প্রচারবিমুখ একজন আবু শাহরিয়ার by আবু জাফর রাজীব
প্রচারবিমুখ ছিলেন আবু শাহরিয়ার। ছিলেন
নিভৃতচারী। কবি শামসুর রাহমান ২৮ জুন ২০০২ খ্রি. দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়
‘কালের ধুলোয় লেখা’ আত্মজীবনীর চল্লিশতম পর্বের একপর্যায়ে লিখেছেন, ‘এই
নিভৃতলোক আবু শাহ্রিয়ারের...’। আবু শাহরিয়ার নিজেও বলতেন, সাহিত্য শিল্প
এবং শিল্পী বাজারের জন্য নয় যে প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। একজন কথাশিল্পী
বা কবির কাজ হল লিখে যাওয়া। যা মনে আসে তা-ই লেখা। পরে ঠিকঠাক করা। তা
প্রচার ও প্রসার হোক বা না হোক তাতে কিছু যায় আসে না। যারা প্রচারের
অপেক্ষায় থাকেন বা নিজের ঢোল নিজে বাজান তাদের আমি লেখক বলি না। ঢোল
বাজাবেন পাঠক। এভাবে প্রায়ই আমাকে কথাগুলো বলতেন তিনি। আবু শাহরিয়ার নিজেও
তেমনই একজন কথাশিল্পী ও অনুবাদক ছিলেন। তিনি লিখতেন অনেকের মতো নয় নিজের
মতো গুছিয়ে। লেখার একটা নিজস্ব ফর্ম তৈরি করেছিলেন। তবে একটা সমস্যার কারণে
তার মৌলিক লেখার সংখ্যা ছিল খুবই কম।
ইউলিয়াম শেকসপীয়রের বেশ কয়েকটি নাটক অনুবাদ করে বাংলা সাহত্যি ও ইংরেজি সাহিত্যের ওপর গভীর দক্ষতার ছাপ রেখেছেন আবু শাহরিয়ার। তার মূল্যায়নও করেছে বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমি তাকে অনুবাদক হিসেবে পুরস্কার দেয়। ১৯৭৪ সালে ইউলিয়াম শেবসপীয়রের হ্যামলেট নাটক অনুবাদ করে এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার নামের পেছনে অনুবাদ শব্দটি বসেছিল তখনই।
‘কালের ধুলোয় লেখা’ আত্মজীবনীতে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘যতদূর মনে পড়ে, একসময় আবু শাহরিয়ার কয়েকটি কবিতাও লিখেছিলেন। একটি কি দু’টি তো আমিও পড়েছি কোনো পত্রিকায়’। তার মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে ‘অন্বেষা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ১৯৬০ সালে, মুক্তধারা থেকে গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নলোক’ প্রকাশিত হয় পৌষ ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, ২০০০ সালের একুশের বইমেলায় শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘এইসময়’। লেখক হুমায়ুন কাদিরের জীবনী গ্রন্থ লিখেছেন ১৯৯৪ সালে। প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি। দ্বিতীয় খণ্ড বাংলা একাডেমিতে জমা রয়েছে ছয় বছর ধরে। এছাড়াও আত্মজীবনী ‘খণ্ডিত মানুষ’ প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালে। ২য় খণ্ড ‘বালুকা বেলায়’ প্রকাশ পায় ২০১০ সালে। অনুবাদের মধ্যে হ্যামলেট ছাড়াও উইলিয়াম শেকসপীয়রের আরও একটি নাটক ‘অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা’ অনুবাদ করেন ১৯৭৮ সালে। তার সর্বশেষ অনুবাদ এবং লেখা যেটাই বলি না কেন পারিজাত প্রকাশনী থেকে ২০১২ সালে উইলিয়াম শেকসপীয়রেরই ‘দুটি নাকট’ শিরোনামে এক মলাটের ভেতর Much Ado About Nothing I As You Like it নামে দুটি নাটক। তিনি আর কখনোই উইলিয়াম শেকসপীয়রের নাটক অনুবাদ করবেন না। এমনকি লেখার টেবিলেও বসবেন না। কারণ আমাদের সবার সঙ্গে অভিমান করে চলে গেছেন সেই দেশে। যে দেশ থেকে ফেরা যায় না।
