শিকার by রুহুল আমিন বাচ্চু
এরিরে
জেডা, ভালা আছতনি বাপ? তোর মা আছেনি এককানা ভালা? আহ্হারে দুষ্ট রোগ
বেচারিরে এক্কাই কাইত করি হালাইছে। তোর বাপ মরণের হর ধরি যে হড়লো....আল্লা
রহম করুক। আর শইল্যের অবস্থাও ভালা ন’রে বা-জি। শইল্যে জোর হাইনা, হাঁটতে
কষ্ট লাগে......
জেঠার এত দুক্ষিত দুক্ষিত আলাপের অর্থ মানিকের জানা। জেঠাকে এড়িয়ে ক্ষেতের আইল পার হয়। জেঠাও তার পিছু নেয়। মানিক দ্রুত পা ফেলেও জেঠার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে পারে না।
এরে বা-জি হ্যইল মাছগা আঁরে দি-যা। তোর জেডি, জানস্তো অসুখ্যা মানুষ। কিস্সু খাইতো হারে না। মুখে রুচি অয়না। দুগা কদু হাতা কুডি লই বই রইছে। কি দি সালুন চড়াইবোরে? বা-জি তুইই ক! ‘মাছগা দে, খাই হেতনে দোয়া কইরবো।’
টেঁটার ঘাই খাওয়া দেড় হাত মাপের শোল মাছটা মানিকের হাতে ছাটাছাটি করছে। কলাগাছের আঁশ মাছের কানকা দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে গিঠ্যু মেরে বাম হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে মানিক। ডান কাঁধে টেঁটা রেখে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে। বারাইলের গড়ের মাছ। এক ঝাঁক লাল পোনা নিয়ে ভেসে উঠে, এক-দুই বুদবুদ ছাড়তেই আমগাছে চড়ে থাকা মানিকের টেঁটা সজোরে মাছটার ঘাড় বিদ্ধ করে। মানিকও লাফিয়ে পড়ে পানিতে। কতক্ষণ জোরাজুরি চলে মাছ আর মানুষের। শেষে অস্ত্র মানব জয়ী হয়। মানিককে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে পুবের আড়ায় জোর কদম ফেলে জেঠা। মানিক পাড়ে উঠার আগেই জেঠা পাড়ের আলে পৌঁছে যায়।
হাসতে হাসতে মাথার ছাতিটা বন্ধ করে বলে, বাক্কা কাম কইছত্ জেডা। আঁইতো দেখছি, কম করি অইলেও দশ দিন মাছগা তোরে ঘুরাইছে। লেজের বাড়িদি হানি ঘোলা করি তোর লগে বাইছালি কইচ্ছে কদিন। এককাই দিছত্ বা-জি ঘাড় ছেদা করি। হোমুন্দির হুতের মাছ, আংগো মাইনকারে চিনস্ ন.....
মানিক আজকে বেশ কঠোর। জেঠা যত বাঁওয়েড় কথাই বলুক, পাম্প-পট্টি মারুক, এ মাছ সে দিবে না। দুই সের ওজনের মাছকে সোয়া সের বলে দাম কমাতে যতই কারসাজি করুক, কান পাততেও নারাজ। আজকের শোল মাছটা জেঠা-জেঠির উদরে যাবে না এটাই শেষ কথা। জেঠা ব্যাগ হাতে বাজারের পথে না গিয়ে মাছের লোভে দিক পরিবর্তন করে বাড়ির পথে ফিরে।
তুই অইছত এককাই তোর দাদা খলিফার লাইন। আঁর জেডা আছিল হেতন। টেডা কান্দে বাইর অইলে হ্যইল, গজার একগা না একগা লই হিরবই। হেই সময় মাছের এতো আকালও আছিল না। সারা বছর পুকুর-খাল, গড়, খন্দকে হানি থাকত; থাকত নানা কিছিমের মাছ। আহ্হারে বড় বড় ভেদা মাছ আমরা পুকুর, গড়ে হাতাই ধইচ্ছি। জুত করি হড়ি থায় পেক কাদার মইধ্যে, গাছের হছা হাতার লাইন। চাপদি ধইল্যে খালি মোচড় একগা মারে।
এরি মধ্যে মানিকের ছেলে আবুল লুঙ্গি-গামছা আর একটা কাপড় কাচা সাবান নিয়ে আসে।
ঘাটে কাপড় রেখে দাদাকে প্রশ্ন করে, ভেদা মাছ কুনগারে কয়?
বেক্কল, ভেদা মাছ চিনস্ না! হ, চিনবি কমেনে? এইতো পনর-বিশ বছরের মাথায় নাই নাই অই গেছে। বুইজলি, মেনিমাছ...আরে হে সময় পুকুরের কিনারদি হাতাইলে পুঁটি, কই, ভেদা, শিং, বাইলা কত কি পাওন যাইতো। এক ঘণ্টায় আংগো দুই সেরি ডেকচির আধা আধি হই যাইতো। এইতো হেই দিনের কথা। আইলো সার, আইলো পাম্প মেশিন। মাইনষের হেডে ভাত আইলো আর বেক কিছু চলি গেল। এই যে আংগো, হুরান পুকুর, আগে জীবনে দেখিনো হিচতে, কেউ সাহসও করে ন’। অন বছর বছর হিচি হালায়। এই পুকুর থুন চত্রিশ সের ওজনের কাতল মাছ ধরা হড়ছে, কেউ বিশ্বাস কইরবোনি! আরে তোর ফুফু রহিমার বিয়ার সময় দুগা মাছে একশ কুটুম কাইত।
হাডে গেলে হাইয়্যুম জাইল্যা বাড়ির অধীরের হুইরের সিলভার কাপ। না আছে হোয়াদ, না কিছু।
আবুল দাদার ঘাড়ের ওপর ঘাপটি মোরে আছে। হঠাৎ দাদাগো আন্নের কান্দে জোঁক, বলে চিৎকার দিতেই অপ্রস্তুত দাদা চিৎ হয়ে পড়ে। জেঠা নিচের কাপড় সামলে উঠার আগেই আবুল ছো মেরে মাছটা নিয়ে ছুট।
এরি চুদির ভাই খাড়া। এরি, এরি দাদা-দাদা হুনি যা। এরে, তোর বাপে মহব্বত করি মাছগা...
