কবির গোপন আকাঙ্ক্ষার মানচিত্র
স্প্যানিশ
সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে একনিষ্ঠ গবেষণা, সৃজনশীল প্রবন্ধ রচনা ও
বিশ্বস্ত অনুবাদের কল্যাণে রাজু আলাউদ্দিনের নাম বোদ্ধা মহলে গবেষক,
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসেবে সমাদৃত হলেও তিনি কবি হিসেবে পরিচিত হতেই বেশি
আগ্রহী। এর কারণও আছে। রাজু আলাউদ্দিন শুরু করেছিলেন বিদেশী কবিতার অনুবাদ
দিয়েই। সেই ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা’ (সে সূত্রেই
তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয়); এর পর ‘সিপি কাভাফির কবিতা’; আরও পরে
হর্হে লুই বোর্হেসের কবিতার অনুবাদ। বিপুল গদ্য রচনার মাঝে মধ্যে রাজু
কবিতা লিখেছেন। সাহিত্যের সবচেয়ে পরিশীলিত ও আঁটোসাঁটো দুর্জ্ঞেয়তাকে তিনি
সবচেয়ে বেশি আয়াসসাধ্য আর আরাধ্য করে রেখেছেন। যখন অনুবাদ আর প্রবন্ধে তিনি
স্বতোৎসারিত, বহুলপ্রজ, তখনও কবিতায় তিনি সতর্ক, বিরলপ্রজ। তিনি যে অনেক
বিলম্বে, আমি বলব মাত্রাতিরিক্ত বিলম্বে, প্রথম বইটি প্রকাশ করলেন তার একটি
কারণ দীর্ঘ ত্রিশ বছরের লেখালেখির জীবনে খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি।
কবিতার দেবীকে অতিরিক্ত ভক্তিতে পুজোমণ্ডপের কেন্দ্রে রেখে দিয়েছেন, তাকে
সাধারণ্যে অবতরণের আহ্বান জানাননি, না সেই চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীরূপে দেখার
বাসনায় ছটফট করেছেন। যদিও শেষাবধি তিনি তাকে বাহুবন্ধনেই বেঁধেছেন। অবশ্য
তার জীবনে সুদীর্ঘকালের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটে গেছে ভাগ্যান্বেষণে।
রাজু আলাউদ্দিনের এ বিলম্বিত প্রকাশকে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিরতি নয়,
দীর্ঘ প্রস্তুতি বলেছেন। রাজু আলাউদ্দিনের দীর্ঘ প্রস্তুতির ফসল এ গ্রন্থ
‘আকাক্সক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি’ তার গোপনে অংকিত আকাক্সক্ষাকে পাঠকের
সমুখে উন্মুক্ত করেছে।
কবি রাজু আলাউদ্দিন একজন আধুনিক মননের যুক্তিবাদী মানুষ, পৌরাণিক বিশ্বাস তাকে টানেনি, তিনি পুরোপুরি সংস্কারবর্জিত। তার প্রেমের প্রকাশ প্রথাগত নয়। লৌকিক প্রেমকে পারলৌকিক বিশ্বাসের সমান্তরালে দাঁড় করাতে কবি কোনো সংকোচ করেননি। ‘চুম্বনের আলো’ কবিতায় তিনি প্রেমাস্পদের চুম্বনকে আয়াতের মতো নিজের শরীরে ঝরে পড়তে দেখেন। গ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা ‘অভিন্ন যাপন’-এ তিনি লেখেন,
তোমাকে যে ভালোবাসি-এ কথা গড়িয়ে গেছে সুদূর জাপানে
নিঃসন্দেহে আনকোরা; আনকোরা এবং হৃদয়গ্রাহী। অন্যত্র প্রেমিকার জন্য তার প্রস্তুতি ও অপেক্ষাকে বিপ্লবের জন্য একটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর অপেক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন,
যেভাবে একটি দেশ বিপ্লবে বিকশিত হয়
আমিও তোমার জন্য সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। (ভালোবাসার ওক্সিমোরন)