১৯৩৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এ পৃথিবীতে আসা আবু শাহরিয়ার গত ৫ অক্টোবর ২০১৪ রোববার ঈদুল-আজহার আগের দিন ২টার দিকে নিউমোনিয়া ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে মারা যান। তার বাড়ি ফরিদপুর। কিন্তু পুর্বপুরুষের একজন এসে ঢাকার আরমানীটোলায় বাড়ি করেছিলেন। সেখানেই জন্ম তার। পরে তার বাবা নাজিমউদ্দিন রোডে বাড়ি করেন। সেখানে বসবাস করতেন আবু শাহরিয়ার। তার পরে অর্থাৎ জীবনের শেষ ক’টা দিন বসবাস করেছেন মোহাম্মদপুরের নিজের কেনা ফ্ল্যাট বাড়িতে।
অনুবাদ ও লেখালেখি ছাড়াও তিনি একজন সংগঠকও ছিলেন। হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার প্রবর্তন করেন এবং তার কর্ণধারও ছিলেন আবু শাহরিয়ার। ওই সংগঠন থেকে যারা পুরস্কার পেয়েছিলেন তারা হলেন, কথাশিল্পী নাজমুল আলম, জনপ্রিয় নাট্যকার ও কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, সাংবাদিক, নাট্যকার ও কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী প্রমুখ। হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার কমিটি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদর প্রতি বছর বৃত্তি দেয়ার জন্য ট্রাস্টি বোর্ড করে দিয়ে গেছে।
‘কথাসাহিত্য’ নামে একটা সংগঠনও চালাতেন তিনি। যার সভাপতি ছিলেন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। আবু শাহরিয়ার সহ-সভাপতি হলেও দ্বায়িত্ব পালন করতেন সাধারণ সম্পাদকের। আমাকে কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই দফতর সম্পাদকের কাজ করতে হতো তার অনুরোধে। ‘কথাসাহিত্য’ নামে একটা মাসিক বুলেটিন বের করা হয়েছিল কয়েক সংখ্যা। সংগঠনের সহ-সভাপতি হলেও বুলেটিনের সম্পাদক ছিলেন তিনি।
এ কথাসাহিত্য বুলেটিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে নাট্যকার ও কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন সাপ্তাহিক রোববারের ২০ ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে সাহিত্যের খবর কলামে কথাসাহিত্য বুলেটিনের প্রথম পর্বে লিখেছিলেন, ‘কথাসাহিত্যের উদ্যোগ অবশ্যই আমার প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না। তবুও একজন নগণ্য সাহিত্যকর্মী হিসেবে ‘কথাসাহিত্য’ বুলেটিন সম্পাদক আবু শাহরিয়ারের কাছে বিনীত নিবেদন এই যে, বুলেটিন যেন নিয়মিত বেরোয়।’ তিনি ছিলেন আমার খুব কাছের। আমি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করি। তিনিও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন উপ-পরিচালক ছিলেন। একই বোর্ডে চাকরি করলেও চেনা-জানা ছিল না। তার অফিসিয়াল নাম ছিল আবুল হোসেন। এ নামে তার শ্রদ্ধাভাজন একজন প্রথিতযশা কবি থাকায় বাধ্য হয়েই তিনি আবু শাহরিয়ার নামে লেখালেখি শুরু করেন।