আপনা না হলেও বয়সে মানিকের বাপের বড় এবং ভাই সম্পর্কীয়। বাড়ির বয়েসী মুরুব্বী। জেঠার সন্তানাদি নেই। জরিপের সময় বাড়ির অনেকের সম্পত্তি প্যাঁচ মেরে দখলে নিয়েছে। আবার জরিপ অফিসে ত্রিশ ধারা করে ঝুলিয়ে রেখেছে অনেককেই। জেঠার জমির পাশে যার জমি, আইল তো নয় যেন এক বিষাক্ত রেখা। মানিকের বাপের প্রায় জমিই জেঠার দখলে।
জেঠা-জেঠি দুজনের প্যাঁচে প্যাঁচে বাড়ির সবাই কাতর।
গত দুদিন স্বপ্নে আজরাইলকে দেখে জেঠা একটু নরম হয়ে পড়েছেন। প্রথম রাতে ভেবেছিলেন ভুল দেখছেন। দ্বিতীয় রাতে সেই একই স্বপ্ন। আজরাইলের বত্রিশ পাটি দাঁতের গিজ গিজ জেঠা সহ্য করতে পারলেন না। রাত দুপুরেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসে ছিলেন। সারা রাত জেঠিকেও ঘুমাতে দেননি। জোরে জোরে আল্লাকে ডেকেছেন আর নিজের মাগফেরাত কামনা করেছেন।
মানিক কাপড় বদলে টেঁটা কাঁধে বাড়ির দিকে এগোয়। জেঠা তার আগে আগে চলে। জেঠার ঘাড় বরাবর তার টেঁটার পাঁচফলা কেঁপে কেঁপে এগোচ্ছে। বাপের লাগানো পঞ্চাশ বছরের পুরনো নারকেল গাছের বাগান এখন জেঠার দখলে। আইনের প্যাঁচ, পুলিশের ভয় সব মিলিয়ে তটস্থ করে রেখেছে মানিককে। শামসু জেলে। এটেম্পট টু মার্ডার কেস। লক্ষ্মীপুর জেলে ছয় মাস ধরে বসবাস। কোনো জামিন নেই, দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মানিকের ইচ্ছা হয় শোল মাছের ঘাড় মনে করে জেঠার ঘাড়টা যদি...
পুকুরঘাট থেকে বাড়ির কাছারির দূরত্ব দু’শ কদম। দু’দিকে নারকেল-সুপারির বাগানের ঘের। একটা সবুজ ছায়া বিস্তার করে আছে পথে। মাঝামাঝি ডান দিকে পারিবারিক কবরস্থান। পশ্চিমে বিরাট পুকুর। কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে মানিক নিজেকে সামলে নেয়। বাপ-দাদাদের মতো সবার শেষ অবস্থান এ মাটির নিচে। কেমন আছে বাপ-দাদারা! কবরস্থানের উদ্দেশে আস্সালা মুয়ালাইকুম ইয়া আহ্্লাল কবুরে, বলতে বলতে হাঁটুর উপরে উঠানো লুঙ্গির গিটটা খুলে দেয়।
-কইলামতো, আন্নে হাডে যান। জানেনতো আঁর মাছ কিনি খাওনের হইসা নাই। ধরি মারি কোনোরকম চলি। আগের দুগা গজার মাছের টেঁয়াও দেন্ন।
-দিউম। দিউম। তোঁর টেঁয়াকি আঁই মারি খাইতাম হাইরুম?
-হাডে মাছ আছে, আন্নে যান হেম্মুই-
-কষ্ট হাইলামরে জেডা। আরও বেশি কষ্ট হাইবো তোর জেডি, বেচারি ক’গা কদু হাতা কুডি লই বই রইছে। এরুম বেরহম অইস্না বা-জি।
-কদু হাতা! কদু হাতাওতো আঁর মাচানের! আন্নে ইগিন কিয়া কন?
-তুই জেডা আসলেই হিয়াল্যা। হ্যইল মাছ টেডাদি মারণ কি এতই সোজা? চোখ-কান খাড়া না রাখলে কোনো হালার হুতে হ্যইল মাছ মাইত্তো হারে...
