তারেকের ফাঁদে আওয়ামী লীগের পা by এ কে এম জাকারিয়া

রাজনীতিতে অবস্থা ও পরিস্থিতির বদল খুবই স্বাভাবিক। তা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কৌশল নেয়, প্রয়োজনে পাল্টায়। গত ৫ জানুয়ারির বৈধ, কিন্তু একতরফা বা বিতর্কিত নির্বাচনের পর সে নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া উচিত ছিল কি না বা অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল কি না—এসব নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলে অনেক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। দলের মধ্যেও এ বিষয়ে নানা মতের কথা শোনা গেছে। তবে এসব নিয়ে আমরা শুধু আঁচ-অনুমানই করতে পারব, কারণ দলের পক্ষ থেকে একটি পরিষ্কার চিত্র বা মূল্যায়ন হয়তো কখনোই পাওয়া যাবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, সরকার যেভাবে সবকিছুর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং একটি ‘স্বস্তির ভাব’ জনগণকে দিতে পেরেছে, সে অবস্থায় বিএনপির মতো দল কী কৌশল নিতে পারে?

বিএনপি এখন সংসদে নেই। ‘সংসদের ভেতরে-বাইরে’ আন্দোলন বলে যেসব কথা আমরা অতীতে শুনে এসেছি, দলটির পক্ষে তা আর করা সম্ভব নয়। এখন শুধু ‘বাইরের’ আন্দোলনকেই ভরসা মানতে হবে তাদের। দলটির বর্তমান যে সাংগঠনিক অবস্থা, তাতে রুটিন কিছু কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আন্দোলনে যাওয়ার পরিস্থিতি বা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দলের বড় নেতাদের কে কখন জেলে বা জেলের বাইরে থাকেন, সে হিসাব রাখা গণমাধ্যমের লোকজনের জন্যও কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতির বিভিন্ন মামলাও বেশ চাঙা হয়ে উঠেছে। দলের মহাসচিব ‘ভারপ্রাপ্ত’ অবস্থায় রয়েছেন বছর তিনেক ধরে। সিনিয়র নেতাদের বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে ‘লাইম লাইটে’ আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছেন। সমালোচকেরা বলেন, দলের প্রধান খালেদা জিয়ার কারও ওপর ঠিক আস্থা নেই। আমাদের রাজনীতির ঐতিহ্য মেনে তাঁরও সব আস্থা (দলে ও দলের বাইরে যতই বিতর্ক থাক) ছেলে তারেক রহমানের ওপরই। কিন্তু দেশে ফিরে তিনি দলের দায়িত্ব নেবেন, সে অবস্থাও নেই। পরিস্থিতিটি বিএনপির জন্য বড়ই বেকায়দার, কিন্তু বিএনপিকে তো কোনো না কোনো কৌশল নিতেই হবে, কূটকৌশল হলেও!
যেকোনো রাজনৈতিক দলের কৌশল গ্রহণ ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনার কারণে বিভিন্ন ধরনের হবে, এটাই স্বাভাবিক। স্টকহোমভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ) বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দলের কৌশল গ্রহণের বিষয়গুলোকে সাধারণভাবে কিছু ভাগে ভাগ করেছে। এই কৌশলগুলোর কোনোটি প্রো-অ্যাকটিভ (proactive), কোনোটি অ্যাডাপটিভ (adaptive), কোনোটি রি-অ্যাকটিভ (reactive), আবার কোনোটি এনভায়রনমেন্টালি ডিটারমাইন্ড (environmentally determined)। কোনো দলের প্রো-অ্যাকটিভ বা সক্রিয় উদ্যোগের কৌশল নেওয়ার অর্থ হচ্ছে বর্তমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিয়ে সামনের কৌশল ঠিক করা। অ্যাডাপটিভ বা সমন্বয়মূলক উদ্যোগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়ে এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর যে পরিবর্তন সম্পর্কে আগাম ধারণা ছিল না এবং এর ফলাফল হিসেবে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ামূলক বা রি-অ্যাকটিভ উদ্যোগ ও কৌশল অনেক ক্ষেত্রে দল থেকে নেওয়া হয়। এনভায়রনমেন্টালি ডিটারমাইন্ড চেঞ্জ বা পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল পরিবর্তন হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি পরিবর্তনে সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের বদলে ফেলা।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে তাদের কৌশল ঠিক করে, তার সঙ্গে আমাদের দেশের একক নেতা ও ব্যক্তিনির্ভর দলগুলোর পার্থক্য রয়েছে। এখানে দলের নেতার সিদ্ধান্ত ও কৌশলই দলের সিদ্ধান্ত বা কৌশল। বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কৌশল গ্রহণের যেসব ধারা আমরা অতীতে দেখেছি, সেখানে আর যা-ই হোক সক্রিয় উদ্যোগমূলক, সমন্বয়মূলক বা পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের বদলে ফেলার মতো কোনো কৌশল নিতে দেখা যায়নি। যা হয়েছে, সবই প্রতিক্রিয়ামূলক বা রি-অ্যাকটিভ। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় হকচকিত বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলও তাই প্রতিক্রিয়ামূলকই হওয়ার কথা। লন্ডনে বসে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুই দফায় সেই প্রতিক্রিয়ামূলক চালই চেলেছেন এবং দৃশ্যত সফলও হয়েছেন! তবে তারেক রহমানকে সফল করার কৃতিত্ব সরকারি দলের লোকজনকেই দিতে হচ্ছে!