১৯৮৫ সালের কথা। আমার এক সহকর্মী তখন তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর তিনি হয়ে গেলেন বড় আপনজন, খুব কাছের একজন মানুষ, বড়ভাই, সাহিত্য জগতের শিক্ষা শুরু। কর্মময় জীবনে তিনি ছিলেন খুবই শান্ত। কাজ নিয়ে কারও ওপর রাগ হলে চুপচাপ বসে থাকতেন। অপর পক্ষের সঙ্গে কোনো তর্ক করতেন না। তার অধীনে চাকরি করা রুবিয়া খাতুন বলেছেন, ‘তার মতো নম্র, ভদ্র, মার্জিত ও জ্ঞানী অফিসার এ বোর্ডে (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে) খুব কমই ছিলেন।’ তবে দীর্ঘদিন সহকারী পরিচালক থাকায় এবং শেষ বয়সে অর্থাৎ যখন যাই যাই অবস্থা তখন পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিচালক হওয়ায় তেমন একটা খুশি হতে পারেননি তিনি।
আবু শাহরিয়ার কানে শুনতেন না। মুখেও কথা একটু বাজত। তাই তাকে কিছু বললে হাতে লিখে বলতে হতো। কাগজটা তিনি নিজেই বের করে দিতেন। উত্তর দিতেন মুখে। যেটুকু কথা বাজত তাতে বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। মানুষের মুখে বলা সংলাপ নিজ কানে শোনা আর লেখার মাধ্যমে শোনা এক নয়। যিনি লিখে উত্তর দেন তিনি গুছিয়ে সুন্দর করে লিখে দেন। আর মুখে বলেন তার স্বভাব-সুলভ বক্তব্য। এ বক্তব্য শোনা থেকে বঞ্চিত না হলে হয়তো মৌলিক রচনায় তিনি দুই বাংলার অনেক প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিকদের ছাড়িয়ে যেতে পারতেন।
বাংলা একাডেমির ফেলো আবু শাহরিয়ার লেখালেখি করতে গিয়ে যেসব বই কিনেছিলেন এবং সংগ্রহ করেছিলেন ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারে সেসব বই উপহার দিয়ে গেছেন। বাংলা একাডেমির প্রধান গ্রন্থাগারিক সেলিনা হোসেন ডাকযোগে আবু শাহরিয়ারকে জানান, ‘মহোদয়, আপনি বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারে যেসব গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন, ধন্যবাদের সঙ্গে তা গ্রহণ করা হল। আগ্রহী পাঠক ও গবেষক এতে উপকৃত হবেন। আপনার আন্তরিক সহযোগিতা জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধি করে তুলবে। ভবিষ্যতে একাডেমির প্রতি আপনার এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি। ধন্যবাদান্তে...’। না, তিনি ভবিষ্যতে আর বাংলা একাডেমিকে কোনো সহযোগিতা করতে পারেননি।
কবি শামসুর রাহমানকে তিনি বড়মাপের কবি বলে সম্মান করতেন। আবু শাহরিয়ারের ভাষায়, বাংলাদেশে কবি শামসুর রাহমানের মতো কবি আর হবে না। কবি শামসুর রাহমান নিজেও আবু শাহরিয়ারকে খুব পছন্দ করতেন। সে কথাও তিনি ২৮ জুন ২০০২ সালে দৈনিক জনকণেষ্ঠ ‘কালের ধুলোয় লেখা’ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মানুষটি আমার প্রকৃত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আপনজনদের মধ্যে অন্যতম। আমাকে, যতদূর জানি, তিনি খুবই পছন্দ করেন।’
আবু শাহরিয়ার জনপ্রিয় নাট্যকার, কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ও সাংবাদিক, নাট্যকার, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনকেও খুব পছন্দ করতেন। তার প্রধান কারণ লেখকের ধর্ম লিখে যাওয়ায়। তারাও লিখে যাচ্ছিলেন। ভালো-মন্দের বিচার করার দায়িত্ব লেখকের নয়, পাঠকের। তিনি কবি সাহিত্যিকদের সম্মান করতেন সব সময়। সে ছোট হোক আর বড় হোক। বলতেন, আমি কী? আমি কিছু না। আমি লিখতে পারি না। লিখতে চাইলেও হয়ে ওঠে না নানা সমস্যায়। আমাকে একান্তে অনেক সময় বলতেন, আপনি চালিয়ে যান, আপনার দ্বারা হবে। কিন্তু আমার দ্বারা কতটুকু হয়েছে তা আমি উপলব্ধি করলে মনে হয়, শূন্য। আমি কিছুই করতে