-অইছে বুইজ্জি, যান আধা আধি হাডাই দিউম।
-আল্লায় তোর দেলে আধা রহমত দিছে। আল্হামদুলিল্লাহ্ কইলাম।
বাড়ির উঠোন পেরিয়ে মানিকের রসুই ঘর। বাম দিকে লেব্বার ঘর আর ডাইনে ইসুফের ঘর পেরিয়ে যেতে হয়। লেব্বার রসুই ঘরের পাশে সুপারি-নাকেল পাতার বেড়া থাকায় সরাসরি তার রসুই ঘর দেখা যায় না। লেব্বার বউয়ের পুঁইয়ের মাচান পেরিয়ে দেখে তার রসুই ঘরে কুলা হাতে জেঠি বসে আছে।
মেজাজের উদগত গরম বাষ্প মানিক গিলে ফেলে। ভুঁইয়ার বেটি আগে ভাগেই সব টের পায়। যেন সত্য সত্যই জিবরাঈল। আবুল মাছ হাতে জেঠির একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে। মানিকের বউ স্বামীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বড় ঘরে। কাজের উছিলায় বের হচ্ছে না। সেও জানে এ বুড়ি মাছ না নিয়ে ছাড়বে না। এখন স্বামী মুখ ফস্কে আস্ত মাছটা জেঠিকে না দিতে বল্লেই হয়। বাপকে আসতে দেখে আবুল মাকে ডেকে রসুই ঘরের দিকে এগোয়।
মানিক উঠানের রশিতে লুঙ্গি মেলে দিতে দিতে স্ত্রীকে ইশারা করে। আবুল দাদির গায়ের দিকে মাছটা ছুড়ে ফেলে কাশেমের উঠোন দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। বুড়ি আবুলের উদ্দেশে একটা ভেংচি কেটে মানিকের স্ত্রীর দিকে দা এগিয়ে দেয়।
ঝট্পট্ কাডি’ল। আঁর কদু হাতাগুন হুয়াই যাইবো। মাছদি যাদু দুগা খাইতাম হারি।
মাছ কুটা শেষ হওয়ার আগেই বুড়ি মাছ ভাগ করতে থাকে। শেষমেশ বাড়তি টুকরাটা নিজের ভাগে যোগ করে।
এবার লেজ মাথা নিজের কুলায় উঠাতে উঠাতে বলে, বাউরে মাছ খাইলেও দিন যায়, না খাইলেও দিন যায়। তোর জেডারে, কদুদি মাথা-লেজ রান্দি দিউম, খাই দোয়া কইরবো।
-জেডি কদুগাও আঁর মাচানের, এই তো!
-কিয়া কস্ বা-জি! আঁর কি কদু গাছ নাইনি! আল্লায় দিলে হুইরের দইন হাড়ে আঁর গাছওতো অইছে...জবাব দিতে দেরি নাই বুড়ির।
-দেখছি। হবে দুই হাতা মেইলছে। কদু ধইত্তে আরও দুই মাস। এতদিন হ্যইল মাছের কল্লা কোনাই থুইবেন?
সকালবেলা জেঠার হাঁকাহাঁকিতে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে যায়। ছুটে আসে মাইনকা, ছরোয়ার, কাশেম, ফরিদুল, ইসুফ। জেঠার জরুরি মিটিং। জেঠার পরামর্শে ছরোয়ার কালার বাপকে ডেকে আনে।
জেঠার আরজ, বিয়ানে ফজরের নামাজ হড়তে বাইর অইলে কালা জানালাদি খাড়াই হেতনের শইল্যে মুতি দিছে। এইডার বিচার কইত্তে অইবো।
জেঠার ঘরের পাশে কালার বাপের ঘর। কালার বাপেও হাজির। অস্বীকার করার উপায় নেই। জেঠা পাঞ্জাবি বেড়ার মধ্যে টাঙ্গিয়ে রেখেছে। বিচারকেরা গন্ধ শুকে কালার মুত শনাক্ত করে।
কালা জানালা দিয়ে একবার সবাইকে দেখে দে দৌড়। এবার কালার অপকর্মে বিচারকদের সাক্ষীর দরকার হয় না।
কালার বাপে চেতে ওঠে, হারামজাদারে কইছি মুতে ধইলে হিগার মারে বোলাইতে। আঁই কানচোপাড়দি এককাই হিগারে ধেন্দা করি ছাড়িয়্যুম, বলে কালার বাপ তড়াক্ করে উঠে যায়।
বিচার শেষে হাহুতাশ করে কেঁদে ওঠে জেঠা। এক প্রস্থ জলবিহীন কান্না শেষে জেঠার শোকাচ্ছন্ন বক্তব্য, আঁই অইলাম বাড়ির মুরব্বী, তোগো মুরব্বী। ভালা অইলেও আছি, খারাপ অইলেও তোগো। হাল্দা বাড়ির হরাজী বলে আঁর বিরুদ্ধে মামলা কইচ্ছে। আঁরে বলে জেল খাটাইবো।
ছরোয়ার একটু চিকন স্বরে বলে, দাদা হুইনছি ওয়ারেন্টও জারি অইছে। এককাই জিন্দা ওয়ারেন্ট। জামিন অইতো ন’। জেডা ভয়ার্ত আর্তনাদে হু হু করে কেঁদে ওঠে। ভেতর থেকেও জেঠির হা-হুতাশের শব্দ শোনা যায়। সত্যি সত্যি এবার চোখের নোনা জল মুছে জেঠা ছরোয়ারের হাত চেপে ধরে।
-আলীমুদ্দি মুন্সিবাড়ির ইজ্জত তোরাই বাঁচাইতে হারস্। হে হোমুন্দির হুতে আঁর নামে গাছ কাডনের মামলা কইচ্ছে। তোমরা হেতারে জিগাও, আঁই কি হেতারে ইলটুস্ কইচ্ছিনি কোন! আঁর হোন্দে হোন্দে লাগছে? আংগো গোষ্টির কেউ কি থানা কাছারিতে গেছেনি! আঁরে জেল খাটাইবো। কি অইলো তোরা কথা কস্নাক্যা? অপরাধ কইল্লে তোরা বাড়িওয়ালা, আঁর বিচার কর। আঁই, তোগো ঠুণ্ডা মুরব্বী’ন। এক্কাই বেকের বড়। ইয়ান মিছা ’ন। কিরে বাবুল্যা, জেডা কথা কস্ না ক্যা?
