সাক্ষ্য আইন যুগোপযোগী হওয়া প্রয়োজন by নাওমী নাজ চৌধুরী
যদি একজন ধর্ষিতার ধর্ষণের পরবর্তী সময়ের মানসিক যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনা নিয়ে আপনার মনঃকষ্ট হয়, তবে চিন্তা করে দেখুন যে সেই মেয়েটির কী অবস্থা হয় যখন আদালতে তাঁরই চরিত্র নিয়ে তাঁকে অপ্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্নের জালে আটকা পড়তে হয়?
যেকোনো মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রমাণের ওপরেই জোর দেওয়া হয় বেশি। অন্তত স্বাভাবিক একটি বিচারপ্রক্রিয়ায় তা-ই হওয়া উচিত। কিন্তু একটি ধর্ষণের মামলায় বিচারকার্য ভিন্নভাবে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের আইনজীবী ধর্ষিতাকে তাঁর চরিত্র ও অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন, যার কারণে ওই মামলার সম্পূর্ণ মনোযোগ আসামি থেকে সরে যেতে বাধ্য। আইন যে শুধু এই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফল মামলায় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেয় তা নয়, এর ওপরে ভিত্তি করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত হওয়া বা সাজাপ্রাপ্ত হওয়া থেকেও তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে থাকে।
ঔপনিবেশিক সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ‘চরিত্র বিশ্লেষণ’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি ধর্ষণ মামলার বাদী যদি সাধারণভাবেই একজন অনৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী হন, তাহলে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর ধর্ষণকারীর বা হরণকারীর পক্ষে আদালতে ব্যবহার করা যাবে’, অন্যভাবে বলা যায়, ওই বিধানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বিচারকার্যে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ওই বিধান অনুযায়ী ‘বিচারকার্যকে’ অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
উচ্চ আদালতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) একটি গবেষণা করেছে। ঢাকা ল রিপোর্টস এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনে গত ১০ বছরে (২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত) প্রকাশিত সব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈবাহিক অবস্থান থেকে শুরু করে একজন ধর্ষিতার অতীত সম্পর্কের ইতিহাস আসামি দ্বারা নিজকে রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেসব বিবৃতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র [১৩ বিএলসি ২০০৮[ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তাঁর শিশুসহ তাঁর কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালানোর সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে তাঁর ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাঁকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয়, ‘...ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন...।’
রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য [২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাঁকে তাঁর নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল...’ এবং ‘এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না...’।
সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র ৫৭ ডিএলআর (এডি) (২০০৫) মামলায় আগের সম্পর্কের ইতিহাস টেনে আনা এবং ধর্ষিতার দ্বারা শারীরিক প্রতিরোধ প্রদর্শন করতে না পারার বিষয়ে দেওয়া অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আদালত আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন এবং অভিযোগকারীকে সম্মানের সঙ্গে এই বলেন যে ‘...যদি একজন নারী সহজেই একজন পুরুষের লালসার শিকার হন এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সামান্যতম বাধাও না দেন, যা তাঁর কাছে তাঁর জীবনের থেকেও মূল্যবান, তবে তা ধর্ষণ নয়...।’ এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী তাঁরই নিজ বাসায় তাঁর প্রতিবেশী দ্বারা ধর্ষিত হন, যিনি তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে বিয়ে করার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে আদালত অভিযোগকারীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তাঁর ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তাঁর সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারী ছিলেন একজন অল্প বয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তাঁর চাকরিদাতা দ্বারা ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে ‘...যেহেতু অভিযোগকারী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে ঢুকেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তাঁর দেওয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে...।’