আরেকটি কবিতায় বলেন, ‘তবুও তোমার প্রতি আমার পিপাসা/ অনিঃশেষ রবে আমরণ (মাইগ্রেশন)।’ ওই হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানির মতো কিংবা আরও প্রমত্ত্ব বজ্রের মতো উচ্চকিত হলেও রাজু আলাউদ্দিনের প্রেম বেশিরভাগ কবিতাতেই কিছুটা অনুচ্চ, মূলত শব্দচয়নে অত্যন্ত মিতব্যয়ীর এ কবির ভেতরে অতিকথনের ঝোঁক প্রায় অনুপস্থিত। কবিতার আড়াল ও নিটোল গাঁথুনির ওপরে তার পক্ষপাত। ‘পারস্পরিক’ কবিতায় এঁকেছেন ভালোবাসার সুনন্দ ছবি,
‘যখন বসেছ এসে মুখোমুখি তখন অথৈ
দুপুর গড়িয়ে গেছে, ততক্ষণে তোমার চুলের
স্নানাস্তের শিশির ছায়ারা গেছে ঝরে
যে রকম প্রণালীতে ভালোবাসা বিশ্বচরাচরে
পুষ্টিহীন শিশুর মতো ঝরে যায়
তবু সে বিকেল জানি, ঈশ্বরী তোমার প্রভায়
জীবন নতুন করে জেগেছিলো অর্থের গাঢ় প্রেরণায়’
উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিসমূহে জীবনানন্দ উঁকি দিয়ে গেলেও ‘যে রকম প্রণালীতে ভালোবাসা বিশ্বচরাচরে/পুষ্টিহীন শিশুর মতো ঝরে যায়’ অভিনব। কবিতাটি রাজু আলাউদ্দিনের একটি নিটোল প্রেমের কবিতা। ‘অর্থের গাঢ় প্রেরণায়’ ভিন্ন অর্থ তুলে ধরে। কেননা ‘অর্থ-স্তুতি’ নামে তার একটি কবিতা আছে যেখানে তিনি লিখেন, ‘অর্থ, তাই জরুরি ভীষণ/অর্থ পেলে পুনরায় নিজেকে আবার/মানবিক আলো দিয়ে প্রক্ষালন করে নেব আর/আদিগন্ত বিস্তৃত করে দেব আমার হৃদয়/ ফুল্ল হবে পুনরায় আমার গভীর ভালোবাসা।’ আধুনিক কবি জানেন অর্থের মাহাত্ম্য, কেননা অভাব দরোজা দিয়ে ঢুকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং অর্থ সেই মানবিক আলো যা দিয়ে প্রক্ষালন করে নেয়া যায় হৃদয়, ভালোবাসা ফুল্লময় হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন বিত্তহীন শুদ্ধ ভালোবাসা থেকে কতই না আলাদা বিবর্তিত সময়ের এ অর্থময় ভালোবাসা!
রাজু আলাউদ্দিনের কবিতায় আলো এবং আঁধারের সহাবস্থান কিংবা সংঘাত বারবার ফিরে আসে। জগতের এ দুই প্রধান উপস্থিতি নিয়ে তার কাব্যিক কৌতূহলের শেষ নেই। আলোর চেয়েও, আধুনিক কবি বলেই হয়তোবা, আঁধার তার কাছে অধিকতর প্রিয়, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তিনি ফিরে আসেন আলোর কাছেই, কেননা শুভত্বে বিশ্বাসী এ কবি আপাদমস্তক রোমান্টিক। ‘আলোকপ্রাপ্তির যুগ’ কবিতায় তার উচ্চারণ :
চারিদিক যতো বেশি আলোকিত হয়ে ওঠে
অন্ধকার তত বেশি আলোর গভীরে গিয়ে
ঘনীভূত হয়
তাই এতো আলোর বিকাশ
তাই এতো রাত্রি, দেখ,
নিহিত পাতালে বহমান
তবু জানি, মানুষের সকল উদ্যম
আলোর গরিমা নিয়ে চিরন্তন আঁধারের
পিছে ধেয়ে যায়।
আঁধারের আবাস হলো রাত্রি, দিবসের যে পর্ব নিয়ে উচ্ছ্বাসময় এই কবি।
‘রাত্রির বন্দনা’ কবিতায় রাজু লেখেন,
এসো, রাত্রি মাতৃভূমি আমাদের প্রায়োবাসের
জীবনের গুহার ভিতরে
তোমার জরায়ু ছিঁড়ে আজো আমি বেরুতে পারিনি
এখন যেখানে আছি
এ তো সেই জরায়ুর অরোময় সম্প্রসারণ,