-বা-জিরে তোগো জেডারে বাঁচা। বলেই জেঠি এক থালা পান সুপারি নিয়ে সামনে আসে। বাবুলের হাত চেপে ধরে বলে, তুই অইছত্ হোলাহানের মুরব্বী। তোরা একটা ব্যবস্থা কর। এ বুড়া মানুষগারে জেলে হাডাইলে তোগো ইজ্জত থাকবোনি! আঁইওবা কি কইরুম? আঁই চোক্ষে দেই না-কানে হুনিনা। আঁর কি অইবোরে! হেতন জেলে গেলে আঁই কোনাই যাইয়্যুম? কোনাই থাইক্কুম? শেষ পর্যন্ত তোগোরেই দেখতে অইবো! হাইরবিনি হালাইতে? আল্লায়তো আঁরে হুত ঝি দেয়’ন। কি দোষ কইচ্ছিলাম আল্লার দরবারে! অন বুড়াকালে বেইজ্জতি!
জেডা কু-কা করে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আল্লাগো-আল্লা, মেহেরবাণী কর। শান্তি দেও......
জেঠি এগিয়ে আসে, ব্যথা বাড়ছেনি কোন? কি কইত্তে অইবো কন?
জেঠা গলা কাঁপা শব্দে বলে, এম্নে কইলজার ব্যথা হের হরে বিয়ানে ওজু কইত্তাম যাই ঘাটে আছাড় খাইছি, কোমর গেছেরে। হিয়ার হর জেলে ধরি লই গেলে আঁই বাঁইচতান্নে। তোরা আঁরে বাঁচা। বাউরে বাউ, জেলে বলে বড্ডা বড্ডা আডার হিডা, আবার ছাগলের চামড়ার মতন শক্ত, আঁর তো দাঁত নাই। আঁই কেন্নে খাইয়ুম্য। উকুনে ভরা কালা কালা কম্বল। তিরিশ সের ওজনের ডান্ডা বেড়ি, আঁরে মারি হালা। আঁই বাপ-দাদার কবরের কিনারদি হুতি থাইক্কুম।
অন আমরা কিত্তাম হেই কথা কন জেডি, মানিক অস্থির হয়ে সমাধান চায়। তোরা সাক্ষী দিবি হেতন বাড়ির মুরুব্বী, ফরহেজগার মানুষ, হেতন ইগিন কাম করে’ন। মামলা এক্কাই মিছা...
-আন্নে এতো তাড়াতাড়ি মইত্তেন্ন জেডা। আরেক খিলি পান মুখে পুরে বাবুল জবান ছাড়ে, কথা আরওা রইছে। আন্নে মইল্লেও আন্নোরে আমরা দাফন কইত্তান্নো।
-ওরে বাউরে-তোমরা হুইনছনি বেকে, এ জালিমে ইগিন কিয়া কয়!
-হ, কথা ইয়ান আংগো বেকের। তিরিশ ধারার হ্যাঁচে আন্নে আংগোরে টাঙ্গাই রাখছেন। আমরাও সুযোগ হাইছি সাক্ষী দিউম আন্নের বিপক্ষে। তিরিশ সের ওজনের ডাণ্ডা বেড়ি...
এরি মধ্যে আবুল্যা খবর আনে দুই পুলিশ আর এক দারোগা বাড়ির দিকে আসছে। সাথে দুই বন্দুক আর একখান প্যাঁচমারা মোটা রশি।
জেঠিতো হাউমাউ করে বাবুলের হাত ধরে ফেলেছে। বাবুল কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না। কাঁই-কুঁই করে জেঠা উঠতে গিয়েও পারছে না কোমর ব্যথায়।
ছরোয়ার চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, আংগো ইজ্জতের ছওয়াল, কথাডা হাছা। হরাজির গাছ কাটনাটাও মিছা’ন। এই হরাজির কাটন্যা নাইরকেল গাছ যে আন্নের দুয়ারের ঠেঙ্গা অই জ্যান্ত সাক্ষী বনি রইছে হিয়ান খেয়াল আছেনি!
ওরে বাউরে, বলে জেডিতো মূর্ছা যাবার অবস্থা।
জেঠা ধমকে ওঠে জেঠির প্রতি, তাড়াতাড়ি হুইরের দিকে ঠেলি হালাইদে। ও, আঁই গেছিরে। তোরা আঁরে বাঁচা।
আই হাইত্তান্নো, ভেজাল বাজাইছেন আন্নে, হামাল দিবেনও আন্নে। আন্নের ঘরে আঁই জীবনভর প্যাঁচের মইদ্যে গিটটু মাইচ্ছি। আন্নে কেউরে শান্তিতে থাকতে দেন্ন। এইবার আল্লায় ডাইরেক্ট ধইচ্ছে আন্নেরে, বলে জেঠি হন হন করে ভেতর ঘরে যায়।
একটু পরে একটা স্টিলের ট্রাংক নিয়ে ফিরে আসে। ট্রাংকের চাবি বাবুলের হাতে দিয়ে ম্যাচের বাক্স দেয় মানিকের হাতে, ইগিন বেকগিন জ্বালাইদে। এ পাপের বোঝা আঁই লাইতাম হাইত্তান্নো। আঁই ভাইর বাড়িত চলি যাইয়্যুম।
এই দুষ্ট লোকের লাই আঁই দোজখে যাইয়্যূমের।
ট্রাংকের দলিলে আগুনের প্রফুল্ল শিখা বাড়ির সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জেঠার তাক করা চোখে সে শিখায় প্রতিফলন দেখা যায় ততক্ষণ, যতক্ষণ না আগুনের শিখা ছাইয়ে পরিণত হয়।
আবুল্যা ছুটে এসে খবর দেয়, আব্বা, আংগো হুরান হইরের উত্তর হাড়ে নাইল গাছ তলে গজার একগা হোনা লই ভাসি উঠছে।
মানিক টিনের চালের নিচে আড়াআড়ি টাঙ্গানো টেঁটার পাঁচ ফলার দিকে তাকিয়ে বলে, বা-জি আইজ আর ন’।
