এত সংবর্ধনা কেন? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন
র‌্যাডিসন হোটেল থেকে লালদীঘির ময়দান, কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিল্পকলা একাডেমী—চট্টগ্রাম শহরের সর্বত্র আয়োজন করা হচ্ছে নবনির্বাচিত মেয়রের সংবর্ধনা সভা। নাগরিক কমিটি, চেম্বার, বিজিএমইএ, সিজেকেএস থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠন পর্যন্ত সবাই শামিল এই সংবর্ধনা জ্ঞাপনের প্রতিযোগিতায়। এতে নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে নবীন নেতৃত্বের প্রতি প্রত্যাশা আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর গত এক মাসেরও কম সময়ে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, আয়োজনের ঘনঘটায় যেন ধন্দ জাগে মনে। এর সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও উৎসাহ, নাকি এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্যও আছে অন্তত কারও কারও মনে।
আ জ ম নাছির উদ্দিন দীর্ঘদিন রাজনীতি করা মানুষ, এই সন্দেহ তাঁর মনেও জাগছে না, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। ধারণা করি, বুঝেশুনে অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ‘এই মনিহার’ গ্রহণ করতে হচ্ছে তাঁকে। তবে আমাদের ধারণা, তাঁর নিজেরই এখন ভক্তিতে গদগদ আয়োজক-সমর্থকদের উদ্দেশে বলার সময় হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ, এবার দয়া করে সরে দাঁড়ান, আমাকে কাজ করতে দিন।
নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা এখনো আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পাননি। পূর্বেকার নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ পূর্তি হবে আগামী ২৬ জুলাই। তার পরই দায়িত্ব বুঝে নেবেন তাঁরা। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন না করলেও মেয়র যে হোমওয়ার্ক শুরু করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কিছু কাজকর্ম থেকে। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও নতুন মেয়র ওয়াকিবহাল বলে মনে হয়। ইতিমধ্যেই তিনি জানিয়েছেন, এ বছর বর্ষার মৌসুম প্রায় এসে পড়েছে, এত দ্রুত তাঁর পক্ষে জলাবদ্ধতা সংকট নিরসন অসম্ভব।
আ জ ম নাছির একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র। এই বিরল সৌভাগ্য এর আগের মেয়রদের ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায়, উন্নয়নকাজের জন্য সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দপ্রাপ্তির দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন তিনি। সুতরাং সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলে আগামী পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে এবং আধুনিক বিশ্বমানের একটি নগর হিসেবে গড়ে উঠবে—এই আশা করা যেতেই পারে।
নির্বাচিত হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই এক বক্তৃতায় ‘জিরো টলারেন্সে’র কথা বলেছিলেন আ জ ম নাছির। বলা বাহুল্য, করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশেই এ কথা বলেছিলেন তিনি। সম্প্রতি এই সংস্থার রাজস্ব ও সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছেন, এই দুটি বিভাগের প্রচণ্ড দুর্নাম রয়েছে। স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘করপোরেশনে কর্মরতদের কোথায় কী আছে, আমার জানা আছে।’ তাঁর বক্তব্য নিঃসন্দেহে একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের। আমরা চাই, এই কঠোর মনোভাবের বাস্তব প্রতিফলন ঘটুক তাঁর কর্মকাণ্ডে, যাতে নগরবাসী এই সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্য ও প্রত্যাশিত সেবা পায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, সদ্য সাবেক মেয়র মনজুর আলমের সুনাম ছিল সৎ, সজ্জন ও নির্বিরোধী ব্যক্তি হিসেবে। তাঁর আগের মেয়াদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে তিনি নির্বিচারে অনুমোদন যেমন দিয়েছেন, তেমনি প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতর পরিবর্তন এনে নিজের মতো করে পরিচালনা করার উদ্যোগ নেননি বা নিতে পারেননি। এতে নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম, শৈথিল্য বা আদেশ অমান্য করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। ফলে সদিচ্ছা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি মনজুর।