উপরের ওই উপলব্ধি একজন আধুনিক কবির। একই কবিতায় তিনি আলোকে ঘাতক বলেছেন যা পুরোপুরি বিরাশ করে। আলো-আঁধারির মতোই ঘুম আর স্বপ্ন রাজু আলাউদ্দিনের আরেকটি প্রিয় বিষয়। উল্লেখ্য, মান্নান সৈয়দের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন রাজু আলাউদ্দিন। গ্রন্থের একমাত্র টানা গদ্যে লেখা কবিতাটির নামও ‘স্বপ্নের অনুবাদ’। এ কবিতাটিতে রাজু আলাউদ্দিনের টানা গদ্যে কবিতা লেখার শক্তি প্রস্ফুটিত, যা ভবিষ্যতে আরও আরও টানাগদ্যে লেখার সম্ভাবনাকে উসকে দিয়েছে। কিছু অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।
ঘুমের স্ট্রেচার যখন সন্তর্পণে আমাকে লোকান্তরের মর্গে ফেলে দিয়ে আসে, আমার
শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো তখন খরস্রোতা নদীর মতো কলকলিয়ে ওঠে। নিজস্ব মুদ্রায় তারা
শিরদাঁড়ায় নির্ভয়ে ফণা তুলে দাঁড়ায়, নিহিত নির্জনের ছায়ার পাৎলুনে ঢাকা তাদের
শরীর, বাৎসল্যের চূড়ান্ত ছুঁয়ে আছে তাদের প্রত্যেকের নিকানো শরীর-সংসার।
এই কবিতায় তিনি বলেন ‘আমি প্রতিদিন ঘুমের গভীর অলিঙ্গনে মরে যাই।’ একই কবিতার অন্যত্র ঘুমকে ‘মৃত্যুর খুচরো আলিঙ্গন’ বলেছেন। উদ্ধৃত করছি :
আমি যখন এইসব কবিতার ঝনাৎকারে মৃত্যুর খুচরো আলিঙ্গন ভেঙে জেগে উঠি;
ওরা ততক্ষণে ঊর্ধ্বশ্বাসে উধাও পালায়, যেন অবাঞ্ছিত কেউ; যেন টিলো এক্সপ্রেস
খেলতে গিয়ে ভুল করে মৈথুন-মগ্ন কোন দম্পতির ঘরের জানলায় চোখ পড়তেই
দ্রুত-সটকে-পড়া এক বালক।
প্রিয় রমণীর প্রতি দুর্লভ আকাক্সক্ষা ছাড়াও এ গ্রন্থে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট লক্ষ্য করা যায়। আত্মপরিচয়ের সংকট এসেছে তার অভিবাসী জীবনের কারণে। জীবিকা ও স্প্যানিশ সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে রাজু আলাউদ্দিন বেশ কিছু বছর মেহিকোতে কাটিয়েছেন। ‘আত্মপরিচয়’ শিরোনামের কবিতাটিতে তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় বিদ্ধ করেন নিজেকেই, ‘কোথায় আমার দেশ?/মেহিকোয় নাকি বাংলাদেশে?’ শুধু কবি নন, তার প্রেয়সীও ছেড়ে গেছে মাতৃভূমির অঞ্চল (মাইগ্রেশন)। সেখানে হাহাকারজনিত একটি উচ্চারণ আছে, ‘হয়তো কোন দেশ নেই মানুষের, আছে শুধু ঘর’। স্বদেশভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতা তাতে নস্টালজিক করে তোলে। রোমান্টিক বলেই তিনি নস্টালজিক। ভৌগলিক দূরত্ব যত বাড়ে, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা তত সুতীব্র হতে থাকে। ‘তুমি আমার পৃথিবী’ কবিতাটি মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার আবেগে ভরপুর। তিনি লিখেন,
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
আবেগের কারণেই এতে হয়তো অতিশোয়ক্তি আছে, আছে পুনরাবৃত্তিও, কিন্তু দেশপ্রেমের এক অভাবিত নতুনরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি এ কবিতায়। কবিতাটির ক্যাটালগিং কাঠামোর মাঝে লুকিয়ে আছে ওই চমৎকার উচ্চারণ, যা কবিতাটিতে তিনবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
রাজু আলাউদ্দিনের বেশিরভাগ কবিতাই পরিমিত, মেদহীন। ‘অনুবাদ’ কবিতাটি এরূপ-
‘বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ
কে তুমি এবং কোত্থেকে
এসেছো এখানে?’