জেঠার এত দুক্ষিত দুক্ষিত আলাপের অর্থ মানিকের জানা। জেঠাকে এড়িয়ে ক্ষেতের আইল পার হয়। জেঠাও তার পিছু নেয়। মানিক দ্রুত পা ফেলেও জেঠার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে পারে না।
এরে বা-জি হ্যইল মাছগা আঁরে দি-যা। তোর জেডি, জানস্তো অসুখ্যা মানুষ। কিস্সু খাইতো হারে না। মুখে রুচি অয়না। দুগা কদু হাতা কুডি লই বই রইছে। কি দি সালুন চড়াইবোরে? বা-জি তুইই ক! ‘মাছগা দে, খাই হেতনে দোয়া কইরবো।’
টেঁটার ঘাই খাওয়া দেড় হাত মাপের শোল মাছটা মানিকের হাতে ছাটাছাটি করছে। কলাগাছের আঁশ মাছের কানকা দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে গিঠ্যু মেরে বাম হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে মানিক। ডান কাঁধে টেঁটা রেখে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে। বারাইলের গড়ের মাছ। এক ঝাঁক লাল পোনা নিয়ে ভেসে উঠে, এক-দুই বুদবুদ ছাড়তেই আমগাছে চড়ে থাকা মানিকের টেঁটা সজোরে মাছটার ঘাড় বিদ্ধ করে। মানিকও লাফিয়ে পড়ে পানিতে। কতক্ষণ জোরাজুরি চলে মাছ আর মানুষের। শেষে অস্ত্র মানব জয়ী হয়। মানিককে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে পুবের আড়ায় জোর কদম ফেলে জেঠা। মানিক পাড়ে উঠার আগেই জেঠা পাড়ের আলে পৌঁছে যায়।
হাসতে হাসতে মাথার ছাতিটা বন্ধ করে বলে, বাক্কা কাম কইছত্ জেডা। আঁইতো দেখছি, কম করি অইলেও দশ দিন মাছগা তোরে ঘুরাইছে। লেজের বাড়িদি হানি ঘোলা করি তোর লগে বাইছালি কইচ্ছে কদিন। এককাই দিছত্ বা-জি ঘাড় ছেদা করি। হোমুন্দির হুতের মাছ, আংগো মাইনকারে চিনস্ ন.....
মানিক আজকে বেশ কঠোর। জেঠা যত বাঁওয়েড় কথাই বলুক, পাম্প-পট্টি মারুক, এ মাছ সে দিবে না। দুই সের ওজনের মাছকে সোয়া সের বলে দাম কমাতে যতই কারসাজি করুক, কান পাততেও নারাজ। আজকের শোল মাছটা জেঠা-জেঠির উদরে যাবে না এটাই শেষ কথা। জেঠা ব্যাগ হাতে বাজারের পথে না গিয়ে মাছের লোভে দিক পরিবর্তন করে বাড়ির পথে ফিরে।
তুই অইছত এককাই তোর দাদা খলিফার লাইন। আঁর জেডা আছিল হেতন। টেডা কান্দে বাইর অইলে হ্যইল, গজার একগা না একগা লই হিরবই। হেই সময় মাছের এতো আকালও আছিল না। সারা বছর পুকুর-খাল, গড়, খন্দকে হানি থাকত; থাকত নানা কিছিমের মাছ। আহ্হারে বড় বড় ভেদা মাছ আমরা পুকুর, গড়ে হাতাই ধইচ্ছি। জুত করি হড়ি থায় পেক কাদার মইধ্যে, গাছের হছা হাতার লাইন। চাপদি ধইল্যে খালি মোচড় একগা মারে।
এরি মধ্যে মানিকের ছেলে আবুল লুঙ্গি-গামছা আর একটা কাপড় কাচা সাবান নিয়ে আসে।
ঘাটে কাপড় রেখে দাদাকে প্রশ্ন করে, ভেদা মাছ কুনগারে কয়?
বেক্কল, ভেদা মাছ চিনস্ না! হ, চিনবি কমেনে? এইতো পনর-বিশ বছরের মাথায় নাই নাই অই গেছে। বুইজলি, মেনিমাছ...আরে হে সময় পুকুরের কিনারদি হাতাইলে পুঁটি, কই, ভেদা, শিং, বাইলা কত কি পাওন যাইতো। এক ঘণ্টায় আংগো দুই সেরি ডেকচির আধা আধি হই যাইতো। এইতো হেই দিনের কথা। আইলো সার, আইলো পাম্প মেশিন। মাইনষের হেডে ভাত আইলো আর বেক কিছু চলি গেল। এই যে আংগো, হুরান পুকুর, আগে জীবনে দেখিনো হিচতে, কেউ সাহসও করে ন’। অন বছর বছর হিচি হালায়। এই পুকুর থুন চত্রিশ সের ওজনের কাতল মাছ ধরা হড়ছে, কেউ বিশ্বাস কইরবোনি! আরে তোর ফুফু রহিমার বিয়ার সময় দুগা মাছে একশ কুটুম কাইত।
হাডে গেলে হাইয়্যুম জাইল্যা বাড়ির অধীরের হুইরের সিলভার কাপ। না আছে হোয়াদ, না কিছু।
আবুল দাদার ঘাড়ের ওপর ঘাপটি মোরে আছে। হঠাৎ দাদাগো আন্নের কান্দে জোঁক, বলে চিৎকার দিতেই অপ্রস্তুত দাদা চিৎ হয়ে পড়ে। জেঠা নিচের কাপড় সামলে উঠার আগেই আবুল ছো মেরে মাছটা নিয়ে ছুট।
এরি চুদির ভাই খাড়া। এরি, এরি দাদা-দাদা হুনি যা। এরে, তোর বাপে মহব্বত করি মাছগা...
