দোষারোপ নয়, জবাবদিহিই গবেষণার লক্ষ্য by মোহাম্মদ রফিক হাসান
টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর
সম্প্রতি যে গবেষণা পরিচালনা করেছে, তার উদ্দেশ্য হলো এই খাতের সার্বিক
পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। গবেষণালব্ধ তথ্যসমূহকে
প্রত্যাখ্যান না করে বাস্তবতার নিরিখে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের
মাধ্যমে লাখ লাখ অভিভাবক, শিক্ষার্থী তথা সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা
সম্ভব বলে টিআইবি মনে করে। সমাজবিজ্ঞান গবেষণার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে
টিআইবির এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ফলাফলের
বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে সন্দেহ করার অবকাশ নেই।
টিআইবির গবেষণাটি দুই বছর ধরে (২০১২-১৪) পরিচালিত হয়। ওই সময়ের মধ্যে গবেষণার সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সেলে কর্মরত একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। ইউজিসিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য এবং পরিচালকসহ একাধিক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার ছাড়াও প্রশ্নমালা সরবরাহ করে লিখিতভাবে জবাব নেওয়া হয়।
অভিযোগ করা হয়েছে, টিআইবির প্রতিবেদনে ঢালাওভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সমালোচনা, আক্রমণ এবং হেয় করা হয়েছে। কিন্তু টিআইবির প্রতিবেদনের প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রাপ্ত ফলাফল সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অংশীজনের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। এ ছাড়া, প্রতিবেদন উপস্থাপনার প্রথমেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অংশীজনের ২০টি ইতিবাচক অর্জন/উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইতিমধ্যেই কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে, বিদেশগামিতার বিকল্প হিসেবে ভূমিকা রাখছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ঘটছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকেরা বর্তমানে বিদেশে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করছেন এবং প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে স্থান করে নিচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অব্যাহত শিক্ষার সুযোগকে সম্প্রসারিত করেছে, বিশেষত যাঁরা দ্বাদশ শ্রেণির পর নানা কারণে চাকরিতে প্রবেশ করতে বাধ্য হন, তাঁদের জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই প্রথম চাকরির বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে বিভিন্ন নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়, যেমন: বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োইনফরম্যাটিকস ইত্যাদি এবং শিক্ষা-শিখনের আধুনিক উপায়-উপকরণগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। এ ছাড়া, শিক্ষক মূল্যায়নে ছাত্রছাত্রীদের ফিডব্যাক গ্রহণ করা হয় এবং তা শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় ইত্যাদি।
দেখা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে বোর্ড অব ট্রাস্টির বিশেষ ভূমিকা ছিল বা বোর্ড অব ট্রাস্টি কেবল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করে শিক্ষাবিদদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ভার ছেড়ে দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো করেছে। টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন অর্জনে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ/অর্জনসহ এই খাতে ইতিবাচক অর্জনগুলোকে মোট ২০টি ধারায় উপস্থাপন করে দেখায়।
এরপর গবেষণায় প্রাপ্ত নেতিবাচক ফলগুলো উপস্থাপন করা হয় মোট ১৯টি ধারায়, যা গণমাধ্যমে বেশি আলোচিত হয়েছে। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্য ৭৯টি। এর মধ্যে সীমিতসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুশাসনের সমস্যা বিদ্যমান। টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান ২৪ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান অনিয়ম ও দুর্নীতি শুধু টিআইবির গবেষণার একক আবিষ্কার নয়। টিআইবি পদ্ধতিসম্মত গবেষণার মাধ্যমে বিরাজমান বাস্তবতার একটি চিত্র তুলে ধরেছে মাত্র। এ গবেষণায় দৈবচয়ন পদ্ধতিতে মোট ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচিত করে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে কথা বলা হয় এবং প্রত্যক্ষ পরিদর্শনের মাধ্যমেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যকে নির্বিচারে গ্রহণ না করে অভ্যন্তরীণ সামঞ্জস্যতা, তথ্যসমূহের পারস্পরিক সংগতি এবং একই তথ্য একাধিক ভিন্ন ভিন্ন সূত্র থেকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইউজিসি বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। মন্ত্রণালয়ও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া তারা অবৈধ অর্থ প্রদান করেছে কি না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে যেখানে ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া দুটিই বেআইনি, সেখানে সরকারি জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ লিখিতভাবে বলতে পারেন কি না যে তিনি বা তাঁর প্রতিষ্ঠান ঘুষ দিয়েছেন। টিআইবির প্রতিবেদনে প্রাপ্ত নেতিবাচক ফলগুলোকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে একধরনের অস্বীকৃতি বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যদিও টিআইবি তার প্রতিবেদনে সব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ঢালাওভাবে মন্তব্য করেনি, বরং এর সার্বিক উন্নয়নে ১৬ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অবিলম্বে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন, ২০১০ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাস্তবায়নে একটি পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা প্রণয়ন, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার স্থাপনে অতিসম্প্রতি যে বিধিমালা জারি করা হয়েছে, সেটি সংশোধনপূর্বক কেবল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রেটিংসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুমোদন প্রদান এবং শর্ত বা নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে দেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমতা আনয়ন, এবং সর্বোপরি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারকিকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে ইউজিসির এখতিয়ার বৃদ্ধি এবং ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়—উভয়ের জনবল, দক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা পড়ছে, যদিও এই সংখ্যা সীমিত। বিদেশ থেকে আসা মোট এক হাজার ৬৪২ জন ছাত্রছাত্রীর ৭৫ শতাংশই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নরত। বিদেশি অভিভাবকেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছেন। কারণ, ইউজিসি বা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সহায়ক তথ্য নেই। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক মানের রেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সব অভিভাবক/ছাত্রছাত্রীর সামনে বেছে নেওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরা প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি পাবেন, তেমনি অনেক বেশি বিদেশি ছাত্রছাত্রী আকর্ষণ করা সম্ভব হবে। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল দেশের অভ্যন্তরেও উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের পথকে অনেকাংশে রুদ্ধ করবে। তাই সব অংশীজনের কাছে অনুরোধ যে তাঁরা ঢালাও প্রত্যাখ্যান না করে দেশের সম্ভাবনাময় এই উচ্চশিক্ষা খাতটির সার্বিক উন্নয়নে টিআইবির গবেষণাভিত্তিক সুপারিশগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
মোহাম্মদ রফিক হাসান: পরিচালক (গবেষণা), টিআইবি।
No comments