আমি হচ্ছি অনুবাদ
গোপন কিছুর;
দৃশ্যাতীত, অচেনা ভাষার
পাণ্ডুলিপি থেকে
অনুবাদ করেছেন আমার বাবা-মা
কোলাবোরেশনে।
মানব সৃষ্টিরহস্যকে তিনি সৃজনশীল প্রতীকে উপস্থাপন করেছেন। জনক-জননীর মিলনকে কোলাবোরেশন হিসেবে উল্লেখ অভিনব। এ কবিতার শুরুর মতো রাজুর অনেক কবিতাতেই কথোপথনের ভঙ্গিটি পাওয়া যায়, কবি নিরন্তর কথা বলছেন বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে বা উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন জিজ্ঞাসার। এভাবে পাঠকের সঙ্গে সেতু গড়ার অলক্ষ্য কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন সচেতনভাবেই। যিনি লিখেন-
আমি জানি সংসারের কথা
নদীর আর লতাগুল্ম পাতা
যতদূর গড়ায় ছড়ায়
উৎস তার বেঁচে থাকে
ব্যাকুল ডগায় (অভিন্ন যাপন)
তিনি যে আমাদের চমকিত করবেন সন্দেহ কী? আমার কাছে তার এই হঠাৎ থেমে যাওয়াকে সুন্দর মনে হয়। কখনও তিনি নিজেও সন্দিহান কোথায় থামবেন বা কীভাবে থামবেন।
রাজু আলাউদ্দিনের কবিতার সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা মন্তব্য করেছেন ‘তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মনপ্রিয়তাকে রাজু অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন।....উপলব্ধীগত অভিনবত্ব ও বাকভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী এ কবি এভাবেই যেন শব্দ ও চেতনা মেপে মেপে তৈরি করেন কবিতার রহস্যপ্রতিমা।’ তার এ মূল্যায়নের সঙ্গে আমি একমত। রাজু আলাউদ্দিনের উপলব্ধীগত অভিনবত্ব ও বাকভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যসন্ধান রয়েছে। তার সব কবিতাই যে আমাকে টেনেছে তা নয়, তবে কবিতাপাঠে ক্লান্তি জমেনি, দীর্ঘসময়ে জমে উঠা লেখালেখি থেকে সচেতনভাবেই কবিতা বাছাই করেছেন কবি, রাখতে চেয়েছেন বিভিন্ন স্বাদের কবিতা। তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। তাকে অভিবাদন! কাব্য প্রকাশনার ভুবনে রাজু আলাউদ্দিনের বিলম্বে প্রবেশ একটি সুসংবাদ হয়ে উঠুক- এ প্রত্যাশা করছি।
কামরুল হাসান
বই
আকাক্সক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি
প্রকাশক রবীন আহসান ।। শ্রাবণ প্রকাশন
প্রচ্ছদ ।। আলফ্রেড খোকন দাম ।। ৮০ টাকা
কবি রাজু আলাউদ্দিন একজন আধুনিক মননের যুক্তিবাদী মানুষ, পৌরাণিক বিশ্বাস তাকে টানেনি, তিনি পুরোপুরি সংস্কারবর্জিত। তার প্রেমের প্রকাশ প্রথাগত নয়। লৌকিক প্রেমকে পারলৌকিক বিশ্বাসের সমান্তরালে দাঁড় করাতে কবি কোনো সংকোচ করেননি। ‘চুম্বনের আলো’ কবিতায় তিনি প্রেমাস্পদের চুম্বনকে আয়াতের মতো নিজের শরীরে ঝরে পড়তে দেখেন। গ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা ‘অভিন্ন যাপন’-এ তিনি লেখেন,