পারিনি, কিছুই হতে পারিনি। অথচ আমার গুরু, সাহিত্যের শিক্ষক আবু শাহরিয়ারের আশা ছিল তার শিষ্য কিছু একটা হবে। গুরুর আশা আমি সফল করতে পারিনি। অনেকবার লেখা ছেড়ে দিতে চেয়েছি। তিনি নানা দেশের লেখকদের লেখক হওয়ার কাহিনী শুনিয়ে আমাকে সাহিত্যচর্চায় লেগে থাকতে বলেছেন সবসময়। এখন পরকাল থেকে আমার সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছু ভাবছেন তিনি। আমি মনে মনে বলি, আপনি ভাবুন। আপনি যেমন অভিমান করে চলে গেছেন, আমিও তেমনই অভিমান করে থাকব।
ইউলিয়াম শেকসপীয়রের বেশ কয়েকটি নাটক অনুবাদ করে বাংলা সাহত্যি ও ইংরেজি সাহিত্যের ওপর গভীর দক্ষতার ছাপ রেখেছেন আবু শাহরিয়ার। তার মূল্যায়নও করেছে বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমি তাকে অনুবাদক হিসেবে পুরস্কার দেয়। ১৯৭৪ সালে ইউলিয়াম শেবসপীয়রের হ্যামলেট নাটক অনুবাদ করে এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার নামের পেছনে অনুবাদ শব্দটি বসেছিল তখনই।
‘কালের ধুলোয় লেখা’ আত্মজীবনীতে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘যতদূর মনে পড়ে, একসময় আবু শাহরিয়ার কয়েকটি কবিতাও লিখেছিলেন। একটি কি দু’টি তো আমিও পড়েছি কোনো পত্রিকায়’। তার মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে ‘অন্বেষা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ১৯৬০ সালে, মুক্তধারা থেকে গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নলোক’ প্রকাশিত হয় পৌষ ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, ২০০০ সালের একুশের বইমেলায় শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘এইসময়’। লেখক হুমায়ুন কাদিরের জীবনী গ্রন্থ লিখেছেন ১৯৯৪ সালে। প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি। দ্বিতীয় খণ্ড বাংলা একাডেমিতে জমা রয়েছে ছয় বছর ধরে। এছাড়াও আত্মজীবনী ‘খণ্ডিত মানুষ’ প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালে। ২য় খণ্ড ‘বালুকা বেলায়’ প্রকাশ পায় ২০১০ সালে। অনুবাদের মধ্যে হ্যামলেট ছাড়াও উইলিয়াম শেকসপীয়রের আরও একটি নাটক ‘অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা’ অনুবাদ করেন ১৯৭৮ সালে। তার সর্বশেষ অনুবাদ এবং লেখা যেটাই বলি না কেন পারিজাত প্রকাশনী থেকে ২০১২ সালে উইলিয়াম শেকসপীয়রেরই ‘দুটি নাকট’ শিরোনামে এক মলাটের ভেতর Much Ado About Nothing I As You Like it নামে দুটি নাটক। তিনি আর কখনোই উইলিয়াম শেকসপীয়রের নাটক অনুবাদ করবেন না। এমনকি লেখার টেবিলেও বসবেন না। কারণ আমাদের সবার সঙ্গে অভিমান করে চলে গেছেন সেই দেশে। যে দেশ থেকে ফেরা যায় না।
১৯৩৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এ পৃথিবীতে আসা আবু শাহরিয়ার গত ৫ অক্টোবর ২০১৪ রোববার ঈদুল-আজহার আগের দিন ২টার দিকে নিউমোনিয়া ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে মারা যান। তার বাড়ি ফরিদপুর। কিন্তু পুর্বপুরুষের একজন এসে ঢাকার আরমানীটোলায় বাড়ি করেছিলেন। সেখানেই জন্ম তার। পরে তার বাবা নাজিমউদ্দিন রোডে বাড়ি করেন। সেখানে বসবাস করতেন আবু শাহরিয়ার। তার পরে অর্থাৎ জীবনের শেষ ক’টা দিন বসবাস করেছেন মোহাম্মদপুরের নিজের কেনা ফ্ল্যাট বাড়িতে।