আপনা না হলেও বয়সে মানিকের বাপের বড় এবং ভাই সম্পর্কীয়। বাড়ির বয়েসী মুরুব্বী। জেঠার সন্তানাদি নেই। জরিপের সময় বাড়ির অনেকের সম্পত্তি প্যাঁচ মেরে দখলে নিয়েছে। আবার জরিপ অফিসে ত্রিশ ধারা করে ঝুলিয়ে রেখেছে অনেককেই। জেঠার জমির পাশে যার জমি, আইল তো নয় যেন এক বিষাক্ত রেখা। মানিকের বাপের প্রায় জমিই জেঠার দখলে।
জেঠা-জেঠি দুজনের প্যাঁচে প্যাঁচে বাড়ির সবাই কাতর।
গত দুদিন স্বপ্নে আজরাইলকে দেখে জেঠা একটু নরম হয়ে পড়েছেন। প্রথম রাতে ভেবেছিলেন ভুল দেখছেন। দ্বিতীয় রাতে সেই একই স্বপ্ন। আজরাইলের বত্রিশ পাটি দাঁতের গিজ গিজ জেঠা সহ্য করতে পারলেন না। রাত দুপুরেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসে ছিলেন। সারা রাত জেঠিকেও ঘুমাতে দেননি। জোরে জোরে আল্লাকে ডেকেছেন আর নিজের মাগফেরাত কামনা করেছেন।
মানিক কাপড় বদলে টেঁটা কাঁধে বাড়ির দিকে এগোয়। জেঠা তার আগে আগে চলে। জেঠার ঘাড় বরাবর তার টেঁটার পাঁচফলা কেঁপে কেঁপে এগোচ্ছে। বাপের লাগানো পঞ্চাশ বছরের পুরনো নারকেল গাছের বাগান এখন জেঠার দখলে। আইনের প্যাঁচ, পুলিশের ভয় সব মিলিয়ে তটস্থ করে রেখেছে মানিককে। শামসু জেলে। এটেম্পট টু মার্ডার কেস। লক্ষ্মীপুর জেলে ছয় মাস ধরে বসবাস। কোনো জামিন নেই, দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মানিকের ইচ্ছা হয় শোল মাছের ঘাড় মনে করে জেঠার ঘাড়টা যদি...
পুকুরঘাট থেকে বাড়ির কাছারির দূরত্ব দু’শ কদম। দু’দিকে নারকেল-সুপারির বাগানের ঘের। একটা সবুজ ছায়া বিস্তার করে আছে পথে। মাঝামাঝি ডান দিকে পারিবারিক কবরস্থান। পশ্চিমে বিরাট পুকুর। কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে মানিক নিজেকে সামলে নেয়। বাপ-দাদাদের মতো সবার শেষ অবস্থান এ মাটির নিচে। কেমন আছে বাপ-দাদারা! কবরস্থানের উদ্দেশে আস্সালা মুয়ালাইকুম ইয়া আহ্্লাল কবুরে, বলতে বলতে হাঁটুর উপরে উঠানো লুঙ্গির গিটটা খুলে দেয়।
-কইলামতো, আন্নে হাডে যান। জানেনতো আঁর মাছ কিনি খাওনের হইসা নাই। ধরি মারি কোনোরকম চলি। আগের দুগা গজার মাছের টেঁয়াও দেন্ন।
-দিউম। দিউম। তোঁর টেঁয়াকি আঁই মারি খাইতাম হাইরুম?
-হাডে মাছ আছে, আন্নে যান হেম্মুই-
-কষ্ট হাইলামরে জেডা। আরও বেশি কষ্ট হাইবো তোর জেডি, বেচারি ক’গা কদু হাতা কুডি লই বই রইছে। এরুম বেরহম অইস্না বা-জি।
-কদু হাতা! কদু হাতাওতো আঁর মাচানের! আন্নে ইগিন কিয়া কন?
-তুই জেডা আসলেই হিয়াল্যা। হ্যইল মাছ টেডাদি মারণ কি এতই সোজা? চোখ-কান খাড়া না রাখলে কোনো হালার হুতে হ্যইল মাছ মাইত্তো হারে...