তোমাকে যে ভালোবাসি-এ কথা গড়িয়ে গেছে সুদূর জাপানে
নিঃসন্দেহে আনকোরা; আনকোরা এবং হৃদয়গ্রাহী। অন্যত্র প্রেমিকার জন্য তার প্রস্তুতি ও অপেক্ষাকে বিপ্লবের জন্য একটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর অপেক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন,
যেভাবে একটি দেশ বিপ্লবে বিকশিত হয়
আমিও তোমার জন্য সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। (ভালোবাসার ওক্সিমোরন)
আরেকটি কবিতায় বলেন, ‘তবুও তোমার প্রতি আমার পিপাসা/ অনিঃশেষ রবে আমরণ (মাইগ্রেশন)।’ ওই হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানির মতো কিংবা আরও প্রমত্ত্ব বজ্রের মতো উচ্চকিত হলেও রাজু আলাউদ্দিনের প্রেম বেশিরভাগ কবিতাতেই কিছুটা অনুচ্চ, মূলত শব্দচয়নে অত্যন্ত মিতব্যয়ীর এ কবির ভেতরে অতিকথনের ঝোঁক প্রায় অনুপস্থিত। কবিতার আড়াল ও নিটোল গাঁথুনির ওপরে তার পক্ষপাত। ‘পারস্পরিক’ কবিতায় এঁকেছেন ভালোবাসার সুনন্দ ছবি,
‘যখন বসেছ এসে মুখোমুখি তখন অথৈ
দুপুর গড়িয়ে গেছে, ততক্ষণে তোমার চুলের
স্নানাস্তের শিশির ছায়ারা গেছে ঝরে
যে রকম প্রণালীতে ভালোবাসা বিশ্বচরাচরে
পুষ্টিহীন শিশুর মতো ঝরে যায়
তবু সে বিকেল জানি, ঈশ্বরী তোমার প্রভায়
জীবন নতুন করে জেগেছিলো অর্থের গাঢ় প্রেরণায়’
উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিসমূহে জীবনানন্দ উঁকি দিয়ে গেলেও ‘যে রকম প্রণালীতে ভালোবাসা বিশ্বচরাচরে/পুষ্টিহীন শিশুর মতো ঝরে যায়’ অভিনব। কবিতাটি রাজু আলাউদ্দিনের একটি নিটোল প্রেমের কবিতা। ‘অর্থের গাঢ় প্রেরণায়’ ভিন্ন অর্থ তুলে ধরে। কেননা ‘অর্থ-স্তুতি’ নামে তার একটি কবিতা আছে যেখানে তিনি লিখেন, ‘অর্থ, তাই জরুরি ভীষণ/অর্থ পেলে পুনরায় নিজেকে আবার/মানবিক আলো দিয়ে প্রক্ষালন করে নেব আর/আদিগন্ত বিস্তৃত করে দেব আমার হৃদয়/ ফুল্ল হবে পুনরায় আমার গভীর ভালোবাসা।’ আধুনিক কবি জানেন অর্থের মাহাত্ম্য, কেননা অভাব দরোজা দিয়ে ঢুকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং অর্থ সেই মানবিক আলো যা দিয়ে প্রক্ষালন করে নেয়া যায় হৃদয়, ভালোবাসা ফুল্লময় হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন বিত্তহীন শুদ্ধ ভালোবাসা থেকে কতই না আলাদা বিবর্তিত সময়ের এ অর্থময় ভালোবাসা!