অনুবাদ ও লেখালেখি ছাড়াও তিনি একজন সংগঠকও ছিলেন। হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার প্রবর্তন করেন এবং তার কর্ণধারও ছিলেন আবু শাহরিয়ার। ওই সংগঠন থেকে যারা পুরস্কার পেয়েছিলেন তারা হলেন, কথাশিল্পী নাজমুল আলম, জনপ্রিয় নাট্যকার ও কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, সাংবাদিক, নাট্যকার ও কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী প্রমুখ। হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার কমিটি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদর প্রতি বছর বৃত্তি দেয়ার জন্য ট্রাস্টি বোর্ড করে দিয়ে গেছে।
‘কথাসাহিত্য’ নামে একটা সংগঠনও চালাতেন তিনি। যার সভাপতি ছিলেন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। আবু শাহরিয়ার সহ-সভাপতি হলেও দ্বায়িত্ব পালন করতেন সাধারণ সম্পাদকের। আমাকে কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই দফতর সম্পাদকের কাজ করতে হতো তার অনুরোধে। ‘কথাসাহিত্য’ নামে একটা মাসিক বুলেটিন বের করা হয়েছিল কয়েক সংখ্যা। সংগঠনের সহ-সভাপতি হলেও বুলেটিনের সম্পাদক ছিলেন তিনি।
এ কথাসাহিত্য বুলেটিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে নাট্যকার ও কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন সাপ্তাহিক রোববারের ২০ ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে সাহিত্যের খবর কলামে কথাসাহিত্য বুলেটিনের প্রথম পর্বে লিখেছিলেন, ‘কথাসাহিত্যের উদ্যোগ অবশ্যই আমার প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না। তবুও একজন নগণ্য সাহিত্যকর্মী হিসেবে ‘কথাসাহিত্য’ বুলেটিন সম্পাদক আবু শাহরিয়ারের কাছে বিনীত নিবেদন এই যে, বুলেটিন যেন নিয়মিত বেরোয়।’ তিনি ছিলেন আমার খুব কাছের। আমি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করি। তিনিও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন উপ-পরিচালক ছিলেন। একই বোর্ডে চাকরি করলেও চেনা-জানা ছিল না। তার অফিসিয়াল নাম ছিল আবুল হোসেন। এ নামে তার শ্রদ্ধাভাজন একজন প্রথিতযশা কবি থাকায় বাধ্য হয়েই তিনি আবু শাহরিয়ার নামে লেখালেখি শুরু করেন।
১৯৮৫ সালের কথা। আমার এক সহকর্মী তখন তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর তিনি হয়ে গেলেন বড় আপনজন, খুব কাছের একজন মানুষ, বড়ভাই, সাহিত্য জগতের শিক্ষা শুরু। কর্মময় জীবনে তিনি ছিলেন খুবই শান্ত। কাজ নিয়ে কারও ওপর রাগ হলে চুপচাপ বসে থাকতেন। অপর পক্ষের সঙ্গে কোনো তর্ক করতেন না। তার অধীনে চাকরি করা রুবিয়া খাতুন বলেছেন, ‘তার মতো নম্র, ভদ্র, মার্জিত ও জ্ঞানী অফিসার এ বোর্ডে (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে) খুব কমই ছিলেন।’ তবে দীর্ঘদিন সহকারী পরিচালক থাকায় এবং শেষ বয়সে অর্থাৎ যখন যাই যাই অবস্থা তখন পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিচালক হওয়ায় তেমন একটা খুশি হতে পারেননি তিনি।