-অইছে বুইজ্জি, যান আধা আধি হাডাই দিউম।
-আল্লায় তোর দেলে আধা রহমত দিছে। আল্হামদুলিল্লাহ্ কইলাম।
বাড়ির উঠোন পেরিয়ে মানিকের রসুই ঘর। বাম দিকে লেব্বার ঘর আর ডাইনে ইসুফের ঘর পেরিয়ে যেতে হয়। লেব্বার রসুই ঘরের পাশে সুপারি-নাকেল পাতার বেড়া থাকায় সরাসরি তার রসুই ঘর দেখা যায় না। লেব্বার বউয়ের পুঁইয়ের মাচান পেরিয়ে দেখে তার রসুই ঘরে কুলা হাতে জেঠি বসে আছে।
মেজাজের উদগত গরম বাষ্প মানিক গিলে ফেলে। ভুঁইয়ার বেটি আগে ভাগেই সব টের পায়। যেন সত্য সত্যই জিবরাঈল। আবুল মাছ হাতে জেঠির একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে। মানিকের বউ স্বামীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বড় ঘরে। কাজের উছিলায় বের হচ্ছে না। সেও জানে এ বুড়ি মাছ না নিয়ে ছাড়বে না। এখন স্বামী মুখ ফস্কে আস্ত মাছটা জেঠিকে না দিতে বল্লেই হয়। বাপকে আসতে দেখে আবুল মাকে ডেকে রসুই ঘরের দিকে এগোয়।
মানিক উঠানের রশিতে লুঙ্গি মেলে দিতে দিতে স্ত্রীকে ইশারা করে। আবুল দাদির গায়ের দিকে মাছটা ছুড়ে ফেলে কাশেমের উঠোন দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। বুড়ি আবুলের উদ্দেশে একটা ভেংচি কেটে মানিকের স্ত্রীর দিকে দা এগিয়ে দেয়।
ঝট্পট্ কাডি’ল। আঁর কদু হাতাগুন হুয়াই যাইবো। মাছদি যাদু দুগা খাইতাম হারি।
মাছ কুটা শেষ হওয়ার আগেই বুড়ি মাছ ভাগ করতে থাকে। শেষমেশ বাড়তি টুকরাটা নিজের ভাগে যোগ করে।
এবার লেজ মাথা নিজের কুলায় উঠাতে উঠাতে বলে, বাউরে মাছ খাইলেও দিন যায়, না খাইলেও দিন যায়। তোর জেডারে, কদুদি মাথা-লেজ রান্দি দিউম, খাই দোয়া কইরবো।
-জেডি কদুগাও আঁর মাচানের, এই তো!
-কিয়া কস্ বা-জি! আঁর কি কদু গাছ নাইনি! আল্লায় দিলে হুইরের দইন হাড়ে আঁর গাছওতো অইছে...জবাব দিতে দেরি নাই বুড়ির।
-দেখছি। হবে দুই হাতা মেইলছে। কদু ধইত্তে আরও দুই মাস। এতদিন হ্যইল মাছের কল্লা কোনাই থুইবেন?
সকালবেলা জেঠার হাঁকাহাঁকিতে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে যায়। ছুটে আসে মাইনকা, ছরোয়ার, কাশেম, ফরিদুল, ইসুফ। জেঠার জরুরি মিটিং। জেঠার পরামর্শে ছরোয়ার কালার বাপকে ডেকে আনে।
জেঠার আরজ, বিয়ানে ফজরের নামাজ হড়তে বাইর অইলে কালা জানালাদি খাড়াই হেতনের শইল্যে মুতি দিছে। এইডার বিচার কইত্তে অইবো।
জেঠার ঘরের পাশে কালার বাপের ঘর। কালার বাপেও হাজির। অস্বীকার করার উপায় নেই। জেঠা পাঞ্জাবি বেড়ার মধ্যে টাঙ্গিয়ে রেখেছে। বিচারকেরা গন্ধ শুকে কালার মুত শনাক্ত করে।
কালা জানালা দিয়ে একবার সবাইকে দেখে দে দৌড়। এবার কালার অপকর্মে বিচারকদের সাক্ষীর দরকার হয় না।
কালার বাপে চেতে ওঠে, হারামজাদারে কইছি মুতে ধইলে হিগার মারে বোলাইতে। আঁই কানচোপাড়দি এককাই হিগারে ধেন্দা করি ছাড়িয়্যুম, বলে কালার বাপ তড়াক্ করে উঠে যায়।
বিচার শেষে হাহুতাশ করে কেঁদে ওঠে জেঠা। এক প্রস্থ জলবিহীন কান্না শেষে জেঠার শোকাচ্ছন্ন বক্তব্য, আঁই অইলাম বাড়ির মুরব্বী, তোগো মুরব্বী। ভালা অইলেও আছি, খারাপ অইলেও তোগো। হাল্দা বাড়ির হরাজী বলে আঁর বিরুদ্ধে মামলা কইচ্ছে। আঁরে বলে জেল খাটাইবো।
ছরোয়ার একটু চিকন স্বরে বলে, দাদা হুইনছি ওয়ারেন্টও জারি অইছে। এককাই জিন্দা ওয়ারেন্ট। জামিন অইতো ন’। জেডা ভয়ার্ত আর্তনাদে হু হু করে কেঁদে ওঠে। ভেতর থেকেও জেঠির হা-হুতাশের শব্দ শোনা যায়। সত্যি সত্যি এবার চোখের নোনা জল মুছে জেঠা ছরোয়ারের হাত চেপে ধরে।
-আলীমুদ্দি মুন্সিবাড়ির ইজ্জত তোরাই বাঁচাইতে হারস্। হে হোমুন্দির হুতে আঁর নামে গাছ কাডনের মামলা কইচ্ছে। তোমরা হেতারে জিগাও, আঁই কি হেতারে ইলটুস্ কইচ্ছিনি কোন! আঁর হোন্দে হোন্দে লাগছে? আংগো গোষ্টির কেউ কি থানা কাছারিতে গেছেনি! আঁরে জেল খাটাইবো। কি অইলো তোরা কথা কস্নাক্যা? অপরাধ কইল্লে তোরা বাড়িওয়ালা, আঁর বিচার কর। আঁই, তোগো ঠুণ্ডা মুরব্বী’ন। এক্কাই বেকের বড়। ইয়ান মিছা ’ন। কিরে বাবুল্যা, জেডা কথা কস্ না ক্যা?