রাজু আলাউদ্দিনের কবিতায় আলো এবং আঁধারের সহাবস্থান কিংবা সংঘাত বারবার ফিরে আসে। জগতের এ দুই প্রধান উপস্থিতি নিয়ে তার কাব্যিক কৌতূহলের শেষ নেই। আলোর চেয়েও, আধুনিক কবি বলেই হয়তোবা, আঁধার তার কাছে অধিকতর প্রিয়, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তিনি ফিরে আসেন আলোর কাছেই, কেননা শুভত্বে বিশ্বাসী এ কবি আপাদমস্তক রোমান্টিক। ‘আলোকপ্রাপ্তির যুগ’ কবিতায় তার উচ্চারণ :
চারিদিক যতো বেশি আলোকিত হয়ে ওঠে
অন্ধকার তত বেশি আলোর গভীরে গিয়ে
ঘনীভূত হয়
তাই এতো আলোর বিকাশ
তাই এতো রাত্রি, দেখ,
নিহিত পাতালে বহমান
তবু জানি, মানুষের সকল উদ্যম
আলোর গরিমা নিয়ে চিরন্তন আঁধারের
পিছে ধেয়ে যায়।
আঁধারের আবাস হলো রাত্রি, দিবসের যে পর্ব নিয়ে উচ্ছ্বাসময় এই কবি।
‘রাত্রির বন্দনা’ কবিতায় রাজু লেখেন,
এসো, রাত্রি মাতৃভূমি আমাদের প্রায়োবাসের
জীবনের গুহার ভিতরে
তোমার জরায়ু ছিঁড়ে আজো আমি বেরুতে পারিনি
এখন যেখানে আছি
এ তো সেই জরায়ুর অরোময় সম্প্রসারণ,
উপরের ওই উপলব্ধি একজন আধুনিক কবির। একই কবিতায় তিনি আলোকে ঘাতক বলেছেন যা পুরোপুরি বিরাশ করে। আলো-আঁধারির মতোই ঘুম আর স্বপ্ন রাজু আলাউদ্দিনের আরেকটি প্রিয় বিষয়। উল্লেখ্য, মান্নান সৈয়দের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন রাজু আলাউদ্দিন। গ্রন্থের একমাত্র টানা গদ্যে লেখা কবিতাটির নামও ‘স্বপ্নের অনুবাদ’। এ কবিতাটিতে রাজু আলাউদ্দিনের টানা গদ্যে কবিতা লেখার শক্তি প্রস্ফুটিত, যা ভবিষ্যতে আরও আরও টানাগদ্যে লেখার সম্ভাবনাকে উসকে দিয়েছে। কিছু অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।
ঘুমের স্ট্রেচার যখন সন্তর্পণে আমাকে লোকান্তরের মর্গে ফেলে দিয়ে আসে, আমার
শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো তখন খরস্রোতা নদীর মতো কলকলিয়ে ওঠে। নিজস্ব মুদ্রায় তারা
শিরদাঁড়ায় নির্ভয়ে ফণা তুলে দাঁড়ায়, নিহিত নির্জনের ছায়ার পাৎলুনে ঢাকা তাদের
শরীর, বাৎসল্যের চূড়ান্ত ছুঁয়ে আছে তাদের প্রত্যেকের নিকানো শরীর-সংসার।
এই কবিতায় তিনি বলেন ‘আমি প্রতিদিন ঘুমের গভীর অলিঙ্গনে মরে যাই।’ একই কবিতার অন্যত্র ঘুমকে ‘মৃত্যুর খুচরো আলিঙ্গন’ বলেছেন। উদ্ধৃত করছি :
আমি যখন এইসব কবিতার ঝনাৎকারে মৃত্যুর খুচরো আলিঙ্গন ভেঙে জেগে উঠি;
ওরা ততক্ষণে ঊর্ধ্বশ্বাসে উধাও পালায়, যেন অবাঞ্ছিত কেউ; যেন টিলো এক্সপ্রেস
খেলতে গিয়ে ভুল করে মৈথুন-মগ্ন কোন দম্পতির ঘরের জানলায় চোখ পড়তেই
দ্রুত-সটকে-পড়া এক বালক।
প্রিয় রমণীর প্রতি দুর্লভ আকাক্সক্ষা ছাড়াও এ গ্রন্থে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট লক্ষ্য করা যায়। আত্মপরিচয়ের সংকট এসেছে তার অভিবাসী জীবনের কারণে। জীবিকা ও স্প্যানিশ সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে রাজু আলাউদ্দিন বেশ কিছু বছর মেহিকোতে কাটিয়েছেন। ‘আত্মপরিচয়’ শিরোনামের কবিতাটিতে তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় বিদ্ধ করেন নিজেকেই, ‘কোথায় আমার দেশ?/মেহিকোয় নাকি বাংলাদেশে?’ শুধু কবি নন, তার প্রেয়সীও ছেড়ে গেছে মাতৃভূমির অঞ্চল (মাইগ্রেশন)। সেখানে হাহাকারজনিত একটি উচ্চারণ আছে, ‘হয়তো কোন দেশ নেই মানুষের, আছে শুধু ঘর’। স্বদেশভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতা তাতে নস্টালজিক করে তোলে। রোমান্টিক বলেই তিনি নস্টালজিক। ভৌগলিক দূরত্ব যত বাড়ে, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা তত সুতীব্র হতে থাকে। ‘তুমি আমার পৃথিবী’ কবিতাটি মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার আবেগে ভরপুর। তিনি লিখেন,