কিন্তু শুরু থেকেই নাছিরের কঠোর মনোভাব প্রশাসনে গতি সঞ্চারের পথ সুগম করেছে বলে আমাদের ধারণা। দুর্নীতির বিষয়ে নাছির বলেছেন, ‘কেউ যদি মনে করেন মহিউদ্দিন ভাইয়ের আত্মীয়, মনজুর আলম ভাইয়ের লোক কিংবা আমাদের এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এই সূত্রে পার পেয়ে যাবেন, তাহলে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’ খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু নাছির একটা কথা স্পষ্ট করেননি, স্বয়ং তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে কেউ পার পাবেন কি না। এ কথা উঠছে এ কারণে যে শহরজুড়ে এই যে সংবর্ধনার বহর, পোস্টারে-বিলবোর্ডে অভিনন্দনবার্তা জ্ঞাপনের হিড়িক, তাতে আবেগ ও সমর্থন ছাপিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধির কোনো গোপন অভিসন্ধি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।
বিলবোর্ড উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মেয়র বলেছেন, ‘যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, বিলবোর্ড উচ্ছেদে আপনি কাউকে ছাড় দেবেন না। অভিযান শুরু করেন। প্রয়োজনে আগামীকাল থেকে শুরু করেন। কে মন্ত্রীর স্বজন বা কে প্রভাবশালীর স্বজন, তা দেখবেন না। অবৈধ বিলবোর্ড হলেই উচ্ছেদ।’
অবৈধ বিলবোর্ড প্রকৃতপক্ষেই চট্টগ্রামের এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতিশোভিত এই নগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঢেকে দিয়ে এসব বিলবোর্ড ঘনবসতিপূর্ণ এ অঞ্চলের মানুষের মুক্ত নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগও কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলেও এর প্রতিকার মেলেনি। বর্তমান পুলিশ কমিশনার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু বিলবোর্ড উচ্ছেদ করলেও এখনো বহু অবৈধ বিলবোর্ড রয়ে গেছে। নতুন মেয়র এ ব্যাপারে কতটা সফল হন, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছে নগরবাসী। তবে এখন শহরের অনেক বিলবোর্ডে ঝুলছে মেয়রের প্রতি অভিনন্দনবার্তা। বিলবোর্ড তো বটেই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুনে আ জ ম নাছিরের হাসিমাখা মুখের ছবিতে শহর সয়লাব। এই ছবির নিচে আবার অভিনন্দন জ্ঞাপনকারীর ছবিসমেত নাম-পরিচয়ও লেখা রয়েছে। সবার আগে এসব বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করার নির্দেশ দিয়ে মেয়র একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। এতে তোষামোদকারীদের প্রতি একটি সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করি আমরা।
মেয়রের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আ জ ম নাছিরকে। তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের দুটি অংশ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। লালদীঘি ময়দান ও রীমা কনভেনশন সেন্টারে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই ছুরি–চাপাতি নিয়ে পরস্পরের ওপর হামলা করেছেন ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের কর্মীরা। আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের এসব তৎপরতার কারণে সরকারের ভাবমূর্তি নানা সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, চাপা পড়ে গেছে উন্নয়নের কৃতিত্ব। এসব দিকে নজর দিয়ে দলকে শৃঙ্খলায় আনতে না পারলে তাঁর নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে।
শিরোনামে বলেছি, এত সংবর্ধনা কেন? আসলে সংবর্ধনা আমরা দিতেই চাই। তবে আজ নয়। মেয়র হিসেবে মেয়াদ পূর্তির পর যখন দেখব আ জ ম নাছির একটি আধুনিক পরিচ্ছন্ন ও শান্তিতে বসবাসযোগ্য নগর আমাদের উপহার দিয়েছেন, সেদিন অকুণ্ঠচিত্তে দলমত-নির্বিশেষে তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করবে এই নগরের মানুষ। সেটাই হবে তাঁর প্রকৃত ও প্রাপ্য সংবর্ধনা।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.