আওয়ামী লীগ ছিল অ্যান্টি লিবারেশন ফোর্স: সিরাজুল আলম খান
জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি ফোর্স আর আওয়ামী লীগ ছিল অ্যান্টি লিবারেশন ফোর্স। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সম্পর্কে জাসদের আধ্যাত্মিক গুরু সিরাজুল আলম খানের পর্যবেক্ষণ এরকম। সদ্য প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদ লিখিত ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থের ৭১ পৃষ্ঠায় এ কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ওই গ্রন্থে বলা হয়েছে, “১৯৭২ সালের জানুয়ারির কোনো এক সময় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের একটি বৈঠক হয়। সিরাজুল আলম খান ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে একটি ১৫ দফা কর্মসূচির খসড়া দিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে। নতুন রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, এই কর্মসূচিতে তিনি তা উল্লেখ করেছিলেন। প্রস্তাবগুলো ছিল : ১. অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনর্গঠনের একটা পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি বিপ্লবী জাতীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দলের সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু। ২. কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত নেতৃত্ব দ্বারা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন। ৩. বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনবোধে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাঁকে কেন্দ্র কের বাঙালি জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে। ৪. বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে, কোনো দেশের অনুকরণে নয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হবে। ৫. চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ে রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী গঠন করা হবে। এফএফ এবং বিএলএফসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী তৈরি হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোনো বাহিনী থাকবে না। ৬. রেভল্যুশনারি গার্ডের মধ্যে থাকবে: ক) বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, যা কিনা হবে ‘পিপলস আর্মি’। খ) কৃষিকাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য রেভল্যুশনারি কৃষক ব্রিগেড। গ) শিল্প এলাকার জন্য রেভল্যুশনারি লেবার ব্রিগেড। ৭. নিবর্তনমূলক পুলিশ বাহিনীর বদলে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন করা হবে। ‘পুলিশ’ নামটি ব্যবহার করা হবে না। ৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত খোলা হবে না। মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে ছোট ছোট স্কোয়াড তৈরি করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এক বছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ৯. উচ্চশিক্ষার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রয়োজনে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে যোগদিয়ে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হবে। ১০. ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের ধারাবাহিকতায় জেলা-মহকুমা-থানায় কমপক্ষে দুই-তিন বছর প্রশাসনের কোনো ক্যাডার বা গোষ্ঠীকে জনপ্রশাসনের দায়িত্বে রাখা যাবে না। ১১. মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরাই জনপ্রশাসনের দায়িত্বে থাকবেন। ১২. জনপ্রশাসনে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ- এই সব শ্রেণিবিন্যাস থাকবে না। কাজের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পাওয়ার জন্য যে স্তর হয়, তার কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থাকবে না। ১৩. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত হবে অনধিক১:৭। ১৪. সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতি চালু হবে। পরিত্যক্ত কলকারখানা মুক্তিযোদ্ধা শ্রমিক-কর্মচারীদের সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ১৫. কেবল ভারত ও রাশিয়ার ওপর নির্ভর না করে চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। কর্মসূচিটি একঝলক দেখে শেখ মুজিব সেটা তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেন। ড্রয়ার থেকে সেটা আর বের হয়নি। সর্বদলীয় সরকারের ব্যাপারে শেখ মুজিবের প্রাথমিক সম্মতি ছিল। তবে তার মনে হয়েছিল, এটা সম্ভব হবে না। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে বেশ কিছু কথাবার্তা হয়। মুজিব : অন্য কোনো দল আসবে না। সুতরাং ওই চিন্তা বাদ দাও। সিরাজ: কথাবার্তা বলতে হবে সবার সাথে। তোহা ভাইকে আমি যেমন করেই হোক ম্যানেজ করব। সিরাজ শিকদারকেও আমি আনতে পারব। মুজিব: আমার মনে হয় না এটা সম্ভব হবে। আমার দলের অনেকেই এটা পছন্দ করবে না। গণভবনের সবুজ চত্বরে এক সন্ধ্যায় সিরাজুর আলম খানের কাঁধে হাত রেখে শেখ মুজিব অনেকক্ষণ হেঁটেছিলেন। এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, ‘পারলাম না রে, সিরাজ।’ আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাজউদ্দীনের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি লক্ষ করলেন, তাজউদ্দীন ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীনের ভূমিকা ও পরবর্তী সময়ে তাঁর নেপথ্যে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সিরাজুল আলম খানের পর্যবেক্ষণ ছিল এরকম : বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ের নেতা হলেন তাজউদ্দীন। জামায়াতে ইসলামী হলো পাকিস্তানি ফোর্স আর আওয়ামী লীগ ছিল অ্যান্টি লিবারেশন ফোর্স। আওয়ামী লীগ তো ছয় দফা থেকে এক ইঞ্চিও আগে বাড়তে চায়নি। এদের সত্যিকার চেহারা জানতে পারলে মানুষ এদের গায়ে থুতু দেবে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীনের নাম আসা উচিত এক নম্বরে। অথচ তিনিই হলেন এর প্রথম ক্যাজুয়ালটি। সিরাজুল আলম খানের দেওয়া প্রস্তাবগুলো শেখ মুজিব অবশ্য নীতিগতভাবে মেনে নেন এবং স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ) উপলক্ষে তিনি এই বিষয়ে একটি ঘোষণা দেবেন বলে মন্তব্য করেন।”
No comments