মানব পাচারের প্রধান কারণ ‘রোহিঙ্গা’ -থাইল্যান্ড সম্মেলনে অভিমত
মানব
পাচারের প্রধান কারণ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা। গত
২৯শে মে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সমস্যা
নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ বিষয়টিই ঘুরেফিরে তুলে এনেছেন
সম্মেলনে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। ১৭টি দেশের উচ্চপর্যায়ের
প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে মানব পাচাররোধে করণীয় এবং এই
অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনা
হয়। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের
প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা সমস্যাটি মানব পাচারের মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন।
সম্মেলনে বলা হয়, নিপীড়নের কারণে মিয়ানমারের হাজার হাজার মানুষ নিজ
আবাসভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে কাজের সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে কিছু
মানুষও অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে। এসব মানুষ বিদেশে পৌঁছে দেয়ার
সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র জড়িত রয়েছে। সম্মেলন শেষে দেশে
ফিরেই গত ৩১ শে মে বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম
আজাদকে লিখিত আকারে সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান ও আলোচনা সম্পর্কে
জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও
দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার জন্য মুখ্য সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ
করেছেন তিনি। সম্মেলনে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের
সহকারী কমিশনার (প্রটেকশন) মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বা
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানের উপর জোর দেন। তিনি
বলেন, বিষয়টি শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়া অঞ্চলে অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, নিরাপদ ও নিয়মতান্ত্রিক করার
মাধ্যমে মানব পাচার সমস্যার টেকসই সমাধান খোঁজা উচিত। পররাষ্ট্র সচিব মানব
পাচার রোধে বাংলাদেশের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, উদ্ধারকৃত
ভিকটিমদের মধ্যে বাংলাদেশী হিসেবে শনাক্ত করা ব্যক্তিদের যথাশিগগির,
সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আগামী এক মাসের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া
হবে। মানব পাচার দমনে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কোন ব্যত্যয়কে
প্রশ্রয় দেয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আইনি, প্রশাসনিক ও
প্রচারণামূলক কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতামূলক
কার্যক্রমে সরকারের সক্রিয় ও সচেষ্ট কর্মতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। পররাষ্ট্র
সচিব বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রপথে মানব পাচার সমস্যার গঠনমূলক ও স্থায়ী
সমাধান করতে দেশের বাইরে কিছু বাস্তবতা ও নিয়ামকগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি দিতে
হবে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত মূল কারণ হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে যথেষ্ট
সাহস ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। পররাষ্ট্র সচিবের
চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মানব পাচারের মূল কারণ হিসেবে
যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশ সরাসরিভাবে
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তবে মিয়ানমারের
প্রতিনিধি রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে পুরোপুরিভাবে আড়াল করে মানব পাচারের
বিষয়টিকে মূলত একটি অর্থনৈতিক অভিবাসন প্রক্রিয়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা
করেন। অন্যদিকে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো এ ব্যাপারে খুব খোলামেলাভাবে বক্তব্য
না দিলেও রোহিঙ্গা সমস্যাটি যে সমুদ্রপথে মানব পাচার প্রবণতার প্রধানতম
কারণ, ওই বিষয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের মতৈক্য পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে মানব
পাচারের ভিকটিমদের বাঙালি বা অবৈধ বাংলাদেশী হিসেবে ঢালাওভাবে চিহ্নিত করার
ব্যাপারে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অপকৌশল আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
চিঠিতে জানানো হয়, বৈঠকের শেষে আয়োজক দেশের পক্ষ থেকে মূল আলোচ্য বিষয়গুলোর
একটি খসড়া সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়। সার-সংক্ষেপটিতে অনিয়মিত অভিবাসন ও
মানব পাচার রোধে তাৎক্ষণিক, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কিছু কর্মপন্থা নির্ধারণ
করা হয়। সার-সংক্ষেপে রোহিঙ্গা সমস্যাটি সরাসরিভাবে উল্লেখ করা না হলেও
পরোক্ষভাবে এতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, আত্মপরিচয়, মানবাধিকার ও মৌলিক
অধিকার সংরক্ষণের বিষয় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। মানব পাচার
প্রতিরোধে সম্ভাব্য ভিকটিমদের মানবাধিকার সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা বাড়ানোর উপর
জোর দেয়া হয়। একই সঙ্গে নিয়মিত অভিবাসন বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে
যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব তার চিঠিতে জানান,
মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও জাতীয়তা
সম্পর্কিত সমস্যাটি জোরালোভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে। আপাত দৃষ্টিতে
বাংলাদেশের জন্য সৃষ্ট বিব্রতকর পরিস্থিতি সাময়িকভাবে কিছুটা সামাল দেয়া
গেলেও জাতীয় পর্যায়ে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জোরালো, দৃশ্যমান ও
দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। এই সমস্যা কার্যকরভাবে
মোকাবিলা করতে না পারলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে
এবং মূল সমস্যার বিষয়ে সৃষ্ট ঐকমত্য আবারও দুর্বল হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য,
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত মহাসাগর এলাকায় মানব পাচারের ঘটনার উদ্বেগজনক বৃদ্ধি,
পাচারের শিকার ব্যক্তিদের দুঃসহ ও মানবেতর পরিস্থিতি এবং থাইল্যান্ড ও
মালয়েশিয়ায় আবিষ্কৃত ভিকটিমদের গণকবর ও নির্যাতন শিবিরের কথা আন্তর্জাতিক
গণমাধ্যমে উঠে আসার প্রেক্ষিতে থাইল্যান্ডের সরকার এই বিশেষ বৈঠকটি আহ্বান
করে। এতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র,
অস্ট্রেলিয়া ও সুইজারল্যান্ডসহ মোট ১৭টি দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিগণ
অংশ নেয়।
No comments