আগেই বলেছি, রুটিন কিছু রাজনৈতিক বা বিক্ষোভ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে এখন আর করার তেমন কিছু নেই। খালেদা জিয়াকে তাই বারবার বলে যেতে হচ্ছে ‘সময় হলে আন্দোলন’। কিন্তু সেই ‘সময়’ হওয়ার আগ পর্যন্ত? ‘জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক’—মার্চের শেষে তারেক রহমানের হঠাৎ এমন ঘোষণা দেওয়ার পেছনের কারণটি তাই খুবই স্পষ্ট। চালে কাজ হয়েছে দেখে একটু সময় নিয়ে এপ্রিলের শুরুর দিকে আবার বললেন, ‘১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।’ ব্যস, সরকারি দল ও দলটির বড় নেতারা উঠেপড়ে লাগলেন তারেকের গুষ্টি উদ্ধারে। সম্ভবত এমনটিই চেয়েছিলেন তারেক রহমান। ‘জেল-জুলুম’ থেকে দূরে বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি গরম করার এর চেয়ে ভালো কৌশল আর কী হতে পারে!
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন’—তারেক রহমানের এ বক্তব্য আওয়ামী লীগ এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে যে এ কারণে দলটিকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করতে হয়েছে! দিতে হয়েছে লিখিত ব্যাখ্যা: ‘৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি প্রথম শপথ নেন। ওই দিনই রাষ্ট্রপতির এক আদেশে দেশে অস্থায়ী শাসনতন্ত্র জারি হয়। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হন রাষ্ট্রপতি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারেক রহমানের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মামলাও করছেন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানের বক্তব্যকে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহমূলক’। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে, আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তিনি দেশে ফিরছেন না। এমন অবস্থায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ খেতাবটিই যে তাঁর সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছিল! ‘দুর্নীতিবাজ’-এর চেয়ে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ খেতাবটি যে কারও জন্যই লোভনীয়। আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে তা ‘নিশ্চিত’ করেছে।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতার কাছে তারেক রহমান ‘মূর্খ’, ‘আহাম্মক’, কারও কাছে ‘অর্বাচীন’। তাঁর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ। আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের এসব প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, তারেক রহমানের হঠাৎ এ ধরনের বক্তব্যের পেছনে কৌশলের কোনো বিষয় যে থাকতে পারে, তা তাঁদের বিবেচনায় নেই। আওয়ামী লীগ বা দলটির নেতারা যা-ই ভাবুন না কেন, এটা পরিষ্কার যে তারেক রহমান সচেতনভাবেই বিষয়টি সামনে এনেছেন এবং এ ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলেন। খালেদা জিয়ার সব আস্থা যেহেতু তারেক রহমানে, তাই তাঁর কৌশলকেও তিনি যথার্থই মেনেছেন। খালেদা জিয়ার মুখ থেকেও এর পরপরই আমরা শুনলাম, ‘জিয়াউর রহমানই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের এর সঙ্গে গলা না মিলিয়ে আর উপায় কী! তাঁর ভাষায় তারেক রহমান ‘ইতিহাসের সত্য’ তুলে ধরেছেন। তারেক যে কৌশল বা কূটকৌশল নিয়েছেন, এর পাল্টা হিসেবে নেওয়ার মতো নানা কৌশল আওয়ামী লীগের ছিল, কিন্তু তারাও সেই রি-অ্যাকটিভ বা প্রতিক্রিয়ামূলক কৌশলই গ্রহণ করল। বোঝা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারেক রহমান হঠাৎ এ ধরনের বিতর্ক তুলতে পারেন, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আগাম ধারণা ছিল না এবং তারেকের বক্তব্যের সূত্র ধরে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি দলটিই ‘অবৈধ’।
রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল বলতে নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করার বিষয়টিকে বোঝায়। কিন্তু ভোট একটি নির্দিষ্ট সময়ের বিষয়, এবং রাজনৈতিক দলের জন্য ‘কৌশল’ বিষয়টি বহুমাত্রিক। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল কোনোভাবেই শুধু ভোটারদের আকৃষ্ট বা ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়ার কথা নয়। আমরা দেখে আসছি যে বিভক্তির এই বাংলাদেশে বিভক্তির রাজনৈতিক কৌশলই দলগুলোর কাছে কার্যকর মনে হয়। তারেক রহমান সম্ভবত সেই পথেই আরও জোরালোভাবে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও এর নেতারা তারেকের সেই পথকে দৃশ্যত আরও সহজ করে দিচ্ছেন। তারেক রহমানের এই কৌশল বা কূটকৌশলে চূড়ান্ত বিচারে তাঁর দল লাভবান হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু তিনি সচেতনভাবে যে বিতর্ক তৈরি করতে চাইলেন এবং সেই বিতর্কে পা দিয়ে বা বলা যায় ‘পাত্তা দিয়ে’ আওয়ামী লীগ যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, এই দুটোই সামনের দিনে আরও অসহিষ্ণু রাজনীতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.