-বা-জিরে তোগো জেডারে বাঁচা। বলেই জেঠি এক থালা পান সুপারি নিয়ে সামনে আসে। বাবুলের হাত চেপে ধরে বলে, তুই অইছত্ হোলাহানের মুরব্বী। তোরা একটা ব্যবস্থা কর। এ বুড়া মানুষগারে জেলে হাডাইলে তোগো ইজ্জত থাকবোনি! আঁইওবা কি কইরুম? আঁই চোক্ষে দেই না-কানে হুনিনা। আঁর কি অইবোরে! হেতন জেলে গেলে আঁই কোনাই যাইয়্যুম? কোনাই থাইক্কুম? শেষ পর্যন্ত তোগোরেই দেখতে অইবো! হাইরবিনি হালাইতে? আল্লায়তো আঁরে হুত ঝি দেয়’ন। কি দোষ কইচ্ছিলাম আল্লার দরবারে! অন বুড়াকালে বেইজ্জতি!
জেডা কু-কা করে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আল্লাগো-আল্লা, মেহেরবাণী কর। শান্তি দেও......
জেঠি এগিয়ে আসে, ব্যথা বাড়ছেনি কোন? কি কইত্তে অইবো কন?
জেঠা গলা কাঁপা শব্দে বলে, এম্নে কইলজার ব্যথা হের হরে বিয়ানে ওজু কইত্তাম যাই ঘাটে আছাড় খাইছি, কোমর গেছেরে। হিয়ার হর জেলে ধরি লই গেলে আঁই বাঁইচতান্নে। তোরা আঁরে বাঁচা। বাউরে বাউ, জেলে বলে বড্ডা বড্ডা আডার হিডা, আবার ছাগলের চামড়ার মতন শক্ত, আঁর তো দাঁত নাই। আঁই কেন্নে খাইয়ুম্য। উকুনে ভরা কালা কালা কম্বল। তিরিশ সের ওজনের ডান্ডা বেড়ি, আঁরে মারি হালা। আঁই বাপ-দাদার কবরের কিনারদি হুতি থাইক্কুম।
অন আমরা কিত্তাম হেই কথা কন জেডি, মানিক অস্থির হয়ে সমাধান চায়। তোরা সাক্ষী দিবি হেতন বাড়ির মুরুব্বী, ফরহেজগার মানুষ, হেতন ইগিন কাম করে’ন। মামলা এক্কাই মিছা...
-আন্নে এতো তাড়াতাড়ি মইত্তেন্ন জেডা। আরেক খিলি পান মুখে পুরে বাবুল জবান ছাড়ে, কথা আরওা রইছে। আন্নে মইল্লেও আন্নোরে আমরা দাফন কইত্তান্নো।
-ওরে বাউরে-তোমরা হুইনছনি বেকে, এ জালিমে ইগিন কিয়া কয়!
-হ, কথা ইয়ান আংগো বেকের। তিরিশ ধারার হ্যাঁচে আন্নে আংগোরে টাঙ্গাই রাখছেন। আমরাও সুযোগ হাইছি সাক্ষী দিউম আন্নের বিপক্ষে। তিরিশ সের ওজনের ডাণ্ডা বেড়ি...
এরি মধ্যে আবুল্যা খবর আনে দুই পুলিশ আর এক দারোগা বাড়ির দিকে আসছে। সাথে দুই বন্দুক আর একখান প্যাঁচমারা মোটা রশি।
জেঠিতো হাউমাউ করে বাবুলের হাত ধরে ফেলেছে। বাবুল কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না। কাঁই-কুঁই করে জেঠা উঠতে গিয়েও পারছে না কোমর ব্যথায়।
ছরোয়ার চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, আংগো ইজ্জতের ছওয়াল, কথাডা হাছা। হরাজির গাছ কাটনাটাও মিছা’ন। এই হরাজির কাটন্যা নাইরকেল গাছ যে আন্নের দুয়ারের ঠেঙ্গা অই জ্যান্ত সাক্ষী বনি রইছে হিয়ান খেয়াল আছেনি!
ওরে বাউরে, বলে জেডিতো মূর্ছা যাবার অবস্থা।
জেঠা ধমকে ওঠে জেঠির প্রতি, তাড়াতাড়ি হুইরের দিকে ঠেলি হালাইদে। ও, আঁই গেছিরে। তোরা আঁরে বাঁচা।
আই হাইত্তান্নো, ভেজাল বাজাইছেন আন্নে, হামাল দিবেনও আন্নে। আন্নের ঘরে আঁই জীবনভর প্যাঁচের মইদ্যে গিটটু মাইচ্ছি। আন্নে কেউরে শান্তিতে থাকতে দেন্ন। এইবার আল্লায় ডাইরেক্ট ধইচ্ছে আন্নেরে, বলে জেঠি হন হন করে ভেতর ঘরে যায়।
একটু পরে একটা স্টিলের ট্রাংক নিয়ে ফিরে আসে। ট্রাংকের চাবি বাবুলের হাতে দিয়ে ম্যাচের বাক্স দেয় মানিকের হাতে, ইগিন বেকগিন জ্বালাইদে। এ পাপের বোঝা আঁই লাইতাম হাইত্তান্নো। আঁই ভাইর বাড়িত চলি যাইয়্যুম।
এই দুষ্ট লোকের লাই আঁই দোজখে যাইয়্যূমের।
ট্রাংকের দলিলে আগুনের প্রফুল্ল শিখা বাড়ির সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জেঠার তাক করা চোখে সে শিখায় প্রতিফলন দেখা যায় ততক্ষণ, যতক্ষণ না আগুনের শিখা ছাইয়ে পরিণত হয়।
আবুল্যা ছুটে এসে খবর দেয়, আব্বা, আংগো হুরান হইরের উত্তর হাড়ে নাইল গাছ তলে গজার একগা হোনা লই ভাসি উঠছে।
মানিক টিনের চালের নিচে আড়াআড়ি টাঙ্গানো টেঁটার পাঁচ ফলার দিকে তাকিয়ে বলে, বা-জি আইজ আর ন’।
No comments