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান ২৫ বিএলডি (এডি) (২০০৫) মামলায় আদালত বলেছিলেন, ‘...বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী...এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধর্ষণের মামলাকারীর চরিত্র এবং তাঁর আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন এ পর্যন্ত যে মামলাগুলো উল্লিখিত হয়েছে তার মধ্যে সব মামলাতেই দণ্ডাদেশ উচ্চ আদালতে খারিজ করা হয়েছিল শুধু একটি বাদে, যা ছিল ওই ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান মামলাটি। এখানে গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত আট পুরুষের মধ্যে পাঁচজনকেই সাজা দেওয়া হয়। তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়; তদুপরি আদালত উপলব্ধি করেন যে অভিযোগকারী একজন সুচরিত্রের অধিকারিণী। ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধর্ষণের মামলাকারীর চরিত্র এবং তাঁর আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন। এখানে খেয়াল করা অত্যন্ত জরুরি যে একটি ধর্ষণের মামলায় সাধারণত ধর্ষিতাই একমাত্র সাক্ষী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি তাঁর চরিত্র নিয়ে কোনো ইঙ্গিত করেন, তাতে তাঁর একান্ত সাক্ষ্য সহজেই আক্রান্ত হতে পারে। একজন ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার পথে এসব আইন বাস্তবে পর্বত প্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ধর্ষণের পরবর্তীকালে একজন ধর্ষিতা যে ধরনের সামাজিক চাপের সম্মুখীন হন, তা প্রায় সময়েই তাঁকে চুপ থাকতে এবং বিচার না চাইতে বাধ্য করে। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় যে ২০১৪ সালে ‘নারী ও শিশু নিপীড়নের’ (যাতে ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন অপরাধও অন্তর্ভুক্ত) ২১ হাজার ২৯১টি মামলা দায়ের করা হয়, যা ২০১৩ সালে দায়ের করা ১৯ হাজার ৬০১টি মামলা হতে সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। এর মধ্যে কতগুলো মামলার ফলাফল হিসেবে দণ্ড প্রদান করা হয়েছিল সে ব্যাপারটি অস্পষ্ট। ধর্ষণের শিকার যাঁরা হয়ে থাকেন বা হয়েছেন, তাঁদের প্রতিকারে এ ধরনের ১৪৩ বছর আগে অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন এই আইনটির কতিপয় বিধানের সংশোধন অতি জরুরি। একটি ধর্ষণের মামলায় ধর্ষিতার চরিত্রের প্রতি আঘাত করা এবং তাঁর আগেরযৌন সম্পর্কের ইতিহাস টেনে আনা যে তাঁর প্রতি কতটা অনুভূতিহীন এবং অপ্রাসঙ্গিকই শুধু নয়, তাঁকে একটি অগ্নিপরীক্ষায় পুনরায় ঠেলে দেওয়া এবং তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার অস্বীকার করার নামান্তরও বটে। এশিয়ার অনেক দেশের মতো তা উপলব্ধি করার সময় এখন বাংলাদেশেরও এসেছে।
নাওমী নাজ চৌধুরী: বার অ্যাট ল, আইনজীবী, ব্লাস্ট।
যেকোনো মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রমাণের ওপরেই জোর দেওয়া হয় বেশি। অন্তত স্বাভাবিক একটি বিচারপ্রক্রিয়ায় তা-ই হওয়া উচিত। কিন্তু একটি ধর্ষণের মামলায় বিচারকার্য ভিন্নভাবে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের আইনজীবী ধর্ষিতাকে তাঁর চরিত্র ও অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন, যার কারণে ওই মামলার সম্পূর্ণ মনোযোগ আসামি থেকে সরে যেতে বাধ্য। আইন যে শুধু এই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফল মামলায় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেয় তা নয়, এর ওপরে ভিত্তি করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত হওয়া বা সাজাপ্রাপ্ত হওয়া থেকেও তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে থাকে।
ঔপনিবেশিক সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ‘চরিত্র বিশ্লেষণ’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি ধর্ষণ মামলার বাদী যদি সাধারণভাবেই একজন অনৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী হন, তাহলে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর ধর্ষণকারীর বা হরণকারীর পক্ষে আদালতে ব্যবহার করা যাবে’, অন্যভাবে বলা যায়, ওই বিধানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বিচারকার্যে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ওই বিধান অনুযায়ী ‘বিচারকার্যকে’ অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
উচ্চ আদালতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) একটি গবেষণা করেছে। ঢাকা ল রিপোর্টস এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনে গত ১০ বছরে (২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত) প্রকাশিত সব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈবাহিক অবস্থান থেকে শুরু করে একজন ধর্ষিতার অতীত সম্পর্কের ইতিহাস আসামি দ্বারা নিজকে রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেসব বিবৃতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র [১৩ বিএলসি ২০০৮[ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তাঁর শিশুসহ তাঁর কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালানোর সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে তাঁর ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাঁকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয়, ‘...ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন...।’
রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য [২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাঁকে তাঁর নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল...’ এবং ‘এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না...’।
সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র ৫৭ ডিএলআর (এডি) (২০০৫) মামলায় আগের সম্পর্কের ইতিহাস টেনে আনা এবং ধর্ষিতার দ্বারা শারীরিক প্রতিরোধ প্রদর্শন করতে না পারার বিষয়ে দেওয়া অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আদালত আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন এবং অভিযোগকারীকে সম্মানের সঙ্গে এই বলেন যে ‘...যদি একজন নারী সহজেই একজন পুরুষের লালসার শিকার হন এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সামান্যতম বাধাও না দেন, যা তাঁর কাছে তাঁর জীবনের থেকেও মূল্যবান, তবে তা ধর্ষণ নয়...।’ এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী তাঁরই নিজ বাসায় তাঁর প্রতিবেশী দ্বারা ধর্ষিত হন, যিনি তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে বিয়ে করার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে আদালত অভিযোগকারীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তাঁর ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তাঁর সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারী ছিলেন একজন অল্প বয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তাঁর চাকরিদাতা দ্বারা ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে ‘...যেহেতু অভিযোগকারী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে ঢুকেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তাঁর দেওয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে...।’
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান ২৫ বিএলডি (এডি) (২০০৫) মামলায় আদালত বলেছিলেন, ‘...বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী...এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধর্ষণের মামলাকারীর চরিত্র এবং তাঁর আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন এ পর্যন্ত যে মামলাগুলো উল্লিখিত হয়েছে তার মধ্যে সব মামলাতেই দণ্ডাদেশ উচ্চ আদালতে খারিজ করা হয়েছিল শুধু একটি বাদে, যা ছিল ওই ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান মামলাটি। এখানে গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত আট পুরুষের মধ্যে পাঁচজনকেই সাজা দেওয়া হয়। তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়; তদুপরি আদালত উপলব্ধি করেন যে অভিযোগকারী একজন সুচরিত্রের অধিকারিণী। ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধর্ষণের মামলাকারীর চরিত্র এবং তাঁর আগের যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন। এখানে খেয়াল করা অত্যন্ত জরুরি যে একটি ধর্ষণের মামলায় সাধারণত ধর্ষিতাই একমাত্র সাক্ষী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি তাঁর চরিত্র নিয়ে কোনো ইঙ্গিত করেন, তাতে তাঁর একান্ত সাক্ষ্য সহজেই আক্রান্ত হতে পারে। একজন ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার পথে এসব আইন বাস্তবে পর্বত প্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ধর্ষণের পরবর্তীকালে একজন ধর্ষিতা যে ধরনের সামাজিক চাপের সম্মুখীন হন, তা প্রায় সময়েই তাঁকে চুপ থাকতে এবং বিচার না চাইতে বাধ্য করে। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় যে ২০১৪ সালে ‘নারী ও শিশু নিপীড়নের’ (যাতে ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন অপরাধও অন্তর্ভুক্ত) ২১ হাজার ২৯১টি মামলা দায়ের করা হয়, যা ২০১৩ সালে দায়ের করা ১৯ হাজার ৬০১টি মামলা হতে সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। এর মধ্যে কতগুলো মামলার ফলাফল হিসেবে দণ্ড প্রদান করা হয়েছিল সে ব্যাপারটি অস্পষ্ট। ধর্ষণের শিকার যাঁরা হয়ে থাকেন বা হয়েছেন, তাঁদের প্রতিকারে এ ধরনের ১৪৩ বছর আগে অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন এই আইনটির কতিপয় বিধানের সংশোধন অতি জরুরি। একটি ধর্ষণের মামলায় ধর্ষিতার চরিত্রের প্রতি আঘাত করা এবং তাঁর আগেরযৌন সম্পর্কের ইতিহাস টেনে আনা যে তাঁর প্রতি কতটা অনুভূতিহীন এবং অপ্রাসঙ্গিকই শুধু নয়, তাঁকে একটি অগ্নিপরীক্ষায় পুনরায় ঠেলে দেওয়া এবং তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার অস্বীকার করার নামান্তরও বটে। এশিয়ার অনেক দেশের মতো তা উপলব্ধি করার সময় এখন বাংলাদেশেরও এসেছে।
নাওমী নাজ চৌধুরী: বার অ্যাট ল, আইনজীবী, ব্লাস্ট।
No comments