আবু শাহরিয়ার কানে শুনতেন না। মুখেও কথা একটু বাজত। তাই তাকে কিছু বললে হাতে লিখে বলতে হতো। কাগজটা তিনি নিজেই বের করে দিতেন। উত্তর দিতেন মুখে। যেটুকু কথা বাজত তাতে বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। মানুষের মুখে বলা সংলাপ নিজ কানে শোনা আর লেখার মাধ্যমে শোনা এক নয়। যিনি লিখে উত্তর দেন তিনি গুছিয়ে সুন্দর করে লিখে দেন। আর মুখে বলেন তার স্বভাব-সুলভ বক্তব্য। এ বক্তব্য শোনা থেকে বঞ্চিত না হলে হয়তো মৌলিক রচনায় তিনি দুই বাংলার অনেক প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিকদের ছাড়িয়ে যেতে পারতেন।
বাংলা একাডেমির ফেলো আবু শাহরিয়ার লেখালেখি করতে গিয়ে যেসব বই কিনেছিলেন এবং সংগ্রহ করেছিলেন ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারে সেসব বই উপহার দিয়ে গেছেন। বাংলা একাডেমির প্রধান গ্রন্থাগারিক সেলিনা হোসেন ডাকযোগে আবু শাহরিয়ারকে জানান, ‘মহোদয়, আপনি বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারে যেসব গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন, ধন্যবাদের সঙ্গে তা গ্রহণ করা হল। আগ্রহী পাঠক ও গবেষক এতে উপকৃত হবেন। আপনার আন্তরিক সহযোগিতা জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধি করে তুলবে। ভবিষ্যতে একাডেমির প্রতি আপনার এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি। ধন্যবাদান্তে...’। না, তিনি ভবিষ্যতে আর বাংলা একাডেমিকে কোনো সহযোগিতা করতে পারেননি।
কবি শামসুর রাহমানকে তিনি বড়মাপের কবি বলে সম্মান করতেন। আবু শাহরিয়ারের ভাষায়, বাংলাদেশে কবি শামসুর রাহমানের মতো কবি আর হবে না। কবি শামসুর রাহমান নিজেও আবু শাহরিয়ারকে খুব পছন্দ করতেন। সে কথাও তিনি ২৮ জুন ২০০২ সালে দৈনিক জনকণেষ্ঠ ‘কালের ধুলোয় লেখা’ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মানুষটি আমার প্রকৃত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আপনজনদের মধ্যে অন্যতম। আমাকে, যতদূর জানি, তিনি খুবই পছন্দ করেন।’
আবু শাহরিয়ার জনপ্রিয় নাট্যকার, কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ও সাংবাদিক, নাট্যকার, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনকেও খুব পছন্দ করতেন। তার প্রধান কারণ লেখকের ধর্ম লিখে যাওয়ায়। তারাও লিখে যাচ্ছিলেন। ভালো-মন্দের বিচার করার দায়িত্ব লেখকের নয়, পাঠকের। তিনি কবি সাহিত্যিকদের সম্মান করতেন সব সময়। সে ছোট হোক আর বড় হোক। বলতেন, আমি কী? আমি কিছু না। আমি লিখতে পারি না। লিখতে চাইলেও হয়ে ওঠে না নানা সমস্যায়। আমাকে একান্তে অনেক সময় বলতেন, আপনি চালিয়ে যান, আপনার দ্বারা হবে। কিন্তু আমার দ্বারা কতটুকু হয়েছে তা আমি উপলব্ধি করলে মনে হয়, শূন্য। আমি কিছুই করতে পারিনি, কিছুই হতে পারিনি। অথচ আমার গুরু, সাহিত্যের শিক্ষক আবু শাহরিয়ারের আশা ছিল তার শিষ্য কিছু একটা হবে। গুরুর আশা আমি সফল করতে পারিনি। অনেকবার লেখা ছেড়ে দিতে চেয়েছি। তিনি নানা দেশের লেখকদের লেখক হওয়ার কাহিনী শুনিয়ে আমাকে সাহিত্যচর্চায় লেগে থাকতে বলেছেন সবসময়। এখন পরকাল থেকে আমার সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছু ভাবছেন তিনি। আমি মনে মনে বলি, আপনি ভাবুন। আপনি যেমন অভিমান করে চলে গেছেন, আমিও তেমনই অভিমান করে থাকব।
No comments