আর ডাকাতি করব না by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় গিয়েছিলাম সরেজমিন প্রতিবেদন করার জন্য। বিষয়টা আগেই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু থানা সদরে পৌঁছানোর পরপরই শুনলাম, আগের রাতে ভয়াবহ ডাকাতি হয়েছে এখানকার একটি বাড়িতে। নির্ধারিত বিষয়টি আপাতত স্থগিত রেখে ছুটে যাই সেই বাড়িটিতে। গিয়ে দেখি ডাকাতেরা বাড়ির লোকজনকে মেরে গুরুতর জখম করার পর সোনা, নগদ টাকাসহ মূল্যবান সবকিছুই নিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়েছে। খোঁজখবর করার সময়ই শুনতে পাই, একই রাতে আরও কয়েকটি বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। অবাক হয়েছিলাম গ্রামের লোকজনের প্রতিক্রিয়া দেখে। যেন এটাকেই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন তাঁরা। থানা-পুলিশের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরাও অসহায়ত্ব পকাশ করলেন। জেনেছিলাম, শুধু আনোয়ারা না, পার্শ্ববর্তী বাঁশখালী বা চকরিয়ায়ও ডাকাতি প্রায় নিয়মিত ঘটনা। ওই ঘটনার পরদিন প্রথম আলোয় আনোয়ারার ডাকাতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে অবস্থার যে খুব পরিবর্তন হয়েছিল, তা-ও বলা যায় না।

সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে কয়েক বছর আগের সেই ঘটনা মনে পড়ল আবার। পাশাপাশি কিছুটা বিস্ময়ও জেগেছে মনে। বিস্ময়ের কারণটা জানানোর জন্য প্রতিবেদনটির মূল বিষয়টি এখানে তুলে ধরছি।
গত ১৭ মার্চ চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগরঘোনা সাইক্লোন শেল্টারে ৪০-৪৫ জন ডাকাত ও তাঁদের অভিভাবকেরা এসে পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং এলাকার লোকজনের উপস্থিতিতে ঘোষণা দেন যে তাঁরা আর কোনো দিন ডাকাতি করবেন না। এমনকি এলাকায় কোনো ধরনের ডাকাতির ঘটনা হলে তাঁরাই খুঁজে এনে ডাকাতদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করবেন।
আবেগঘন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল সভায়। ডাকাতদের কেউ কেউ অকপটে বলেছেন, অনেক অন্যায় করেছেন তাঁরা, একবার সুযোগ পেলে প্রায়শ্চিত্ত করবেন এবং বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন।
চকরিয়া এলাকায় চিংড়িঘেরে ডাকাতির বিষয়টি ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। তা ছাড়া বাড়িঘর বা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে গাড়ি আটকে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। ডাকাতদের এ রকম ‘আত্মসমর্পণ’ বা আত্মসংশোধনের ঘোষণায় নিশ্চয় কিছুটা স্বস্তি পাবেন ভুক্তভোগীরা। কথা হচ্ছে, এই ডাকাতদের প্রতিশ্রুতির ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, কেনই বা তাঁরা হঠাৎ দীর্ঘদিনের ‘পেশা’ পরিবর্তন করতে চান?
এর তাৎক্ষণিক উত্তর পাওয়া যায়নি। কৌতূহলবশত ডাকাতিপ্রবণ এলাকা আনোয়ারা ও বাঁশখালীতেও খোঁজ নিয়েছি। সেখানকার সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, ডাকাতির ঘটনা সেখানেও আজকাল প্রায় নেই বললেই চলে। এর কারণ নির্দিষ্ট করে কেউ জানাতে না পারলেও মোটা দাগে তাঁদের ধারণা, মানুষের আয়-উপার্জন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। সম্প্রতি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাপক প্রচলন হয়েছে চট্টগ্রামের শহরে ও গ্রামে। এই রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে যা আয় করা যায়, তাতে মোটামুটি সংসার চালিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে আগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও অনৈতিক পেশায় জড়িত হতে চান না কেউ। এই ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে জরিপ বা গবেষণা হতে পারে। তবে গ্রামাঞ্চলে মোটের ওপর ডাকাতির প্রকোপ যে কমেছে সন্দেহ নেই।
দুর্ভাগ্য, আমাদের কোনো সুসংবাদই যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গ্রামাঞ্চলে ডাকাতি কমেছে এই সংবাদে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার আগেই পত্রিকান্তরে ছাপা হয়েছে নৌপথে ডাকাতির সংবাদ। গত ১৬ মার্চ রাতে সোনাদিয়া দ্বীপের কাছে একদল জলদস্যু একটি মাছ ধরার ট্রলারে হামলা চালিয়ে লুট করে নিয়ে গেছে মাছ, জালসহ মূল্যবান সরঞ্জামাদি। পাশাপাশি ট্রলারসহ জেলেদেরও অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেছে তারা। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সাগর ও নদীপথে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে ডাকাতির ঘটনা।
