ভাগ্য তাড়া করে ফিরছে মেসিকে by মতিউর রহমান চৌধুরী
কাঁদছে বিশ্ব। কাঁদছেন মেসি নিজেও।
ম্যারাডোনার খবর কি? তিনি হয়তো মনে মনে খুশিই হয়েছেন। তার রেকর্ড ভাঙতে
পারলেন না লিওনেল মেসি। বাংলাদেশ কি করছে? রীতিমতো আহাজারি চলছে সর্বত্র।
রাতের ঘুম হারাম করেছিলেন মেসি। স্বপ্ন ছিল মেসিকে ঘিরেই। এবার তার হাত
ধরেই বিশ্ব ফুটবলের মুকুটটা আসবে আর্জেন্টিনার কাছে। কেন আর্জেন্টিনা? কেন
মেসি? এর কোন জবাব নেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে। কোন মুহূর্তে তারা
আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। তবে
ফলাফল যে একদম নিখুঁত হবে তা বলা যায় না কোন অবস্থাতেই। কারণ ম্যারাডোনা
ক্রেজ তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি ফুটবল-ভক্তদের মধ্যে। সেই ৮৬ সন
থেকে আজ অবদি। ৯০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কাছ থেকেই লোথার ম্যাথিউস মুকুটটা
কেড়ে নিয়েছিলেন। এবার আর্জেন্টিনা চেয়েছিল মেসির নেতৃত্বে কাপ ফিরিয়ে আনতে।
কিন্তু সেটা হলো না। এর জন্য কাকে দায়ী করবেন? কোচ সাবেলাকে? মেসিকে?
ভাগ্যকে? নাকি পুরো টিমটাকে। পাকিস্তানের তৈরী ব্রাজুকাকে? যে বল দিয়ে
বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসি-ভক্তদের কাঁদিয়েছে জার্মানি। বাংলাদেশে এমনই ক্রেজ
তৈরি হয়েছিল যেখানে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত রাত জেগে খেলা দেখেছেন। তিনি
সহকর্মীদের বলেছেন, মেসি গোল করলে বা আর্জেন্টিনা জিতলে খুব খুশি হতেন।
প্রস্তুতি ছিল বিজয় মিছিলের। দেশজুড়ে ছিল টানটান উত্তেজনা। সেহেরির সময়ে এ
রকম উত্তেজনার সাক্ষী বাংলাদেশীরা কখনও হয়েছেন বলে জানা নেই। একদিকে
নির্ঘুম রাত। অন্যদিকে সেহেরির প্লেট রেখে টিভির পর্দায় চোখ। কখন কি হয়?
মেসির পায়ে যখন বল তখন সবাই নড়ে চড়ে বসেছেন। কিন্তু মেসি কি জানতেন তাকে
ইতিমধ্যেই বোতলবন্দি করা হয়েছে।
মেসি তো খালি খালি স্বপ্ন দেখাননি বিশ্ব জয়ের। দ্বারপ্রান্তে এসে সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। আর্জেন্টিনা তো সুযোগ কম পায়নি। হিগুয়েন যদি সহজ সুযোগটি হাতছাড়া না করতেন তাহলে মারাকানার ইতিহাস যা ছিল তা-ই থাকতো। কোন ইউরোপীয় টিম ল্যাটিন আমেরিকা থেকে কাপ নিয়ে দেশে ফিরতে পারতো না। মেসিও অন্তত দু’টো সুযোগ নষ্ট করেন স্বার্থপরের মতো শট নিয়ে। বিশ্বকাপ ফাইনালে এমন সুযোগ বারবার আসে না। শেষ বাঁশি বাজার দু’মিনিট আগে মেসির ফ্রি কিক এমনভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে তা কে ভেবেছিল। মেসি নিজেও ভেবেছিলেন কিনা জানি না। পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে তাকে বোতল বোতল পানি খেতে দেখা গেছে জার্মানদের ট্রফি নেয়ার সময়। জার্মানরা বিশ্ব জয় করেছে তাদের শক্তি আর কৌশল দিয়ে। ২৮ বছর আগে ফ্রেঞ্জ বেকেনবাউয়ারের নেয়া কৌশল ঠিকই কাজে লাগান জোয়াকিম লো। সেবার ম্যারাডোনাকে বোতলবন্দি করতে না পারলেও মেসিকে ঠিকই করেছেন। আরও নাটকীয়তা ক্লসাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে এই বিশ্বকাপে সম্পূর্ণ নতুন মুখ ব্রায়ান মিউনিখের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার গোয়েটসাকে নামিয়ে। আর্জেন্টাইন কোচ সাবেলা টেরই পাননি কেন এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন জোয়াকিম লো। তার কাছে হয়তো মনে হয়েছে সে আর কি? বিশ্বকাপ আসবে অপরিচিত মুখ তাকে মার্কিং-এর মধ্যে রাখার দরকার কি? ২২ বছর বয়স্ক গোয়েটসাকে সুযোগই দেয়া হচ্ছিল না। ক্লসার শূন্যস্থান তাকে দিয়ে পূরণ করার এত বড় ঝুঁকি নেবেন কিনা?
অথচ কে না জানে বিশ্বকাপে সুযোগ না পেলেও জার্মানির হয়ে ৩৫ খেলায় ১১ গোল পেয়েছেন এই গোয়েটসা। যাকে এক সময় ফ্রেঞ্জ বেকেনবাউয়ার মেসির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আর্জেন্টাইনকে কুপোকাত করার পর বলা হচ্ছে মেসি নয়, গোয়েটসাই সেরা। তাকে নিয়েই নতুন ইতিহাস লিখতে হবে। এটাকেই বলে ভাগ্য। না হলে প্রথম দিন নেমেই সব চেয়ে দামি গোল পেয়ে গেলেন। যে গোল তার দেশকে এনে দিলো বিশ্ব ফুটবলের তকমা। তাকে দিল ভবিষ্যৎ গড়ার নতুন এক স্বপ্ন। মেসি আসলেই আনলাকি প্লেয়ার। স্প্যানিশ লীগে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। ফিফার চারবার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন। অথচ বিশ্বকাপ! ফাইনালে মাত্র পনের গজ দূর থেকে বল মেরেও গোল পাননি। এমনকি গোলকিপারের কাছেও যায়নি। ফ্রি কিক বিশারদ হয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি। বীরের মতো আর্জেন্টিনায় যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু আর্জেন্টিনা গেলেন এক রাশ হতাশা নিয়ে। দেশের মানুষ মুখিয়ে ছিল বিজয় উল্লাসের জন্য। বাংলাদেশে পরস্থিতি কি হতো জানি না। তবে শেষ রাতে হয়তো বা পুলিশ ডাকতে হতো। কারণ এমন অন্ধ মেসি-ভক্ত খোদ আর্জেন্টিনায় আছেন কিনা তা বলা সম্ভব নয়। কথায় আছে জিতলে নায়ক, হারলে খলনায়ক। গোয়েটসা নায়ক হয়ে গেলেন রাতারাতি। কিন্তু নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে গেলেন মেসি। ফুটবলে এমনই হয়। অনেকেই এখন বলছেন মেসির পাশে সত্যিই ঈশ্বর নেই। থাকলে ভ্যাটিকান থেকে পোপ আশীর্বাদ করেও কোন ফল পেলেন না। এটা আমি মানবো না। ফুটবল যেমন টেকনিকের খেলা-তেমনি ভাগ্যেরও। দেখুন না জার্সি বদলের পালা আর্জেন্টিনার ওপর পড়বে কেন? সেটা তো জার্মানদের ওপরও পড়তে পারতো। নিজের জার্সি ছাড়া বিশেষ করে আর্জেন্টিনা যখন নীল জার্সি পড়ে খেলতে নামে তখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। অনেকেই বলেন, এটা নাকি এক অভিশপ্ত জার্সি। ’৯০ বিশ্বকাপেও জার্মানির কাছে হেরেছিল আর্জেন্টিনা একই জার্সি পরে। সেই দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। যা-ই হোক জার্মানরা লড়াকু জাতি। রক্ত দেখলে ওরা সিংহের মতো গর্জে ওঠে। সোয়েনস্টাইগারের রক্ত বৃথা যেতে দেয়নি তারা। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে দেখে কোচ জোয়াকিম লো ‘বেঞ্চ মেটদের’ বলেছিলেন, এর জবাব দেবো আমরা অন্যভাবে। ঠিকই দিয়েছেন। এই জবাব জার্মানির জন্য দ্যুতিময়। আর মেসির জন্য মর্মবেদনা- যা থেকে মেসি কখনও বের হতে পারবেন না। তাকে তাড়া করে বেড়াবে সারাজীবন।
No comments