বিভক্তির কবলে বিশ্বাস ৬: সিভিল সোসাইটি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক by মনির হায়দার
দেশে
সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ায় বিশেষ
উদ্বিগ্ন উত্তর আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করছেন,
নাগরিক সমাজের তৎপরতার পরিসর সংকুচিত করে দেয়ার চলমান ধারা রাষ্ট্রের জন্য
বিপজ্জনক। আর তাই নানামুখী বৈরিতার মধ্যেও যারা ঝুঁকি নিয়ে এখনও সিভিল
সোসাইটির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাদের উচিত হবে যে করেই হোক
নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয়ে নাগরিকদের অধিকার প্রশ্নে একটা কার্যকর অবস্থান
গ্রহণ করা। মানবজমিন প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, বাস্তবতা হলো
আশির দশকে দেশে যখন গণতন্ত্র ছিলনা, সেই সময় নাগরিক সমাজ বেশ সোচ্চার
ছিল। কিন্তু নব্বই দশকের গোড়ার দিকে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার
পর থেকেই অপ্রত্যাশিত ভাবে নাগরিক সমাজ ধ্বংসের ধারা শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন
সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় বসে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে
সিভিল সোসাইটির কার্যক্রম ধ্বংস করেছে। সব সরকারই সিভিল সোসাইটির সদস্যদের
কোনরকম সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবি দিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছে,
এখনও করছে। রাজনীতিকরা হয়তো মনে করছেন যে, দেশে সিভিল সোসাইটি থাকার দরকার
নেই, সবাই তাদের পক্ষে চলে আসুক। রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিকভাবে এটাকে
নিজেদের জন্য সুবিধাজনক মনে করলেও অনিবার্য বাস্তবতা হলো, সিভিল সোসাইটির
অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়াটা আদতে রাজনৈতিক দলের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি ডেকে
আনবে। তারা বলেন, এখন কেবল সিভিল সোসাইটিকে পুনরুজ্জীবিত করাই নয়, দেশে
একটা কার্যকর নাগরিক অধিকার আন্দোলন তথা সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে তোলাও
জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রফেসর জিল্লুর আর খান বলেন, গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল যেমন দরকার, তেমনি সক্রিয় নাগরিক সমাজও অত্যাবশ্যক। তা না হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভারসাম্য থাকে না। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এই চিত্রটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। যদিও কিছু কিছু থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ও সিভিল সোসাইটি সংগঠন কাজ করছে, তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশেও সরকার তথা রাষ্ট্র এসব তৎপরতাকে উৎসাহিত করে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এ কারণে এখানে নাগরিক সমাজের টিকে থাকা খুব সহজ কাজ নয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্র চাইলে বিরোধীদল ও ভিন্নমতকে সম্মান করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিরোধী দলকে সংসদে ডেপুটি স্পিকারের পদটি দেওয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে পরস্পরের প্রতি আস্থার সংকট আরও বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অবশ্য তিনি আশা ছেড়ে না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের অবস্থাতো অন্তত সে সব দেশের চেয়ে ভাল, যেখানে নাগরিক সমাজের তৎপরতা এবং থিংকট্যাঙ্কের কর্মকাণ্ড এক্কেবারে শূন্যের কোঠায়। রাশিয়াতো সামপ্রতিক সময়ে নতুন করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বন্ধ করে দিচ্ছে। আর চীনে এগুলোর অস্বিত্বকেই শিকার করা হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো এখানে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল নাগরিক সমাজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মানতে নারাজ। তারা উভয়েই চেষ্টা করে যেন নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের পক্ষে কথা বলে। অথচ আশির দশকে এরশাদ শাসনামলে নাগরিক সমাজ তথা সিভিল সোসাইটি বেশ জোরালোভাবে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু নব্বইয়ে গণতন্ত্রে পুনর্যাত্রার পর থেকে নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব ক্রমশ: ধ্বংস হয়েছে। সাংবাদিকদেরকে দুই ভাগ করে দেয়া হলো। এরপর একে একে ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সবাইকেই দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। গোটা দেশটাই এখন যেন দুই ভাগে বিভিক্ত। যারাই যখন ক্ষমতায় বসেছে তারাই সিভিল সোসাইটির অংশবিশেষকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছে। এটা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই কার্যত ধীরে ধীরে সিভিল সোসাইটির ধারণাটাকেই রীতিমতো নিঃশেষ করে দিয়েছে, যা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমন দলীয়করণ দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর হবে, যা হয়তো তারা এখন বুঝতে পারছেন না।
আলী রীয়াজ বলেন, এমন বৈরী পরিস্থিতি সত্ত্বেও এখনও কিছু লোক ঝুঁকি নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। তাদের উচিত হবে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূলে চলে যাওয়ার আগেই নিজেরা নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয়ে নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে একটা কার্যকর অবস্থান গ্রহণ করা। এটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ, কিন্তু এর কোন বিকল্পও নেই। সুতরাং যারা করবেন, তাদেরকে ঝুঁকি নিয়েই কাজটি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে মূলত নাগরিকদের অধিকার নিয়ে সে রকম কোন আন্দোলন কখনই হয়নি। ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক লড়াইয়ের বাইরে আর কোন লড়াই নেই। অথচ দেশে এখন ব্যাপকভিত্তিক একটি নাগরিক অধিকার আন্দোলন তথা সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে ওঠাটাই বেশি জরুরি। কারণ নির্বাচনের নামে ১৫৩টি আসনে কোন ভোট ছাড়াই এমপি নির্বাচিত হয়ে গেল, কিন্তু সেখানে নাগরিকদের ভোটের অধিকার নিয়ে কোন কথা হচ্ছে না। এটা তো কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দলের একটি ইস্যু মাত্র নয়। জীবিকার আশায় শ’ শ’ তরুণ নৌকায় করে বিদেশ যেতে গিয়ে সমুদ্রে জীবন দিয়েছে। এটাও নাগরিক অধিকারের গুরুতর ইস্যু। অথচ এ নিয়ে কোন আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না। কেবলমাত্র বক্তৃতা- বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একটি সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্রে নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ শুরুর সময় একটি জাতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র হিসাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা রয়েছে। অথচ আমাদের আজকের রাষ্ট্রব্যবস্থা অব্যাহতভাবে সেই চুক্তিভঙ্গ করে চলেছে। কিন্তু সেটার বিরুদ্ধে আমরা কোন নাগরিক আন্দোলন দেখছি না।
সিনিয়র সাংবাদিক মনজুর আহমদ বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের পুরো সমাজটাই আজ বিভক্ত। খুব স্থূলভাবে এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ বলে দু’টি ভাগ করা হচ্ছে। অথচ আমরা দেখেছি যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই সেটার বিরোধিতা করেছিল। দেশের প্রায় সকল মানুষ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে যে, বিরাট জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শিবিরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কথা বললেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বড় অংশটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ায় সিভিল সোসাইটির অস্তিত্ব এখন রীতিমতো হুমকির মুখে। দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বলেন, এখন যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবী, তারা এমনকি বিরোধী দল তথা যে কোন ভিন্নমতের শক্তিকে নিষ্ঠুরভাবে নির্মূল বা দমনের প্রক্রিয়াকে নির্দ্বিধায় সমর্থন জানিয়ে দিচ্ছেন এবং সেটার পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করছেন। তাদের কাছে নাগরিক অধিকার বা মানবাধিকারের প্রসঙ্গে আজ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। মনজুর আহমদ বলেন, তবে এ অবস্থা আর বেশি দিন চলতে পারে না। দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। মানুষ বিএনপি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা নাও করতে পারে। নাগরিক সমাজের বহু মানুষ এখনও কোন পক্ষ নেননি। পরিস্থিতির কারণে তারা হয়ত নির্লিপ্ত বা চুপচাপ আছেন। কিন্তু দমবন্ধ অবস্থা ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সংগঠিত হয়ে মাঠে নেমে আসতে পারেন এবং তখন দেখা যাবে যে, জনগণ তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
টরন্টো প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট এম শহিদুল ইসলাম বলেন, সিভিল সোসাইটির আজকের করুণ দশার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বড় দুই দলের নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতা। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কারও ওপর নাখোশ হলেই তার অসম্মানিত হওয়া ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বর্তমান পর্যায়ে এসে নাগরিক সমাজের অনেকেই আপাতত সেই ঝুঁকিটা হয়তো নিতে চাইছেন না। সকলেই এখন নিজের মান-সম্মান ও পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অথচ সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের জন্য কিছু নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষ দরকার, যারা শাসকচক্রের রোষানলে পড়ার সাহস দেখাবে। দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে সাহসী লোকের সংখ্যা অস্বাভাবিক কমে গেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছেন যে, নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের কোন প্রয়োজন নেই। কোন কারণে বুদ্ধিজীবী দরকার হলে তাদের কিনতে পাওয়া যায়। পরিতাপের বিষয় হলো, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীকে সত্যিই কিনতে পাওয়া যায়। কারণ মূল্যবোধ ও নীতি- নৈতিকতার অবক্ষয় চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। তবে এটাই আসার কথা যে, আমরা এখন পচনের শেষ ধাপে আছি এবং এখান থেকেই হয়তো ঘুরে দাঁড়াবার পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
প্রফেসর জিল্লুর আর খান বলেন, গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল যেমন দরকার, তেমনি সক্রিয় নাগরিক সমাজও অত্যাবশ্যক। তা না হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভারসাম্য থাকে না। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এই চিত্রটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। যদিও কিছু কিছু থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ও সিভিল সোসাইটি সংগঠন কাজ করছে, তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশেও সরকার তথা রাষ্ট্র এসব তৎপরতাকে উৎসাহিত করে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এ কারণে এখানে নাগরিক সমাজের টিকে থাকা খুব সহজ কাজ নয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্র চাইলে বিরোধীদল ও ভিন্নমতকে সম্মান করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিরোধী দলকে সংসদে ডেপুটি স্পিকারের পদটি দেওয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে পরস্পরের প্রতি আস্থার সংকট আরও বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অবশ্য তিনি আশা ছেড়ে না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের অবস্থাতো অন্তত সে সব দেশের চেয়ে ভাল, যেখানে নাগরিক সমাজের তৎপরতা এবং থিংকট্যাঙ্কের কর্মকাণ্ড এক্কেবারে শূন্যের কোঠায়। রাশিয়াতো সামপ্রতিক সময়ে নতুন করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বন্ধ করে দিচ্ছে। আর চীনে এগুলোর অস্বিত্বকেই শিকার করা হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো এখানে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল নাগরিক সমাজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মানতে নারাজ। তারা উভয়েই চেষ্টা করে যেন নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের পক্ষে কথা বলে। অথচ আশির দশকে এরশাদ শাসনামলে নাগরিক সমাজ তথা সিভিল সোসাইটি বেশ জোরালোভাবে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু নব্বইয়ে গণতন্ত্রে পুনর্যাত্রার পর থেকে নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব ক্রমশ: ধ্বংস হয়েছে। সাংবাদিকদেরকে দুই ভাগ করে দেয়া হলো। এরপর একে একে ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সবাইকেই দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। গোটা দেশটাই এখন যেন দুই ভাগে বিভিক্ত। যারাই যখন ক্ষমতায় বসেছে তারাই সিভিল সোসাইটির অংশবিশেষকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছে। এটা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই কার্যত ধীরে ধীরে সিভিল সোসাইটির ধারণাটাকেই রীতিমতো নিঃশেষ করে দিয়েছে, যা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমন দলীয়করণ দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর হবে, যা হয়তো তারা এখন বুঝতে পারছেন না।
আলী রীয়াজ বলেন, এমন বৈরী পরিস্থিতি সত্ত্বেও এখনও কিছু লোক ঝুঁকি নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। তাদের উচিত হবে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূলে চলে যাওয়ার আগেই নিজেরা নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয়ে নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে একটা কার্যকর অবস্থান গ্রহণ করা। এটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ, কিন্তু এর কোন বিকল্পও নেই। সুতরাং যারা করবেন, তাদেরকে ঝুঁকি নিয়েই কাজটি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে মূলত নাগরিকদের অধিকার নিয়ে সে রকম কোন আন্দোলন কখনই হয়নি। ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক লড়াইয়ের বাইরে আর কোন লড়াই নেই। অথচ দেশে এখন ব্যাপকভিত্তিক একটি নাগরিক অধিকার আন্দোলন তথা সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে ওঠাটাই বেশি জরুরি। কারণ নির্বাচনের নামে ১৫৩টি আসনে কোন ভোট ছাড়াই এমপি নির্বাচিত হয়ে গেল, কিন্তু সেখানে নাগরিকদের ভোটের অধিকার নিয়ে কোন কথা হচ্ছে না। এটা তো কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দলের একটি ইস্যু মাত্র নয়। জীবিকার আশায় শ’ শ’ তরুণ নৌকায় করে বিদেশ যেতে গিয়ে সমুদ্রে জীবন দিয়েছে। এটাও নাগরিক অধিকারের গুরুতর ইস্যু। অথচ এ নিয়ে কোন আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না। কেবলমাত্র বক্তৃতা- বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একটি সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্রে নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ শুরুর সময় একটি জাতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র হিসাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা রয়েছে। অথচ আমাদের আজকের রাষ্ট্রব্যবস্থা অব্যাহতভাবে সেই চুক্তিভঙ্গ করে চলেছে। কিন্তু সেটার বিরুদ্ধে আমরা কোন নাগরিক আন্দোলন দেখছি না।
সিনিয়র সাংবাদিক মনজুর আহমদ বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের পুরো সমাজটাই আজ বিভক্ত। খুব স্থূলভাবে এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ বলে দু’টি ভাগ করা হচ্ছে। অথচ আমরা দেখেছি যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই সেটার বিরোধিতা করেছিল। দেশের প্রায় সকল মানুষ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে যে, বিরাট জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শিবিরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কথা বললেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বড় অংশটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ায় সিভিল সোসাইটির অস্তিত্ব এখন রীতিমতো হুমকির মুখে। দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বলেন, এখন যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবী, তারা এমনকি বিরোধী দল তথা যে কোন ভিন্নমতের শক্তিকে নিষ্ঠুরভাবে নির্মূল বা দমনের প্রক্রিয়াকে নির্দ্বিধায় সমর্থন জানিয়ে দিচ্ছেন এবং সেটার পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করছেন। তাদের কাছে নাগরিক অধিকার বা মানবাধিকারের প্রসঙ্গে আজ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। মনজুর আহমদ বলেন, তবে এ অবস্থা আর বেশি দিন চলতে পারে না। দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। মানুষ বিএনপি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা নাও করতে পারে। নাগরিক সমাজের বহু মানুষ এখনও কোন পক্ষ নেননি। পরিস্থিতির কারণে তারা হয়ত নির্লিপ্ত বা চুপচাপ আছেন। কিন্তু দমবন্ধ অবস্থা ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সংগঠিত হয়ে মাঠে নেমে আসতে পারেন এবং তখন দেখা যাবে যে, জনগণ তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
টরন্টো প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট এম শহিদুল ইসলাম বলেন, সিভিল সোসাইটির আজকের করুণ দশার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বড় দুই দলের নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতা। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কারও ওপর নাখোশ হলেই তার অসম্মানিত হওয়া ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বর্তমান পর্যায়ে এসে নাগরিক সমাজের অনেকেই আপাতত সেই ঝুঁকিটা হয়তো নিতে চাইছেন না। সকলেই এখন নিজের মান-সম্মান ও পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অথচ সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের জন্য কিছু নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষ দরকার, যারা শাসকচক্রের রোষানলে পড়ার সাহস দেখাবে। দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে সাহসী লোকের সংখ্যা অস্বাভাবিক কমে গেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছেন যে, নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের কোন প্রয়োজন নেই। কোন কারণে বুদ্ধিজীবী দরকার হলে তাদের কিনতে পাওয়া যায়। পরিতাপের বিষয় হলো, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীকে সত্যিই কিনতে পাওয়া যায়। কারণ মূল্যবোধ ও নীতি- নৈতিকতার অবক্ষয় চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। তবে এটাই আসার কথা যে, আমরা এখন পচনের শেষ ধাপে আছি এবং এখান থেকেই হয়তো ঘুরে দাঁড়াবার পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
No comments