এসব নিয়ন্ত্রণ করছে জলদস্যুদের অন্তত ১১টি দল। ডাকাতির পর এসব লুণ্ঠিত সামগ্রী নদীপথে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘাটে এসে বিক্রি করা হয়। এসব কেনাবেচায় জড়িত আরও চারটি সিন্ডিকেট। প্রতিটি সিন্ডিকেটে ৮-১০ জন সদস্য। এরাই অগ্রিম টাকা দিয়ে জলদস্যুদের ডাকাতি ও লুণ্ঠনের জন্য প্ররোচিত করে থাকে। ডাকাতির মাল বিক্রি হয় সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিসি ঘাট, চাক্তাইখাল, চরপাথরঘাটা, বার আউলিয়া ঘাট, পারকির চর প্রভৃতি এলাকায়। কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকের নামই নৌঘাট এলাকায় লোকমুখে শোনা যায়। এমনকি পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে অনেকের নাম। কিন্তু কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না তার কারণ ‘অজ্ঞাত’। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আক্তার চৌধুরী সম্প্রতি পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘সাগর ও নদীপথে চোরাইকৃত মালামাল চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হওয়ার কথা কিছুটা শুনেছি। এটা নিয়ে আমরা কাজও করছি। তবে বেশি দূর যেতে পারিনি।’
বেশি দূর যেতে বলি না। নদী-সাগরে জলদস্যুতা হলে তার দায় অনেকটাই কোস্টগার্ডের ওপর বর্তায়। কিন্তু ডাঙ্গায় এসে যখন সেই লুণ্ঠিত মালামাল কেনাবেচা হয়, সেখানে মাল জব্দ বা ক্রেতা-বিক্রেতাদের আটক করতে বাধা কোথায়? লুণ্ঠিত মালামাল বিক্রির পথ রুদ্ধ হলে, এ কাজে অগ্রিম টাকা বিনিয়োগ করা লোকগুলোকে আইনের আওতায় আনা গেলে জলদস্যুতা কমে আসবে।
বাবুল আক্তার চৌধুরী আরও বলেছেন, ‘যে এলাকায় চুরি-ডাকাতি হয়, মামলাও সাধারণত সেখানে করা হয়। ফলে সেখানকার পুলিশ বিষয়টি দেখে থাকে। এ কারণে আমাদের পক্ষে জোরালোভাবে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’ এসব শিশুতোষ যুক্তি গোয়েন্দা পুলিশের মুখপাত্রের জবানিতে মানানসই নয়। যে এলাকায় মামলা, সে এলাকার বাইরে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধরা যাবে না, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, এমন যুক্তি দাঁড় করালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়হীনতার ব্যাপারটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জেলে সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, জলদস্যুতা আর সম্পদহানির আশঙ্কায় জেলেদের জন্য সাগরে মাছ শিকার দিন দিন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। দ্রুতগতির ফিশিং ট্রলার নিয়ে জলদস্যুরা সারা বছরই অতর্কিত জেলেদের ওপর হামলা করে জাল, মাছ, ইঞ্জিন ও টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। শারীরিক নির্যাতন চালায়, এমনকি খুন করে সমুদ্রে ফেলে দেয়।
জলদস্যুতা রোধে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট আইন নেই। তবে সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ৪২ ধারায় মৎস্যশিকারি নৌযান, মাছ ধরার খুঁটি, যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জামাদির ক্ষতি বা ধ্বংস করার অপরাধে তিন বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
এসব বিধান যে যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বা জলদস্যুরা এর তোয়াক্কা করছে না তার প্রমাণ পত্রপত্রিকা খুললে তো পাওয়া যাচ্ছেই, পাঠকের অগোচরে থাকছে তার চেয়েও বেশি সংবাদ। শুরু করেছিলাম সুসংবাদ দিয়ে। চকরিয়ার ডাকাতেরা আর ডাকাতি করবেন না প্রতিশ্রুতি দিয়ে আত্মসংশোধনের সুযোগ চেয়েছেন। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁদের আয়-উপার্জন বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গের পাশে যে কথাটি বলা হয়নি, তা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। জলদস্যুতা প্রতিরোধেও সে রকম সক্রিয় ভূমিকা দেখতে চাই তাদের। যাতে এই ডাকাতদের মতো জলদস্যুরাও আত্মসমর্পণ করে প্রকাশ্যে এসে কবুল করতে বাধ্য হন, ‘আর ডাকাতি করব না।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.