৫ কারণে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল খারাপ by শরিফুজ্জামান ও মোশতাক আহমেদ
পাঁচ কারণে এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল আগের তুলনায় বেশ খারাপ হয়েছে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা—দুটোই অনেক কমেছে।
কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতামত নিয়ে এবং ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইংরেজিতে সাড়ে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া, প্রথম চালু হওয়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে ১৩ শতাংশের মতো ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ না হতে পারা, সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে জটিলতা, মাতৃভাষা বাংলায় তুলনামূলক খারাপ করা এবং যশোর বোর্ডে ফল বিপর্যয় সামগ্রিকভাবে ফলাফলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গতকাল রোববার প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, আট বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষার পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৫ দশমিক ৭৪। এবার পৌনে নয় লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন পৌনে ছয় লাখ। এবার জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২১, যা গতবারের চেয়ে ২৩ হাজার ৬৮ জন কম। গতবার এই সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৭৮৯।
তথ্যপ্রযুক্তিতে হোঁচট: এ বছর থেকে ১০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে চালু হয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি। কিন্তু প্রথমবারই ফল খারাপ হয়েছে। ছয়টি বাধ্যতামূলক বিষয়ের পাসের হার উল্লেখ করা হলেও নতুন চালু হওয়া এ বিষয়টিতে পাসের চিত্র তুলে ধরা হয়নি।
তবে আটটি শিক্ষা বোর্ডে পৃথকভাবে যোগাযোগ করে জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে পাসের হার সন্তোষজনক নয়। এর কারণ সম্পর্কে জানা যায়, এ বিষয়টি চালু হলেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও শিক্ষা-উপকরণ নেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ বিষয়ে শিক্ষকের অভাব প্রকট।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এ বিষয়টির কারণে সারা দেশে গড় পাসের হার ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমেছে। ঢাকা বোর্ডে এ বিষয়ে প্রায় ৮৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৫ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৯০ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে পাস করেছেন।
শিক্ষকদের অনেকেই বলছেন, পৌরনীতিতে ৯৫, বাংলায় ৯৩, রসায়নে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করলেও তথ্যপ্রযুক্তিতে পাসের হার তুলনামূলক কম, যার কিছুটা প্রভাব পড়েছে গড় পাসের হারের ওপর।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, গ্রামে শিক্ষক-সংকট বেশি, এ জন্য সরকারকে এখন থেকে বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। কারণ, গ্রামের ছেলেমেয়েরা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পিছিয়ে থাকলে বৈষম্য আরও বাড়বে।’
ইংরেজির ফল ভালো নয়: পাসের হার কমে যাওয়ার মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে ইংরেজি। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বাদে ছয় বোর্ডের ফল গতবারের চেয়ে খারাপ। শুধু যশোর বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। গতবার ওই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ছিল ৬৫, এবার ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ডেও ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এই বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী বেশি থাকায় সার্বিক ফলে বেশি প্রভাব পড়েছে। ইংরেজিতে পাস করেছে ৭৯ দশমিক ১০ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৯২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। কুমিল্লায় ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। রাজশাহী, সিলেট ও দিনাজপুর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে ৩ শতাংশ পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি বুঝতেই পারে না, লেখা বা বলা তো দূরের কথা। এর মধ্যে সৃজনশীল হওয়ায় অনেক শিক্ষকও ইংরেজি পড়ানোর বিষয়টি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারেননি।
প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব থাকার কথা উল্লেখ করে মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ জন্য প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকর্ষণ করতে হলে বেতন-ভাতা ও সম্মান বাড়াতে হবে।
মাতৃভাষায় খারাপ ফল: ফল খারাপের পেছনে মাতৃভাষা বাংলায় পরীক্ষার্থীদের খারাপ করাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা। বাংলায় গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করা ছাড়াও জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এ বিষয়টি। আবার জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের অনেকেই বাংলায় এ প্লাস (৮০ নম্বরের ওপরে) পাননি।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা বিষয়ে প্রায় প্রতিটি বোর্ডের ফল গতবারের চেয়ে খারাপ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বোর্ডে বাংলায় পাসের হার প্রায় ২ শতাংশ কমেছে। এই বোর্ডে বাংলা বিষয়ে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। গতবার ছিল ৯৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ বিষয়ে রাজশাহী বোর্ডে প্রায় ৩, যশোরে ৪ ও বরিশাল বোর্ডে ৫ শতাংশ পাসের হার কমেছে।
ফলাফলের অনুলিপি তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ছেলেমেয়েরা বাংলা ও ইংরেজিতে খারাপ করায় তিনি দুঃখ পেয়েছেন।
সৃজনশীলের আলাদা প্রশ্নপত্রের প্রভাব: এবার ১২টি বিষয়ের ২৩টি পত্রে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সৃজনশীল বিষয়গুলোর প্রশ্নপত্র সব বোর্ডে অভিন্ন হতো। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এবার প্রথমবারের মতো বোর্ডগুলো আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়েছে। আগে আন্তবোর্ড মিলে চার সেট প্রশ্ন করত। সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে এক সেট বাছাই করে পরীক্ষা নেওয়া হতো। এবার প্রতিটি বোর্ডের জন্য চারটি করে মোট ৩২ সেট প্রশ্নপত্র করা হয়। সেখান থেকে লটারি করে বোর্ডগুলো আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে সব বোর্ডে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে, সে বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এবার হঠাৎ করে আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ায় পরীক্ষার্থীরা কিছুটা সমস্যায় পড়ে। সার্বিক ফল খারাপের জন্য এটাও বড় কারণ।
যশোরের প্রভাব সার্বিক ফলে: আট বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮৪ হলেও যশোরে পাসের হার মাত্র ৪৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই বোর্ডে অর্ধেকেরও বেশি পরীক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হয়েছে, যা সার্বিক ফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই বোর্ড ছাড়া বাকি সাত বোর্ডে গড় পাসের হার দাঁড়ায় প্রায় ৬৯ শতাংশ।
এই বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে এই বোর্ডের খারাপ ফলের কারণে গড় হারে প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার মাত্র ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর কারণ, এই বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র খুব কঠিন হয়েছিল।
প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ার প্রভাব: গতবার ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন ও গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। গতবার ইংরেজিতে পাসের হারও অনেক বেশি ছিল। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আগের বছরগুলোর তুলনায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বড় ধরনের অভিযোগ ছিল না। পরীক্ষার পাস-ফেলের ক্ষেত্রে এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, পাস-ফেল কিছু বেশি বা কম হতে পারে। কিন্তু এবার যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, সেটি ইতিবাচক দিক।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রশ্নপত্র এবার ফাঁস হয়নি, ভবিষ্যতেও যাতে না হয় সেই চেষ্টা থাকবে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
সহিংসতা ছিল, তবে তা পরীক্ষার আগে: ফল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফল খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও ও নাশকতাকে দায়ী করেন। কিন্তু ১ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই বিএনপি-জামায়াত জোটের এসব কর্মকাণ্ড থেমে যায়।
হইচই কমেছে, প্রযুক্তির জয়জয়কার: ফল প্রকাশে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, সময়মতো ফল প্রকাশ ও সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফল হস্তান্তরের সময় শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল তুলে ধরার পাশাপাশি এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও কিছু নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান।
সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা নেই: সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ না করার পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী। তবে রাজধানীর ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাকছুদউদ্দিন বলেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি সমর্থন করেন না। বিষয়টিকে তিনি চোরের ভয়ে ভালো কাজ করা বন্ধের সঙ্গে তুলনা করেন।
ঢাকা বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী মনজুরুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, জিপিএ পদ্ধতি চালুর লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করা।
এ বছর পরীক্ষার কাগজবিহীন ফল প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ই-মেইলের মাধ্যমে ফল পৌঁছে গেছে জেলা বা উপজেলা প্রশাসন, পরীক্ষাকেন্দ্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফল হস্তান্তরের সময় বিকল্প হিসেবে এক সেট ছাপা ফলাফল থাকলেও তাঁর কাছে ডিজিটাল ফল হস্তান্তর করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী আইপ্যাডে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফল দেখেছেন। শিক্ষা বোর্ডগুলোও ই-মেইলের মাধ্যমে ফল পাঠিয়েছে।
৮ বোর্ডে পাসের হার
রাজশাহী ৭৭.৫৪
সিলেট ৭৪.৫৭
দিনাজপুর ৭০.৪৩
বরিশাল ৭০.০৬
ঢাকা ৬৮.১৬
চট্টগ্রাম ৬৩.৪৯
কুমিল্লা ৫৯.৮
যশোর ৪৬.৪৫
কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতামত নিয়ে এবং ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইংরেজিতে সাড়ে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া, প্রথম চালু হওয়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে ১৩ শতাংশের মতো ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ না হতে পারা, সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে জটিলতা, মাতৃভাষা বাংলায় তুলনামূলক খারাপ করা এবং যশোর বোর্ডে ফল বিপর্যয় সামগ্রিকভাবে ফলাফলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গতকাল রোববার প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, আট বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষার পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৫ দশমিক ৭৪। এবার পৌনে নয় লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন পৌনে ছয় লাখ। এবার জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২১, যা গতবারের চেয়ে ২৩ হাজার ৬৮ জন কম। গতবার এই সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৭৮৯।
তথ্যপ্রযুক্তিতে হোঁচট: এ বছর থেকে ১০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে চালু হয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি। কিন্তু প্রথমবারই ফল খারাপ হয়েছে। ছয়টি বাধ্যতামূলক বিষয়ের পাসের হার উল্লেখ করা হলেও নতুন চালু হওয়া এ বিষয়টিতে পাসের চিত্র তুলে ধরা হয়নি।
তবে আটটি শিক্ষা বোর্ডে পৃথকভাবে যোগাযোগ করে জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে পাসের হার সন্তোষজনক নয়। এর কারণ সম্পর্কে জানা যায়, এ বিষয়টি চালু হলেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও শিক্ষা-উপকরণ নেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ বিষয়ে শিক্ষকের অভাব প্রকট।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এ বিষয়টির কারণে সারা দেশে গড় পাসের হার ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমেছে। ঢাকা বোর্ডে এ বিষয়ে প্রায় ৮৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৫ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৯০ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে পাস করেছেন।
শিক্ষকদের অনেকেই বলছেন, পৌরনীতিতে ৯৫, বাংলায় ৯৩, রসায়নে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করলেও তথ্যপ্রযুক্তিতে পাসের হার তুলনামূলক কম, যার কিছুটা প্রভাব পড়েছে গড় পাসের হারের ওপর।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, গ্রামে শিক্ষক-সংকট বেশি, এ জন্য সরকারকে এখন থেকে বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। কারণ, গ্রামের ছেলেমেয়েরা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পিছিয়ে থাকলে বৈষম্য আরও বাড়বে।’
ইংরেজির ফল ভালো নয়: পাসের হার কমে যাওয়ার মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে ইংরেজি। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বাদে ছয় বোর্ডের ফল গতবারের চেয়ে খারাপ। শুধু যশোর বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। গতবার ওই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ছিল ৬৫, এবার ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ডেও ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এই বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী বেশি থাকায় সার্বিক ফলে বেশি প্রভাব পড়েছে। ইংরেজিতে পাস করেছে ৭৯ দশমিক ১০ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৯২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। কুমিল্লায় ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। রাজশাহী, সিলেট ও দিনাজপুর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার কমেছে ৩ শতাংশ পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি বুঝতেই পারে না, লেখা বা বলা তো দূরের কথা। এর মধ্যে সৃজনশীল হওয়ায় অনেক শিক্ষকও ইংরেজি পড়ানোর বিষয়টি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারেননি।
প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব থাকার কথা উল্লেখ করে মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ জন্য প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকর্ষণ করতে হলে বেতন-ভাতা ও সম্মান বাড়াতে হবে।
মাতৃভাষায় খারাপ ফল: ফল খারাপের পেছনে মাতৃভাষা বাংলায় পরীক্ষার্থীদের খারাপ করাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা। বাংলায় গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করা ছাড়াও জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এ বিষয়টি। আবার জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের অনেকেই বাংলায় এ প্লাস (৮০ নম্বরের ওপরে) পাননি।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা বিষয়ে প্রায় প্রতিটি বোর্ডের ফল গতবারের চেয়ে খারাপ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বোর্ডে বাংলায় পাসের হার প্রায় ২ শতাংশ কমেছে। এই বোর্ডে বাংলা বিষয়ে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। গতবার ছিল ৯৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ বিষয়ে রাজশাহী বোর্ডে প্রায় ৩, যশোরে ৪ ও বরিশাল বোর্ডে ৫ শতাংশ পাসের হার কমেছে।
ফলাফলের অনুলিপি তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ছেলেমেয়েরা বাংলা ও ইংরেজিতে খারাপ করায় তিনি দুঃখ পেয়েছেন।
সৃজনশীলের আলাদা প্রশ্নপত্রের প্রভাব: এবার ১২টি বিষয়ের ২৩টি পত্রে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সৃজনশীল বিষয়গুলোর প্রশ্নপত্র সব বোর্ডে অভিন্ন হতো। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এবার প্রথমবারের মতো বোর্ডগুলো আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়েছে। আগে আন্তবোর্ড মিলে চার সেট প্রশ্ন করত। সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে এক সেট বাছাই করে পরীক্ষা নেওয়া হতো। এবার প্রতিটি বোর্ডের জন্য চারটি করে মোট ৩২ সেট প্রশ্নপত্র করা হয়। সেখান থেকে লটারি করে বোর্ডগুলো আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে সব বোর্ডে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে, সে বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এবার হঠাৎ করে আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ায় পরীক্ষার্থীরা কিছুটা সমস্যায় পড়ে। সার্বিক ফল খারাপের জন্য এটাও বড় কারণ।
যশোরের প্রভাব সার্বিক ফলে: আট বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮৪ হলেও যশোরে পাসের হার মাত্র ৪৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই বোর্ডে অর্ধেকেরও বেশি পরীক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হয়েছে, যা সার্বিক ফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই বোর্ড ছাড়া বাকি সাত বোর্ডে গড় পাসের হার দাঁড়ায় প্রায় ৬৯ শতাংশ।
এই বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে এই বোর্ডের খারাপ ফলের কারণে গড় হারে প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার মাত্র ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর কারণ, এই বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র খুব কঠিন হয়েছিল।
প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ার প্রভাব: গতবার ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন ও গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। গতবার ইংরেজিতে পাসের হারও অনেক বেশি ছিল। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আগের বছরগুলোর তুলনায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বড় ধরনের অভিযোগ ছিল না। পরীক্ষার পাস-ফেলের ক্ষেত্রে এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, পাস-ফেল কিছু বেশি বা কম হতে পারে। কিন্তু এবার যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, সেটি ইতিবাচক দিক।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রশ্নপত্র এবার ফাঁস হয়নি, ভবিষ্যতেও যাতে না হয় সেই চেষ্টা থাকবে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
সহিংসতা ছিল, তবে তা পরীক্ষার আগে: ফল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফল খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও ও নাশকতাকে দায়ী করেন। কিন্তু ১ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই বিএনপি-জামায়াত জোটের এসব কর্মকাণ্ড থেমে যায়।
হইচই কমেছে, প্রযুক্তির জয়জয়কার: ফল প্রকাশে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, সময়মতো ফল প্রকাশ ও সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফল হস্তান্তরের সময় শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল তুলে ধরার পাশাপাশি এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও কিছু নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান।
সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা নেই: সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ না করার পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী। তবে রাজধানীর ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাকছুদউদ্দিন বলেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি সমর্থন করেন না। বিষয়টিকে তিনি চোরের ভয়ে ভালো কাজ করা বন্ধের সঙ্গে তুলনা করেন।
ঢাকা বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী মনজুরুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, জিপিএ পদ্ধতি চালুর লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করা।
এ বছর পরীক্ষার কাগজবিহীন ফল প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ই-মেইলের মাধ্যমে ফল পৌঁছে গেছে জেলা বা উপজেলা প্রশাসন, পরীক্ষাকেন্দ্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফল হস্তান্তরের সময় বিকল্প হিসেবে এক সেট ছাপা ফলাফল থাকলেও তাঁর কাছে ডিজিটাল ফল হস্তান্তর করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী আইপ্যাডে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফল দেখেছেন। শিক্ষা বোর্ডগুলোও ই-মেইলের মাধ্যমে ফল পাঠিয়েছে।
৮ বোর্ডে পাসের হার
রাজশাহী ৭৭.৫৪
সিলেট ৭৪.৫৭
দিনাজপুর ৭০.৪৩
বরিশাল ৭০.০৬
ঢাকা ৬৮.১৬
চট্টগ্রাম ৬৩.৪৯
কুমিল্লা ৫৯.৮
যশোর ৪৬.৪৫
No comments