বিবেক মারা গেছে by সাজেদুল হক
এমন
মৃত্যু সংবাদ বাংলাদেশ অতীতে কখনও পায়নি। এ অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস খুব
বেশি গৌরবের নয়। যদিও অনেক পরাবাস্তববাদী ইতিহাসবিদ নানা রঙ দেয়ার চেষ্টা
করেছেন। পরাধীনতার শিকলে দীর্ঘদিন বন্দি ছিলাম আমরা। দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনারও
কোন অভাব ছিল না। ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে দীর্ঘসময়। তবে এ
অঞ্চলের মানুষের বিবেকের এমন মৃত্যু অতীতে আর কখনোই হয়নি। মানুষের বিপদে
মানুষের এগিয়ে আসাÑ এই ছিল আমাদের ট্রেডমার্ক। হয়তো শত্রুতা ছিল, হয়তো
প্রতিবেশীর অমঙ্গলও অনেকে দেখতে চাইতেন। তাই বলে মানুষ কখনও এতটা নিষ্ঠুর
হয়নি। সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনের হত্যাকা- দেখে শিউরে উঠেছিলাম আমরা।
মানুষ এতটা বর্বর হয়? এভাবে একটা শিশুকে পিটিয়ে কেউ হত্যা করে। সে দৃশ্য
আবার ধারণ করে মোবাইল ক্যামেরায়। ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিশাল
বিশাল বাহিনী, বড় বড় ইমারত আমাদের মানবিকতাকে কী ক্রমশ মুছে ফেলছে।
নিষ্ঠুর এ হত্যার সময় কেউই বাধা দেয়নি। যদিও পরে আসামিদের ধরতে এগিয়ে আসে
আমজনতা। তারাই মূলত আসামিদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। প্রধান অভিযুক্ত সৌদি
আরবে পালিয়ে গিয়েও রেহাই পায়নি। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাকে ধরে
পুলিশে দেয়।
সামিউল আলম রাজনের নিষ্ঠুরতাকেও ছাপিয়ে গেছে খুলনার বর্বরতা। যেভাবে ১২ বছরের একটি ছেলেকে কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হলো তার বিবরণ দেয়াও অসাধ্য। ইতিহাসে এমন বর্বরতার ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। ‘মা আর দিয়েন না, মরে যাবো’- একথা শুনেও খুনিদের মন একটুও গলেনি।
সাম্প্রতিক এ নিষ্ঠুরতা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘সীমাহীন নিষ্ঠুরতার খবর পড়ছি আমরা সবাই। একেকটি মর্মান্তিক ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চরিত্রে, প্রকৃতিতে। গতকাল এ নিষ্ঠুরতার খবর দেখে মনে হয়েছে ‘এও কি সম্ভব?’ আজ আরেক ঘটনায় তাকে মনে হচ্ছে শিশুতোষ। অথচ দেখুন যারা এসব পৈশাচিক ঘটনা ঘটাচ্ছে এরা কিন্তু অতি সাধারণ মানুষ; আপনার চারপাশে যে মানুষগুলোকে আপনি প্রতিদিন দেখেন, চেনেন, এরা তার চেয়ে ভিন্ন নয়। ফেসবুকে যার কথা আপনি ‘পছন্দ’ করেন এরা কী তার চেয়ে খুব বেশি আলাদা? আপনি ভাবেন- কী করে মানুষের মধ্যে এই সীমাহীন বিকারগ্রস্ততার জন্ম হয়েছে? কিন্তু আসলে এ প্রশ্নের উত্তর আপনি জানেন, চাইলেই বুঝতে পারবেন। এসব ঘটনায় যেসব প্রতিক্রিয়া সেগুলো দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। ক্ষোভ ও ক্রোধের প্রকাশ হিসেবে আমার-আপনার বন্ধুর প্রতিক্রিয়ার ভাষা লক্ষ্য করুন, তাহলেই স্পষ্ট হবে। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমি-আপনি যে ভাষায় আক্রমণ করছি, এসব অপরাধীর যেসব শাস্তির পরামর্শ দিচ্ছি সেগুলোই আসলে বলে দেয় এ মনোভাবের শেকড় কত গভীরে। মানুষকে কতভাবে শাস্তি দেয়া যায় বলে যে পরামর্শ দেয়া হয় তার যদি একটি তালিকা করার চেষ্টা করেন তাহলে দেখবেন এগুলোর মধ্যে নির্মমতার কত নগ্ন প্রকাশ আছে। আর যারা প্রতিক্রিয়া দেখালেন না তাদের মধ্যে আছেন সেসব মানুষ, যাদের নির্লিপ্ততা সীমাহীন। আমার গায়ে এসে লাগেনি, সেটা ধর্ষণের ঘটনাই হোক কী হত্যার ঘটনাই হোক। অতএব, এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। এই দুই-ই বলে দেয় মানুষের মনের কোণে যে অন্ধকার তা দূর তো হয়ইনি, বরং আরও বেশি করে গেড়ে বসেছে। বাইরের উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলোয় আমরা তা দেখতে পাই না বটে, কিন্তু আরেক অন্ধকারের দেখা পাওয়া গেলে সেই অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে। গত কয়েক বছরে কথা বলার ভাষায়, আলোচনার ভাষায়, ভিন্নমত প্রকাশের ভাষায় কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন? এই যে ফেসবুক, কিংবা ধরুন অন্য সোশ্যাল মিডিয়া, সেটা একার্থে এই সময়ের এক অনন্য দলিল, সমাজ বদলে যাওয়ার একটি দলিল শুধু এই কারণে নয় যে, সেটা প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্রমাণ, এই কারণেও নয় যে, তা দূরকে কাছে এনেছে। আমার কাছে মনে হয় এই কারণে যে আমার-আপনার ভেতরের মানুষকে এই প্রযুক্তি উন্মুক্ত করেছে। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে আমরা যখন কথা বলি তখন আসলে কথা বলি একা একা, যে কথাটা যে ভাষায় আর দশজনের সামনে বলতে আমাদের দ্বিধা হতো এখন তা নির্বিবাদেই বলি। ফলে যতটুকু মানসিক বাধা; সামাজিকতার যতটুকু লেশ আমাদের আটকে রাখতো এখন সেই বাধা নেই। একান্তে আমরা আমি যে কী রকম মানুষ তারই প্রকাশ ঘটে এসব নির্মমতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিক্রিয়ায়। শুধু তাই নয়, অন্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। অন্ধকারকে অন্ধকার দিয়ে দূরে ঠেলতে পারা যাবে এমন আশা বাতুলতা মাত্র; আমাদের ভেতরের অন্ধকার বিষয়ে আত্মোপলব্ধি দেখতে পাই না। মনের সেই অন্ধকারের মধ্যে যে আলো প্রবেশ করছে না, সে কথা বলার সময় কোথায়? বিত্ত, প্রাচুর্যের অহংকার আর আপাত সাফল্যের ঘোর কী আমাদের অন্ধ করে দিচ্ছে?’
কিন্তু কেন মানুষের বিবেক মারা গেল? ক্রমশ কেন বর্বর হয়ে গেলাম আমি, আপনি, তুমি, সে। এ কী সভ্যতার অভিশাপ? বিশাল বিশাল বাহিনী তৈরি করলেই যে রাষ্ট্র মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না তারও কী প্রমাণ নয় এসব ঘটনা। একসময় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বেডরুমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। এখন দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র মায়ের পেটের সন্তানের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারছে না। ছোট্ট সুমাইয়া পৃথিবীতে আসার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এমন ঘটনা কী পৃথিবীতে আগে কখনও ঘটেছিল?
