোধ তো ব্যক্তিগতভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সেটিকেও সামাজিক হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিতে গেলে জীবন বিপন্ন হবে, যার দৃষ্টান্ত সহজলভ্য। পুলিশ অফিসারই যেখানে প্রাণ হারান সেখানে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসবে কোন সাহসে, শুনি? সামাজিক প্রতিরোধের জন্য সামাজিক সংগঠন দরকার। আর সে ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারেন স্থানীয় সরকারের প্রধানরা। কিন্তু সেটা যে সম্ভব হবে না, তার নিশ্চিত লক্ষণ তো এটা যে, স্থানীয় সরকারকে মোটেই জোরদার করা হচ্ছে না, উল্টো তাদের ক্ষমতা যেটুকু পাওয়ার কথা ছিল নির্মমভাবে তা হরণ করা হচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান চলে গেছেন উপদেষ্টা এমপি এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অধীনে; একদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় সরকার দাঁড়াবে কেমন করে?
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা খুবই জরুরি। কথাটা চকিতে উঠেছিলও। রাষ্ট্র যদি দৃঢ় অবস্থান না নেয়, যদি দল নিরপেক্ষভাবে বখাটেদের শায়েস্তা করার প্রশাসনকে সেভাবে নির্দেশ না দেয় এবং সর্বোপরি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনে উপজেলায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ও স্থানীয় নেতৃত্ব গঠন করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে না দেয় তাহলে বখাটেদের প্রতিরোধ করা দুঃসাধ্য হবে বৈকি।
আলোচনায় আমার কথা বলার পালা যখন এলো তখন আমি অস্পষ্টভাবে ও চকিতে উপস্থাপিত রাজনৈতিক প্রশ্নটিতে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। বিশদভাবে বলার সময় ছিল না; তাই শুধু এটাই বললাম যে, এই যে এত বড় একটা সামাজিক সমস্যা, এ নিয়ে আমাদের প্রধান যে দুই রাজনৈতিক দল তাদের ভেতর তো কোনো উদ্বেগ দেখি না, তারা যে একত্র হয়ে এর চিকিৎসা করবেন তার তো কোনো লক্ষণ নেই। এমপি সাহেবরা অনেক বিষয়ে বলেন, কিন্তু এ বিষয়ে বলতে চান না। সরকারি এবং সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলই নারী নির্যাতন রোধের ব্যাপারে এগিয়ে আসে না। বরং নারী নির্যাতনকারী বখাটেদের তারা প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়ে থাকে; বখাটেদের তারা ব্যবহার করে, দলীয় কাজে। কিন্তু যে কথাটি আমার বিশেষভাবে বলার ছিল সেটা হলো এই যে, বখাটেপনা একটা সমস্যা বটে, অসুখও বলা যায়। কিন্তু এটা মূল ব্যাধি নয়, মূল ব্যাধি রয়েছে অন্যত্র; যেটি এক ও অভিন্ন, যার প্রবাহ সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে। সেটি হলো পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। আলোচনা সভার কার্যপত্রে
বখাটেদের উৎপাতকে যে নারী নির্যাতন প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়েছে সেটা অত্যন্ত সঠিক বৈকি। নারী আজো ঘরে-বাইরে, সমাজে-সংসারে, কর্মস্থলে-শিক্ষায়তনে, পথে-ঘাটে সর্বত্র নির্যাতিত হচ্ছে, শিকার হচ্ছে সহিংসতার, বাধ্য হচ্ছে আত্মহননে। এটা হলো সেই বৈষম্য যা পুঁজিবাদ সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদ বৈষম্য সৃষ্টি করেই যে শান্ত থাকে তা নয়, সে সঙ্গে দুর্বলকে নানাভাবে পীড়ন করে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |
এক্ষেত্রে বৈষম্য মানে বৈচিত্র্য নয়,
বৈষম্য হচ্ছে শোষণের প্রতিফল এবং ব্যবস্থা; একই সঙ্গে দুটোই। তথাকথিত উন্নত
বিশ্বেও যে মেয়েরা যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছে তাও তো বলা যাবে না। অন্য
প্রমাণের দরকার পড়ে না, পণ্যের বিজ্ঞাপনে মেয়েদের যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে
সেটা দেখলেই জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এটা যে কেবল কয়েকজন মেয়ের ব্যাপার
নয়, মেয়েরা যে পণ্যেরও সেবকে পরিণত হচ্ছে সেটাই বাস্তবিক সত্য। সামাজিক,
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সবকিছু মিলিয়ে গোটা ব্যবস্থাটাই যে মেয়েদের
বিরুদ্ধে কাজ করছে সেটা যেন না ভুলি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments