সাংস্কৃতিক জাগরণই সব অন্ধকার দূর করতে পারে by ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
জঙ্গি
তৎপরতা নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার এবং দায়িত্বশীল কিছু পত্রপত্রিকা ও
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দায়িত্বশীলরা যতটা সচেতনতার পরিচয় দিচ্ছেন বৃহত্তর
জনসাধারণের মধ্যে ততটা সচেতনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিষয়টি মনে হয় আরো
তলিয়ে দেখার দাবি রাখে। এই লেখায় সেই চেষ্টা কিছুটা করা হলো। তবে শুরুতে
দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় জিহাদি গোষ্ঠী কিংবা দল নানা নামে বেশকিছু সংগঠন
সক্রিয় রয়েছে কিংবা সক্রিয় হচ্ছে, প্রায়শ তাদের আক্রমণ, হত্যা ও ধরপাকড়ের
সংবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারছে এবং এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরই
মধ্যে জঙ্গিরা বেশ ক’জন মুক্তমনা লেখককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, কয়েকজন
জঙ্গি ধরা পড়েছে, তাতে উঠতি বয়সের তরুণদের যুক্ত হওয়া, হত্যাকাণ্ডে অংশ
নেয়া ইত্যাদি নানা বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ নানা নামের জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশীয় তরুণদের ওপর শুধু নয়, বিদেশি জঙ্গিবাদী বেশকিছু সংগঠনের মতাদর্শগত চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ, আর্থিক এবং সামরিক প্রশিক্ষণসহ নানা সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের আর্থিকসহ নানা ধরনের সহযোগিতার ধরন-ধারণগুলো এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে এরা যন্ত্রপ্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, অনলাইনের ব্যবহার ইত্যাদিতে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। কেননা, এদের সঙ্গে আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসাপড়ুয়া কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী যেমন রয়েছে, অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষজনও জড়িত রয়েছে বলে তথ্যে প্রকাশ। তারা দেশের বাইরে কোনো দেশে গিয়ে অথবা বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য নিজেদের উৎসর্গীকৃত করছেন। তবে উৎসর্গের পথটি তাদের মোটেও মানবিক বা যুক্তিসঙ্গত নয় বরং নির্মম এবং পৈশাচিক। নৃশংসতার প্রতীক হতেও তাদের মানা নেই। নিজেদের বিশ্বাসকে নিরঙ্কুশভাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতে গিয়ে এসব সংগঠনের কর্মীরা সমাজের উদারবাদী ও যুুক্তিবাদী মানুষ যারা কাউকে জোর করে নয় বরং নিজেদের লেখালেখির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করছেন, চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করছেন তাদের হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এরা মানুষ হত্যা করাকে তাদের ‘পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব’ বলে বিশ্বাস করছে। এমন পর্যায়ে চিন্তা করতে শেখা, অমানবিক এবং নৃশংসতাকে বাস্তবায়ন করতে দ্বিধা না করা মোটেও সহজ কাজ নয়। ধর্মীয়ভাবে এসব অপকাণ্ড সমর্থিত হতে পারে না। ইসলাম এমন অপকাণ্ডে কখনোই সায় দেয় না। বিষয়গুলো নিয়ে মিডিয়ায় অনেক কিছু লেখা হচ্ছে, বলা বলিও হচ্ছে। তারপরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ-তরুণী ধর্মীয় উগ্রপন্থির অবস্থান থেকে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাত্ম হচ্ছে, নিজেদের বিলিয়ে দিতে চাচ্ছে এবং পরকালে এর প্রতিদান পেতে প্রয়োজনে আত্মঘাতী হামলায়ও অংশ নিচ্ছে। নিজের জীবনকে এতখানি পর্যন্ত সঁপে দেয়ার জন্য যেসব তরুণ জঙ্গিবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, সংগঠনের নেতার সিদ্ধান্ত মানতে তৎপর রয়েছে, সেসব তরুণের মনোজগতের গঠনকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
সাংস্কৃতিক জাগরণই সব অন্ধকার দূর করতে পারেবাংলাদেশে জঙ্গিবাদী সংগঠনের উত্থান আশির দশকে শুরু হয়েছে। মূলত আফগান সংকটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উগ্রধর্মীয় গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যখন তালেবানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান শুরু করে তখন বেশকিছু মাদ্রাসা ছাত্র, শিক্ষক, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে এক সময় সক্রিয় ছিল এমন কিছু নেতাকর্মী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও যুদ্ধে অংশ নেয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা বদর ও শামস বাহিনীতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অংশ নিয়ে গণহত্যাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যায় অংশ নেয় যা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এখানেও উগ্র, হঠকারী, মানবতাবিরোধী মানসিকতার স্ফুরণ ঘটতে দেখা যায়। সত্তর দশকে ভিন্ন বাস্তবতায় এদের উত্থানের শুরুতে ওই দশকের মাঝামাঝি থেকে একত্রিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যের অবতরণের বিষয়টিকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুনভাবে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে বিভিন্ন দেশ থেকে বেশকিছু তরুণ পাকিস্তানে অস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সরকার উৎখাত এবং সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়নে যুক্ত হয়। বিষয়টিকে তাদের কাছে ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব হিসেবে তখন দেখানো হয়। এক সময় সোভিয়েত বাহিনী চলে গেলেও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকার উৎখাতে অংশ নেয়ার তরুণরা দেশে বা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন স্থানে নানা সংঘাতকে তাদের মতো করে দেখাতে শুরু করে। এদের মাধ্যমে জন্ম নিতে থাকে নানা ধরনের জঙ্গিবাদী সংগঠন। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের সংগঠনও গড়ে ওঠে। তালেবান-আলকায়দা সংগঠন নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে আর্থিক, সামরিক এবং আদর্শিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এরই মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রজঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোকে বিশ্ব মতাদর্শের বিরোধ ও দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ বিগ্রহের অবস্থানে একটি নতুন জায়গা দেখিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে প্রলেতারিয়েত আন্তর্জাতিকবাদের নামে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রণোদনা জুগিয়েছিল তা বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নিয়মতান্ত্রিক ধারায় নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও মাঠপর্যায়ে অনেক তথাকথিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন তা ধারণ করার ক্ষেত্রে সশস্ত্র পন্থায় বিপ্লব সংঘটিত করার ধারায় পরিচালিত হয়। তখন এমন কাজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক দেশেই নানা ধরনের উগ্র হঠকারী বিপ্লবী ছোট ছোট সংগঠন গড়ে ওঠে যেগুলো শেষ পর্যন্ত মার্কসবাদী রাজনীতির বুকে ছুরিকাঘাত করেছিল। এটি মূলত মার্কসবাদী তত্ত্ব বোঝা এবং প্রয়োগ ঘটানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতাকর্মীদের জ্ঞানগত অভাবের কারণেই বেশি ঘটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সর্বত্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার বিষয়টি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেই সময় অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে আদর্শিক জায়গায় স্থান করে নেয়ার জন্য আল কায়েদাসহ এসব ধর্মীয় নামধারী সংগঠনের উদ্যোগ ও আবির্ভাব ঘটে। যদিও ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে একটি বিজয় ঘটেছিল, কিন্তু যেহেতু ইরান একটি শিয়া অধ্যুষিত দেশ তাই ইরানের প্রভাব এসব সংগঠনে খুব বেশি ঘটানো সম্ভব হয়নি। সৌদি আরব প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংগঠনকে আন্তর্জাতিকভাবে মদদ না দিলেও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, তুরস্কসহ অপেক্ষাকৃত দুর্বল মুসলিম দেশগুলোর নানা গোষ্ঠী আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামি বিপ্লব সংঘটনে বিভিন্ন তাত্ত্বিক, আর্থিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইসলামের মূল্যবোধ ও চেতনায় যদি প্রকৃতই শানিত হওয়া যায় তাহলে বর্বরতা পৈশাচিকতা-নৃশংসতার সব শিকড় উপড়ে ফেলা সহজ হবে। কারণ ইসলাম মানবিক হতে শিক্ষা দেয়। উগ্রবাদের স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম মহানুভবতার শিক্ষা দেয়।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এসব সংগঠনে নানা ভাঙাগড়া যেমন ঘটেছে, আবার নতুন নতুন শক্তির আবির্ভাবও ঘটেছে। অর্থ, সাংগঠনিক সংযোগ এবং জনবল সংগ্রহ করার দিক থেকে তালেবান-আল কায়েদা বাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর প্রভাব পড়ে আমাদের মতো দেশগুলোর তরুণদের একটি অংশের ওপর। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রচুর অর্থ মিডিয়ায় লগ্নি করে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে তারা দেশে দেশে তরুণদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিতটাকে এমনভাবে পোক্ত করার চেষ্টা করেছে যে, তাতে অন্য কোনো ধর্মের সঙ্গে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক রয়েছে এমনটি প্রতিভাত হয় না। এর ফলে উঠতি বয়সের তরুণ মানসের গঠন এক রৈখিকভাবে হতে বাধ্য হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একাংশ এসব প্রচার-প্রচারণায় ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। এরা সর্বজনীন ধারণা গড়ার শিক্ষা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয়। অনেকের পক্ষেই এসব জটিল ধর্মীয় কথাবার্তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা, ভিন্ন ব্যাখ্যা ও বিতর্কের যুক্তি বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিষয়গুলো বুঝতে হয় জ্ঞানবিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণকে হাজির করে। বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও জনপদের মানুষকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সুমহান সৃষ্টি হিসেবে দেখার শিক্ষাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা। সব সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রদর্শনপূর্বক সৃষ্টিকর্তার অসীমতাকে বোঝার চেষ্টা করব, তেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার বিষয়টি ১৫ থেকে ২০-২৫ বছরের তরুণ-তরুণীর পক্ষে বোঝা খুব বেশি সম্ভব হয়নি। এসব কিছু জানা এবং বোঝার বিষয়টি হতে হয় জীবনভর। আমি ২০ বছর বয়সে যা বুঝব না নিশ্চয়ই ৩০ বছরে তা অনেক বেশি বুঝব। ৪০, ৫০ বা ৬০ বছর বয়সে আরো অনেক বেশি গভীরতাকে স্পর্শ করা যেতে পারে। আসলে ধর্মের নানা দিক বোঝার জন্যও যে কোনো মানুষের পর্যাপ্ত সময়, অধ্যবসায়, জ্ঞান, গবেষণা ও ধৈর্যের যথেষ্ট প্রয়োজন। একজন ১৫-২০ বছরের তরুণের মন অনেক বেশি অপরিপক্ব, বিশ্বাসকেন্দ্রিক এবং সরল, আবেগনির্ভর থাকে। তাকে চরমপন্থায় ঠেলে দেয়া যত সহজ একজন অভিজ্ঞ বয়স্ক, অনেক বেশি পড়াশোনা জানা মানুষকে উগ্র, হঠকারী পথে ঠেলে দেয়া মোটেও তত সহজ কাজ নয়।
আমাদের দেশে যেসব তরুণ এসব উগ্র, হঠকারী, জঙ্গিবাদী সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২০-এর নিচে কিংবা ৩০-এর মধ্যে। এরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নানা অগভীর, যুক্তি ও তথ্য প্রমাণহীন ধর্মীয় আলোচনায় অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়। তাদের মধ্যে তখন যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এটি তাদের কোনো জঙ্গি সংগঠনের ভেতরে আবদ্ধ করে দেয়া খুবই সহজ। এককালে সর্বহারা মতবাদ গরিব, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের অনেক তরুণকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছিল, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হয়েছিল এবং গুপ্ত হত্যা সংঘটনে লিপ্ত হয়েছিল। যারা একজন ধনীর গলা কেটে ‘সমাজ বিপ্লব’ তথা সাম্যবাদ কায়েম করার মন্ত্রে পা বাড়িয়েছিল, তাদের পথ হারানোর বিষয়টি ছিল আবেগ এবং অজ্ঞানতা দ্বারা বিপ্লবীতত্ত্বকে বুঝতে যাওয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমাজ বিপ্লবের জটিল জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না লাভ করেই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য ‘শ্রেণীশত্রু খতম’ করার হিংস্র অমানবিক পথে যুক্ত হওয়া তাদের দর্শন হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একইভাবে ইসলাম ধর্মের পবিত্র শিক্ষাকে ঠিকভাবে বোঝার পরিবর্তে অল্প কিছু বিষয় শুনে আবেগ, অজ্ঞানতায় ও উগ্রতায় যুক্ত হয়ে অনেক তরুণই জঙ্গিবাদী সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে। ‘নাস্তিক খতম’ করার নামে তারা মানুষ হত্যার অপরাধ ও পাপকে অবজ্ঞা করছে। নিজের মানবিকতাকে বিকশিত না করে জলাঞ্জলি দিয়ে বেড়ে উঠেছে। যে কোনো উগ্রবাদী চিন্তায় বেড়ে ওঠা যে কোনো তরুণের পরিণতি শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকরই হয়। মানুষের মধ্যে যারা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষা, সংস্কৃতির বিষয়গুলো জীবনভর শেখার চিরন্তন ধারায় যুক্ত করতে সচেষ্ট থাকেন তারা সত্যিকার জ্ঞান এবং সমস্যা ও সমাধানের পথের সন্ধান করতে পারেন। যারা বিপ্লব ঘটানোর মতো অবাস্তব কল্পনায় নেমে পড়েন নিজের জীবনের মূল্য তখন তার কাছে যেমন কানাকড়ির চাইতেও কম মনে হয়, অন্যের জীবনও তেমন মূল্যহীনভাবে দেখা হয়। মানুষের বেড়ে ওঠার এমন সংকট যে কোনো জঙ্গি বা উগ্রবাদী সংগঠনের কারণে বহুগুণ বাড়তে পারে। এ কারণেই দরকার সাংস্কৃতিক জাগরণ। এই জাগরণই সব অন্ধকার দূর করতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এ মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে আল কায়েদার জায়গা অনেকটাই আইএস নামক আরেক উগ্রবাদী সংগঠন নিতে পেরেছে। একটি খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ওই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আইএসের সঙ্গে যুক্ত হতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বলে সংবাদে প্রকাশ। ব্রিটেনে বসবাসকারী তিনজন তরুণী এমন উন্মাদনায় মত্ত হয়ে ব্রিটেন ছেড়ে আইএসেতে যোগদান করেছিল। তাদের ‘গণিমতের মালের মতো’ ব্যবহার করার সংবাদ শুনে দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু সেই তরুণী তিনজনের বিশ্বাসের জগতে এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা কতখানি কার্যকর তা বোঝা দরকার। তবে আমাদের মানসে খিলাফত সম্পর্কে যে ধারণা বিরাজ করছে তার সঙ্গে আইএস কর্তৃক দাবিকৃত ভবিষ্যৎ খিলাফত রাষ্ট্রের কতটা মিল রয়েছে, বাস্তবে তেমন রাষ্ট্র গঠিত হবে কিনা, এসব জটিল বিষয় অনেকেই গভীরভাবে না ভেবে সরল বিশ্বাসেই জঙ্গি সংগঠনের ফাঁদে পা দিচ্ছে।
তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের হামলা ও তৎপরতা চলছে এগুলোতে প্রতি দেশের তরুণদের ছোট একটি অংশের সমর্থন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থান এক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট। তারা স্পষ্টতই এমন পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে। এসব সংগঠন এবং জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের দেশের যেসব মানুষ এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানায় তাদের প্রতি ঘৃণা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতে হবে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো জনমত তৈরি করতে হবে। আমাদের নিজ নিজ পরিবারের কোনো তরুণই যেন এতে বিভ্রান্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে জঙ্গিবাদী সংগঠনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেই। চরমপন্থি দলগুলো যেমন হারিয়ে গেছে পবিত্র ধর্মের নামে উগ্রপন্থির, রাজনীতিও পৃথিবীতে কিছু ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতিসাধন করা ব্যতীত আদর্শিক কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। তারাও একদিন হারিয়ে যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে ধ্বংসাত্মক অনেক কিছুই তারা করে ফেলবে। সুতরাং বাস্তবতা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। সেভাবে ধর্ম শিক্ষা ও রাজনীতির শিক্ষা এবং প্রচার সর্বত্র সেভাবেই পরিচালিত করতে হবে। সরকার ও বেশকিছু গণমাধ্যম উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ-প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যেভাবে সজাগ রয়েছে, সতর্কতার সঙ্গে এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরছে এই কাজটি আরো বেগবান করতে হবে এবং সংস্কৃতি মনষ্ক সবাইকে এ জন্য দাঁড়াতে হবে এক কাতারে। এ কাজগুলো করতে হবে খুব দ্রুততার সঙ্গে। কারণ জঙ্গিবাদ কিংবা উগ্রবাদ যেভাবে বিস্তার লাভ করছে এখনই তা গোটানোর সব উদ্যোগ-আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে গভীর অন্ধকারে সব তলিয়ে যাবে এমনটি তো কাম্য হতে পারে না।
লেখক : ইতিহাসতত্ত্ব ও শিক্ষাবিদ
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ নানা নামের জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশীয় তরুণদের ওপর শুধু নয়, বিদেশি জঙ্গিবাদী বেশকিছু সংগঠনের মতাদর্শগত চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ, আর্থিক এবং সামরিক প্রশিক্ষণসহ নানা সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের আর্থিকসহ নানা ধরনের সহযোগিতার ধরন-ধারণগুলো এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে এরা যন্ত্রপ্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, অনলাইনের ব্যবহার ইত্যাদিতে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। কেননা, এদের সঙ্গে আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসাপড়ুয়া কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী যেমন রয়েছে, অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষজনও জড়িত রয়েছে বলে তথ্যে প্রকাশ। তারা দেশের বাইরে কোনো দেশে গিয়ে অথবা বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য নিজেদের উৎসর্গীকৃত করছেন। তবে উৎসর্গের পথটি তাদের মোটেও মানবিক বা যুক্তিসঙ্গত নয় বরং নির্মম এবং পৈশাচিক। নৃশংসতার প্রতীক হতেও তাদের মানা নেই। নিজেদের বিশ্বাসকে নিরঙ্কুশভাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতে গিয়ে এসব সংগঠনের কর্মীরা সমাজের উদারবাদী ও যুুক্তিবাদী মানুষ যারা কাউকে জোর করে নয় বরং নিজেদের লেখালেখির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করছেন, চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করছেন তাদের হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এরা মানুষ হত্যা করাকে তাদের ‘পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব’ বলে বিশ্বাস করছে। এমন পর্যায়ে চিন্তা করতে শেখা, অমানবিক এবং নৃশংসতাকে বাস্তবায়ন করতে দ্বিধা না করা মোটেও সহজ কাজ নয়। ধর্মীয়ভাবে এসব অপকাণ্ড সমর্থিত হতে পারে না। ইসলাম এমন অপকাণ্ডে কখনোই সায় দেয় না। বিষয়গুলো নিয়ে মিডিয়ায় অনেক কিছু লেখা হচ্ছে, বলা বলিও হচ্ছে। তারপরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ-তরুণী ধর্মীয় উগ্রপন্থির অবস্থান থেকে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাত্ম হচ্ছে, নিজেদের বিলিয়ে দিতে চাচ্ছে এবং পরকালে এর প্রতিদান পেতে প্রয়োজনে আত্মঘাতী হামলায়ও অংশ নিচ্ছে। নিজের জীবনকে এতখানি পর্যন্ত সঁপে দেয়ার জন্য যেসব তরুণ জঙ্গিবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, সংগঠনের নেতার সিদ্ধান্ত মানতে তৎপর রয়েছে, সেসব তরুণের মনোজগতের গঠনকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
সাংস্কৃতিক জাগরণই সব অন্ধকার দূর করতে পারেবাংলাদেশে জঙ্গিবাদী সংগঠনের উত্থান আশির দশকে শুরু হয়েছে। মূলত আফগান সংকটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উগ্রধর্মীয় গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যখন তালেবানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান শুরু করে তখন বেশকিছু মাদ্রাসা ছাত্র, শিক্ষক, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে এক সময় সক্রিয় ছিল এমন কিছু নেতাকর্মী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও যুদ্ধে অংশ নেয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা বদর ও শামস বাহিনীতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অংশ নিয়ে গণহত্যাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যায় অংশ নেয় যা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এখানেও উগ্র, হঠকারী, মানবতাবিরোধী মানসিকতার স্ফুরণ ঘটতে দেখা যায়। সত্তর দশকে ভিন্ন বাস্তবতায় এদের উত্থানের শুরুতে ওই দশকের মাঝামাঝি থেকে একত্রিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যের অবতরণের বিষয়টিকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুনভাবে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে বিভিন্ন দেশ থেকে বেশকিছু তরুণ পাকিস্তানে অস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সরকার উৎখাত এবং সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়নে যুক্ত হয়। বিষয়টিকে তাদের কাছে ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব হিসেবে তখন দেখানো হয়। এক সময় সোভিয়েত বাহিনী চলে গেলেও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকার উৎখাতে অংশ নেয়ার তরুণরা দেশে বা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন স্থানে নানা সংঘাতকে তাদের মতো করে দেখাতে শুরু করে। এদের মাধ্যমে জন্ম নিতে থাকে নানা ধরনের জঙ্গিবাদী সংগঠন। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের সংগঠনও গড়ে ওঠে। তালেবান-আলকায়দা সংগঠন নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে আর্থিক, সামরিক এবং আদর্শিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এরই মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রজঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোকে বিশ্ব মতাদর্শের বিরোধ ও দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ বিগ্রহের অবস্থানে একটি নতুন জায়গা দেখিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে প্রলেতারিয়েত আন্তর্জাতিকবাদের নামে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রণোদনা জুগিয়েছিল তা বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নিয়মতান্ত্রিক ধারায় নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও মাঠপর্যায়ে অনেক তথাকথিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন তা ধারণ করার ক্ষেত্রে সশস্ত্র পন্থায় বিপ্লব সংঘটিত করার ধারায় পরিচালিত হয়। তখন এমন কাজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক দেশেই নানা ধরনের উগ্র হঠকারী বিপ্লবী ছোট ছোট সংগঠন গড়ে ওঠে যেগুলো শেষ পর্যন্ত মার্কসবাদী রাজনীতির বুকে ছুরিকাঘাত করেছিল। এটি মূলত মার্কসবাদী তত্ত্ব বোঝা এবং প্রয়োগ ঘটানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতাকর্মীদের জ্ঞানগত অভাবের কারণেই বেশি ঘটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সর্বত্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার বিষয়টি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেই সময় অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে আদর্শিক জায়গায় স্থান করে নেয়ার জন্য আল কায়েদাসহ এসব ধর্মীয় নামধারী সংগঠনের উদ্যোগ ও আবির্ভাব ঘটে। যদিও ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে একটি বিজয় ঘটেছিল, কিন্তু যেহেতু ইরান একটি শিয়া অধ্যুষিত দেশ তাই ইরানের প্রভাব এসব সংগঠনে খুব বেশি ঘটানো সম্ভব হয়নি। সৌদি আরব প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংগঠনকে আন্তর্জাতিকভাবে মদদ না দিলেও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, তুরস্কসহ অপেক্ষাকৃত দুর্বল মুসলিম দেশগুলোর নানা গোষ্ঠী আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামি বিপ্লব সংঘটনে বিভিন্ন তাত্ত্বিক, আর্থিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইসলামের মূল্যবোধ ও চেতনায় যদি প্রকৃতই শানিত হওয়া যায় তাহলে বর্বরতা পৈশাচিকতা-নৃশংসতার সব শিকড় উপড়ে ফেলা সহজ হবে। কারণ ইসলাম মানবিক হতে শিক্ষা দেয়। উগ্রবাদের স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম মহানুভবতার শিক্ষা দেয়।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এসব সংগঠনে নানা ভাঙাগড়া যেমন ঘটেছে, আবার নতুন নতুন শক্তির আবির্ভাবও ঘটেছে। অর্থ, সাংগঠনিক সংযোগ এবং জনবল সংগ্রহ করার দিক থেকে তালেবান-আল কায়েদা বাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর প্রভাব পড়ে আমাদের মতো দেশগুলোর তরুণদের একটি অংশের ওপর। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রচুর অর্থ মিডিয়ায় লগ্নি করে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে তারা দেশে দেশে তরুণদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিতটাকে এমনভাবে পোক্ত করার চেষ্টা করেছে যে, তাতে অন্য কোনো ধর্মের সঙ্গে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক রয়েছে এমনটি প্রতিভাত হয় না। এর ফলে উঠতি বয়সের তরুণ মানসের গঠন এক রৈখিকভাবে হতে বাধ্য হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একাংশ এসব প্রচার-প্রচারণায় ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। এরা সর্বজনীন ধারণা গড়ার শিক্ষা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয়। অনেকের পক্ষেই এসব জটিল ধর্মীয় কথাবার্তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা, ভিন্ন ব্যাখ্যা ও বিতর্কের যুক্তি বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিষয়গুলো বুঝতে হয় জ্ঞানবিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণকে হাজির করে। বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও জনপদের মানুষকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সুমহান সৃষ্টি হিসেবে দেখার শিক্ষাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা। সব সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রদর্শনপূর্বক সৃষ্টিকর্তার অসীমতাকে বোঝার চেষ্টা করব, তেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার বিষয়টি ১৫ থেকে ২০-২৫ বছরের তরুণ-তরুণীর পক্ষে বোঝা খুব বেশি সম্ভব হয়নি। এসব কিছু জানা এবং বোঝার বিষয়টি হতে হয় জীবনভর। আমি ২০ বছর বয়সে যা বুঝব না নিশ্চয়ই ৩০ বছরে তা অনেক বেশি বুঝব। ৪০, ৫০ বা ৬০ বছর বয়সে আরো অনেক বেশি গভীরতাকে স্পর্শ করা যেতে পারে। আসলে ধর্মের নানা দিক বোঝার জন্যও যে কোনো মানুষের পর্যাপ্ত সময়, অধ্যবসায়, জ্ঞান, গবেষণা ও ধৈর্যের যথেষ্ট প্রয়োজন। একজন ১৫-২০ বছরের তরুণের মন অনেক বেশি অপরিপক্ব, বিশ্বাসকেন্দ্রিক এবং সরল, আবেগনির্ভর থাকে। তাকে চরমপন্থায় ঠেলে দেয়া যত সহজ একজন অভিজ্ঞ বয়স্ক, অনেক বেশি পড়াশোনা জানা মানুষকে উগ্র, হঠকারী পথে ঠেলে দেয়া মোটেও তত সহজ কাজ নয়।
আমাদের দেশে যেসব তরুণ এসব উগ্র, হঠকারী, জঙ্গিবাদী সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২০-এর নিচে কিংবা ৩০-এর মধ্যে। এরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নানা অগভীর, যুক্তি ও তথ্য প্রমাণহীন ধর্মীয় আলোচনায় অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়। তাদের মধ্যে তখন যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এটি তাদের কোনো জঙ্গি সংগঠনের ভেতরে আবদ্ধ করে দেয়া খুবই সহজ। এককালে সর্বহারা মতবাদ গরিব, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের অনেক তরুণকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছিল, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হয়েছিল এবং গুপ্ত হত্যা সংঘটনে লিপ্ত হয়েছিল। যারা একজন ধনীর গলা কেটে ‘সমাজ বিপ্লব’ তথা সাম্যবাদ কায়েম করার মন্ত্রে পা বাড়িয়েছিল, তাদের পথ হারানোর বিষয়টি ছিল আবেগ এবং অজ্ঞানতা দ্বারা বিপ্লবীতত্ত্বকে বুঝতে যাওয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমাজ বিপ্লবের জটিল জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না লাভ করেই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য ‘শ্রেণীশত্রু খতম’ করার হিংস্র অমানবিক পথে যুক্ত হওয়া তাদের দর্শন হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একইভাবে ইসলাম ধর্মের পবিত্র শিক্ষাকে ঠিকভাবে বোঝার পরিবর্তে অল্প কিছু বিষয় শুনে আবেগ, অজ্ঞানতায় ও উগ্রতায় যুক্ত হয়ে অনেক তরুণই জঙ্গিবাদী সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে। ‘নাস্তিক খতম’ করার নামে তারা মানুষ হত্যার অপরাধ ও পাপকে অবজ্ঞা করছে। নিজের মানবিকতাকে বিকশিত না করে জলাঞ্জলি দিয়ে বেড়ে উঠেছে। যে কোনো উগ্রবাদী চিন্তায় বেড়ে ওঠা যে কোনো তরুণের পরিণতি শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকরই হয়। মানুষের মধ্যে যারা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষা, সংস্কৃতির বিষয়গুলো জীবনভর শেখার চিরন্তন ধারায় যুক্ত করতে সচেষ্ট থাকেন তারা সত্যিকার জ্ঞান এবং সমস্যা ও সমাধানের পথের সন্ধান করতে পারেন। যারা বিপ্লব ঘটানোর মতো অবাস্তব কল্পনায় নেমে পড়েন নিজের জীবনের মূল্য তখন তার কাছে যেমন কানাকড়ির চাইতেও কম মনে হয়, অন্যের জীবনও তেমন মূল্যহীনভাবে দেখা হয়। মানুষের বেড়ে ওঠার এমন সংকট যে কোনো জঙ্গি বা উগ্রবাদী সংগঠনের কারণে বহুগুণ বাড়তে পারে। এ কারণেই দরকার সাংস্কৃতিক জাগরণ। এই জাগরণই সব অন্ধকার দূর করতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এ মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে আল কায়েদার জায়গা অনেকটাই আইএস নামক আরেক উগ্রবাদী সংগঠন নিতে পেরেছে। একটি খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ওই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আইএসের সঙ্গে যুক্ত হতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বলে সংবাদে প্রকাশ। ব্রিটেনে বসবাসকারী তিনজন তরুণী এমন উন্মাদনায় মত্ত হয়ে ব্রিটেন ছেড়ে আইএসেতে যোগদান করেছিল। তাদের ‘গণিমতের মালের মতো’ ব্যবহার করার সংবাদ শুনে দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু সেই তরুণী তিনজনের বিশ্বাসের জগতে এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা কতখানি কার্যকর তা বোঝা দরকার। তবে আমাদের মানসে খিলাফত সম্পর্কে যে ধারণা বিরাজ করছে তার সঙ্গে আইএস কর্তৃক দাবিকৃত ভবিষ্যৎ খিলাফত রাষ্ট্রের কতটা মিল রয়েছে, বাস্তবে তেমন রাষ্ট্র গঠিত হবে কিনা, এসব জটিল বিষয় অনেকেই গভীরভাবে না ভেবে সরল বিশ্বাসেই জঙ্গি সংগঠনের ফাঁদে পা দিচ্ছে।
তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের হামলা ও তৎপরতা চলছে এগুলোতে প্রতি দেশের তরুণদের ছোট একটি অংশের সমর্থন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থান এক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট। তারা স্পষ্টতই এমন পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে। এসব সংগঠন এবং জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের দেশের যেসব মানুষ এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানায় তাদের প্রতি ঘৃণা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতে হবে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো জনমত তৈরি করতে হবে। আমাদের নিজ নিজ পরিবারের কোনো তরুণই যেন এতে বিভ্রান্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে জঙ্গিবাদী সংগঠনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেই। চরমপন্থি দলগুলো যেমন হারিয়ে গেছে পবিত্র ধর্মের নামে উগ্রপন্থির, রাজনীতিও পৃথিবীতে কিছু ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতিসাধন করা ব্যতীত আদর্শিক কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। তারাও একদিন হারিয়ে যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে ধ্বংসাত্মক অনেক কিছুই তারা করে ফেলবে। সুতরাং বাস্তবতা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। সেভাবে ধর্ম শিক্ষা ও রাজনীতির শিক্ষা এবং প্রচার সর্বত্র সেভাবেই পরিচালিত করতে হবে। সরকার ও বেশকিছু গণমাধ্যম উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ-প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যেভাবে সজাগ রয়েছে, সতর্কতার সঙ্গে এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরছে এই কাজটি আরো বেগবান করতে হবে এবং সংস্কৃতি মনষ্ক সবাইকে এ জন্য দাঁড়াতে হবে এক কাতারে। এ কাজগুলো করতে হবে খুব দ্রুততার সঙ্গে। কারণ জঙ্গিবাদ কিংবা উগ্রবাদ যেভাবে বিস্তার লাভ করছে এখনই তা গোটানোর সব উদ্যোগ-আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে গভীর অন্ধকারে সব তলিয়ে যাবে এমনটি তো কাম্য হতে পারে না।
লেখক : ইতিহাসতত্ত্ব ও শিক্ষাবিদ
No comments