ক্ষমতার লোভ কী আমাদের বিবেক অন্ধ করে দিয়েছে। আইনের শাসন কখন ভেঙে পড়ে? অপরাধীরা যখন নিশ্চিত হয়, নিরপরাধী যখন আতঙ্কে থাকেন, তখনই তো আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। সীমাহীন লোভের কাছে মানুষ নিজেই কী হেরে গেছে। না যন্ত্রসভ্যতা মুছে দিয়েছে মানুষের সব আবেগ, সব মানবিকতা। অন্যের বিনাশেই কী এখন মুক্তি খুঁজছে মানুষ। নৈতিকতার জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে মেকি নৈতিকতা। আদিম সমাজে যখন কোন রাষ্ট্র ছিল না, কোন বাহিনী ছিল না, সেই অর্থে কোন নৈতিকতাও ছিল না। তখনও কী মানুষ এতটা নিষ্ঠুর ছিল?
মানবিকতার সঙ্কটের এই সময়ে প্রার্থনা করি, মৃত বিবেক জেগে ওঠুক। বন্ধ হোক এই হত্যা, এই বর্বরতা।
সামিউল আলম রাজনের নিষ্ঠুরতাকেও ছাপিয়ে গেছে খুলনার বর্বরতা। যেভাবে ১২ বছরের একটি ছেলেকে কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হলো তার বিবরণ দেয়াও অসাধ্য। ইতিহাসে এমন বর্বরতার ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। ‘মা আর দিয়েন না, মরে যাবো’- একথা শুনেও খুনিদের মন একটুও গলেনি।
সাম্প্রতিক এ নিষ্ঠুরতা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘সীমাহীন নিষ্ঠুরতার খবর পড়ছি আমরা সবাই। একেকটি মর্মান্তিক ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চরিত্রে, প্রকৃতিতে। গতকাল এ নিষ্ঠুরতার খবর দেখে মনে হয়েছে ‘এও কি সম্ভব?’ আজ আরেক ঘটনায় তাকে মনে হচ্ছে শিশুতোষ। অথচ দেখুন যারা এসব পৈশাচিক ঘটনা ঘটাচ্ছে এরা কিন্তু অতি সাধারণ মানুষ; আপনার চারপাশে যে মানুষগুলোকে আপনি প্রতিদিন দেখেন, চেনেন, এরা তার চেয়ে ভিন্ন নয়। ফেসবুকে যার কথা আপনি ‘পছন্দ’ করেন এরা কী তার চেয়ে খুব বেশি আলাদা? আপনি ভাবেন- কী করে মানুষের মধ্যে এই সীমাহীন বিকারগ্রস্ততার জন্ম হয়েছে? কিন্তু আসলে এ প্রশ্নের উত্তর আপনি জানেন, চাইলেই বুঝতে পারবেন। এসব ঘটনায় যেসব প্রতিক্রিয়া সেগুলো দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। ক্ষোভ ও ক্রোধের প্রকাশ হিসেবে আমার-আপনার বন্ধুর প্রতিক্রিয়ার ভাষা লক্ষ্য করুন, তাহলেই স্পষ্ট হবে। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমি-আপনি যে ভাষায় আক্রমণ করছি, এসব অপরাধীর যেসব শাস্তির পরামর্শ দিচ্ছি সেগুলোই আসলে বলে দেয় এ মনোভাবের শেকড় কত গভীরে। মানুষকে কতভাবে শাস্তি দেয়া যায় বলে যে পরামর্শ দেয়া হয় তার যদি একটি তালিকা করার চেষ্টা করেন তাহলে দেখবেন এগুলোর মধ্যে নির্মমতার কত নগ্ন প্রকাশ আছে। আর যারা প্রতিক্রিয়া দেখালেন না তাদের মধ্যে আছেন সেসব মানুষ, যাদের নির্লিপ্ততা সীমাহীন। আমার গায়ে এসে লাগেনি, সেটা ধর্ষণের ঘটনাই হোক কী হত্যার ঘটনাই হোক। অতএব, এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। এই দুই-ই বলে দেয় মানুষের মনের কোণে যে অন্ধকার তা দূর তো হয়ইনি, বরং আরও বেশি করে গেড়ে বসেছে। বাইরের উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলোয় আমরা তা দেখতে পাই না বটে, কিন্তু আরেক