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
আবেগের কারণেই এতে হয়তো অতিশোয়ক্তি আছে, আছে পুনরাবৃত্তিও, কিন্তু দেশপ্রেমের এক অভাবিত নতুনরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি এ কবিতায়। কবিতাটির ক্যাটালগিং কাঠামোর মাঝে লুকিয়ে আছে ওই চমৎকার উচ্চারণ, যা কবিতাটিতে তিনবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
রাজু আলাউদ্দিনের বেশিরভাগ কবিতাই পরিমিত, মেদহীন। ‘অনুবাদ’ কবিতাটি এরূপ-
‘বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ
কে তুমি এবং কোত্থেকে
এসেছো এখানে?’
আমি হচ্ছি অনুবাদ
গোপন কিছুর;
দৃশ্যাতীত, অচেনা ভাষার
পাণ্ডুলিপি থেকে
অনুবাদ করেছেন আমার বাবা-মা
কোলাবোরেশনে।
মানব সৃষ্টিরহস্যকে তিনি সৃজনশীল প্রতীকে উপস্থাপন করেছেন। জনক-জননীর মিলনকে কোলাবোরেশন হিসেবে উল্লেখ অভিনব। এ কবিতার শুরুর মতো রাজুর অনেক কবিতাতেই কথোপথনের ভঙ্গিটি পাওয়া যায়, কবি নিরন্তর কথা বলছেন বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে বা উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন জিজ্ঞাসার। এভাবে পাঠকের সঙ্গে সেতু গড়ার অলক্ষ্য কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন সচেতনভাবেই। যিনি লিখেন-
আমি জানি সংসারের কথা
নদীর আর লতাগুল্ম পাতা
যতদূর গড়ায় ছড়ায়
উৎস তার বেঁচে থাকে
ব্যাকুল ডগায় (অভিন্ন যাপন)
তিনি যে আমাদের চমকিত করবেন সন্দেহ কী? আমার কাছে তার এই হঠাৎ থেমে যাওয়াকে সুন্দর মনে হয়। কখনও তিনি নিজেও সন্দিহান কোথায় থামবেন বা কীভাবে থামবেন।
রাজু আলাউদ্দিনের কবিতার সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা মন্তব্য করেছেন ‘তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মনপ্রিয়তাকে রাজু অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন।....উপলব্ধীগত অভিনবত্ব ও বাকভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী এ কবি এভাবেই যেন শব্দ ও চেতনা মেপে মেপে তৈরি করেন কবিতার রহস্যপ্রতিমা।’ তার এ মূল্যায়নের সঙ্গে আমি একমত। রাজু আলাউদ্দিনের উপলব্ধীগত অভিনবত্ব ও বাকভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যসন্ধান রয়েছে। তার সব কবিতাই যে আমাকে টেনেছে তা নয়, তবে কবিতাপাঠে ক্লান্তি জমেনি, দীর্ঘসময়ে জমে উঠা লেখালেখি থেকে সচেতনভাবেই কবিতা বাছাই করেছেন কবি, রাখতে চেয়েছেন বিভিন্ন স্বাদের কবিতা। তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। তাকে অভিবাদন! কাব্য প্রকাশনার ভুবনে রাজু আলাউদ্দিনের বিলম্বে প্রবেশ একটি সুসংবাদ হয়ে উঠুক- এ প্রত্যাশা করছি।
কামরুল হাসান
বই
আকাক্সক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি
প্রকাশক রবীন আহসান ।। শ্রাবণ প্রকাশন
প্রচ্ছদ ।। আলফ্রেড খোকন দাম ।। ৮০ টাকা
No comments