আকাশ দখলে কেন মুখোমুখি গুগল-ফেসবুক?
মাটি থেকে ১২ মাইল উচ্চতা। সবকিছুই নীরব,
শান্ত। বাণিজ্যিক বিমানগুলোও নিরাপদ যাত্রাপথ হিসেব করে এত উঁচুতে ওড়ে না।
তাপমাত্রাও অনেকটা স্থির। তবে আছে প্রখর সূর্যকিরণ। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের
এই অঞ্চলটির দখল নিয়েই যেন যুদ্ধ বাঁধতে যাচ্ছে। এ যুদ্ধের দুটি পক্ষ
বিশ্বের দুটি বড় প্রতিষ্ঠান গুগল ও ফেসবুক। ড্রোন নিয়ে মুখোমুখি তারা।
>>টাইটানের তৈরি ড্রোন
অধিক উচ্চতায় একনাগাড়ে দীর্ঘদিন উড়তে পারে মনুষ্যবিহীন এমন বিমান বা ড্রোন তৈরিতে বিনিয়োগ করে চলেছে গুগল ও ফেসবুক। গুগল ও ফেসবুকের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুগল আর ফেসবুকের মধ্যে এখনই সরাসরি কোনো লড়াই বাঁধেনি। তবে, বাণিজ্যিক বিষয়গুলোতে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। সৌরশক্তিচালিত ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাইটান অ্যারোস্পেসকে গুগল কেনার ঘোষণা দেওয়ার পর তা আরও সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি কিনতে গত মার্চ মাসেই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ।
১৫ এপ্রিল ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটিকে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে গুগল।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরশক্তিচালিত বিশাল আকারের ড্রোন দিয়ে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই টাইটান অ্যারোস্পেসকে কিনছে গুগল। তবে প্রতিষ্ঠানটিকে কিনতে গুগল কী পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে, সে তথ্য জানায়নি।
গুগলের একজন মুখপাত্র এএফপিকে বলেছেন, ‘যদিও এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি, তারপরও পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষের কাছে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে বায়ুমণ্ডলের কৃত্রিম উপগ্রহগুলো কাজে লাগানো সম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পরিবেশের ক্ষতি থেকে রক্ষা এবং মানুষের নানা সমস্যায় কাজে লাগানো যাবে এই প্রযুক্তিকে। এ কারণেই গুগল পরিবারে টাইটান অ্যারোস্পেসকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।’
টাইটানের তৈরি ড্রোন ৬৫ হাজার ফুট উঁচুতে টানা পাঁচ বছর উড়তে পারে। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের মতোই কাজ করতে পারে এই ড্রোন। সৌরশক্তির সাহায্যে দীর্ঘদিন অনেক বেশি উচ্চতায় শূন্যে ভেসে থাকার ক্ষমতা থাকায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সুবিধা যোগ করতে পারে টাইটানের ড্রোন। এ ড্রোনে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকবে, যাতে ফিচার ফোনেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন এর আওতায় থাকা ব্যবহারকারীরা।
>>অ্যাসেন্টার তৈরি ড্রোন
ফেসবুক-গুগল দ্বন্দ্ব
এর আগে টাইটানকে কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছিল ফেসবুক। মার্চে টাইটান অ্যারোস্পেস কিনতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। ইন্টারনেট অর্গানাইজেশন প্রকল্পের জন্য তিনি টাইটানকে কিনতে চেয়েছিলেন। ফেসবুকসহ বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিলে ইন্টারনেট সংস্থা তৈরি করেছে, যার মূল লক্ষ্য ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া। টাইটানের তৈরি ড্রোনগুলো এই ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দিতে সক্ষম। তবে শেষ নাগাদ টাইটান কেনেনি জাকারবার্গ। কেন কেনেননি? গুগল কর্তৃপক্ষ টাইটান কিনতে ফেসবুকের চেয়ে বেশি অর্থ দিতে রাজি হয়েছে। তবে টাইটান কিনতে না পারলেও ড্রোন পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি জাকারবার্গ। তিনি অ্যাসেন্টা নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান কেনার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার কিছু গবেষককেও ফেসবুকের ড্রোন প্রকল্পে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছেন তিনি।