অন্ধকারের দেখা পাওয়া গেলে সেই অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে। গত কয়েক বছরে কথা বলার ভাষায়, আলোচনার ভাষায়, ভিন্নমত প্রকাশের ভাষায় কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন? এই যে ফেসবুক, কিংবা ধরুন অন্য সোশ্যাল মিডিয়া, সেটা একার্থে এই সময়ের এক অনন্য দলিল, সমাজ বদলে যাওয়ার একটি দলিল শুধু এই কারণে নয় যে, সেটা প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্রমাণ, এই কারণেও নয় যে, তা দূরকে কাছে এনেছে। আমার কাছে মনে হয় এই কারণে যে আমার-আপনার ভেতরের মানুষকে এই প্রযুক্তি উন্মুক্ত করেছে। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে আমরা যখন কথা বলি তখন আসলে কথা বলি একা একা, যে কথাটা যে ভাষায় আর দশজনের সামনে বলতে আমাদের দ্বিধা হতো এখন তা নির্বিবাদেই বলি। ফলে যতটুকু মানসিক বাধা; সামাজিকতার যতটুকু লেশ আমাদের আটকে রাখতো এখন সেই বাধা নেই। একান্তে আমরা আমি যে কী রকম মানুষ তারই প্রকাশ ঘটে এসব নির্মমতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিক্রিয়ায়। শুধু তাই নয়, অন্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। অন্ধকারকে অন্ধকার দিয়ে দূরে ঠেলতে পারা যাবে এমন আশা বাতুলতা মাত্র; আমাদের ভেতরের অন্ধকার বিষয়ে আত্মোপলব্ধি দেখতে পাই না। মনের সেই অন্ধকারের মধ্যে যে আলো প্রবেশ করছে না, সে কথা বলার সময় কোথায়? বিত্ত, প্রাচুর্যের অহংকার আর আপাত সাফল্যের ঘোর কী আমাদের অন্ধ করে দিচ্ছে?’
কিন্তু কেন মানুষের বিবেক মারা গেল? ক্রমশ কেন বর্বর হয়ে গেলাম আমি, আপনি, তুমি, সে। এ কী সভ্যতার অভিশাপ? বিশাল বিশাল বাহিনী তৈরি করলেই যে রাষ্ট্র মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না তারও কী প্রমাণ নয় এসব ঘটনা। একসময় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বেডরুমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। এখন দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র মায়ের পেটের সন্তানের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারছে না। ছোট্ট সুমাইয়া পৃথিবীতে আসার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এমন ঘটনা কী পৃথিবীতে আগে কখনও ঘটেছিল?
ক্ষমতার লোভ কী আমাদের বিবেক অন্ধ করে দিয়েছে। আইনের শাসন কখন ভেঙে পড়ে? অপরাধীরা যখন নিশ্চিত হয়, নিরপরাধী যখন আতঙ্কে থাকেন, তখনই তো আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। সীমাহীন লোভের কাছে মানুষ নিজেই কী হেরে গেছে। না যন্ত্রসভ্যতা মুছে দিয়েছে মানুষের সব আবেগ, সব মানবিকতা। অন্যের বিনাশেই কী এখন মুক্তি খুঁজছে মানুষ। নৈতিকতার জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে মেকি নৈতিকতা। আদিম সমাজে যখন কোন রাষ্ট্র ছিল না, কোন বাহিনী ছিল না, সেই অর্থে কোন নৈতিকতাও ছিল না। তখনও কী মানুষ এতটা নিষ্ঠুর ছিল?
মানবিকতার সঙ্কটের এই সময়ে প্রার্থনা করি, মৃত বিবেক জেগে ওঠুক। বন্ধ হোক এই হত্যা, এই বর্বরতা।
No comments