আন্দোলন, না নতুন তত্ত্বকৌশল? by মলয় ভৌমিক
ঢাকায় খালেদা জিয়া যখন উপজেলা নির্বাচন
শেষে নতুন করে আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিচ্ছেন, তখন একই সময় লন্ডনে বসে তারেক
রহমান ‘প্রথম রাষ্ট্রপতিতত্ত্ব’ হাজির করেন। প্রশ্ন হলো, আন্দোলনের কথা বলে
স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে চার দশক পর মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য জিয়াউর
রহমানই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি—এমন তত্ত্ব বয়ান করা হলো কেন?
এই ‘কেন’র জবাব তারেক রহমান নিজেই দিয়েছেন ৯ এপ্রিল ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রীতত্ত্ব’ নামে আরেকটি তত্ত্ব হাজির করে। অর্থাৎ, প্রথম তত্ত্বের পর বিএনপির আন্দোলন নিয়ে যে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, দ্বিতীয় তত্ত্বের মাধ্যমে সেই সন্দেহ দূর করে দেওয়া হলো। সহজ কথায় এই দাঁড়াচ্ছে যে বিএনপি আপাতত আন্দোলনে যেতে পারছে না। এখন নেতা-কর্মীরা মাঠে না থাকলেও তত্ত্ব দুটি অন্তত বেশ কিছুদিন মাঠে থাকবে।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ কি না বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ‘প্রথম অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ কি না—মীমাংসিত এসব বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। অনেকেই মনে করছেন, আন্দোলনের ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য এ ধরনের তত্ত্ব আসলে একটা আত্মরক্ষামূলক কৌশল। এ কৌশল বর্তমানের অগোছালো সময় পার হতে বিএনপিকে সহায়তা করবে।
খালেদা জিয়া গত ২৯ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএফইউজের একাংশের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর আন্দোলনের মাধ্যমে গিনেস বুকে রেকর্ড করার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের আয়োজনকে কটাক্ষ করে আরও বলেছিলেন, ওই আয়োজনে টাকা দিয়ে লোক আনা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনে টাকা দিয়ে লোক আনতে হবে না, তারা স্বেচ্ছায় আসবে। ভাষণে তিনি আরেকটি কথাও বলেছিলেন, যা তাঁর ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর আন্দোলন জোরদার হবে’—এমন বক্তব্যের সঙ্গে মেলে না। তিনি বলেছিলেন, দিনক্ষণ ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন হয় না। তা যদি না-ই হয়, তাহলে আন্দোলন তীব্র করার প্রশ্নে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ডেডলাইনের তিনি উল্লেখ করলেন কেন?
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আন্দোলনের মাধ্যমে গিনেস বুকে রেকর্ড করার আলামত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাঁর ভাষণের দুই দিনের মাথায়, অর্থাৎ ৩১ মার্চ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম কিস্তি শেষ হয়। নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের প্রতিবাদে বিএনপি-জামায়াত জোট অন্তত ১০টি উপজেলায় হরতাল আহ্বান করেছিল। হরতাল-পরবর্তী সংবাদ শিরোনাম হলো ‘হরতাল ডেকে বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা মাঠে নেই’। আগের চার কিস্তির নির্বাচন-পরবর্তী চিত্রও প্রায় একই। দেখা যাচ্ছে, নেতা-কর্মীরা স্বেচ্ছায় মাঠে নামছেন না।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন যে ভালো হয়নি, তা নির্বাচন কমিশনও স্বীকার করেছে। এ নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার তা আরও বেশি দলীয় রূপ পায়। উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের সঙ্গে তৃণমূলের দলীয় নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা নানা কারণে জাতীয় নির্বাচনের থেকে বেশি। কাজেই নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটার কথা। অথচ আমরা দেখলাম, একেবারে হাতের নাগালে পাওয়া এ রকম একটা ইস্যুতেও বড় দল বিএনপি তাদের কর্মীদের মাঠে নামাতে পারল না।
৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ছিল একপেশে এবং এ নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর কথা উঠেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও ছিল একতরফা। সেই নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি দেড় মাসও ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সংসদ ভেঙে দিতে হয়েছিল। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ’৯৬-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলেও, আন্দোলনের ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি কিন্তু লক্ষ করা গেল না। প্রায় সাড়ে তিন মাস পেরোল, অথচ বিএনপির পক্ষ থেকে উল্লেখ করার মতো কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির দাবি অনুযায়ী তাদের জনসম্পৃক্ততা থেকে থাকলে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষোভের সঙ্গে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ক্ষোভের মিশেলে একটা বিস্ফোরণ ঘটার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই চোখে পড়ছে না।
বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবের উল্লেখ করা যায়। হিসাব দুটিতে হয় দলটি সত্যি সত্যি ভুল করেছে, অথবা ভুল জানা সত্ত্বেও তা সঠিক বলে প্রচার করেছে। প্রথম হিসাবটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ পড়লে বিএনপি ক্ষুব্ধ হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের ডাক দেয়। অবশ্য তারা প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এ বিষয়ে একেকবার একেক রকম বিভ্রান্তিকর প্রস্তাব দিয়েছে। তবে হিসাবের ভুলটি এখানে নয়। তাহলে ভুলটি কোথায়? তাদের আন্দোলনের সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে নানা রকম জরিপ আসতে থাকে। এসব থেকে অনেকের মনে একটা গড় ধারণা জন্মে যে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সমর্থন করে। বিএনপির হিসাবের ভুলটা ছিল এখানেই যে তারা বোঝার বা বলার চেষ্টা করেছে, বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, সুতরাং তারা সবাই বিএনপিকেও চায়। কিন্তু একটা নির্বিরোধ নির্বাচনের প্রত্যাশায় অনেক আওয়ামী লীগ-সমর্থকও যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সমর্থন করেছে, তা বিএনপি হয় বোঝেনি অথবা বুঝেও বাজার জমাতে চুপ করে থেকেছে।
বিএনপি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে গণভোটের দাবি তুলেছিল। একই সময়ে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে গণভোটের দাবি উঠত (যদিও এ দাবি সংবিধানের মূল মর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়), তাহলে দেখা যেত, শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ তা সমর্থন করছে এবং এর মধ্যে প্রচুর বিএনপিপন্থী মানুষও থাকত। অর্থাৎ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলেই যেমন বিএনপিকে চাওয়া বোঝায় না, তেমনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেই বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান বোঝায় না।
দ্বিতীয় ভুলটি করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলকে কেন্দ্র করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে একের পর এক বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হতে থাকলে এমন একটা আবহ সৃষ্টির চেষ্টা চলে যে ভোটাররা সব বিএনপিকে সমর্থন করছেন। আসলে ভোটাররা অনেকেই যে বিএনপিকে সমর্থন করে তাঁদের প্রার্থীকে ভোট দেননি, ভোট দিয়েছেন ক্ষমতাসীন মেয়রকে অপছন্দ করার কারণে—সেই সত্য সম্ভবত বিএনপি হিসাবে নিতে চায়নি। ফলে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে দেখা গেল, যেসব মহানগরে বিপুলসংখ্যক ভোটার বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন, সেসব মহানগরেও বিএনপির ডাকে কেউ মাঠে নামছে না।
বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতার প্রশ্নে আরেকটি হিসাব আছে। এটি হলো আন্দোলনের নামে ব্যাপক সহিংসতা। জামায়াত-শিবিরকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনের নামে গত দেড়-দুই বছরে যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তাতে আন্দোলনের প্রতি কেবল সাধারণ মানুষই বীতশ্রদ্ধ হয়নি, বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থকও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
নানা যৌক্তিক ইস্যু থাকা সত্ত্বেও বিএনপি কেন আন্দোলনে কর্মী-সমর্থক বা সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না, তা বিএনপিকেই তলিয়ে দেখতে হবে। এটাই শোভন ও সরল পথ। সে পথ পরিহার করে ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য যদি নতুন তত্ত্বকৌশল খোঁজার চেষ্টা করা হয়, তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। নিকট অতীতেও আমরা বিএনপিকে আন্দোলনের সরল পথ পরিহার করে নানা ধূম্রজালে জড়াতে দেখেছি। এতে মানুষ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে, কিন্তু বিএনপির কোনো লাভ হয়নি। ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়েই জাতি এগিয়ে যায়। বারবার সেই পাটাতন নিয়ে টানাহেঁচড়া দায়িত্বশীল কোনো পক্ষের কাছ থেকেই কাম্য নয়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
No comments