টাইটান ও অ্যাসেন্টা
টাইটানের মতো অ্যাসেন্টাও উঁচু দিয়ে উড়তে পারে, এমন ড্রোন তৈরি করতে সক্ষম। অ্যাসেন্টা নতুন ধরনের হালকা বিমান তৈরি করে, যা ৬০ হাজার মিটার উঁচুতে উড়তে পারে।
গুগল ও ফেসবুক উভয় প্রতিষ্ঠানের দাবি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দিতে তাদের এই বিনিয়োগ। অবশ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, গুগল ও ফেসবুকের বিশেষ এই অর্থলগ্নি করার পেছনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তবে এ ধরনের প্রকল্প থেকে তাঁর কীভাবে লাভ তুলে আনবে, তা এখনও অনেকের কাছে বোধগম্য নয়।
টাইটানের তৈরি সৌরশক্তিচালিত ‘সোলারা ৫০’ ও ‘সোলারা ৬০’ এরইমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে। এই ড্রোনের পাখা বোয়িং৭৬৭ এর চেয়ে বড়। তাতে সৌরপ্যানেল বসানো রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় একটি অভিযানে সোলারা ২৮ লাখ মাইল জুড়ে বিচরণ করতে পারে এবং ফিল্ড অব ভিউ হতে পারে ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
সোলারাতে একটি শক্তিশালী বেজ স্টেশন স্থাপন করা হলে ভূমিতে থাকা শত শত বেজ স্টেশনের তুলনায় বেশি মোবাইল কাভারেজ দেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া এর আগে টাইটার অ্যারোস্পেস দাবি করেছিল, তারা প্রতি সেকেন্ডে এক গিগাবিট গতির ইন্টারনেট সেবা দিতে সক্ষম, যা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের ইন্টারনেটের বর্তমান গতির চেয়েও বেশি।
ফেসবুক ও গুগলের নতুন ড্রোন থেকে ইন্টারনেট ছাড়াও কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর মতো অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। গুগল উল্লেখ করেছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়গুলো নজরদারি করতে এই ড্রোন ব্যবহার করা যেতে পারে।
মানুষের প্রয়োজন আগে কোনটি?
গুগল ও ফেসবুকের এই ধরনের উচ্চাভিলাসী প্রকল্প ইতিমধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এর আগে ফেসবুকের দাতব্য সংগঠন ইন্টারনেট অর্গানাইজেশনে ব্যবসায়িক স্বার্থ খুঁজে পেয়েছিলেন সমালোচকেরা। এদিকে গুগলের বেলুন দিয়ে ইন্টারনেট প্রকল্প ‘লুন’ও সমালোচনার মুখে পড়েছিল। এই সমালোচকদের মধ্যে বিল গেটসের মতো ব্যক্তিও রয়েছেন। গুগলের লুন প্রকল্পের সমালোচনা করে বিল গেটস বলেছিলেন, ‘যেখানে অসংখ্য শিশু ডায়রিয়ায় মারা যাচ্ছে, তখন বেলুনের দিকে তাকিয়ে কী হবে, তা আমি ভেবে পাই না।’
আকাশে ড্রোন: নতুন সম্ভাবনা
সমালোচনা থাকলেও গুগল ও ফেসবুক যে তাদের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাবে, তা বর্তমান বিনিয়োগ দেখলেই বোঝা যায়। যদি দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি বা দুটিই তাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়, তবে একগুচ্ছ ড্রোন সারা বিশ্বে ইন্টারনেট সুবিধা দিতে কাজ করবে। এই ড্রোন সুবিধার কিছু অংশ বৈজ্ঞানিক ও মানবিক কাজে ব্যবহূত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। ড্রোন প্রকল্পকে অনেকটাই গুগলের স্ট্রিট ভিউ প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করা চলে। ড্রোনের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্প এবং এতে প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়টি নিয়ে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন থাকলেও ব্যবসা ও গ্রাহকদের জন্য তা কার্যকর একটি সমাধান হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কৃত্রিম উপগ্রহের সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।
No comments